#ধারাবাহিকগল্প
#আকাঙ্খিত প্রণয়
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী
প্রতিটি মানুষের বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্নটা যখন পূরণ হয় বিয়েটা অনেক মধুময় হয়। আজ আমার বিয়ে। খুব আয়োজন করে আমার ভালবাসার মানুষের সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে। আমি এই মুহুর্তে বিয়ে নামক আবেগ ইমোশনে ডুবে আছি। আমার স্বামীর বাড়িটা আমার আসার কারণে আলোয় ঝলমল করছে। পঞ্চাশে আমার এতো আয়োজন করে বিয়ে হবে আমি কখনও কল্পনাও করিনি। স্বপ্নেও কোনদিন ভাবিনি আমার নিজের একটা মানুষ হবে। হালকা নীলাভ রঙের ডিম লাইটের আলোতে আমার বাসর খাটটাকে খুব সুন্দর লাগছে। সমস্ত খাট বেলীফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। রাজীব জানে বেলীফুলের ঘ্রাণ আমার খুব ভাল লাগে । নিজেকে রাজকন্যার মতো ফিল হচ্ছে। সিনেমার নায়িকাদের মতো আমারও ভয় হতে লাগলো এতো সুখ আমার কপালে সইবেতো। দুই হাত দুই পায়ে মেহেদি পড়ানো হয়েছে। এমনকি আমার গায়ে হলুদও খুব জাঁকজমক করে হয়েছে। ওখানে আমার আর রাজীবের ছেলের বন্ধুরা নাচগান করে খুব মজা করেছে। যদিও আমার ছেলে মেহেদী আমাকে নাচানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু আমার ইচ্ছে হয়নি। এমনিতেই আমার আত্মীয়স্বজন এই বিয়ে নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প বানিয়ে বলাবলি করছে। তারউপর যদি আবার নাচানাচি করি তাহলে তো আর কোনো কথাই নাই। আমার নাকি শরীরের জ্বালা বেশি তাই বিয়ের উপযুক্ত ছেলের বিয়ের কথা না ভেবে নিজেই আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসেছি।
উনারা আরো বলেছেন আমার ছেলের দুর্ভাগ্য ওর বাবা থেকেও নেই। আর মায়ের বুড়ো বয়সে বিয়ের ভীমরতী ধরেছে। অথচ আমার বিয়েটা আমার ছেলেই দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছে। ঠিক একজন বাবা তার মেয়েকে যে ভাবে পাত্রস্থ করে সেভাবেই আমার ছেলে আমাকে স্বামীর বাড়ি পাঠিয়েছে। বিয়ের বাজার থেকে শুরু করে বরের পোষাক আংটি ঘড়ি, কনভেনশন হল ভাড়া করা সব সে একা হাতেই সামলে নিয়েছে। এর মাঝে বাড়তি প্যারা ছিলো আত্মীয়স্বজনের কটুকথা হজম করা। ওদিকে রাজীবের ছেলে মিরাজও বাবার বিয়েতে ওর দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করে যাচ্ছে। আমার বিয়ের শাড়িটা যেদিন কেনা হয় মিরাজ আমাকে ফোন দিয়ে বলে,
—–আন্টি আজ বসুন্ধরায় মেহেদীকে নিয়ে সন্ধা ছ,টায় চলে আসুন। শপিং ও হবে তারপর হালকা খাওয়া দাওয়া চলবে।
সেদিন খুব মজা হয়েছিলো। ঐ প্রথম মনে হলো আমার একটা পরিপূর্ণ পরিবার। তাই মেহেদীও যেদিন বরের শেরওয়ানি কিনেছিলো সেদিন রাজীব আর মিরাজকে ডেকে নেয়।
আজ আমার বিয়েতে আমার ছেলের ভুমিকা দেখে তিরিশ বছর আগের স্মৃতি মনে পড়ে গেল।
আমি ছাত্রী হিসাবে বেশ ভালো ছিলাম। পড়াশোনায় ও বেশ মনোযোগী ছিলাম। কিন্তু আমার কাল হলো আমার সৌন্দর্য। হাতে পায়ে অনেক বড় হয়ে গিয়েছিলাম। বিশ বছরের মেয়েকে দেখতে পঁচিশ বছরের মেয়ের মতো মনে হয়। আত্মীয়স্বজন বলাবলি শুরু করলো গরীবের মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দিতে হয়। এতে নাকি মেয়ের দাম থাকে। আমার তখন চারিদিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে লাগলো। কিন্তু সব পাত্রের বয়স আমার থেকে দশ বারো বছরের বেশী। আমি এসব দেখে ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাকে বললাম,
—–মা আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। লেখাপড়া করে আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।
—–শোন,লেখাপড়া করে কি অফিসার হবি? লেখাপড়া করতে গেলেও টাকা লাগে। সেই টাকা আসবে কোত্থেকে? আজকাল চাকরি পেতে গেলে ঘুষ দিতে হয়। তোমার বাপ তো করে কেরানীর চাকরি। আমার সংসার চালাতে কষ্ট হয়। ধনী ফ্যামেলি দেখে তোর বিয়ে দিবো। এতে যদি ছেলের বয়স একটু বেশি হয় তাতে কোনো সমস্যা নাই। কথায় আছে না, সোনার চামচ তার আবার আঁকা বাঁকা। তুই নিজেও ভাল খেতে পড়তে পারবি, তোর বাপের সংসারে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করবি। তোর ছোটো ভাই দুটোকে তো মানুষ করতে হবে?
আমার বাবাও সেদিন মায়ের কথার কোনো প্রতিবাদ করেনি। শুধু উনাদের কথা শুনে আমার বুকটা ফেটে চৌচির হলো। আমি মেয়ে সন্তান বলে আমার চাওয়া পাওয়ার কোনো মুল্য নাই। আমার সেদিন মনে হলো আমার বাবা মা আমাকে হাত পা বেঁধে গাঙ্গের জোয়ারে ভাসিয়ে দিবে।
অবশেষে আমার বিয়ে ঠিক হলো। আমার বয়স বিশ বছর আর পাত্রের বয়স বত্রিশ বছর। ওদের গাড়ি বাড়ি সবই আছে। ছেলে আমাকে দেখতে এসে পছন্দ করে ফেলেছে। উনার বাবা মাকে জানিয়ে দিয়েছে বিয়ে করলে সে আমাকেই করবে। অগত্যা ওখানেই আমার বিয়ে হলো।
বিয়ের প্রথম দিনেই মনে হলো আমাকে হাত পা বেধে গাঙ নয় উত্তাল সাগরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আমার বাবা গরীব বলে সে রকম গয়নাগাটি দিতে পারে না। হাতে চিকন একজোড়া চুড়ি আর কানে একজোড়া দুল। এটুকু সোনা আমার বাবা মা অনেক কষ্টকরে যোগাড় করেছে। থাকলে না আমাকে গা ভর্তি করে গয়না দিবে। ওদের নিজেদের খাওয়া পড়া জুটে না। যাই হোক আমার গয়না কাপড় দেখে খালা শাশুড়ি চিৎকার দিয়ে আমার শাশুড়িকে বললো,
—–বুবু তোর সোনার টুকরা ছেলেটাকে শেষ পযর্ন্ত কেরানীর বাড়িতে বিয়ে দিলি। গয়নাগাটি কাপড়চোপড়ের ঐ তো ছিড়ি? তোর ছেলের শ্বশুর শাশুড়ীর পরিচয় আত্মীয় স্বজনের কাছে কিভাবে দিবি? আমি অবাক হয়ে গেলাম দুলাভাই ডাক্তার হয়ে কেরানীর বাড়িতে কি করে নিজের ছেলের বিয়ে করাতে রাজি হলো? রাসেলের কি এতই মেয়ের আকাল পড়েছিলো।
খালা শাশুড়ীর কথা শুনে আমার শাশুড়িমা বললো,
—–কি করবো বল এই মেয়েকে দেখার পর রাসেল গোঁ ধরে বসলো বিয়ে করলে সে এই মেয়েকেই বিয়ে করবে। বাধ্য হয়েই এখানে আমার হীরের টুকরাে ছেলেকে বিয়ে করাতে হলো।
অপমানে আমি যেন ক্ষুদ্র থেকে আরোও ক্ষুদ্রতর প্রাণিতে পরিনত হতে লাগলাম। আমার এক দেবর আর দুই ননদ। ওরাও যেন এই গরীবের মেয়েটাকে নিজের ভাইয়ের বউ হিসাবে মেনে নিতে পারলো না। আমার স্বামীও এসব কথার কোনো প্রতিবাদ করলো না। সে তো অন্তত কিছু বলতে পারতো?আমি তো যেচে এ বাড়ির বউ হয়ে আসেনি। উনি পছন্দ করেছেন বলেই তো আমাকে এ বাড়ির বউ হয়ে আসতে হয়েছে।
ছ,ফিট মেদহীন শরীর দেখতে সুপুরুষ ছিলো আমার স্বামী। বাহ্যিক দিক থেকে যতটা সুন্দর ছিলো ভিতরটা ওর ততটাই নোংরা ছিলো।
বাসর ঘরে দুরু বুকে বসে আছি। চোখটা একটু বুঁজে আসছিলো। হঠাৎ ছিটকিনি লাগার শব্দে আমার তন্দ্রাভাব কেটে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত একটা বাজে। খাটের পাশে বসে আমাকে বললো,
—-আমার জুতো জোড়া খুলে দাওতো খুব টায়ার্ড লাগছে।
আমি রোবট চালিত পুতুলের মতো খাট থেকে নেমে ওর জুতো খুলে দিলাম। কারণ এ বাড়িতে আসার সময় মা বলে দিয়েছিলো স্বামীর অবাধ্য যেন কখনও না হই। আসলে ও আমার থেকে এতো বড় ছিলো যে ওর হুকুম না মেনে আমার উপায় নেই। আমি জুতো জোড়া খুলে দিয়ে আবারও খাটের কোনায় জড়সড় হয়ে বসে থাকলাম। আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে আবার ধমক দিয়ে বললো,
—–আমি কি বাঘ না ভাল্লুক। এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? ওয়াশ রুমে গিয়ে কাপড় চেঞ্জ করে আসো।
আমি আবার যন্ত্রচালিত রোবটের মতো ওয়াশরুমে গিয়ে পোশাক চেঞ্জ করে ওজু করে আসলাম।
আমি জায়নামাজ বিছিয়ে আমার স্বামীকে ডেকে বললাম,
——আসেন,আমরা একসাথে নামাজ পড়ে নেই।
——-তোমার নামাজ তুমি পড়ে নাও। আমারটা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।
——এই নামাজ একসাথে পড়তে হয়।
——-এই মেয়ে তোমার সমস্যা কি? বাংলা কথা বুঝো না? এখনি আমাকে জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তোমাকে পছন্দ করে বিয়ে করে এনেছি বলে মাথায় উঠো না। তোমার দ্বারা জুতো কেন খুলে নিয়েছি বুঝো না?কারণ আমার জুতোর তলায় তোমাকে জায়গা দিয়েছি। কথাটা মনে রেখো।
আমার চোখে যেন বেদনার ভরা নদীর জোয়ার উথলে উঠলো। নিঃশব্দে বোবা কান্না নিয়ে নামাজ পড়ে খাটের একপাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লাম।
চলবে