#ধারাবাহিকগল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-তেরো
মাহবুবা বিথী
——বাঃ ভালোই তো দিনকাল কাটছে তোমার। আমার ভাইটাকে ছিবড়ে বানিয়ে এখন দেখি এক জোয়ান নাগর জুটিয়েছো। শুধু শুধু আমার কাছে সতীপনা দেখালে। তোমাদের মতো মেয়েদের আমার খুব ভালো চেনা আছে।
সোহেল ওর দলবল নিয়ে চারুকলায় এসেছে। নিশ্চয় কোনো শয়তানী বুদ্ধি মাথায় নিয়ে চারুকলায় পা রেখেছে। তা,না হলে মেডিকেলের মতো এতো পড়ার চাপ রেখে এখানে উদয় হয়েছে কেন? আমি ওর সাথে কথা না বাড়িয়ে হৃদ্যেকে বললাম,
——আমাদের মনে হয় এখন যাওয়া উচিত। তা,না হলে এর পরের ক্লাসটা আমরা ধরতে পারবো না।
হৃদ্যে কিছু বলার আগেই শয়তানটা আবার বললো,
——এক মিনিট, আমার কথার উত্তর না দিয়ে এখান থেকে যাওয়া যাবে না। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে নোংরামো করা হচ্ছে। আর আমার বাবার সামনে ভালোমানুষের মুখোশ পড়ে থাকো। তোমার ভালোমানুষি মুখোশটা আমি খুব তাড়াতাড়ি টেনে ছিড়ে ফেলবো।
এমনসময় আমাদের ডিপার্টমেন্টের কিছু সিনিয়র ভাইয়ারা এসে সোহেলদেরকে বললো,
——আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে আপনারা ক্যাম্পাসে নয়া আমদানি। আবার আমাদের ডিপার্টমেন্টের মেয়ের সাথে ফাজলামী। শোনেন ভালোই ভালোই কেটে পড়েন। নইলে কিন্তু খবর আছে।
আমি এতোক্ষণ প্রচন্ড টেনশনে ছিলাম। সিনিয়র ভাইয়ারা চলে আসাতে সোহেল অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি কেটে পড়লো। আমার মনে হলো ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়লো। আমি উনাদের ধন্যবাদ জানিয়ে হৃদ্যের সাথে ডিপার্টমেন্টের দিকে রওয়ানা হয়ে ওকে বললাম,
——ভাইয়ারা খবর পেলো কিভাবে? ঠিক সময়ে এসে পড়েছিলো। নইলে যে কি হতো?
—–তোমার সাথে শয়তানটা যখন বাকবিতন্ডা করছিলো তখন আমি সাহায্য করার জন্য মোবাইলে ভাইয়াদের ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলাম। আমার ম্যাসেজ পেয়ে ভাইয়া এসেছে।
—– তোমাকে ধন্যবাদ হৃদ্যে। চটজলদি বেশ বুদ্ধি খাটিয়ে কাজটা করলে বলে সব কূল রক্ষা হলো।
—— বন্ধু হয়ে বন্ধুর জন্য এই টুকু তো করতেই পারি।আচ্ছা ঐ ছেলেটাকি তোমার হাসবেন্ডের ভাই?
——-হুম।
——তাহলে তো বড় ভাইয়ের বউ হিসাবে তোমাকে অনেক সম্মান করা উচিত ছিলো। কিন্তু কি নোংরা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বললো।
——বাদ দাও। এই পৃথিবীতে যারা নোংরা মেন্টালিটির মানুষ তাদের কাছে ভালো কিছু আশা করা যায় না।
ক্লাস শেষ করার পর হঠাৎ বৃষ্টি নামলো। যদিও মাঘের শেষ। কিন্তু বৃষ্টি হওয়াতে ভালো লাগছে। এই সময় চারিদিকে বেশ ধুলো থাকে। এখন ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ নাকে লাগছে। ধুলোগুলো এখন বৃষ্টির পানিতে ভেসে যাবে। আমি সঙ্গে ছাতা আনিনি। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছি। প্রকৃতি যেন বৃষ্টির পরশে মেতে উঠেছে। সজীবতার পরশ প্রকৃতিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ভার্সিটির বাসটা এইমাত্র ছেড়ে গেল। আর একটু অপেক্ষা করলে কি হতো? বৃষ্টি না হলে দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠতে পারতাম। আজ বাসায় ফিরতে অনেক দেরী হবে।ছেলেটা আমার কি করছে কে জানে। বৃষ্টি হওয়াতে একদিকে ভালো লাগছে কিন্তু অন্যদিকে রাস্তায় অনেক জ্যাম হয়। কতক্ষণে যে বাসায় পৌঁছাবো তার কোনো ঠিক নাই। পিছনদিক থেকে হৃদ্যে এসে বললো,
——-ছাতা আনা হয়নি নিশ্চয়?
আমি এতটাই আনমনা ছিলাম যে হৃদ্যের কথায় চমকে উঠলাম।
——কি ব্যাপার চমকে উঠলে মনে হয়?
——আসলে মন থেকে ভয়টা এখনও দূর হয়নি।তুমিও বাস মিস করেছো?
—–বন্ধুকে বৃষ্টি বাদলে একা ফেলে বন্ধু কি যেতে পারে? চল সামনে টং দোকানটায় একটু চা খেয়ে নেই। এই ঠান্ডা আবহাওয়ায় ভালো লাগবে।
আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনটা বাজে। অনিচ্ছা সত্বেও ওর সাথে চা খেতে টং দোকানটায় বসলাম। বৃষ্টিটা একটু কমে আসলে একটা রিকশা নিয়ে নিবো।
চা খাওয়া শেষ করার পর বৃষ্টি একটু কমে আসলো।হৃদ্যের সাথে রিকশা করে বাসার পথে রওয়ানা হলাম। আসলে সোহেল আমার সাথে ওরকম আচরণ করাতে এখনও আমার বুকটা ঢিপঢিপ করছে। আবার যদি শয়তানটা দলবল নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। আজকাল রাস্তা ঘাটে কারোও বিপদে কেউ এগিয়ে আসে না। সবাই দাঁড়িয়ে মজা দেখে। তাই ভাবলাম হৃদ্যের সাথে গেলে মন্দ হয় না।
এলিফ্যান্ট রোডের সামনে একটা প্রাডো গাড়ি আমার রিকশার পাশে ব্রেক কষে দাঁড়ালো। আচমকা এভাবে ব্রেক কষাতে আমাদের রিকশাটাও থেমে গেল। গাড়ির দরজা খুলে আগুন্তক বের হয়ে এসে বললো,
—–রুহী বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লেগে যাবে। গাড়িতে আসো।
তাকিয়ে দেখি আমার শ্বশুর মশাই দাড়িয়ে আছেন।
——বাবা আমি এখানেই ঠিক আছি।
——আরে আসো তো। গাড়িতে উঠো।
অগত্যা হৃদ্যেকে বিদায় জানিয়ে শ্বশুরের গাড়িতে গিয়ে উঠলাম।
——ছেলেটা কে?
——আমার সাথেই পড়ে। ওর নাম হৃদ্যে।
মনে মনে ভাবছি বাবাকে সোহেলের বিষয়টা জানানো উচিত।
——বাবা,আজ সোহেল ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে।
—–কোথায়?
——-চারুকলায়। ওখানে একটা আর্ট এক্সিবিশন হচ্ছিলো। আমি দেখতে গিয়েছিলাম। হৃদ্যে আমার সঙ্গে ছিলো। উনি আমাকে দেখে হৃদ্যের সামনে খুব নোংরা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বললেন। ওর বন্ধুদের নিয়ে এসেছিলো। আমাকে আর হৃদ্যেকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছিলো। ভাগ্যিস হৃদ্যে বুদ্ধি খাটিয়ে সিনিয়র ভাইয়াদের ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলো। উনারা চলে আসাতে উনি কেটে পড়লেন।
—–কথায় আছে না সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস আর অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। ওর অবস্থা হয়েছে তাই। এদিকে একের পর এক সাপ্লি খাচ্ছে। আর আমাকে হাজার হাজার টাকা গচ্ছা দিতে হচ্ছে। ওর বন্ধু বান্ধবদের সার্কেলটা ভালো না। বড় লোকের বখে যাওয়া ছেলেমেয়েরা ওর বন্ধু। তার সাথে ওর মায়ের প্রশ্রয় তো আছে। সেটাতো তুমি জানো। আমি ওকে নিয়ে খুব টেনশনে থাকি। কখন যে কি ঘটনা ঘটাবে তার কোনো ঠিক নেই।
আমার শ্বশুর আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিলো। পার্সোনাল গাড়িতে আসাতে পাঁচটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে গেলাম। ভালোই হলো। বাসে বা রিকশায় আসলে সন্ধের পর বাসায় পৌঁছাতে হতো। আমি ইচ্ছে করেই শ্বশুর মশাইকে বাসায় আসতে বললাম না। কারণ আব্বু আম্মু উনাকে দেখলে বিরক্ত হয়। আব্বুর আম্মুর ধারণা আমার শ্বশুর চেষ্টা করলে হয়তো ডিভোর্সটা রোধ করা যেতো। আসলে আমার নিজেরই রাসেলের উপর থেকে মন উঠে গেছে। আমি উনাদের বোঝাতে পারি না নাকি উনারাই বুঝতে চান না যেখানে সম্মান থাকে না ভালবাসা থাকে না সেখানে কোনোদিন মায়া জন্মায় না। মায়াহীন সম্পর্কগুলো একদিন না একদিন ভেঙ্গে পড়বেই।
কারণ ভালবাসা না থাকলে মায়ার জন্ম হয় না। ভালবাসা থেকেই মায়ার সৃষ্টি হয়। আর এই মায়া সম্পর্ককে আগলে রাখে। সুতরাং রাসেলের সাথে আমার ভালবাসাই তৈরী হয়নি। আমার কাছে ভালবাসাহীন মিথ্যা মায়াকে কপটতার মতো মনে হয়। তাই আমি নিজেই চেয়েছি রাসেলের সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসতে। শুধু শুধু কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কিন্তু আমার বাবা মা আমার জীবনের চরম সত্যিটা আজও মেনে নিতে পারেন না।
এর মাঝে আমার ফাস্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। পরীক্ষা ভালোই হয়েছে। আশাকরি রেজাল্টও ভালো হবে। আজ আমার মেহেদীর এক বছর পূর্ণ হলো। প্লাবন আর শোভনের খুব ইচ্ছা আমি যেন জন্মদিনটা খুব ঘটা করে পালন করি। মেহেদী এখনও তেমন বোঝে না তাই জন্মদিন পালন না করলেও সমস্যা ছিলো না। কিন্তু শোভন আর প্লাবনের জন্য দুপুরে একটু হালকা আয়োজন করলাম। পোলাও গরুর ঝাল মাংস, ডিম ভাজি মাছভাজি করলাম। বেকারী থেকে জন্মদিনের কেক অর্ডার করলাম। আব্বু আম্মুও স্বতস্ফুর্তভাবে অংশ নেওয়াতে আমারও খুব ভালো লাগলো। সন্ধের পর কেকটা কাটা হলো। কেক কাটার সময় মেহেদী খুব মজা পেয়েছে। যদিও দু হাত দিয়ে কেকের ক্রীমটা ঘেটে দিয়েছিলো। অনেকদিনপর বাসায় এরকম একটা আয়োজন হলো। প্রতিবেশী দুএকজনকে বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখনি ওদের কটুকথাগুলো মনে পড়ে গেল তখনি মাথা থেকে ওদের দাওয়াত দেওয়ার চিন্তা বাদ দিলাম।
সেদিন রাত এগারোটার সময় মেহেদীকে কেবল ঘুম পাড়ালাম এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো। স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখি আমার শ্বশুর ফোন দিয়েছে। উনি মেহেদীর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে আমাকে যে খবরটা দিলেন আমি চমকে উঠলাম।
চলবে