আকাঙ্খিতো প্রণয় পর্ব-১৭

0
852

#ধারাবাহিকগল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-সতেরো
মাহবুবা বিথী

—–কেমন আছো রুহী। তোমার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে। বহুবার চেষ্টা করেছি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলবো তোমায়। কিন্তু তুমি এমন একটা মাষ্টারনি ভাব নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াও কথাগুলো গলার মধ্যে কুন্ডলী পাঁকিয়ে থাকে। মুখ দিয়ে আর বের হয় না। রুহী আমি যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। এখন আমার কি হবে উপায়।
——গলায় কলসী বেঁধে বুড়িগঙ্গায় ডুইবা মরো।
——ঠাট্টা নয় রুহী। আমি সিরিয়াস।
—-আমিও সিরিয়াস। কারণ তুমি অবিবাহিত পুরুষ হয়ে একজন ডিভোর্সি মেয়েকে ভালবাসলে এ সমাজ মুখ দেখাতে পারবে না । তার থেকে তো ডুবে মরাই ভালো। তোমার ফ্যামেলিও মানবে না। এছাড়াও আমাকে ভালোবাসার পরিনতি সফলতার মুখ কখনই দেখবে না। বরং অশান্তি বাড়বে। আমি অনেক অশান্তির দহনে পুড়ে খাক হয়েছি। আর নতুন করে সেধে এ আগুনে আমি আর পুড়তে চাই না। তাই তুমি মাথা থেকে এই চিন্তা ঝেড়ে ফেলো।
——রুহী কোনো মানুষ যদি কাউকে ভালোবাসে এর পরিনতি কি হবে সেটা কখনও ভাবে না। আর এসব ভেবে কখনও ভালোবাসা হয় না। আমি প্রথম যেদিন তোমায় দেখেছি সেদিন থেকেই তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি। তুমি সেদিন একটা সাদা থ্রীপিছ পরে এসেছিলে। কার্লি চুলগুলো এলোমেলো ভাবে বাতাসে উড়ছিলো। মুখে কোনো প্রসাধন ছিলো না। বড় পাপড়িওয়ালা চোখ দুটিতে কাজলের রেখা টানা ছিলো। আমার কাছে মনে হয়েছিলো এ যেন স্বর্গের অপ্সরি। তুমি আমায় এভাবে ফিরিয়ে দিও না।

আমার এ বয়স পর্যন্ত এমন করে কেউ আমার রুপের প্রশংসা করেনি। আমি হৃদ্যের মেসেজটা যতবার পড়লাম ততবারই ইপ্সিত আবেগে আন্দোলিত হলাম। আমারও তো ইচ্ছে করে ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে হাঁটতে। হুড খোলা রিকশায় ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে। চাঁদনি পসর রাতে খোলা ছাদে দুজনে মুখোমুখি বসে মায়াবী জোৎস্না গায়ে মাখতে। কিন্তু আমার জীবনে এই আবেগের রাশ শক্ত করে টেনে ধরতে হবে। কোনোভাবেই একে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। তাই ওকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে আমার না,বোধক মেসেজটা পাঠিয়ে দিলাম।
——হৃদ্যে আমি এই মুহুর্তে আমার সন্তানকে ভালোবাসা ছাড়া এই পৃথিবীতে কারোজন্য ভালোবাসা অবশিষ্ট নাই। মাতৃত্বের ভালোবাসার কাছে পৃথিবীর সব ভালোবাসাই ম্লান হয়ে যায়। আমি এখন আমার সন্তানকে ভালোবাসার সুখে ভাসছি। ও যখন আধো আধো বোলে আমায় মা বলে ডাকে কিংবা ওর পুতুলের মতো হাত দুটো দিয়ে আমায় স্পর্শ করে তখন এক লহমায় আমার সব কষ্ট সব অপ্রাপ্তিগুলো দূর হয়ে যায়। আবার ওর লোল পড়া ঠোঁট দিয়ে আমায় যখন চুমুতে ভরিয়ে দেয় এযে কি সুখ তা তোমাকে ভাষায় বোঝাতে পারবো না। আমার মনে হয় ও যদি আমার জীবনে না আসতো তাহলে হয়ত জীবনের এতো বড় ধাক্কাটা সামলাতে পারতাম না। আমি লিভ নিচ্ছি। কারণ মেহেদীকে গোসল করিয়ে ভাত খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়াবো।

আমি আর হৃদ্যেকে কথা বাড়ানোর সুযোগ দিলাম না। আসলে ও দেখতে খুব স্মার্ট। জিম করা মেদহীন দেহে যে কোনো পোশাকে ওকে খুব হ্যান্ডসাম লাগে। তারউপর রেজাল্টও বেশ ভালো। ক্লাসের অনেক মেয়ের ও ক্রাশ। আমারও যে ভালো লাগে না তা নয়। কিন্তু কথায় আছে না চুন খেয়ে মুখ পুড়লে মানুষ দই দেখে চমকায়। আমার অবস্থটা অনেকটা সেরকম। যাইহোক ওর ভাবনায় আমার ডুবে যাওয়া উচিত হবে না। আমার সামনে এখন অনেক দায়িত্ব পড়ে আছে।

যাপিত জীবনের রোজনামচায় পাঁচবছর সময় গড়িয়ে যায়। আমি বিসিএস দিয়ে বগুড়া সরকারি কলেজে জয়েন করেছি। মেহেদীর বয়স এখন সাত বছর চলছে। ওকে আজকে এখানেই একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করেছি। ছেলেটা দেখতে মাশাআল্লাহ ওর বাবার মতই সুদর্শন হয়েছে। জন্মের পর মেহেদী আট থেকে দশদিন মাত্র ওর বাবার কাছে গিয়েছে। অনিয়মন্ত্রিত জীবন যাপনের জন্য রাসেল একবার স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলো। কিছুতেই সেন্স আসছিলো না। ডাক্তারের কথা মতে অনেক সময় নাকি সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষটার ডাকে মিরাক্কল ঘটতে পারে।তখন মেহেদীকে ওর দাদুর কথা মতো রাসেলের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। সে সময় দেখা হয়েছিলো।
আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার দু,দিন চেষ্টা করেও যখন রাসেলের রেসপন্স পাচ্ছিলো না। অথচ মেহেদী যেই ওর বাবার হাতে হাত রেখে বাবা বলে ডেকেছিলো হাতের আঙ্গুলগুলো একটু একটু নড়ে উঠলো। চোখের পাপড়িগুলো নড়ে উঠলো। আমি সিনেমা নাটকে এগুলো দেখেছি। কিন্তু বাস্তবে আমার চোখের সামনে এই ঘটনা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। তখন মেহেদীর বয়স পাঁচ বছর। আর মেহেদীও বাবার আদর পাওয়ার জন্য মনে হয় একটু আকুল ছিলো। ওকেও দেখতাম রাসেলের সঙ্গটা উপভোগ করতে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস স্ট্রোকের কারনে রাসেল সেদিন ওর বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো। যে সন্তানকে ও আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে স্বীকৃতি দিতে চায়নি অথচ জন্মের পর যখন প্রথম পিতাপুত্রের সাক্ষাত হলো রাসেল নিজের আবেগ ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারলো না। ফ্যাল ফ্যাল করে মেহেদীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। চোখের কোল বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তো। অথচ জীবনটাতো এমন হওয়ার কথা ছিলো না। জেদ অহঙ্কার মানুষের জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে। ও কি দাম্ভিকতায় বলেছিলো আমায় ওর জীবনে আমার স্থান নাকি জুতোর তলায়। মানুষ অনেক সময় নিজের অজান্তে এমন কিছু ভুল করে যার মাশুল সারাজীবন ধরে গুনতে হয়। সেদিন রাসেলের অসুস্থতার সময় কয়েকদিন মেহেদী ওর সাথে সময় কাঠিয়েছে।

জন্মের পর থেকে ওর দাদুভাইয়ের কাছ থেকে আদর ভালোবাসা পাচ্ছে। আমার শ্বশুর আমাকে প্রায় বলেন, জানো রুহী, “আসলের থেকে না সুদের মায়া বেশী। তাইতো দাদুভাইকে এতো মায়া লাগে”।
এবার বগুড়া আসার আগে ওর দাদুর বাড়িতে গিয়ে ওর বাবার সাথে দেখা করে এসেছে। কেন যেন মেহেদী ইদানিং ওর বাবার কাছে যেতে চায় না। তারপরও আমার শ্বশুর চান মেহেদী যেহেতু বড় হচ্ছে ও যেন ওর দাদুর বাড়িতে আসা যাওয়া করে। আসলে মাসাবা প্লাব দিয়ে লন্ডনে চলে গেছে। ওখানে চাকরির পাশাপাশি মেডিসিনের উপর পড়াশোনা করছে। সাবা সারাদিন স্কুল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ও এখন ঐ স্কুলের প্রিন্সিপাল। সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত স্কুলে থাকতে হয়। রাসেল সারাদিন ওর রুমে বসে থাকে। কারণ স্ট্রোকের কারনে শরীরের বাঁ পাশটাও অবস হয়ে ছিলো। সে কারনে চাকরিও করতে পারলো না। ফিজিও থেরাপি স্পিচ থেরাপি দেওয়ার পর আগের থেকে কিছুটা ভালো। তবে পুরোপুরি সেরে উঠতে আরো বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। ওদের বাড়িটা যেন শশানের নির্জনতায় ঢাকা পড়ে থাকে। এতোবড় বাড়ি। অথচ কোনো জনমানব নেই। তাই মেহেদী যেদিন যায় ও বাড়িতে তখন ইদের আনন্দ নেমে আসে। আমি ও তাই বয়স্ক মানুষটার দাবি অস্বীকার করতে পারিনি। এই কারনে মাঝে মাঝে মেহেদীকে জোর করে পাঠাই।
ওর দাদী ওকে আদর করে কিন্তু তারপরও কোথায় যেন একটু ফাঁক থেকে যায়। উনি এখন হাঁটাচলা করতে পারেন।

বগুড়ায় আমি থাকি কিন্তু মনটা ঢাকায় পড়ে থাকে। আব্বুর শরীরটা বেশী ভালো থাকে না। আম্মুও ইদানিং আরো খিটখিটে হয়ে গেছে। যাক প্লাবনটা ঢাকা ভার্সিটি থেকে সিএসসি তে গ্রাজুয়েশন ফাইনাল দিলো। শোভন বগুড়া মেডিকেল কলেজে ডাক্তারী পড়ছে। আল্লাহর রহমতে আমার বাবা মায়ের সুখের দিন খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।

সেদিন মেহেদীকে স্কুলে বসিয়ে দিয়ে আমি কলেজে গিয়ে টিচার্স রুমে বসে এসির হাওয়ায় ঠান্ডা হচ্ছিলাম। চৈত্রের দহন বেলা বলে কথা। মাথার তালু পর্যন্ত ফেটে যায়। আজকের পত্রিকা নিয়ে চোখ বুলাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা জায়গায় চোখের দৃষ্টি আটকে গেল। ফোন করলাম। কেউ রেসপন্স করলো না। আরো কয়েকবার ফোন দিলাম।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে