#ধারাবাহিকগল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-আঠারো
মাহবুবা বিথী
আজ খবরের কাগজে সোহেলের কেসের মামলার রায় বেড়িয়েছে। ওদের চারজনের ফাঁসি হয়েছে। এখবরটা পেয়ে আমার কোথায় যেন একটা ভালো লাগা কাজ করছে। আসলে পাপ কাউকে ছাড়ে না। দুনিয়াতে বেঁচে থেকে এর শাস্তি ভোগ করতে হয়। আবার যারা নিজেকে শুধরে নিয়ে পাপের পথ থেকে ফিরে আসে তাদের সামনে সুন্দর ভবিষ্যত অপেক্ষা করে। সোহেল নাকি পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে আছে। ওকে দেশের আনার চেষ্টা চলছে। আমার ফোনটা আবার বেজে উঠল। নিউজটা দেখে আমার শ্বশুরকে কয়েকবার ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু উনি ধরেননি। এখন দেখি উনি ফোন দিয়েছেন।
——কেমন আছেন বাবা?
——বুঝতেই তো পারছো আমার কেমন থাকার কথা। আসলে সকাল থেকে সাংবাদিকদের ফোনের নানা কথার উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত। তাই তুমি যখন ফোন দিয়েছিলে ভেবেছিলাম সাংবাদিক ফোন দিয়েছে। তাই ফোনটা ধরিনি। পরে ফোনটা চেক করতে গিয়ে দেখি তুমি ফোন দিয়েছো। দাদুভাই কেমন আছে?
——ভালো। আমি মানে বলতে চাইছিলাম——
আমার কথা শেষ করার আগেই শ্বশুর বললেন
—–আমি সোহেলের বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাইছি না। এটাই তো হওয়ার কথা ছিলো। আমি মানসিকভাবে একদম শক্ত আছি। তবে একটা কথা শুনে রাখো সন্তানের ছোটো খাটো অন্যায়ও কখনও আড়াল করতে হয় না। অন্যায়কে সয়ে নিলে পরবর্তীতে ও দানবে পরিনত হয়। আমি রাখলাম।
—–ঠিক আছে বাবা।
আমি বুঝতে পারছি এই মুহুর্তে উনি কথা বলার মুডে নেই। আসলে জীবন সংসারের রঙ্গমঞ্চে মানুষ পুতুলের মতো নাচে। কেউ নিজে নাচে কেউবা অন্যকে নাচায়। অহঙ্কারের ফাঁদে পরে বেশিরভাগ মানুষ অন্যকে নাচাতে পছন্দ করে। অথচ সে একবারও ভাবে না একদিন তাকেও অন্যজন নাচাতে পারে।
সময়ের আঘাতে একসময় মানুষ ক্ষত বিক্ষত হয়। অথচ এই সময়টাই আবার আঘাতের মলম হয়ে দাঁড়ায়। শুধু সময়ের অপেক্ষা করতে হয়।
জীবনে যা কিছুই ঘটুক না কেন সেটা ভালো হতে পারে আবার মন্দ হতে পারে। কিন্তু জীবন সেখান থেকে কিছু না কিছু চাইলেই শিখে নিতে পারে। আমিও আমার অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছি। সবার আগে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করে নিতে হবে।
অতীতকে কখনও ভোলা যায় না। আমরা শুধুমাত্র ভুলে থাকার অভিনয় করি। আমি আসলে আজও সোহেলকে ক্ষমা করতে পারিনি। কারণ সেদিন ও ছিলো আমার স্বামীর ভাই। যদিও আজ আমার স্বামী প্রাক্তন। কিন্তু সেদিন ও আমার দেবর হয়ে কিভাবে আমার সাথে এই কাজটা করলো আজও ভাবলে আমার গা শিউড়ে উঠে। ভুলটা ভুলের পর্যায়ে থাকলে তাকে ক্ষমা করা যায়। কিন্তু ওটা ভুল ছিলো না। ওটা ছিলো অন্যায়। যাকে এক কথায় বলে গর্হিত অপরাধ। সুতরাং ক্ষমা করার প্রশ্নই আসে না।
ঘন্টা পড়লো। আমাকে ক্লাসে যেতে হবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ন,টা বাজে। এগারোটায় মেহেদীর ছুটি হবে। ভাবনার জগত থেকে ফিরে পরপর দুটো ক্লাস শেষ করে মেহেদীকে নিতে রিকশা করে ওর স্কুলের পথে রওয়ানা হলাম।
বাড়িতে ফিরে আমরা মা ছেলে লাঞ্চ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। মেহেদী ঘুমিয়ে পড়লে আব্বুর খেঁাজ নিতে ঢাকায় ফোন দিলাম।
——হ্যালো রুহী কেমন আছিস। আমিই তোকে ফোন দিতে চাইছিলাম। প্লাবনের চাকরি হয়েছে। ঘন্টাখানিক আগে ঐ অফিস থেকে মেইল পাঠিয়েছে।
——খুব ভালো খবর আম্মু। তা প্লাবন এই খবরটা আমাকে নিজে দিতে পারতো?
—–আসলে খবরটা পেয়ে ও মিথিলার সাথে দেখা করতে গেছে। কারণ চাকরি না হলে মিথিলার বাবা মা মিথিলাকে প্লাবনের সাথে বিয়ে দিবে না। এই নিয়ে ছেলেটা আমার খুব মানসিক চাপে ছিলো।
—–আচ্ছা এখন আব্বুর কথা বলো। শরীরটা এখন কেমন আছে?
—–আল্লাহর রহমতে ভালো আছে। এখন ঘুমুচ্ছে।
—–হুম আমি রাখছি।
আম্মুর কথা শুনে ফোনটা রেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। টিউশনি করে যে ভাইয়ের পড়ার খরচ যুগিয়েছি আজ সে সফলতার চাবিকাঠি হাতে পেয়ে প্রেমিকার সাথে দেখা করতে ছুটে গেছে। আমাকে একটা ফোন দিয়ে জানাতে পারেনি।ওর কতটুকু সময় নষ্ট হতো? খুব কষ্ট লাগলো। আসলে আমরাই সম্পর্ককে জটিল করে ফেলি। ও একটা ফোন দিয়ে আমায় জানালে ওর কিবা এমন ক্ষতি হতো।
যাইহোক জীবনে এই বিষয়গুলোকে নিজেকে ভাল রাখতে ইগনোর করতে হয়। আমিও সে পথেই হাঁটলাম। আসরের আযান শোনা যায়। ওজু করে নামাজটা পড়ে নিলাম। চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে বারান্দায় আমার ফুলের টবগুলোতে পানি দিলাম। চৈত্রের গরমে গাছের গোড়াগুলো শুকিয়ে খটখটে হয়ে আছে। বেলী আর কামিনি গাছটায় অনেক ফুল ধরেছে। বারান্দাটা বেডরুমের কাছে হওয়াতে রাতে বেশ সুবাস পাই।
চা বানিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় বসলাম। আমি ইদানিং অনলাইন একটা সাহিত্য পেইজে লেখালেখি করি। মানুষ ভালোই সাড়া দেয়। আজ একটা লেখা পোস্ট করবো। এমন সময় মেসেজে টুং করে শব্দ হলো। প্লাবন মেসেজ পাঠিয়েছে।
—–আপু আমি প্রথমেই তোমার কাছে সরি হয়ে নিলাম। আসলে আমি তোমাকে নিজেই ফোন করে জানাতে চেয়েছিলাম। প্লিজ তুমি কিছু মনে করো না। মিথিলার বাবা আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলো। তাই তাড়াতাড়ি ওদের বাসায় যেতে হলো।
—–ওকে। আমি কিছু মনে করিনি। আমাকে ফোন দেওয়ার চেয়ে তোর দেখা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। কি ব্যাপারে দেখা করতে বলেছিলেন?
——আমাদের বিয়ের বিষয়ে কথা বলতে।
—–তাহলে তো আমাকে ঢাকায় আসতে হয়।
——না তোমাকে এই মুহুর্তে আসতে হবে না। উনি আব্বু আম্মুর সাথে কথা বলতে চেয়েছেন। তা ছাড়া—-
—-তা ছাড়া কি?
——না,মানে তুমি সামনে থাকলে তোমার ভিভোর্স নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে পারে?
—–প্রশ্ন উঠবে কেন? মিথিলাতো আমার ডিভোর্সের বিষয়টা জানে।
——তা, জানে। কিন্তু আমি এতো ডিটেইলেও বলিনি। কারণ আমাদের ফ্যামেলীর রেপুটেশন খারাপ হতে পারে।
—–এখানে ফ্যামেলী রেপুটেশন খারাপ হওয়ার কি দেখলি? বনিবনা না হলে টক্সিক সম্পর্কে থাকার চেয়ে ডিভোর্স হওয়াই তো সবচেয়ে ভালো সলিউশন।
—–এটাতো তুমি আমি বুঝবো। হয়তো মিথিলাও বুঝবে। কিন্তু ওর বাবা,মাতো নাও বুঝতে পারে।
—–ঠিক আছে আমি রাখছি। মেহেদী মনে হয় উঠে পড়েছে।
মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। প্লাবনের কথা শুনে হাসবো মা কাঁদবো বুঝলাম না। মানে আজ ও নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। তাই হয়তো আমার কাছে ওর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। আচ্ছা আব্বু আম্মুও তো আমাকে বলতে পারতো। ওরাও আমাকে কিছু জানালো না। এমন সময় ডোরবেলটা বেজে উঠলো।
দরজা খুলে দেখি শোভন এসেছে।
—–কিরে ফোন না করে আসলি?
—–আমি জানি তুমি এই সময়ে বাসায় থাকো।
—–তা হঠাৎ কি মনে করে?
—–কালতো শুক্রবার। তুমি কিছু জানো না?
——না, আব্বু আম্মু আমাকে কিছু বলেনি।
——শনিবারে মনে হয় ভাইয়ার বিয়ের ব্যাপারে কথা ফাইনাল হবে। ভাইয়া আমাকে যেতে বলেছে। তুমিও চলো। আমি তো তিনটে টিকিট বুকিং দিয়েছি।
—–নাহ্, তুই যা। ডিভোর্সি মেয়ে সামনে থাকলে ছেলের বিয়েটা ভেঙ্গে যেতে পারে। হয়তো এই কারনে আব্বু আম্মু আমাকে বলেনি। তুই বোস। আমি তোর জন্য চা বানিয়ে আনছি।
—–এটা তো আব্বু আম্মুর অন্যায়। তোমাকে জানানো উচিত ছিলো। তুমি আমাদের বড় বোন।এছাড়া আমাদের সংসারে তোমার অবদানের কথা ভুললে তো চলবে না।
—–বাদ দে। সন্তান হিসাবে আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। এটা বলার মতো কিছু না।
—–আপু তাহলে তুমি যাবে না।
—–না।
আমার আসলে খুব কান্না পাচ্ছিলো। চা বানার ছলে আমি কিচেনে চলে আসলাম।কেমন যেন বিবশ কষ্টগুলো গলার কাছে তড়পাতে লাগলো। শোভন হয়তো বুঝতে পেরেছে। তাই এড়িয়ে যাবার ছলে কিচেনে এসে বললো,
—–আপু আমি বরং তাড়াতাড়ি চলে যাই। টিকিট বুকিং দিয়েছি। তুমি না গেলে তো ক্যান্সেল করাতে হবে।
মেহেদীকে আদর দিয়ে ও তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে চলে গেল।
ও চলে যাবার পর কেন যেন বুক ফেটে কান্না আসলো। আমার মনে হতে লাগলো আমি যেন এ সংসারের প্রয়োজনের প্রিয়জন। তাই আজ হয়তো আমারও প্রয়োজন ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমার ফোনটা আবারো বেজে উঠলো। ফোন বাজার শব্দে ভীষণ বিরক্ত লাগলো। কিন্তু স্ক্রীনে নামটা দেখে ফোনটা ধরতে বাধ্য হলাম।
চলবে