আকাঙ্খিতো প্রণয় পর্ব-২১

0
940

#ধারাবাহিক গল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-একুশ
মাহবুবা বিথী

মাঝে কেটে গেল আমার জীবনের আরো কিছুটা সময়। চাকরি আর আমার লেখালেখি এই নিয়ে কাটছে আমার ব্যস্ততা। আজ সকাল থেকে মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে। এতো দ্রুত থামবে বলে মনে হয় না। প্রকৃতির সব অভিমান বৃষ্টি হয়ে ঝরছে।আর আমি এমন একজন মানুষ হয়ে পৃথিবীতে এসেছি যার অভিমান করার একটা মানুষ নাই। মাঝে মাঝে পার্কে রেস্টুরেন্টে কাপলদের মিষ্টি ঝগড়া দেখি আমার বেশ লাগে। ভাবি আমার জীবনটাও তো এমন হতে পারতো। যাক এসব নিয়ে এখন আর আফসোস করি না। আমার লক্ষ্য তো পূরণ হয়েছে। মেহেদী ডাক্তারী পড়ছে। মানুষের মতো মানুষ হয়েছে। এটাই তো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।
বারান্দায় বসে হাতে এক কাপ কফি নিয়ে নতুন একটা লেখার প্লট সাজাচ্ছিলাম। হঠাৎ মোবাইলের ম্যাসেজে টুং করে শব্দ হলো।
—–ম্যাম আপনার “ইপ্সিত ভালােবাসা” গল্পটির শেষ পর্বটা খুঁজে পাচ্ছি না। লিংকটা দিবেন প্লিজ।
—–হুম দিচ্ছি।
——ম্যাম আপনি কি একটু ফ্রী আছেন?কথা ছিলো।
——হ্যা বলুন।
——না, মানে আপনার সাথে একদিন দেখা করার অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাচ্ছিলাম।
——না,মানে আমি তো একটু ব্যস্ত থাকি তাই সময় বার করতে গেলে চাপ নিতে হবে। তার থেকে এই তো ভালো আপনি ম্যাসেঞ্জারে কথা বলে নিতে পারেন।
—–আসলে সত্যটা হলো আপনাকে দেখার আমার বহুদিনের ইচ্ছা। যার লেখা পড়লে এক লহমায় সব দুঃখ কষ্ট আড়াল হয়ে যায়,নতুন করে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে হয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হাজারো দুঃখ কষ্টের মাঝে নিজেকে ভালবাসতে মন চায়। এসব নানাবিধ কারণে আপনাকে আমার দেখতে মন চায়।
——এটা নিয়ে এতো প্যারা নিয়েন না। ভাগ্যে থাকলে অবশ্যই আমাদের সাথে দেখা হবে।
“নীড়হারা “পাঠকের সাথে কথা শেষ করে আমি আবার আমার লেখা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। অবশ্য মিথ্যে বলবো না। এই পাঠককে আমারও খুব দেখতে ইচ্ছে হয়। আজ অবধি সে আমার প্রতিটি লেখা পড়েছে। সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করে আমাকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু একবার ইচ্ছে হলেও দশবার পিছিয়ে যেতে হয়। মুখ ঢাকা মুখোশের আড়ালে থাকা পৃথিবীর মানুষগুলোকে বিশ্বাস করতে ভয় হয়।

চাকরি ক্ষেত্রে এখন আমার পোস্টিং সরকারি বদরুন্নেছা কলেজে। কলেজের পাশেই একটা ছয়তলা অ্যাপার্টমেন্টের চারতলা ফ্লাট ভাড়া নিয়েছি। আমারও কলেজ কাছে আবার মেহেদীরও মেডিকেল কলেজ কাছে হয়। আমাদের মা ছেলের ভালোই সময় কাটে। সপ্তাহের দুদিনের ছুটি আমরা খুব মজা করে কাটাই। সেদিন ছিলো শুক্রবার। মেহেদী আর আমি দুপুরে লাঞ্চ করছিলাম। হঠাৎ মেহেদী বলে উঠলো
——মা তোমাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি। আমাদের কলেজে নতুন একজন প্রফেসর জয়েন করেছে। অ্যানাটমির প্রফেসর। আমার একটা বিষয় বুঝতে সমস্যা হচ্ছিলো। ক্লাস শেষ করে স্যারের রুমে গিয়ে বুঝে নিলাম। স্যারও বিরক্ত হন না। বরং অনেক খুশী হোন। এই কারণে আমি প্রায় স্যারের কাছে গিয়ে পড়া বুঝে নিয়ে আসি।
——এতো খুব ভালো কথা।
——তোমাকে তো আসল কথা বলাই হয়নি। উনি তোমার লেখার একজন ভক্ত পাঠক। নীড়হারা নামে তোমার লেখা উনি পড়েন।
——উনি কি করে জানলেন আমিই তোর মা? তুই কি হ্যাংলোর মতো বলেছিস যে তোর মা একজন লেখিকা?
——না,মা তা কেন। উনি কথা প্রসঙ্গে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমার বাবা মা কি করেন?
—–তখনি উনাকে বলেছি তুমি কলেজের প্রফেসর আর পাশাপাশি অনলাইনের সাহিত্য পেইজে হালকা পাতলা লেখালেখি করো। তখনই উনি তোমার নাম জানতে চাইলেন। তোমার নাম বলতেই উনি তোমাকে সাথে সাথে চিনে ফেললেন। আমার কিন্তু তখন বেশ লেগেছে। জানো মা স্যার ভীষণ ভালো মানুষ।
——হুম বুঝলাম। এখন তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে আমায় উদ্ধার করো।
—–আম্মু জানো আমি মুখ ফসকে আব্বুর কথাও বলে দিয়েছি।
——কি বলেছিস?
——আব্বুর সাথে তোমার আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
——সত্যটাই বলেছিস।
——আমার না উনাকে ভীষণ ভালো লেগেছে। কারণ উনি যখন শুনলেন তুমি কিভাবে সংগ্রাম করে আমাকে মানুষ করেছো নিজের ক্যারিয়ার করেছো তখন আমাকে বললেন “তোমার মাকে স্যালুট করতে হয়”।

দুপুরে খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। হঠাৎ মোবাইলে ম্যাসেজের টুংটাং শব্দ। আমি জানি, কে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। মোবাইল ওপেন করতেই
——কেমন আছেন?লাঞ্চ করেছেন?
——হুম।
—–গতকাল আপনার ছেলের সাথে পরিচয় হলো। ছেলেটা আপনার ভীষণ মেধাবী। মনে হয় জেনেটিকভাবে আপনার মেধাটাই পেয়েছে।
—–হয়তো।
——আপনি তো রত্নগর্ভা।
——এটা ঠিক বললেন না। এটা আল্লাহপাকের দান। আমি শুধু লালন করেছি।
——আমারও একটাই ছেলে। আমার লাইনে আসলো না। ও বলে ডাক্তারদের নাকি পার্সোনাল লাইভ বলে কিছু থাকে না। তাই বুয়েটে ইন্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হলো। গতবছর বের হয়ে কানাডায় একটা ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে গেছে। আমি আপনার কষ্ট বুঝি একা হাতে সন্তান মানুষ করতে গেলে জীবনে কতটা চাপ নিতে হয়। আমি ও বলতে পারেন একা হাতেই ছেলেটাকে বড় করে তুলেছি।
——কেন আপনার ওয়াইফ?
——আমার ছেলের বয়স যখন পাঁচ বছর তখন ও মারা যায়।
——আমি স্যরি আপনাকে এই কষ্টের প্রসঙ্গ মনে করে দেওয়ার জন্য।
——না,না ইটস ওকে। এখন নিজেকে একাকীত্বের জীবনের সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছি। বলতে পারেন আমার একাকীত্বের জীবনে আপনার গল্পগুলো টনিকের মতো কাজ করে।
——-কাউকে সঙ্গী করে নিতে পারতেন?
——-তা, পারতাম। তবে ছেলের কথা ভেবে আমার আর সে ইচ্ছা হয়নি। তবে কি জানেন ইদানিং আমার ছেলে আমাকে বিয়ে করতে বলে। অথচ ও বুঝে না এই বয়সে যে সঙ্গী মেলানো বড় কঠিন। একা পথ চলতে চলতে এখন আমারও অনেক ক্লান্ত লাগে।আপনিও তো একাই থেকে গেলেন। ছেলের কাছে শুনেছি আপনার সংসার জীবন মাত্র চারমাস। সেই থেকে একলা পথচলা। এতো ম্যাম চাট্টিখানি কথা নয়। আপনার কখনও ইচ্ছে হয়নি জীবনটাকে আবার নতুন করে সাজাতে।
——ওই আপনি বললেন না ছেলের কথা ভেবে পারেননি আমার অবস্থাও তাই।
——এখন তো ছেলে বড় হয়েছে। জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারেন।
——এখনও এ বিষয়টা ভেবে দেখিনি।
আসরের আযান শোনা যায়। আমি চ্যাটিং শেষ করে ওজু করতে ওয়াশরুমে গেলাম।

মেহেদীকে নামাজের জন্য ডাকলাম। আমি নামাজ শেষ করে চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে দিলাম। তারপর দু,মগ চা বানিয়ে বারান্দায় বসে মেহেদীকে জিজ্ঞাসা করলাম,
——ডোনা কেমন আছে?
——ভালো।
——আমাকে তো ওকে এখনও দেখালি না।
——দেখাবো মা। তোমাকে না দেখিয়ে আমার জীবনের এতো বড় সিদ্ধান্ত আমি নিবো না। তার আগে আমারও দেখা দরকার ও সারাজীবন আমার সাথে থাকতে পারবে কিনা। আম্মু আমার স্যার একদিন তোমাকে আর আমাকে একটা ট্রিট দিতে চায়।
——কি পারপাসে?
——তার প্রিয় লেখিকার সম্মানে। তুমি না করো না। আমি আমার স্যারের মুখের উপর না করতে পারিনি। তাই তোমাকে না জানিয়ে মত দিয়েছি।
——কবে যেতে হবে?
——-আগামিকাল। তুমি কিন্তু না করো না।
——সে দেখা যাবে।
——আমি তাহলে স্যারকে তোমার মতামত জানিয়ে দিলাম।
মেহেদী চলে যাবার পর ভাবছি এ আবার কি আপদ আসলো আমার জীবনে। ছেলেটাও নাছোড়বান্দা। আমার খুব আড়ষ্ট লাগছে। আমি জানি উনি আমার লেখাকে অনেক ভালবাসেন।

যথারীতি পরদিন সন্ধায় উনি গাড়ি নিয়ে আমার বাসার সামনে আসলেন। তারপর আমাকে আর ছেলেকে পিক করে বসুন্ধরায় ” শেফস টেবল”গিয়ে হাজির হলেন। জায়গাটা অন্যান্য রেস্টুরেন্টের থেকে একটু নিরিবিলি। অনেকটা জায়গা জুড়ে রেস্টুরেন্টটা গড়ে উঠেছে। আসলে আমি এখনও উনার নামটাই জানতে পারিনি। চাইলে জানতে পারতাম কিন্তু ছেলের কাছে জানতে অস্বস্তি হয়। উনি আমার ছেলেকে বললেন,
——মেহেদী তুমি তোমার পছন্দের খাবার অর্ডার করো।
ছেলে আমাকে উনার সামনে বসিয়ে রেখে খাবার অর্ডার করতে চলে গেল। আমি উনার দিকে না তাকিয়ে বেশ বুঝতে পারছি উনি অনেক মুগ্ধতা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এই অনুভবটা মেয়েরা ভালোই বুঝতে পারে। সংকোচ আর আড়ষ্টতায় আমি কথা বলতে পারছি না। পরিবেশটা কেমন যেন লাগছে। তারপর একসময় উনিই প্রথম কথা বললেন,
——আপনি যদি নিজ মুখে না বলেন তাহলে সবাই ভাববে আপনি আর মেহেদী ভাইবোন। আপনাকে দেখতে তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মতো মনে হয়।
আমিও উনার কমপ্লিমেন্টে বললাম,
——আপনারও তো বয়স বোঝা যায় না। নিজেকে ভালোই ধরে রেখেছেন।
দেখে মনে হলো আমার এই মন্তব্যে উনি দারুণ খুশী হয়েছেন। কথাটা আমি একদম ভুল বলিনি। শ্যাম বর্ণ ক্লিন সেভ, চোখে রিমলেস চশমা মেদহীন লম্বা সুঠাম পোশাকেও বেশ রুচিবান। আড়ং পাঞ্জাবী পাজামা পরে তারসাথে শান্তিপুরী সেন্ডেল সু দারুণ মানিয়েছে। আমার নিরবতা দেখে উনি নিজেই আবার বলা শুরু করলেন।
——জানেন আমি খুব স্পষ্টভাষী। সত্যটা সামনে বলতেই খুব পছন্দ করি। আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। আপনার লেখার প্রেমে তো আগেই পড়েছি এখন আপনার প্রেমেও পড়ে গেলাম।

উনার কথাগুলো শুনে এই বয়সে আমার যেন ভিমরি খাওয়ার যোগাড়। এরপর উনি আবার স্পষ্টভাবে কি বলবেন কে জানে?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে