#আকাঙ্খিত প্রণয়
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী
আমার দুচোখে সেদিন ঘুম ছিলো না। নতুন পরিবেশ নতুন জায়গায় আমার ঘুম আসতে চায় না। এখন জ্যৈষ্ঠ মাস। বেশ গরম পড়েছে। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ঢাকার মিরপুর এলাকার পাইকপাড়ায় আমাদের বাড়ি। বাড়িটা উপরে টিনের চাল চারিদিকে ইটের গাঁথুনী। বৃষ্টির সময় আমার টিনের চালের শব্দ খুব ভাল লাগে। আমার শ্বশুরবাড়ি ধানমন্ডি সাতাশ নাম্বারে। বাড়িটা ডুপ্লেক্স। কিন্তু আমি টিনের চালের শব্দটা এই মুহুর্তে খুব মিস করছি। বাসর খাটে শুয়ে আমার স্কুলের স্মৃতি, বন্ধুদের নিয়ে কাটানো স্মৃতিগুলো সব মনে পড়ছে। খুব অবাক হওয়ার মতো বিষয় বাসর ঘরে স্বামীর আদর ভালবাসায় থাকার কথা অথচ আমি আমার ছেলেবেলার নসটালজিয়ায় ভুগছি। আসলে আমি তো বিয়ের জন্য তৈরী ছিলাম না সেই কারণে বাসর ঘরে আমার এইটুকু জীবনের সবচেয়ে সুখের দিনগুলোর কথা আজ আমার মনে পড়ছে। এছাড়া বিয়ের প্রথম দিনে শ্বশুর বাড়ির বৈরী পরিবেশে আমার দুচোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। এখনও রেজাল্ট দেয়নি। সামনের মাসে রেজাল্ট দিবে। আব্বা আম্মাকে কত অনুরোধ করলাম রেজাল্ট টা অন্তত বের হোক। আমি কোনো ভার্সিটিতে অনার্সে ভর্তি হই। তারপর না হয় আমার বিয়ের ব্যবস্থা করুক। কিছুতেই উনারা শুনলেন না। উনাদের এক কথা এতো ভালপাত্র হাতছাড়া করা যাবে না। প্রথমদিন আমার যে অভিজ্ঞতা হলো এবাড়িতে আমার ভাগ্যে কি লেখা আছে আমি জানি না।
আজ ছোটোবেলার স্মৃতি খুব মনে পড়ছে। খেলার সাথীদের নিয়ে মুচিভর্তা, কাঁচাকলা ভর্তা খাওয়া, শান্ত দিঘীর জলে সাঁতার কাটা, ঝড়ের সময় আম কুড়ানো, কত না মধুর ছিলো সেই জীবন! এসব ভাবতে ভাবতে কখন আমার চোখে ঘুম নেমেছে আমি নিজেই জানি না। কিন্তু যখন ঘুম ভাঙ্গলো মনে হলো একটা দানবের হাত আমার পুরো শরীর খুবলে নিচ্ছে। সেদিন মনে হয়েছিলো আমার স্বামীর হৃদয়টা হিংস্র বাঘের মতো। যার আঁচড়ে শুধু রক্তাক্ত হতে হয়। কোনো আদর ভালবাসা অনুভব হয় না। আমার জীবনের সব স্বপ্নগুলো সেদিন বেদনার অতলান্তিক গহ্বরে হারিয়ে গেল। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণায় ব্যথার শিৎকার ছাড়া আর কিছু অনুভব হয়নি। আমি তো ধর্ম মতে আইন মতে তখন ওর স্ত্রী। আমার মানসিক শক্তির জন্য ওতো দুদিন সময় আমাকে দিতে পারতো। আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না। কিন্তু সেটুকু ধৈর্য উনি সেদিন ধারণ করতে পারেন নাই।
বিয়ের পরদিন আমার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসলো। সকালে গোসল করে নাস্তা খাওয়ার পর আমার শাশুড়ী আমাকে ওষুধ খাইয়ে দিলো। সেই খাওয়ানোর মধ্যে আমি মায়ের ভালবাসা অনুভব করিনি। উনি যেন উনার দায়িত্ব সারলেন। সেদিন কষ্টের অনুভবে শেষ হয়ে যাওয়া আমার দিকে উনার তাকানোর ইচ্ছা জাগেনি।
যাক শুরু হলো আমার বিবাহিত জীবন। এই নতুন জীবনে শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলোর অনাদর ছাড়া আমার কপালে আর কিছু জোটেনি। তারপরও আমার আটপৌরে জীবনে ঐ সংসারের কোনো মানুষের প্রতি দায়িত্বে আমি গাফিলতি করিনি। ভোর ছয়টা থেকে রান্নাঘরে ঢুকে আমার কাজ শুরু হয়। শ্বশুরবাড়িতে কাজের বাঁধা খালা ঠিকই ছিলো কিন্তু তার সেবা পাওয়ার ভাগ্য আমার ছিলো না। সকালের বেড টি থেকে শুরু করে এঁটোবাসন ধোয়া, নাস্তা বানানো, দুপুরের রান্না, রাতের রান্না সব আমাকে একহাতে সামলে নিতে হতো। আর কাজের খালার দায়িত্ব শাশুড়ির মাথার তেল দেওয়া থেকে শুরু করে উনার পুরো শরীর মেসেজ করা লোশন লাগিয়ে দেওয়া সব উনাকে করতে হতো। অথচ আমার শাশুড়ী বেশ শক্ত সামর্থ্যবান মানুষ। আমার ননদদের কাপড় স্ত্রী করা জুতো মুছে পরিস্কার করা এগুলো আমাকে করতে হতো। এ কাজ করার জন্য আমার শাশুড়ী মা আমাকে খুব সুন্দর করে ডায়লগ দিলেন,
——রুহি তুমি ওদের বড় ভাবি। বয়স কম বা বেশি বলে কথা নয়। বড় ভাবিরা সবসময় মায়ের মতো হয়।
আমি উনার দিকে তাকিয়ে ভাবতাম আমিও যে একটা মানুষ। আমারও যে সীমাবদ্ধতা আছে। এরকম অমানুসিক পরিশ্রম করার কারণে ধীরে ধীরে আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে একজন মা হিসাবে সেটা কি উনার চোখে পড়ে না। সকাল দুপুর রাতে সবাইকে খাইয়ে দিয়ে আমি আর কাজের খালা একসাথে খেতে বসতাম। মাছের কাঁটা টুকু আর মুরগীর হাড়হাড্ডি ছাড়া কিছুই কপালে জুটতো না।
আমার শ্বশুরের চেম্বার ছিলো। চেম্বারের দুজন কর্মচারী ছিলো। ড্রাইভার ছিলো। সবাই এ বাড়িতে দুপুরে খেতো। প্রতিদিন দুপুরে দশ থেকে বারোজনের রান্না হতো। সব আমাকেই করতে হতো। বাপের বাড়িতে গিয়ে আম্মাকে শ্বশুরবাড়ির এসব কথা বললে উনি বলতেন,
—–মানিয়ে খেতে শিখো। এতো বড় বাড়িতে তোমার বিয়ে হয়েছে। জামাই ভাল আয় রোজগার করে কিসের কষ্ট তোমার?এগুলো দুঃখ বিলাস ছাড়া আর কিছু নয়।
আব্বা শুনে বলতেন,
—–কখনও শ্বশুর বাড়ির মন্দ কথা বাপের বাড়িতে বলবে না। এতে তোমার গুনাহ্ হবে। এটা গিবত হয়।
আমার স্বামী তখন একটা প্রমিন্যান্ট কোম্পানিতে ডিরেক্টর পদে চাকরি করতেন। ঢাকা ভার্সিটি থেকে এমবিএ কমপ্লিট করেছেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা চাকরির পজিশন সবই ছিলো চোখে লাগার মতো। শুধু আমার চোখে উনি একজন নোংরা মানসিকতার মানুষ। শরীর সর্বস্ব দাম্পত্য জীবন বয়ে নিতে নিতে আমি ক্লান্ত।
ঐ টুকু বয়সে আমি আমার বাবা মায়ের উপদেশমূলক কথা শ্বশুর বাড়িতে প্রতিনিয়ত অপমান আর অবহেলার সাথে মানিয়ে নেওয়া আমার স্বামীর বিকৃত মানসিকতার সাথে লড়াই করে ক্রমে বিষাদগ্রস্ত হতে লাগলাম।
আমার বড় ননদটা সাবা নর্থ সাউথ ভার্সিটিতে ইংরেজীতে অনার্স পড়ে ছোটো ননদ মাসাবা হলিক্রস থেকে সামনে এইচএসসি দিবে। আর আমার দেবর বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারী পড়ে।
সাবা বাড়িতে বন্ধু বান্ধব নিয়ে প্রায় পার্টি করতো। সেই পার্টির রান্না করা ওর বন্ধুদের খেদমত করা আমাকে করতে হতো। একদিন ওর এক বন্ধু জামান আমার সামনে সাবাকে বলে,
—–তোমার কাজের মেয়েটা দেখতে খুব সেক্সি।
ও কি নতুন এসেছে।
—–হুম।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি ওখান থেকে কিচেনে এসে চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। আর মনে মনে ভাবলাম আমার বাবামায়ের ধারণা আমি মহা সুখে আছি। আমার ভাগ্যটা কি! বাবা মায়ের কাছেও আমার কষ্টের কোনো দাম নেই। আর এসব পর মানুষের কাছে আমি কি সম্মান আশা করতে পারি?
তারপরও ভাবলাম রাসেলকে এই কথাটা বলা দরকার। আশা নিরাশার দোলায় দুলে রাতে ওর পাশে বসে ওকে বললাম,
—–আমার কিছু কথা আছে আপনার সাথে?
—–কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো?সারাদিন অফিসে কাজ করার পর রাতে ঘ্যানঘ্যান শুনতে একদম ভাল লাগে না।
আমি প্রথমেই রাসেলের এই কথায় হতাশ হলাম। তারপরও আত্মসম্মান বোধের কারণে সাহস নিয়ে ওকে বললাম,
——আজ সাবা আপুর বন্ধুরা এসেছিলো।
——তাতে সমস্যা কি হলো?
—-ওর বন্ধু জামান আমাকে দেখে ওকে বললো তোমাদের কাজের মেয়েটা খুব সেক্সি। ও কি নতুন এসেছে? সাবা আপু ভুলটা ভাঙ্গালো না। উল্টো জামানের সাথে সুর মিলিয়ে বললো আমি কাজের লোক হিসাবে এ বাড়িতে নতুন এসেছি।
এ কথা শুনে রাসেল প্রচন্ড রেগে গেল।
চলবে