“আকাশী”পর্ব ৯.
আকাশী দূরে সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি চলে যান। আমি যাব না।’
‘কেন যাবে না?’
সে জবাব দিলো না। তার কাছে মনে হলো জয় হাসছে। কিন্তু অন্ধকারে তাকে দেখা যাচ্ছে না।
জয় বলল, ‘এসো, আমি তোমাকে নিয়ে যাই। এসো, আমার হাত ধর।’
হাত ধরার কথায় আকাশী মাথা নেড়ে সাথে সাথে বলে দিলো, ‘না, তার প্রয়োজন নেই। আমি চলে যেতে পারব।’
জয় হেসে বলল, ‘তা তো একটু আগে দেখেছি। ওইজন্যই কি দৌড়ে চলে এসেছ?’
আকাশী চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওই গাছগুলোকে দেখছে। জয় এবার গম্ভীর হয়ে বলল, ‘সত্যিই কি ভয় পেয়েছ?’
‘পেয়েছি মানে? ওই আওয়াজটা আপনি শোনেননি? পুরাই গা শিউরে উঠার মতো। আপনি কি ভয় পাননি?’
‘আসলে আকাশী’, কিছুক্ষণ থেমে থেকে জয় বলল, ‘আমি ভয় পাইনি। তোমাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। তাই তুমি গাছের দিকে তাকাতেই লুকিয়ে মোবাইল বের করে ভৌতিক একটা অডিও প্লে করে দিই।’
শেষের কথাটি বলার সময় জয়ের গলার স্বর নিচু হয়ে গিয়েছিল। আকাশী বুঝতে পেল জয় তাকে ভয় দেখিয়েছে। তাতে তার মোটেও খারাপ লাগল না। ভৌতিক কিছু সে কখনও দেখেনি। এই ভৌতিক পরিবেশে একটিবারের জন্য সে অনুভব তো করেছিল, এখানে সত্যিই ভৌতিক কিছু আছে। জয় রেকর্ডিং বাজালেও তার একটা অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। এজন্য সে রাগ না করে শব্দ করে হাসলো। জয়ের শুকনো মুখটা সজীব হয়। সে ভেবে ফেলেছিল আকাশী বোধ হয় রাগ করবে।
আকাশী বলল, ‘আমি তো ভেবেছি সত্যিই কিছু…’
‘তুমি রাগ করোনি তো?’
‘আরে না বরং আপনাকে থ্যাংকস বলা উচিত। শত হোক, আমি কিছুক্ষণের জন্য ভৌতিক কিছুর আভাস পেয়েছিলাম, যা প্রকৃতপক্ষে পাওয়া যায় না। ভূত দেখার সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য কার হয় বলুন তো?’ আকাশী এবার গলা ছেড়ে হাসলো।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
জয় সেই হাসির আওয়াজটা শোনে রইল। তারপর বলল, ‘তাহলে এরকম রেকর্ডিং আরও বাজানো উচিত।’
‘আরে তখন তো ওটা রেকর্ডিং বলে জানতাম না বলেই বাস্তব লেগেছিল। এখন তো জেনে ফেলেছি। এখন কি আর লাগবে? তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে শুনতে পেলে ভালো হতো। শোনার পর আওয়াজগুলো বারবার কানে এমনিতেই বাজতে থাকত। এদিক-ওদিকে যেতে ভয় পেতাম। দারুণ লাগত। এই ভয় পাওয়ার মাঝেও একটা আনন্দ লুকিয়ে আছে।’
আকাশী কথা শেষ না করতেই চিকন গলার একটা পেত্নীর আওয়াজের অট্টহাসি ভেসে এলো। আচমকা বাজায় আকাশী ভয় পেলেও জয়ের মোবাইল দেখার পর হাসতে হাসতে যেন গড়াগড়ি খেতে লাগল। তারপর তারা ফিরে গেল নিজ নিজ বাড়িতে। পরদিন জয় চলে যাওয়ার সময় আকাশীর সাথে একবার দেখা হয়েছিল। এরপর আর হয়নি। এইদিন এসেছে জয়। সামাজিক কাজকর্মে যোগদান করতে তাকে দেখা যায়। আকাশী ঘুরতে ঘুরতেই পেছনের চাষবিহীন ক্ষেতে এসে সময় কাটাতে বসেছিল। পাশ দিয়ে লম্বা একটা রাস্তা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আকাশীকে দেখতে পেয়ে জয় চলে আসে।
আকাশী তার ভেতরের বকবকানো সবসময় বাইরে এনেছে অনিকের সামনেই। ইতোমধ্যে অনিকের লেখাপড়া বন্ধ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান ফারুক ক্রমশ রোগা হয়ে পড়ছেন। তাই অনিকের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাকে সাবলম্বী করতে বিদেশে তাঁর ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। গ্রামের মানুষের এই এক ভাবনা, সাবলম্বী হতে পড়ালেখা নয়, বিদেশে যাওয়ার বিকল্প নেই।
আকাশী না চাইতেই জয়কে তার সমস্যার কথা বললো, ‘আমার ফ্রেন্ড তাসফিয়ার এইদিন বিয়ে হয়ে গেছে। আমার সাথেই ক্লাস এইটে পড়ত। বেচারি। আমি ওর মা-বাবার কাছে অনেক অনুনয় করেছিলাম। কিন্তু ওরা বলল, উঠতি বয়সের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া দরকার। ওর কাছে নিরুপায় হয়ে বিয়ে করতে হয়েছে। অথচ ওর মনে কোনো খারাপ ভাবনাই ছিল না। এখন ওর স্বামী ওকে খুব মারধর করে। তার মা-বাবাকে এসব সে জানায়নি। সে চায়নি, তারা তাদের সিদ্ধান্তের পরিণাম দেখে কষ্ট পাক। আমাকেই বলেছে সে। আর বলেছে সুখ ফিরে আনার জন্য উপায় বাতলে দিতে। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। ওর স্বামী নেশা করে, মদ খায়। এমন একটা নেশাখোর স্বামীর কাছ থেকে ওকে বাঁচানোর জন্য আমি কীই বা করতে পারব। তার স্বামী তাঁর কামাইয়ের প্রায় অংশই এই মদে শেষ করে দেয়। তাসফিয়া এই নিয়ে বিরোধ করতে গেলেই ওর ওপর ভয়ানক প্রহার শুরু হয়। ওর স্থলে প্রতিটি মেয়েই স্বামীকে মাত্রাতিরিক্ত আর অহেতুক টাকা খরচের এই নিষেধাজ্ঞা দিতে যেত।
আমি এটা বুঝতে পারছি না, এই জায়গায় মদ কোথা থেকে আনা হয়। দূরদূরান্তে তো মদের কোনো আভাস পাচ্ছি না। অথচ খাওয়ার জনেরা খাচ্ছে, কেউ তাদের ধরতে পারছে না। আমি যতদূর জানি এই ইউনিয়নে মদের কোনো ব্যবসা নেই। আমার মনে হচ্ছে চোরা ব্যবসা হচ্ছে। ফারুক চাচাকে এই কথা বলেছিলাম। তিনি ক্ষেপে গিয়ে বলেছিলেন, ইদানীং অনেক লোকের সম্বন্ধে জানছি মদ খায়। কিন্তু এই মদ কে এনেছে, কারা কারা কেনে সেটাই বুঝতে পারছি না। একবার যদি লিডারকে ধরতে পারি, ধাক্কা দিয়ে তাকে গ্রাম থেকে বের করে দিব। আমাকে পরশুই বললেন, ফুলি, আমার তো সামাজিক কাজকামে ব্যস্ত থাকতে হয়। অসুস্থতার কথা ভেবে বসে থাকা যায় না। মরে যাওয়ার আগে কিছু করে দিয়ে যাই। তুই তো ঘুরঘুর করিস, এগুলো নিয়ে একটু খোঁজখবর রাখিস। এসে আমায় বলিস।’
আকাশীকে গভীর চিন্তায় মগ্ন দেখালো। অনেক আগে থেকেই জয়ের চেহারায় অস্বস্তির একটা ছাপ বসে আছে। আকাশী শীঘ্রই তা বুঝে ফেলল। সে নড়েচড়ে বসেই ঢিল ছুঁড়ল, ‘তাহলে আপনিও মদ খান।’
জয় চমকে উঠে কিছুক্ষণ নীরব থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে বলল, ‘ইয়ে মানে হ্যাঁ। মাঝে মাঝে। গতবার এখানের মতি ভাইয়ের সাথে গিয়ে শহর থেকে এনে খেয়েছিলাম। ওর অনুরোধে একটু বেশি করেই আনতে হয়েছিল। তবে আমার জানা নেই এখানে সত্যিই দোকান আছে কিনা। দোকান নেই বলেই বাহির থেকে আনতে হয়েছিল।’
‘এই মতি ভাই বোধ হয় এইদিন যিনি বিয়ে করেছেন, তিনি না?’
‘মতিভাই বিয়ে করেছে? ও তো ভবঘুরে একটা বেকার ছিল। বিয়ের দায়িত্ব কী করে বহন করল?’
আকাশী চুপ করে রইল। কারণ মতিভাই একটাই আছে এবং তারই এইদিন বিয়ে হয়েছে। আকাশী ঘোরাঘুরি করে বলেই এধার-ওধার থেকে জেনেছে, মতিভাইয়ের ভালো ব্যবসা আছে। এজন্যই বিয়ে করতে পেরেছে।
আকাশী বলল, ‘আমি তার বাড়ি আর দোকান কোথায় তা জানি না। আমাকে একটু নিয়ে যাবেন?’
ভ্রূ কুঞ্চিত করল জয়, ‘কেন?’
আকাশী ওঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘নিয়ে যাবেন নাকি যাবেন না?’
জয়ও ওঠে দাঁড়ায়। তারপর হাঁটা ধরল। আকাশীও তার পিছু পিছু যেতে থাকল। ক্ষেতের পাশের রাস্তা ধরে তারা পিছঢালা রাস্তায় উঠার পর ডানপাশের রাস্তাটা ধরে মতি ভাইয়ের বাড়ির আগে তার দোকানে পৌঁছায়। দোকানের প্রস্থ অনুযায়ী দোকানের সামনের দিকটা খুব ছোট। মুদির দোকানটায় এখন মতি ভাই নেই। আকাশীর সন্দেহ হওয়ায় জয়কে নিয়ে দোকানের ভেতরে গেল। ভেতরে ঢুকে সে একটা দরজা পেল। দোকানে যে ছোট ছেলেটি বসে আছে, তার নিষেধাজ্ঞার সত্ত্বেও আকাশী ঢুকে পড়ে। ভাগ্যিস এই সময় মতি ভাই নেই। আকাশীর সন্দেহ বাস্তবে ফলে গেছে। মদের কাজকারবার মতিভাইয়েরই আছে। তিনি আর জয় ভাইয়া ছাড়া কেউই জানে না মদ কোথা থেকে আনা যেতে পারে। আকাশী জয়কে বলল, ‘আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবেন?’
অবাক হয়ে জয় বলল, ‘কীভাবে?’
‘ওইযে, ওখানে খালি বাক্স আছে, ওগুলোতে মদের বোতলগুলো ভরতে আমাকে সাহায্য করুন।’
জয় হতবুদ্ধি হয়ে আকাশীকে সাহায্য করতে লাগল। পেছনের দরজা দিয়ে মদের বোতলগুলো বের করিয়ে নেওয়া হলো। এই সময়টুকুতে দোকানের ছেলেটি কেবল হতবাক হয়ে তাদের চেয়েছিল। ভাবছিল, মতিভাই এই দু’জনকে পাঠিয়েছে। কিন্তু একটি মেয়েকে কেন পাঠিয়েছে? আকাশীরা শীঘ্রই মদের বোতলগুলো সরিয়ে চেয়ারম্যান ফারুকের বাসায় নিয়ে এলো।
তিনি এসব দেখে ফুঁসে উঠে বললেন, ‘কে করেছে এই কাজ? আমাদেরই গ্রামে মদের ব্যবসা চলছে?’
আকাশী বলল, ‘লুকিয়ে চলছে। মতি ভাইয়ের মদের ছোট গোডাউনের সামনেই লোক দেখানো একটা দোকান আছে। কারো এই বিষয়টা ঘুণাক্ষরেও বুঝার কথা নয়। আমার মনে হচ্ছে তিনি এই মদের ব্যবসা করে টাকা কামিয়েই দোকান খুলেছেন। আপনি শীঘ্রই ব্যবস্থা নিন। একজনের কারণেই অনেক লোকের অভ্যাস খারাপ হচ্ছে।’
‘ঠিক বলেছিস। ব্যাটাকে আমি এই গ্রাম থেকে বের করিয়ে ছাড়ব।’
চেয়ারম্যানের নির্দেশে আকাশী তাঁর বাসায় রয়ে যায়। তার ধারণা, দোকানের ছেলেটি শীঘ্রই তাদের কথা মতি ভাইকে জানিয়ে দেবে। সন্ধ্যার দিকে তার অনুমানই সত্য হলো। মতি ভাই খুঁজতে খুঁজতে চেয়ারম্যানের বাড়িতে এসে আকাশীকে পেলেন। আকাশীর আগেই চেয়ারম্যান তাকে দেখা দেন। মতি ভাই ধারণাই করেনি আকাশীকে চেয়ারম্যান সহযোগিতা করছেন। চেয়ারম্যানের ওপর সবগুলো ছেড়ে দিয়ে আকাশী বেরিয়ে যায়।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে বিধায় তার কাছে রান্না করতে হবে। অনিকদের বাসা থেকে বেরুনোর পরই সে জয়কে দেখতে পেল। মাথা নিচু করে কী যেন ভাবছে। আকাশী গিয়ে বলল, ‘মদ খাওয়া ভালো নয়। শুরুতে হয়তো ভালো থাকতে পারে। কিন্তু কখন যে বদলোকের কাতারে পড়ে যাবেন, নিজেই টের পাবেন না। চলি।’ বলে আকাশী নিঃশব্দে হেঁটে চলে গেল। জয় এতক্ষণে মাথা উঁচিয়ে তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকাল।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার