“আকাশী”পর্ব ১৫.
আকাশী খেয়াল করছে, একটি ছেলে অনেকক্ষণ যাবৎ তার পিছু নিচ্ছে। যতই দ্রুত পা বাড়ানোর চেষ্টা করে, ততই বোধ হয়, স্কুলটার দূরত্ব আজ অনেক বেড়ে গেছে। ছেলেদের উপদ্রব বহু আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাসফিয়ার মৃত্যুর পর নেওয়া চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আকাশীকে সকলে চেনে ফেলেছে। সকলেই জানে, এই মেয়েটির ওপর গ্রামের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তির হাত আছে এবং সে খুব সাহসী। ছেলেরা খারাপ চোখে দেখার কথাও ভাবে না। তাই এতদিন পর এতদূর থেকে একটি ছেলে তাকে ধরার চেষ্টা করছে দেখে মোটেই তার ভালো ঠেকছে না। এই বেগে ছেলেটি আসছে যেন এসেই আকাশীর হাত ধরে ফেলবে। সে তার হাঁটার গতি বাড়ায়। কিন্তু শতই হোক, ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে অত্যধিক দ্রুত হাঁটে। আকাশী স্কুলের প্রাঙ্গণে পৌঁছার আগেই কে যেন সত্যিই তার হাত ধরে ফেলল। আকাশী কিছুটা ভয়ার্ত হয়ে রাগে ফেটে পড়ে পেছনে ফিরে। ফিরে সে অবাক হয়ে যায়। অনিক তার বোকামো দেখে আকাশীর নাক টিপে দিলো।
‘অনিক.. তুই?’ আকাশীর বিস্ময় তার টেনে টেনে কথা বলার মধ্যে ধরা পড়ল।
অনিকও তদ্রূপ টেনে টেনে হেসে বলল, ‘হ্যাঁ… আমি।’
‘মাই গড। তুই এতো লম্বা কবে হলি?’
‘যেভাবে তুই হয়েছিস। একেবারেই দেখি বদলে গেছিস। যা লাগছে না তোকে…’
আকাশী ভেঙচি কাটে।
‘সত্যি বলছি। তোকে দেখতে বাংলা সিনেমার পূর্ণিমার মতো লাগছে। হুবহু একই চেহারা। এই লম্বা নাক, এই টসটসে গাল…’
আকাশীর এবার এই ধরনের কথা শোনে খারাপ লাগল।
‘আরে মাইন্ড করলি নাকি? নাকি আমাদের বন্ধুত্বের মুহূর্তগুলাই ভুলে গেছিস?’
‘এমন কথা নয়। এসব শুনতে অভ্যস্ত নই। আর আমি চাইতেও এসব পজিটিভলি নিতে পারি না। এখানে ফ্লার্ট করার মতো একটা ব্যাপার দেখি।’
‘যাহ্! তুই তোর বাল্যবন্ধুর সম্বন্ধেও এই ভাববি?’
আকাশী হাসল, ‘ছেলেরা সবসময় ছেলেই থাকে।’
অনিক কিছুটা গম্ভীর হলো, ‘আমি কিছু বুঝলাম না।’
‘আগে তুই কেবল আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতি। কারণ তখন তুই আর আমি ছোট ছিলাম আর তুই আমাকেও অন্যান্য ছেলেবন্ধুর মতোই দেখতি। আর এখন তোর চোখগুলো একদিকেও স্থির হচ্ছে না।’ আকাশীকে বিজ্ঞ দেখাল।
অনিক নিজেকে যথেষ্ট সংযত করল, ‘ঠিক আছে আমার মা। আমি আমার ভুল বুঝলাম। এখন দেখছি, কথাগুলো বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় নেই যে, তুই বড় হয়ে গেছিস মানসিক কী শারীরিক দিক থেকে।’
আকাশী প্রসঙ্গ পাল্টাল, ‘তুইও অনেক পরিবর্তিত হয়েছিস বলে একটু আগে তোকে চিনতে পারিনি। দূরে ছিলি তো। অনেক লম্বাও হয়েছিস।’
অনিক হাসল, ‘তোর দেখা পাচ্ছিলাম না। এখন বাজারের দিকে যাচ্ছিলাম, তোর দেখা পেয়ে গেলাম। আমার আসার কথা কি শুনিসনি? এমনি তো বাড়ি বেড়াতে পারিস। আমাদের বাসায় একটু আসতে পারলি না?’
‘আমি শুনেছি। কিন্তু এখন একটু পড়ার চাপ। সামনে এসএসসি দেবো। তাই একটু পড়াশোনা চলছে।’
‘আগের মতোই রয়ে গেলি। সারাবছর পড়া এক অক্ষরও না। লাস্টে এসেই বাজিমাত।’
‘আমার অভ্যাসগুলো বদলাতে পারি না। কেন জানি না, পরীক্ষার আগে যে পড়াটা হয়, তা সারাবছর করতে ইচ্ছে হয় না।’
‘আচ্ছা, আমি শুনলাম, এক সপ্তাহ্ আগে আজম চাচাও এসেছেন?’
‘আমাদের নতুন বাড়ি দেখিসনি? বাঁধতে দিয়ে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। কম্পলিট হওয়ার পর আবারও বিদেশ ছেড়ে নতুন বাড়ির সুখ নিতে এসেছেন।’
‘ওহ্ আচ্ছা। আচ্ছা, তুই যা স্কুলে। অনেক কথা বললাম।’
অনিক বিদায় জানালে আকাশী স্কুলে চলে যায়।
এই স্কুলে যেন সে একাই পড়তে আসে। কোনো বন্ধুবান্ধব নেই, কোনো আলাপ-আলোচনা নেই। পড়বে, পড়া শেষে বাসায় ফিরবে। এটুকু সময়ে অন্যান্য সহপাঠীর মতো কিছুই করে না সে। বন্ধু বানানো তার জন্য রীতিমতো খারাপ একটা বিষয়। এর ফলে আমাদের ব্যবহারিক জীবনে খারাপ একটা প্রভাব পড়ে। একবার একটি মেয়ে মাস কয়েকের জন্য ভালো বন্ধু হয়েছিল। এই মেয়েটিকে নিজের সবকথাই শেয়ার করত, যা একপ্রকার দুর্বলতার সম্বন্ধে জানিয়ে দেওয়ার মতোই। একবার তুমুল একটা ঝামেলা বেধে গেল। একটি মেয়ে আকাশীর ওপর রাগে ফেটে পড়ল। পরে আকাশী আন্দাজ করেছে, সেই মেয়েটির সম্বন্ধে বান্ধবীর কাছে ভালোমন্দ কথা বলায় বান্ধবী তা মেয়েটিকে বলে দিয়েছে। আকাশী আর ওই বান্ধবীর সাথে কথা বলতে যায়নি। দুইপক্ষে দ্বিমুখীনীতি করা মেয়ে তার পছন্দ নয়। এই সময়টুকুতে ফারাবিকে সে ভুলেই গিয়েছিল, নতুন বান্ধবী পেয়ে। তার আসল পরিচয় পাওয়ার পর ফারাবির কাছে সে ক্ষমা চেয়ে নেয়। মেয়েটিকে ছোটবেলা থেকে চেনে। আসল বন্ধু ফেলে সে মরীচিকাকে সঠিক ভাবতে গিয়েছিল, কথাটা মনে পড়লে নিজের প্রতিও ঘৃণা জন্মায়। সেবার সে ভেবে ফেলেছে, গীবত মোটেই ভালো নয়। ফারাবি নিতান্ত নিশ্চুপ স্বভাবের মেয়ে। আকাশীর উত্তেজনার অর্ধেক ভাগও তার মাঝে নেই বলে আকাশীর মাঝে মাঝে বোধ হয়, তার একটা বন্ধু থাকার সত্ত্বেও কোনো বন্ধু নেই। বন্ধু বানাতে গেলেও খারাপ লাগে। আবার বন্ধু ছাড়া জীবনে কেমন নিরানন্দ নেমে আসে। লবণহীন তরকারি যেমন অখাদ্য, ঠিক বন্ধুহীন জীবনও ধূ ধূ মরুভূমি। তবু একটা নিশ্চুপ বান্ধবী শত ছলনাময়ী বান্ধবীর চেয়ে ঢের ভালো।
আকাশী টিফিনের বিরতির সময় পেট পুরে এসে শহিদ মিনারের পেছনে ক্ষেতের দিকে মুখ করে বসে। জায়গাটা আড্ডাখানার মতো নয়, তবে ছোট এই জায়গা আড্ডাখানার মতোই হয়ে গিয়েছে। খেয়ে এসে প্রকৃতির বাতাস নিলে হাল্কা লাগে। আকাশী বসে পড়ে। এই জায়গাটা অনেকের দখলে। অথচ আজ সে সিনিয়র এবং টপ ব্যাচের ছাত্রী হওয়ায় জুনিয়ররা জায়গা করে দেয়। সে বসেছিল এক কোণোয়। পাশে তার শ্রেণির জনপ্রিয় উড়ন্ত সুন্দরী মেয়েরা বসে গল্পের আসর জমিয়েছে। অনর্গল তাদের কথাই কানে আসায় সে তাদের কথার বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করছে।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
একজন বলল, ‘আমার এক মামি এতই সরল যে, সব কথাই বলে দিয়েছে। আমাকে তো বললেন, “উনি বিয়ের রাতে আমার শাড়ির পিন নিজেই খুলেছেন।”‘
মেয়েরা খিলখিল করে হাসল।
একজন বলল, ‘আমার আন্টি বলে, বাসররাতে লাইট কখনও জ্বালাতে নেই।’
একটা মেয়ে প্রশ্ন তুলল, ‘লাইট না থাকলে তো কিছুই দেখা যাবে না।’
‘বাসর রাতে লাইট জ্বালিয়ে কিছু করা যায় নাকি? তুই লাইট জ্বালাবি?’ কথাটি বলে মেয়েটি বান্ধবীদের নিয়ে হাসাহাসি করল।
আকাশীর কিছু কথা বোধগম্য হয়নি। মনে কিছু প্রশ্ন কিছু সময়ের জন্য বাতি জ্বালিয়ে উঠতেই নিভে গেল। সে আর ওই জায়গায় বসল না। সময়ের আগে সে মেয়েগুলোর মতো পাকনা হতে চায় না। একদিক থেকে ভালোই, এই কাঁচা দিকটা দেখেই ওকে হয়তো বিয়ে দেরিতে দেবে। তাছাড়া বিয়ের প্রশ্ন তার মাথায় উঠেই না। বাবা বলেছেন, অনেক দূর লেখাপড়া করাবেন। তাকে বিয়ে দেবেন না। একদিন যখন তার জীবনে আনন্দ থাকবে এবং স্বেচ্ছায় বিয়ে করতে চাইবে, তখনই তিনি বিয়ের কথা তুলবেন। বাবার এই চরিত্রটা তার জন্য আশার প্রতীক। লোকটি আছেন বলেই মা তাকে এতদিন সহ্য করছেন। এখন তিনি বিভারও বিয়ের কথা তুলছেন। ভালো একটি প্রস্তাব এসেছে। বাবা বিভার ওপর জোর করতে পারছেন না। তিনি প্রস্তাব আসা ছেলেটিকে সকালে দেখতে গিয়েছেন। আকাশীর মনটা ভালো নেই। আজ কেন যেন স্কুলে মন টিকছে না। ছুটি নিয়ে গিয়েও বাসায় করার মতো কিছু নেই। এই আকাশ, এই পরিবেশ, এই প্রকৃতি সবই বিরক্তিকর লাগছে। জন্মের পর থেকে ষোলোটা বছর এগুলোই দেখতে দেখতে একঘেয়েমি চলে এসেছে। শুধু রাতের নিস্তব্ধ গ্রামটাই তার একমাত্র সঙ্গী। তাছাড়া আশেপাশে মনকাড়া কোনো জায়গায়ও নেই, যেখানে সে কখনও যায়নি। তাকে কী যেন টানছে দূরে কোথাও যেতে। কিসে টানছে জানে না। তবে লাগছে, আজ থেকে নতুন এক অধ্যায় শুরু হবে, চলে যাবে এক নিষ্ঠুর পরিবেশে, যেটা তাকে একদম একা করে ফেলবে। একা থাকতে চাওয়া মেয়েটির মাঝে মাঝে অন্যান্যদের মতোই মন বলে, ইশ এই একাকীত্ব যদি না থাকত। তার কাছে বন্ধুও আছে, তবে কী যেন নেই। কী যেন নেই। সে একদম আলাদা হয়ে গেছে। কী দরকার ছিল শাড়ি পরে মেহেদি পরে চুড়ি পরে ঘোরার, এইগ্রাম ওইগ্রামে আলোচিত একটি মেয়ে হওয়ার? চোখের সামনে আড্ডা দেওয়া মেয়েগুলোর কথা ভেসে উঠে। এদের জীবনে রস আছে। সুন্দর বলে ছেলেরা একবার হলেও তাকিয়ে মুচকি হাসে। মেয়েরা পাত্তা পেতে চায়। আজ তাকে অনেকেই বিশেষ বানিয়ে ফেলেছে বলে সে একদম একাই হয়ে গেছে, যার দরুন তার জীবনে অন্যান্য মেয়েদের মতো কিছুই হচ্ছে না। তার যে সম্মানটা আছে তা কে না পেতে চায়! তবু অনেক সময় একটিববড় জিনিস পাওয়ার ক্ষণকাল পর আপসোস হয় আমি আর অন্যদের কাতারে রইলাম না। আকাশীর তাই হয়। এই সম্মানটা ভালো হলেও মাঝে মাঝে খারাপ ঠেকে। সে কোনো রাজা নয়, যে চাইবে তার প্রজারা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকুক। প্রতিবেশী মেয়েরা আকাশীর সাথে কথা বলতে ভয় পায়। কারণ তারা ভাবে আকাশীর চিন্তা-ভাবনার সাথে তারা পাল্লা দিতে পারবে না। অনেক জ্ঞানী মেয়েরে বাবা! কথাটি একদিন বাতাসের সাথেই আকাশীর কানে এসেছিল। শোনে অনেক খারাপ লাগে। মন বলল, সে এতো বাহাদুরি কেন দেখিয়েছে। ভেতরের সত্তাকে কেন দেখিয়েছে। কখনও মন ভালো না থাকলে প্রশ্নেরা এই জায়গা ওই জায়গা থেকে বেরিয়ে ভিড় জমায়, পাগল বানিয়ে দেয় তাকে।
আকাশী ক্লাস শেষে বিষণ্ণ হয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছিল। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি নিয়ে স্কুলের সামনে অনিক উপস্থিত। সে দ্রুত নেমে এসে আকাশীকে কিছু না বলেই গাড়িতে বসাল। তার লাল চোখ দেখে আকাশী ঘাবড়ে যায়। অনিক ড্রাইভারকে ইশারায় গাড়ি চালাতে বলে।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার