#ধারাবাহিক গল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-বিশ
মাহবুবা বিথী
—-কে?
—–আপু আমি শোভন
আমি দরজা খুলে ওকে বললাম,
—–তুই ঢাকায় রওয়ানা দিসনি?
—–রওয়ানা দিলেতো আর তোমার বাড়িতে আমায় এখন দেখতে পেতে না তাই না?
——ফিরে আসলি কেন?
—–মিথিলা আপু ফোন দিয়ে বললো,আমি আর তুই একসাথে রওয়ানা দিয়েছি কিনা?
——-তুই কি বললি?
—–বললাম,আমি একাই আসছি?
—–আপু আবার বললো তুমি কেন আসছো না। তারপর বললো আমি যেন টিকিট ফিরিয়ে দেই। তারপর তোমাকে নিয়ে একসাথে কাল ভোরে ঢাকায় রওয়ানা দেই। আপু এই যে দইটা রাখো। আর আমাকে একটু দাও। রাতে খাবার কিছু আছে?
——না আমরা এখনও ডিনার করিনি। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। কিন্তু তুই পায়ের মোজা খুলে ওয়াশ রুমে গিয়ে সাবান দিয়ে পা ধুয়ে ফেল। আর মোজাটা ধুয়ে বারান্দার গ্রিলে মেলে দে। তুই কি করে এই গন্ধ সহ্য করিস?
আমি ওকে দই খেতে দিয়ে বললাম,
—–দই খেয়ে এখুনি ওয়াশ রুমে চলে যা।
আমার বমি আসছে। মোজার গন্ধ আমি একদম সহ্য করতে পারি না। টেবিলে খাবার বেড়ে দিতে তাড়াতাড়ি কিচেনে চলে গেলাম।
এমন সময় মেহেদী এসে বললো,
—–কেমন আছো মামাজী?
——ভালো ভাগনে। তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি ওয়াশ রুম থেকে আসছি।
—— মা বকেছে। শোনো তোমাকে একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দেই। আমার প্লানমাফিক চললে তোমার মোজায় কোনো গন্ধ হবে না।
—–বলো ভাগনে তোমার প্লান বলো।
——বাথরুমে গোলাপজল আছে। তুমি সাবান দিয়ে পা ধুয়ে গোলাপ জল ছিটিয়ে দিও। এরপর যখন জুতো পড়বে তখন জুতোর মধ্যে পাউডার দিয়ে নিও। তাহলে আর গন্ধ হবে না।
—–তুমি কেমন করে জানলে?
—–আম্মু শিখিয়েছে।
কিচেন থেকে মেহেদীর কথাগুলো শুনে আমার খুব ভালো লাগলো। আমার ছেলেটা এভাবে যেন সারাজীবন আমার কথাগুলো মেনে চলে।
খুব তাড়াতাড়ি ডিনার করে আমরা শুয়ে পড়লাম। কালখুব ভোরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হবে।
প্রচন্ড গরম পড়েছে। চৈত্রের দহন বেলা বলে কথা। বিছানাটা পর্যন্ত গরম হয়ে আছে। ঘুম আসছে না। আমি মোবাইলটা ওপেন করলাম। বিকালে যে লেখাটা পোস্ট করেছি দেখি পাঠকরা কি কি মন্তব্য করেছে। আমি খুব মনোযোগ সহকারে পাঠকের মন্তব্যগুলো পড়ি। আমার একজন পাঠক আছে সে আমার প্রতিটি গল্প পড়ে। আর সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করে। ওর ফেসবুক নেম নীড়হারা পাখি। সে পুরুষ কিংবা নারী তা আমি জানি না কিন্তু ওর কমেন্টেস এর কারনে ওর সাথে আমার প্রায় প্রতিদিন কথা হয়। আজও কমেন্টস করেছে।
“ম্যাম আপনার গল্পগুলো আমার জীবনে চলার পথে শক্তি যোগায়। আমার প্রতিদিন ঘুমানোর আগে আপনার গল্প না পড়লে ঘুম আসে না”।
আমি লাভ রিয়েক্ট দিলাম। হঠাৎ যেন ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করলো। মনে হয় কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। বাতাসে সোঁদা মাটির সুবাস ছড়াচ্ছে। এই সুবাসটা আমার বেশ লাগে। এ যেন আদি অকৃত্রিম সুবাস। দু,দিন পর নববর্ষ। ভালোই লাগছে এবার নববর্ষটা ঢাকায় গিয়ে পালন করবো। মেহেদীকে নিয়ে রমনায় যাবো। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। ঘরে এসে নিজেকে নিয়ে ঘুমের জগতে হারিয়ে গেলাম।
খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গলো। আমি ফজরের নামাজ আদায় করে নিলাম। তারপর শোভন আর মেহেদীকে ডেকে হালকা কিছু খেয়ে ভোর সাড়ে পাঁচটায় বাসা থেকে বের হলাম।
মাঝখানে বাস থামলে আমরা একটু হালকা নাস্তা করে নিলাম।
খুব তাড়াতাড়ি ঢাকায় পৌঁছে গেলাম। আব্বু আম্মু আমাকে দেখে খুশি হলেও প্লাবন স্বাভাবিক হতে পারছে না।
আজ শনিবার। আঙ্কেল আন্টি এসে অবশেষে বিয়ের কথা ফাইনাল করলো। মাসখানিক পর ওদের বিয়ের তারিখ ঠিক হলো। আগামী কাল নববর্ষ। আমি মেহেদীকে নিয়ে আড়ং থেকে কাল নববর্ষে পড়ার জন্য পাঞ্জাবী কিনতে বের হলাম। ওর জন্য পাঞ্জাবী কিনে আম্মু ও আব্বুর জন্য শাড়ি আর পাঞ্জাবী কিনলাম। আমি কিছু কিনলাম না দেখে আমার ছেলে বললো,
—–মা তুমি একটা শাড়ি কিনলে তো পারতে।
—–আমার অনেক শাড়ি আছে।
—–তা থাক। আমার পাঞ্জাবীর সাথে ম্যাচ করে একটা শাড়ি কিনো। আমাদের যদি নরমাল লাইফ হতো তাহলে হয়ত তুমি আমি বাবা নববর্ষ উপলক্ষে একই রঙের পোশাক কিনতাম। বাবা আমাদের সাথে না থাকুক তাতে কি? আমরা মা ছেলে তো একই রঙের পোশাক পড়তেই পারি।
—–আচ্ছা ঠিক আছে বাবা, এতো পাকামো করতে হবে না। আমি তোর পাঞ্জাবীর সাথে মিলিয়ে শাড়ি কিনছি।
আমি ভাবছি আমার ছেলেটা ভিতরে ভিতরে ম্যাচিওর হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষকে ম্যাচিওর করে দেয়।
মা ছেলে বাইরে ডিনার করে বাসায় ফিরলাম। আসলে মফস্বল এড়িয়াতে থাকি। সেখানে মেহেদীকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেলেও ও ঢাকার ফুড কোর্টকে খুব মিস করে।
আম্মু পাঞ্জাবী আর শাড়ি দেখে বললো,
—— অযথা এতো খরচ করার কি দরকার ছিলো?সামনে প্লাবনের বিয়ে। তোকে তো কিছু শেয়ার করতেই হবে। ওর তো নতুন চাকরি। ও আর কতটুকু ম্যানেজ করতে পারবে।
আব্বু একটু রেগে গিয়ে বললো,
—–তা,তোমার ছেলে দুদিন পরে বিয়ে করলে কি এমন ক্ষতি হতো?চাকরিটা পেলো কি ওমনি বিয়ে করার জন্য পাগলা হয়ে গেল।
—–আমার ছেলের দোষটাই তোমার চোখে পড়লো। মেয়ে পক্ষ থেকে চাপ আসছে সেটা খেয়াল করলে না?
——ও একটু বুঝিয়ে বললেই হতো। আর তোমার দরকার পড়লেই রুহেলীর কাছে টাকা চাও। ওকি টাকা বানানোর মেশিন। ওর একটা ভবিষ্যত আছে না। মেহেদীকে মানুষ করতে হবে না।
—–রুহেলী ওদের বড় বোন। কিছুটা দায়িত্ব তো থেকেই যায়। আর মেহেদীর জন্য ভাবতে হবে না। ওর মামারা ওকে ঠিক সাপোর্ট দিবে।
—–শোনো প্লাবনের মা পৃথিবীটা বড় স্বার্থপর। আর তোমার প্লাবন তো চাকরিটা পেয়েই নিজের স্বার্থ খুঁজতে বিয়ের পিঁড়িতে বসলো। আর শোভন ও কি করবে তা আমার ভালোই জানা আছে। কথায় আছে না “আগা হাল যেদিকে যায় পাছা হালও সেদিকে দৌড়ায়”।
আমি সামান্য শাড়ি আর পাঞ্জাবী নিয়ে আব্বু আম্মুর ঝগড়া দেখে আম্মুকে বললাম,
—–আমি অযথা খরচ করি না মা। সামনে প্লাবনের বিয়ে তাই তোমার আর আব্বুর জন্য শাড়ি পাঞ্জাবী কিনলাম। আর আমার দায়িত্বের ব্যাপারে আমি সবসময় সচেতন। তা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। কাল একটু মেহেদীকে নিয়ে বের হবো। আমি শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ মোবাইলে টুং করে শব্দ হলো।
“কাল আসছো তো রমনা বটমূলে”
“হুম”আমি এখন ঘুমাবো। কাল কথা হবে। গুড নাইট।
খুব ভোরে মেহেদীকে নিয়ে রমনা বটমূলে হাজির হলাম। দূর থেকে দেখেছি হৃদ্যে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেদীকে দেখে বললো,
—-কেমন আছো আঙ্কেল?
—–ভালো, তুমি কেমন আছো?
——আমি ভালো ছিলাম না। তবে তুমি আর তোমার আম্মুকে দেখে আমার মন ভালো হয়ে গেল। তোমাদের দুজনকে দারুন লাগছে।
—–আঙ্কেল তোমাকেও দারুন লাগছে।
আমি আর কোনো কথা বললাম না। জানি ছেলে আমাকে ফলো করবে। কি বলতে কি বুঝবে এর থেকে চুপ থাকাই ভালো। আমার একটু অস্বস্তিও হচ্ছে। ছেলেটা আমার ওর বয়সের থেকে একটু বেশী বোঝার চেষ্টা করে। আমরা রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান উপভোগ করে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিলাম। ওখানে মিছিলে একসময় আমি একটু ভীড়ের মাঝখানে পড়ে গেলাম। অনেক সময় নানা রকম ঝামেলা হয়। কিছু শয়তান ঐ সময় মেয়েদের গায়ে হাত দেয়। আমার অস্বস্তি হচ্ছে। হৃদ্যে বুঝতে পেরে আমাকে আর মেহেদীকে জড়িয়ে ধরে ভীড় থেকে বের করে আনলো। আমি ওকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম,
—-ভাগ্যিস তুই সাথে ছিলি।
—–অবশেষে বোবার মুখে কথা ফুটলো।
আমি হৃদ্যের দৃষ্টিতে দেখেছি আমার জন্য মুগ্ধতা। তাই বেশী কথা বলে মুগ্ধতাকে বাড়াতে চাইলাম না। তারপর একসময় হৃদ্যে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
——তুই যদি রাজি থাকিস তোকে এই মুহুর্তে আমি বিয়ে করতে পারি। সাক্ষী হিসাবে থাকবে মেহেদী। দারুণ হবে বল।
—–হৃদ্যে দুদিন পর তোর বিয়ে। এসময় এ ধরণের মজা করা উচিত না। আর আমার ছেলেও আমার সাথে আছে। আমি চাইনা আমার কোনো আচরণ ওর শিশুমনে নেগেটিভ প্রভাব পরুক। সেটা পরবর্তীতে ওর মানসিক বিকাশে সমস্যা হয়। কারণ এই মুহুর্তে আমার কাছে আমার ছেলের প্রায়োরটি সবচেয়ে বেশি।
—–আজও মাস্টারনির মতো কথা বললি। এই হয়তো আমার বিয়ের আগে তোর সাথে শেষ দেখা। এরপরে যখন দেখা হবে তখনতো আমি অন্য কারো ঘর। অন্য নারীর বর। চাইলেও আবেগের ঢেউয়ে ভাসতে পারবো না। তাই আজ একটু আবেগপ্রবন হয়ে পড়ছিলাম।
তারপর ওর সাথে আমি আর মেহেদী ইলিশ মাছ আর পান্তাভাত দিয়ে লাঞ্চ করে বাসার পথে রওয়ানা হলাম। হৃদ্যে আমার কথায় একটু আহত হয়েছে। এরপরে আমাদের দুজনের আর বেশি কথা হয়নি। হৃদ্যে এ ধরণের কথা বললে আমিও যে ওর প্রতি দুর্বল হয়ে যাই। তাইতো কচ্ছপের মতো শক্ত আবরণে নিজেকে মুড়িয়ে রাখি।
পরদিন বগুড়ায় চলে আসি। না হৃদ্যের বিয়েতে আমার যাওয়া হয়নি। আমি ইচ্ছে করেই যাইনি। পাছে আমার দুর্বলতা ওর কাছে ধরা পড়ে যায়। আমি জানি হৃদ্যে অভিমান করেছে। এও জানি সময়ের গতিপথে হয়ত এই গাঢ় অভিমান হালকা হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে প্লাবনের বিয়ে হয়ে গেল। প্রথম প্রথম মিথিলা আমাকে স্বাভাবিকভাবে নিলেও একসময় ও আমাকে এড়িয়ে চলতে থাকে। আমিও আর আগ বাড়িয়ে মিশতে যাই না। এছাড়া ওদের বিয়ের সময় কোনো এক আত্মীয় বলেছিলো
—–মিথিলার ডিভোর্সি ননদটা ওকে সুখী হতে দিবে না। ও যেহেতু নিজে সুখী হয়নি তাই মিথিলার সুখ ওর সহ্য হবে না।
কথাগুলো শুনে খারাপ লেগেছিলো। তাই প্রথম থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলি। এর মাঝ আমার আব্বুও মারা যায়। বাবা মারা যাওয়ার সাথে সাথে মনে হয় বাবার বাড়ির সাথে মেয়েদের বাঁধন আলগা হয়ে যায়। তাই আমি ও খুব একটা ওদিকটায় পা মাড়াই না। এর মাঝে প্লাবন মিরপুর এক নাম্বারে বারোশত স্কয়ার ফিটের একটা ফ্লাট কিনে মাকে নিয়ে ও বাড়িতে উঠে যায়। শোভন ডাক্তারী পাশ করে আর্মিতে ক্যাপ্টেন হিসাবে জয়েন করে। ওর বউও ক্যাপ্টেন হিসাবে জয়েন করে। এর মাঝে আমার শ্বশুরও মারা যায়। মারা যাওয়ার আগে কিছু সম্পত্তি মেহেদীর নামে উইল করে। ও নাবালক বিধায় আঠারো বছর হওয়ার আগ পর্যন্ত কোর্ট পাওয়ার অফ এটর্নী আমাকে দেয়। কিন্তু সম্পত্তির দাবীদার হয়ে আমার ও বাড়িতে যাওয়া হয়নি। আসলে আমার শাশুড়ীও আমাকে ডাকেননি। তাই কালক্রমে ও বাড়ির সাথে আমার সম্পর্ক শিথিল হয়ে পড়ে।
ব্যস্ততম জীবনের গতিময়তায় আমার জীবনের সময়গুলো খুব দ্রুত পার হয়ে গেল। নিজেও কখন যে বয়স পেরিয়ে প্রৌঢ়ে পা রাখতে চলেছি আমি নিজেই জানি না। মেহেদীর একটা সুন্দর ভবিষ্যত করার লক্ষ্যে আমার নিজের দিকে তাকানোর ফুরসত হয়নি। মেঘে মেঘে অনেকটা বেলা পার হয়ে গেল। সময়ের পরিক্রমায় মেহেদীর জীবনের অনেক সময় পার হয়েছে। ও এখন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারী পড়ছে। সবে ফাস্ট ইয়ার। এখনও অনেক পথ বাকী।
চলবে