#ধারাবাহিক গল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-উনিশ
মাহবুবা বিথী
হৃদ্যের নামটা স্ক্রীণে ভেসে উঠলো। প্রায় ছ,মাস পর ও আমাকে ফোন দিলো।
—–হ্যালো রুহী কেমন আছো?
——এতোদিন পর বন্ধুর কথা তোমার মনে পড়লো?
—–আমি তো সারাজীবন তোমার কাছে থাকতে চেয়েছিলাম। সেই সুযোগটাতো তুমি আমায় দিলে না।
—–কাছে থাকতে গেলেই যে বিয়ে করে থাকতে হবে তা কেন? বন্ধু হয়ে সবচেয়ে বেশী পাশে থাকা যায়। হৃদ্যে,প্রেম ও একসময় ফিকে হয়। মা, বাবা ভাইবোনের সাথে স্বার্থের কারনে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃত বন্ধুত্বের বন্ধন আজীবন থেকে যায়। এতো চুপচাপ, কথা বলছো না কেন?
—–আমি কথা বললে তোমার কথা তো শুনতে পারবো না। বলতে পারো আমি অভিমান করেই এতদিন ফোন দেইনি। তুমিও তো ফোন দিয়ে আমার খবর নিলে না। আমি এতোদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম। হয়ত তোমার মত বদলাবে। কিন্তু তুমি আমায় কিছুই জানালে না।
—–আমি কিন্তু তোমাকে আশা দিয়ে রাখিনি।
—–জানি,তারপরও আশা করতে তো দোষ নাই।
—–আমি তোমাকে হারাতে চাই না বলেই বন্ধুত্বের বন্ধনে বেঁধেছি। এ বাঁধন চিরজীবন অটুট থাকে।
—–থাক ওসব কথা। যে কারণে তোমাকে ফোন দিয়েছি। বাবা মা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। এই শুক্রবারের পরের শুক্রবার আমার বিয়ে। কোনো বাহানা শুনবো না। ছুটি নিয়ে দু,দিন আগেই চলে এসো।
—–দারুণ খবর। তো পাত্রীটা কে?
——আমার বসের বোন।
——মানে ডিসিসাহেবের বোনের সাথে তোমার বিয়ে হচ্ছে। তা হবে নাই বা কেন? আমার বন্ধুটিও কোন অংশে কম। দেখতে সুদর্শন। তুখোর ছাত্র। চোস্ত ম্যাজিস্টেট। যাক ভালোই হলো। সমানে সমান। তুমি কিন্তু ভুলেও বউয়ের কাছে বলো না আমাকে যে পছন্দ করেছিলে। এ্যাই আমি ভাবছি তোকে এখন থেকে তুই বলবো। আরোও বেশী আপন আপন লাগবে।
——-আমার মনটা ভালো নেই। তোর যা খুশি ডাকতে পারিস।
——কনে কি পড়ছে?
——এমবিবিএস ফাইনাল ইয়ার।
——একদম রাজযোটক। ভীষণ ভালো লাগলো। তা মন খারাপ কেন?
—–তুই আসলে আমার অবস্থাটা বুঝতে পারবি না। আসলে তুই তো কোনদিন কাউকে ভালবাসিসনি তো তাই ভালবাসার মানুষকে না পেলে বুকের গহীনে কি যন্ত্রণা হয় অনুভব করতে পারবি না। প্রতিনিয়ত বিবশ কষ্টগুলো হৃদয়ের উঠোনটায় তড়পাতে থাকে।
জানিস আমি একসময় ডিপ্রেশেনে চলে গিয়েছিলাম।
—–আমাকে তো জানাসনি। তবে আমি ডিপ্রেশনকে গুরুত্ব দেই না। ওকে যত গুরুত্ব দিবি ও ততই তোকে আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলবে। ওকে জীবন থেকে সরিয়ে রাখতে হয়। তোকে তো আমার জীবনের সব কথাই বলেছি। আমার অবস্থায় যে কেউ পড়লে ডিপ্রেশন ওকে গ্রাস করতো। আল্লাহর রহমতে আমি সামলাতে পেরেছি।
—–সবাই যে তোর মতো হবে তা কেন ভাবছিস? যাক আমি তোর মতো না হলেও সামলানোর চেষ্টাতো করে যাচ্ছি।
আবীর রঙে গোধুলী নেমে এসেছে। আলো আঁধারিতে পৃথিবী আস্তে আস্তে ঢেকে যাচ্ছে। মাগরিবের আযান শোনা যায়। মেহেদীর ঘুম ভেঙ্গে গেছে।
—–হৃদ্যে আমি নামাজ পড়বো। দোয়া করি তোর বিবাহিত জীবন সুখের হোক। বন্ধুর বিয়ে বলে কথা। ইনশাআল্লাহ অবশ্যই আসবো। রাখলাম।
হৃদ্যের বিয়ের কথা শুনে আমার কেন যেন খুব কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। হৃদ্যের জন্য কষ্ট অনুভব হচ্ছে। আচ্ছা ওর প্রস্তাবে রাজি না হয়ে আমিকি ভুল করলাম। নাকি আমি নিজের অজান্তে ওকে ভালবেসে ফেলেছি। এসব আমি কি ভাবছে। দূর এসব ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়া একদম উচিত না। আমার সব ভাবনা তো শুধু মেহেদীকে নিয়ে। ওকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবো। নিজের অপ্রাপ্তি গুলো ওকে দিয়ে পূরণ করবো। মাগরিবের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। নামাজ টা পড়ে নেই। মেহেদীকে নামাজ পড়তে বলে ওয়াশরুমে ওজু করতে গেলাম।
আমরা মা ছেলে দুজনেই নামাজ পড়ে নিলাম। আমি কিচেনে গিয়ে চিজ দিয়ে পাস্তা বানিয়ে মেহেদীকে খেতে দিলাম।
—–আম্মু তুমি খাবে না?
——না,বাবা আমি বিকেলে চা বিস্কিট খেয়েছি। তুমি খেয়ে স্কুলের হোমওয়ার্ক করে ফেলো।
——আম্মু তুমি আমার ক্লাসের ফাহিমকে তো চেনো। ও আজকে আমাকে কি বলেছে জানো?
——কি বলেছে?
——ওর আম্মু আমার পাশে ওকে বসতে নিষেধ করেছে।
——কারণটা জানতে চাওনি।
——-হুম। ওর মা বলেছে আমি নাকি ব্রোকেন পরিবারের সন্তান। আম্মু ব্রোকেন পরিবার কি?
—–ওসব তুমি বড় হলে বুঝবে। এখন খাওয়া শেষ করে পড়তে বসো।
——কিন্তু আমি তো জানি।
—–কি জানো?
—–যাদের বাবা মা একসাথে থাকেনা তাদেরকে ব্রোকেন ফ্যামেলি বলে।
—–তোমাকে এতকিছু কে বলেছে।
——ফাহিম বলেছে।
——তুমি এখন ছোটো মানুষ। পুরো পৃথিবী জানা বাকি আছে। সব কিছু বাদ দিয়ে ব্রোকেন পরিবার নিয়ে জানতে হবে না। শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। তুমি যখন মানুষের মতো মানুষ হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে তখন তোমার অতীত নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। সূর্যের মতো দীপ্যমান হতে শেখো তখন দেখবে তোমার আলোয় ওরা আলোকিত হতে চাইবে।
——আম্মু তুমি আমি আর বাবা তো কোনদিন একসাথে থাকতো পারবো না তাইনা?
—–তোমার কি বাবার সাথে থাকতে ইচ্ছা করে?
——আগে করতো তবে এখন বাবাকে ভালো লাগে না।
—–কেন?
——নানুমনির কাছে শুনেছি বাবা তোমাকে খুব কষ্ট দিতো।
——থাক ওসব কথা। সবার আগে মনে রাখবে তোমাকে পড়াশোনা করে অনেক বড় মানুষ হতে হবে।
আমি মেহেদীকে পড়তে বসিয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে বসলাম। আর মনে মনে ভাবলাম আমার ছেলেটাকে সারাজীবন ব্রোকেন ফ্যামেলির সন্তান বলে এক দুঃখবোধ বয়ে বেড়াতে হবে। অথচ ওর তো এখানে কোন দোষ নেই। পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ জন্মায় বাবা মায়ের কাছে সমান ভালোবাসা পাবার অধিকার নিয়ে। অথচ কিছু কিছু মানুষের নিষ্ঠুর নিয়তি তাদের ভাগ্যে এটা জোটে না। আমি জানি আমার মেহেদীর বুকেও এক গোপন কষ্ট আজীবন লুকিয়ে থাকবে। তারপর সেগুলো এক বিশাল কষ্টের শিলাখন্ডে পরিনিত হবে। ফোনটা বেজে উঠলো। মিথিলা ফোন দিয়েছে।
—–হ্যালো আপু, আমি মিথিলা
—–হ্যা,কেমন আছো?
—–ভালো। প্লাবন বললো, তুমি নাকি পরশুদিন আসছো না?
——না, মানে কলেজের একটু ব্যস্ততা আছে।
——আমি ওসব কিছু শুনছি না। তুমি না আসলে বিয়ের কথা ফাইনাল করতে আব্বুকে ও বাড়িতে যেতে দিবো না। আর তুমি তো জানো আমার বাবা আমার উপর কতটা দুর্বল। এই আমি বলে রাখলাম। এবার তুমি চিন্তা করো আসবে কি আসবে না।
ফোনটা রাখার সাথে সাথে ডোরবেলটা আবার বেজে উঠলো। মোবাইলে তাকিয়ে দেখি দশটা বাজে। এখন আবার কে আসলো?
চলবে