#ধারাবাহিক গল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী
আমার কারণে আমার ছেলের সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেছে। এটা শোনার পর নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। আসলে এসব খবরতো চাপা থাকে না। আমরা দুজন মাঝে মাঝে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে দেখা করি। আর আমরা তো কোনো অন্যায় করছি না। যে লুকিয়ে দেখা করতে হবে। হয়ত ডোনাও আমাদের দেখেছে। ওর কাছে হয়ত এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লেগেছে। এখনও আমাদের সমাজে সংকীর্ন মানুষের বাস। আমার এ বয়সে একজন মহিলা নতুন করে ঘর বাঁধবে সেটা মেনে নেওয়ার মতো আমাদের সমাজে মানসিকতা এখনও তৈরী হয়নি। আমি এও জানি আমার এই বিষয়টায় মানুষের পজিটিভ যতটা দেখতে পাবো তার থেকে নেগেটিভ আচরণ বহুগুন বেড়ে যাবে। সবার আগে কাছের মানুষগুলোই নেগেটিভ কথা বেশি বলবে। এদিকে ছেলেটার জন্য খারাপ লাগছে। সেদিন সন্ধায় চা খেতে বসে মেহেদীকে বললাম,
——বাবা মেহেদী তুই কি আমাকে ডোনার নাম্বারটা দিবি?
——কেন?তা ছাড়া এখনতো ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
——শোন দুটো পাতিল একসাথে রাখলে ঠোকাঠুকি হয়। সেরকম তোদের দুজনের হালকা পাতলা মানঅভিমান হতে পারে। তাই বলে কি সম্পর্ক ভেঙ্গে দিতে হয়?
——মা এটা হালকা পাতলা মান অভিমান নয়। ও তোমাকে অসম্মান করেছে। বিয়ে না হতে যে তোমাকে অসম্মান করার সাহস দেখায় তাহলে বিয়ের পর তার আচরণ কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়। তাছাড়া ভুল মানুষকে ভালোবেসে যন্ত্রণা পাওয়ার থেকে আমার জীবন থেকে ও সরে গেছে এতে আমি সুখী। যে চলে যেতে যায় সে সামান্য বাহানায় চলে যেতে পারে। কিন্তু যে ভালোবেসে জড়িয়ে থাকতে চায় সে হাজারো কষ্টে বুক দিয়ে আগলে রাখে। তুমি আমাকে নিয়ে মিছে ভেবো না। আমি ঠিক আছি।
এভাবে আরো দুটো বছর পার হয়ে গেল। মেহেদী এবছর ফাইনাল প্রফের পরীক্ষা হবে। পড়াশোনা নিয়ে ছেলে আমার ভীষণ ব্যস্ত। সেদিন দুপুরে আমি আর মেহেদী লাঞ্চ করছিলাম। হঠাৎ মেহেদী আমাকে বললো,
——আম্মু তোমাকে তো বলাই হয়নি। সেদিন কলেজে হৃদ্যে আঙ্কেলের সাথে দেখা হয়েছে।
—–ও কি অসুস্থ ছিলো?
—–না, আম্মু। উনার মেয়ে এই মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। ভর্তির পারপাসে এসেছে।
—–বাসায় আসতে বলিসনি?
——বলেছি। আঙ্কেল আমার কাছ থেকে বাসার ঠিকানা নিয়েছেন। আম্মু তোমাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
——বলে ফেল।
——তোমরা বিয়েটা করে ফেলো।
——-তাতো করাই যায়। কিন্তু আমি ভাবছি আমার চারপাশের মানুষগুলো ব্যাপারটা কিভাবে নিবে।
——আম্মু তুমি যখন একাকীত্বের যন্ত্রণায় দগ্ধ হও কেউ তো এসে জানতে চাইবে না তোমার কষ্টের কথা। তুমি চাইলে বাকি জীবন একা থাকতেই পারতে। কিন্তু জীবনটাকে তোমার কাছে বোঝা মনে হতো। ভালোভাবে বাঁচতে চাইলে একটা অবলম্বনের দরকার হয়। এই যেমন আমার শৈশবে মানে বয়স যখন সাত আট বছর ছিলো তখন তো আমি একা আমার সব প্রয়োজন চাইলে মেটাতে পারতাম। যেমন গোসল করা খাইয়ে দেওয়া। কিন্তু আমি তোমার অপেক্ষায় বসে থাকতাম। কারণ আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তুমি। তাই তোমার সাহচার্য আমার ভালো লাগতো। আর এখন আমি যে প্রফেশনে যাচ্ছি তোমাকে তো আমি সময় দিতে পারবো না। কিন্তু তোমারও তো ভালোভাবে বেঁচে থাকতে গেলে একটা অবলম্বনের প্রয়োজন। আর এছাড়া তুমি বা নিজেকে কেন বঞ্চিত করবে। তোমার বয়স বাড়ছে। নিরাপত্তার জন্য কাজের অ্যাসিসটেন্ট রাখতে চাও না। আমার তোমাকে নিয়ে অনেক টেনশন হয়। তোমাকে আর একটা কথা বলা হয়নি। সেদিন প্লাবন মামা আমার কলেজে এসেছিলো। মামা ভেবেছে তোমার বিষয়টা মনে হয় আমি জানি না। তাই আমাকে বললো তোমার কারণে নাকি ওদের মাথা কাটা যাচ্ছে। আমারও নাকি সম্মানহানি ঘটবে।
——তুই কি বলেছিস?
——আমিও শক্তভাবে বলেছি তোমরাতো কখনও আমার মায়ের সুখের কথা ভাবোনি। কিন্তু আমি আমার মাকে সুখী দেখতে চাই। সেক্ষেত্রে মায়ের সিদ্ধান্তে আমার মত রয়েছে।
——তোর মামা কি বললো?
——আমাদের মান সম্মান না থাকতে পারে তার তো আছে। আমাদের কারনে সে তার মানসম্মান খোয়াতে পারবে না। তাই সে চায় না আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে।
——না রাখলে না রাখুক। কবেই বা তোর আর আমার খোঁজ রেখেছে?
——আমিও তোমার সঙ্গে একমত।
সামনে পরীক্ষা। মেহেদী হোস্টেলে চলে গেছে। বাসায় পড়া ঠিক মতো হয় না। রিডিং পার্টনার থাকলে পড়ার গতি বেড়ে যায়। এই কারণে মাসখানিকের জন্য মেহেদী হোস্টেলে চলে গেল। ওদিকে রাজিব ছেলের সাথে দেখা করতে কানাডায় গিয়েছে। হয়তো সামনের মাসে ক্রীসমাসের ছুটিতে ছেলে সহ দেশে আসার কথা আছে। সে সময় মেহেদীরও পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। সব কিছু যদি ঠিক থাকে আমরা তাহলে সেসময় বিয়ে করে ফেলবো। রাজীবের সাথে আমার সে রকম কথা হয়েছে।
সাতদিন হলো মেহেদী হোস্টেলে চলে গিয়েছে। বাড়ীটা খালি খালি লাগে। ওদিকে রাজীবের সাথে দিনরাত্রীর ব্যবধানের কারনে ঠিক মতো কথা হয় না। আসলে ওর সাথে কথা বলাটা আমার অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। সেটা আমি খুব মিস করছি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত সাড়েদশটা বাজে। ডিনারটা সেরে নেই। হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল। আইপিএসটা এখন আর কাজ করছে না। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো বিছানায় লুটিয়ে পড়ছে। আমি অন্ধকারে হেঁটে কিচেনে গিয়ে মোমবাতি জ্বালানোর সাহস পেলাম না । যদি হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই। এ বয়সে পড়ে হাড়গোড় ভাঙ্গলে অনেক ভোগান্তি। তাই নিজেকে নিজে সাবধানে রাখি। আমি জানালার ধারে বসে মোবাইলে ফেসবুকিং করতে লাগলাম। আর কারেন্ট আসার অপেক্ষায় থাকলাম। একা থাকলে আমার চুলো জ্বালাতে ভয় হয়। আমি সকালবেলা জানালা দরজা সব খুলে তারপর চুলা জ্বালাই। রাতে ওভেনে কাজ সেরে নেই।
মাস দুয়েক পর আজ আমার সেই কাঙ্খিত দিন। না আমার এই বিয়েতে আমার বাবার বাড়ির কেউ অংশ নেয়নি। শুধু হৃদ্যে ওর বউ বাচ্চাকে নিয়ে এসেছিলো। হৃদ্যের বউটা সব দিক থেকে ভালোই হয়েছে। আমার বিয়েটাকে সাধুবাদ জানিয়েছে। ওর মেয়েটা দেখতে বেশ হয়েছে। মেহেদীর সাথে ভালোই মানাবে । মেহেদীর কাছে একটা খবর শুনে খারাপ লেগেছে। ওর দাদী মারা যাবার পর ওর বাবাকে ওল্ডহোমে রেখে আসা হয়েছে। সাবা তো ওর স্কুল নিয়ে ব্যস্ত। মাসাবা লন্ডনে সেটেল্ড। দরজা খোলার শব্দে অতীতের উঠোন থেকে ফিরে বর্তমানের জগতে ফিরে এলাম। তাকিয়ে দেখি মেহেদী আর রাজীব ঘরে প্রবেশ করেছে। আমি মেহেদীর দিকে তাকিয়ে আছি। সাদা পাঞ্জাবী পড়া ছেলেকে দেখে আজ মনে হচ্ছে ও সত্যি আমার বাবা হয়েছে। আমার ছেলে খাটের কোনায় আমার পাশে বসলো। ওর বিপরীতমুখে রাজীব বসে আছে। মেহেদী আমার হাতটা রাজীবের হাতে তুলে দিয়ে বললো,
——আঙ্কেল আমার মেয়েটাকে দেখে রাখবেন। অফুরন্ত ভালোবাসা দিবেন। মেয়েটা আমার অনেক দুঃখী। সারাজীবন দুহাত ভরে দুঃখকে বরণ করে নিয়েছে। কোনোদিন সুখের জন্য লালায়িত হয়নি। কিন্তু আমি আমার মেয়েটাকে সুখী দেখতে চাই।
ছেলের কথাশুনে আমার দুচোখ ভরে বাধভাঙ্গা জল ঝরতে লাগলো। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে সারাজীবনে অর্জন করা সব কষ্টের নোনাজলে নিজেকে সিক্ত করে নিলাম। ছেলে আমার কপালে চুমু দিয়ে বললো,
—–আর এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলবে না। এখন তোমার সুখের সময়।
ও ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
—–আম্মু রাত বারোটা বাজে। আমাকে আবার বাসায় ফিরতে হবে।
——শ্বশুরমশাই সেটাতো হচ্ছে না। আজ থেকে তুমিও আমাদের সাথে থাকবে।
মিরাজও এসে বললো,
——তাইতো,মেহেদী তুমিও থেকে যাও। আমাদের বাড়ীটা জমজমাট হবে।
মেহেদী বললো,
——মিরাজ ভাই তুমি বরং আমার সাথে চলো। আমার মেয়ে আর তোমার ছেলে এ বাড়িতে আজকে একাই থাকুক।
মিরাজ মেহেদীর কথায় রাজি হয়ে আমার ফ্লাটে চলে গেল। ওরা যাওয়ার পর একরাশ লজ্জা যেন আমার উপর ভর করলো। ভালোবাসার কোমল স্পর্শে রাজীব আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
——সারাজীবন তোমাকে বুকের মাঝে আগলে রাখবো। ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবো। তুমিও আমায় ছেড়ে চলে যেও না। তোমায় বড্ডো ভালোবেসে ফেলেছি।
আমি যেন আজ কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। রাজীব কপালে আলতো করে চুমু খেলো। ওর বাড়িটা ডুপ্লেক্স। আজ ভরা পূর্নিমা। আমি আর ও হাতধরে ছাদে এসে দোলনাটায় বসলাম। হাসনাহেনার সুবাসে মনটা যেন রোমান্টিকতায় ভরে উঠছে। একটু শীত পড়েছে। ও ওর ব্লেজারটা খুলে আমার গায়ে জড়িয়ে দিলো। আমি যেন সুখের নৌকায় ভেসে বেড়াচ্ছি। আর আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া জানাচ্ছি। আসলে আল্লাহপাক তার বান্দাকে পরীক্ষা করেন। কিন্তু যখন পুরুস্কৃত করেন তখন বহুগুন তাকে ফিরিয়ে দেন।
সমাপ্ত