#ধারাবাহিক গল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-বাইশ
মাহবুবা বিথী
—–আমার কথাগুলো শুনে আপনার ঘাবড়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। একটু মজা করলাম। আফটার অল আমি আপনার একজন ফ্যান।
আমি একটু মুঁচকি হেসে মনে মনে ভাবলাম আমিও এখন আর এতো ছোটো নেই কোনটা মজা আর কোনটা মুগ্ধতা সেটুকুন বুঝবো না। যাইহোক না বুঝার ভান ধরে থাকলাম।
প্রথমে কেশনাট সালাদ চলে আসলো। আমার ভীষণ পছন্দের। সাথে আপেল জুস। এর পর রাইসের সাথে চিকেন সবজি দিয়ে আমি আর উনি ডিনার সেরে নিলাম। আমার ছেলে খেলো সিফুড। সবার শেষে আইসক্রিম খেয়ে আমরা বাড়ির পথে রওয়ানা হলাম। ভদ্রলোক আমাদের বাসায় নামিয়ে দিলেন। আমি ও ভদ্রতা করে বললাম,
——আসুন, একটু চা খেয়ে যাবেন।
মেহেদীও আমার সাথে সাথে বললো,
——স্যার একটু বসে যান।
——সে আর একদিন হবে। বেশ রাত হয়েছে। আজ চলি।
ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর ছেলে আমায় প্রশ্ন করলো,
——স্যারকে কেমন লাগলো আম্মু?
——ভালোই। বেশ জলি মাইন্ডের।
আমি ওকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুমে এসে ফ্রেস হলাম। আমি জানি এরপর হয়ত মেহেদী বলবে, “স্যারকে কি তোমার পছন্দ হয়েছে আম্মু”। এই জন্য তাড়াতাড়ি রুমে চলে আসলাম। অনেকদিন পর আসলেই খুব সুন্দর সময় কাটলো। যদিও মেহেদীকে জানাতে চাইছি না কিন্তু ভদ্রলোক সত্যিকার অর্থে পছন্দ করার মতো মানুষ।
আমি জানি উনিও একটু পরে ম্যাসেজ পাঠিয়ে
জানতে চাইবেন তাকে আমার ভালো লেগেছে কিনা। ভাবতে ভাবতে মোবাইলে টুং করে শব্দ হলো।
আমি জানি ম্যাসেজটা কে পাঠিয়েছে?
——ঘুমিয়েছেন?
——না,এখনও ঘুমাইনি। তবে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ব। আগামীকাল ক্লাস আছে।
——যতক্ষণ জেগে আছেন একটু কথা বলতে পারি?
ভদ্রলোক এতো যত্নকরে আমাদের মা ছেলেকে ট্রিপ দিলেন আবার বাড়ী পৌঁছে দিয়ে গেলেন তাকে কি করে না বলি।
—–কথা তো আমাদের অনেক হলো।
——হইয়াও হইলো না শেষ। আমাকে আপনার কেমন লাগলো? আমরা কি বন্ধু হতে পারি?
আমি কৌশলে প্রথম প্রশ্নটা এড়িয়ে উনাকে বললাম,
——বন্ধুতো হওয়াই যায়।
——আজ থেকে আমরা তাহলে বন্ধু হলাম। আসলে আমার স্ত্রী মারা যাবার পর ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে আর ডাক্তারী সামলাতে এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম যে একাকীত্বের অনুভবটা তখন অতটা তীব্র হয়নি। কিন্তু ছেলে বড় হয়ে যাবার পর আস্তে আস্তে একাকীত্বের ডিপ্রেশন আমাকে পেয়ে বসে। এখন মনে হয় এ বয়সে পাশে একজন সঙ্গী থাকাটা মনে হয় খুব বেশী প্রয়োজন। যদি অনুমতি দেন আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি।
——বলুন।
——আপনি কখনও কাউকে ভালোবেসেছেন?
——-না, সে সৌভাগ্য আমার জীবনে কখনও আসেনি। কারণ আমার ভালোবাসার ফুলটা ফোঁটার আগেই ঝরা পাতার মতো ঝরে গেছে। বিয়ে আমার হয়েছিলো ঠিক কিন্তু ভালোবাসাটা হয়ে উঠেনি। আমি ও বাড়িতে খাট পালঙ্কের মতো একটা আসবাব বই কিছু ছিলাম না। আমার পছন্দ অপছন্দের কোনো গুরুত্ব ছিলো না। এমনকি আমার স্বামীও আমার সাথে কথা বলতে পছন্দ করতো না। খাবার খেয়ে মানুষ যেমন ক্ষুধা মেটায় তেমনি ঐ খাবারের মতো আমিও ছিলাম ওর কাছে একতাল নারী মাংস। যা দিয়ে শুধু যৌনতার ক্ষুধা মিটানো যায়। কিন্তু তাকে ভালোবাসা যায় না। তাই ভালোবাসতে আমার বড্ডো ভয়।
——-আপনার কথাগুলো শুনে খুব খারাপ লাগলো।
——তবে এর মাঝেও একটা কিছু শিখেছি। সেটা হচ্ছে নিজেকে সবার আগে ভালোবাসতে হয়। আর নিজেকে ভালোবাসতে চাইলে পায়ের তলার মাটি শক্ত করে নিতে হয়।
——সেটা অবশ্য ঠিক বলেছেন। অনেকদিনতো পার হলো। দীর্ঘপথ একা পাড়ি দিতে নিজেকে ক্লান্ত লাগে না। কিংবা একা থাকতে খারাপ লাগে না?
——-এখনও সে অনুভূতীটা আমার তীব্র হয়নি। মেহেদী আমাকে যথেস্ট সময় দেয়। শিক্ষকতা আর লেখালেখি এতেই সময়টা অনেকটা পার হয়ে যায়।
——আমিও যখন মেডিকেলে থাকি তখন ছাত্রছাত্রীদের ভীড়ে ভালোই থাকি। কিন্তু যখন বাসায় আসি তখন মনে হয় কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করলে মন্দ হতো না।
——বিয়ে করে ফেলেন।
——তা ভালোই বলেছেন। আমার ছেলে মিরাজও চায় আমি বিয়ে করে সুখে আর আনন্দে থাকি। কিন্তু মনের মিল না হলে বিয়ে করেও সুখ হয় না। আমার কাছে বিয়ে মানে একটা মুক্ত আকাশ। যেখানে দুটো মানুষ মনের আনন্দে পাখা মেলে উড়তে পারে। কিংবা ভালোবাসার বুননে সংসারের যাত্রাপথে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে পারে। সে রকম সঙ্গী পেলে তবেই না বিয়েটা সুখের হয়।
এরপর থেকে ভদ্রলোকের সাথে আমার প্রায়ই কথা হতে থাকে। একটা সময় এমন হলো উনার সাথে কথা না বললে আমার ঘুম আসতে চায় না। অবচেতন মনে আমি ওর সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করি। এর মাঝে ওর নামটা আমি জেনে নিলাম। মাঝে মাঝে আমরা বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে দেখা করি। এরও একটা কারণ ছিলো। একদিন মেহেদী আমাকে বললো,
——মা, তোমার মনে আছে একবার এক নববর্ষে তুমি আমি আর হৃদ্যে আঙ্কেল একসাথে অনেকটা সময় কাটিয়েছিলাম।
——হুম মনে আছে। তাতে আবার সমস্যা কি হলো?
——সেদিন আমি হৃদ্যে আঙ্কেলের চোখে তোমার জন্য ভালোবাসা দেখেছিলাম।
——ঐটুকু বয়সে তুই ভালোবাসার কি বুঝলি?
——তখন বুঝিনি। বড় হওয়ার পর বুঝেছি। যখন বুঝেছি তখন তোমার জন্য আমার অনেক কষ্ট হয়েছিলো। আমি তো জানি তুমি আমার কথা ভেবে দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা ভাবোনি। তখন আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। একজন মানুষ হিসাবে স্বামীর ভালোবাসা পাওয়া তোমার অধিকার। কিন্তু আমার কারনে তুমি সে সুখ থেকে বঞ্চিত হলে। তাই তুমি যদি আবারও এরকম মনের মতো সঙ্গী পাও তাহলে নিজের মতো করে জীবনটা গুছিয়ে নিও। আমারও খুব দেখতে ইচ্ছে হয় বৌ সাজলে তোমাকে দেখতে কেমন লাগে? আমি তোমাকে কোনোদিন রঙ্গিন দেখিনি। তোমাকে সব সময় দেখেছি রঙহীন বিবর্ণ অনুভবে।
——খুব কথা শিখেছিস। কবে এতো বড় হয়ে গেলি।তাহলে এবার তোকে আগে বর সাজাই । তুই এমবিএস পাশ করার সাথে সাথে তোর বিয়েটা আগে দিয়ে দিবো।
——এখানে আমার শর্ত আছে।
——-কি শর্ত?
——-তুমি তোমার জীবন না গুছালে আমিও বিয়েশাদী করবো না। এই আমার শেষ কথা।
——-এতে লোকে কি বলবে?
——-কে কি বললো সেটা না ভেবে তুমি নিজে কিভাবে ভালো থাকবে সেটা আগে ভাবা দরকার।
এরপর রাজীবের সাথে আমার ঘনিষ্টতা বাড়তে থাকে। আমার স্বামীর বিভৎস কামনার আগুন আমি যেমন দেখেছি তেমনি রাজীবের কাছে ভালোবাসার পেলব স্পর্শে শিহরিতো হয়েছি।
একদিন এক কফিশপে রাজিব আমাকে বললো,
——-তুমি কি পারোনা কবি আমাকে তোমার আঁচলে বেঁধে নিতে।
না, সেদিনের ওর সেই ভালোবাসার আকুতিকে আমি ফিরিয়ে দিতে পারিনি। ওর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লাম। এরপর আমি যেন সুখের সাগরে ভাসতে লাগলাম। ও প্রতিদিন আমাকে একটা করে গাঢ় লাল রঙের গোলাপ উপহার দিতো। ওর কথা হচ্ছে গোলাপের রঙ যত লাল হবে আমাদের প্রেম নাকি তত গভীর হবে। এভাবে আমাদের দুবছরের সম্পর্কে সাতশত ত্রিশটা গোলাপ জমা হলো।
আসলে প্রণয়ের মনে হয় নিজস্ব একটা আলো থাকে। সে আলোতে আমার জীবনের অন্ধকার পথগুলো আলোকিতো হতে থাকে। আমি ওর সাথে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজেছি। যদিও বয়সের কারণে ঠান্ডা লেগে দুজনার জ্বর এসেছে। তাতে কি?
কিন্তু ভালোলাগাটা অনেক বেশী ছিলো। টং দোকানে বসে স্টুডেন্ট লাইফের মতো আড্ডা দিয়েছি। চা খেয়েছি। আমি প্রণয়ের অতল প্রেমে এতোটাই ডুবে ছিলাম যে মেহেদীর জীবনের এতো বড় ঘটনার খবরটা সঠিক সময়ে জানতে পারলাম না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। যখন জানলাম তখন অনেকটা দেরী হয়ে গেছে।
চলবে