#ধারাবাহিকগল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-নয়
মাহবুবা বিথী
——হ্যালো আমি রাসেলের আম্মু বলছি
——বেয়াইন কেমন আছেন?
——কে আপনার বেয়াইন?
——বেয়াইন আমি তো আপনার কথা বুঝতে পারছি না। আমার মেয়ের সাথে আপনার ছেলের বিয়ে হয়েছে। সেই হিসাবে আপনি আমার বেয়াইন।
——আপনার মেয়ে তো সেই সম্পর্ক ধরে রাখতে পারেনি। শোনেন সংসার, স্বামী ধরে রাখা জানতে হয়। আপনার মেয়ে এগুলো কিছু শিখেনি। শুধু মুখে মুখে তর্কটা ঠিক শিখে এসেছে। স্বেচ্ছায় এই সংসার থেকে ও বেড়িয়েও গেছে। তাই আসতে হলে ওকে নিজ ইচ্ছায় আসতে হবে। আমি বা আমার ছেলে গিয়ে সেধে আনতে পারবো না। আমি শুনলাম রুহী কনসিভ করেছে। ও যদি স্বেচ্ছায় এখন না আসে তাহলে বাচ্চা হওয়ার পর ভুলেও ঐ সন্তানের পিতৃত্বের দাবী নিয়ে এ বাড়ির দরজায় যেন ও না আসে। রাসেল এই সন্তানকে শিকার করে না। শীঘ্রই ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবে।
—–বিয়েটা কি আপনাদের কাছে ছেলে খেলা। যখন ইচ্ছে হলো আপনার ছেলে বিয়ে করে নিয়ে গেল আবার ইচ্ছে হলো বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলো এটা ফাজলামী না কি? দেশে আইন আদালত নাই। আমিও আপনার ছেলের নামে নারী নির্যাতনের মামলা করবো।
—–যা পারেন আপনারা করেন। আর আমার ছেলে ওকে তাড়িয়ে দেয়নি। ও স্বেচ্ছায় এ বাড়ির চৌকাঠ ডিঙ্গিয়েছে। ঝামেলা বাড়াতে না চাইলে ওকে স্বেচ্ছায় ফিরে আসতে বলেন। আমি রাখছি।
আমি পাশের রুম থেকে আম্মুর সাথে রাসেলের মায়ের কথপোকথন সবটাই শুনতে পেয়েছি। আজ ছুটির দিন বিধায় আব্বুও বাসায় আছে। হয়ত আব্বুও শুনছে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। ভীষণ কষ্ট লাগলো। মানুষ কতটা পাষন্ড আর কতটা নীচ হতে পারে এদের মা ছেলেকে না দেখলে আমার জানা হতো না। তাই আজকে আমি শপথ নিলাম কোনদিন আমার সন্তানের পিতৃত্বের দাবী নিয়ে রাসেলের কাছে যাবো না। মনে মনে আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করলাম,”হে আল্লাহ আমার সন্তানকে মানুষ করার তওফিক ও ক্ষমতা আমায় তুমি দান করো। ওর লেখাপড়া থেকে শুরু করে সব দায়িত্ব আমি যেন ভালভাবে পালন করতে পারি। কোনোদিন যেন আমায় কারো কাছে হাত পাততে না হয়”। সেদিন আমার চোখদুটো নোনাজলে ভরে গিয়েছিল। তবুও আমি কাঁদিনি। কার জন্য কাঁদবো। যে আমার মুল্যায়ন করিনি তার জন্য আমি কেন কাঁদবো? আমার জীবন থেকে ও সরে গিয়েছে তার মানে আল্লাহপাক এর থেকে বেটার কিছু আমায় দান করবেন। আমি সেদিনের অপেক্ষায় আছি। আর আমি এও জানি যে সন্তানকে রাসেল আজ অস্বীকার করলো ইনশাআল্লাহ একদিন এমন দিন আসবে এই সন্তানের জন্য ও তীর্থের কাকের মতো পথ চেয়ে বসে থাকবে।
আমি বিছানায় শুয়ে আছি। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। আমার পেটটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। পেটে হাত বুলানোর সাথে সাথে আমার বেবিটা যেন নড়ে উঠলো। ও মনে হয় সাড়া দিয়ে আমায় বুঝালো, মা ভয় পেও না। তোমার জীবনের এই সংগ্রামে আমি তোমার পাশে আছি।
আমি জানি আম্মু হয়ত আমার উপর বিরক্ত হয়ে আছে। হয়ত ভাবছে আমি একটু মানিয়ে নিয়ে সংসারটা করলেই তো পারতাম। কার জন্য মানিয়ে নিবো? যে আমার নয় তার জন্য? আচ্ছা শরীরি সম্পর্কে কি ভালবাসা হয়? আমার অভিজ্ঞতায় হয় না। ভালবাসা হতে গেলে মনকে ছুঁতে হয়। দুটো হৃদয়ের উঠোনে ভালবাসার বীজ বুনতে হয়। তখন দুটো দেহের আত্মা মিলে একাত্মায় পরিনিত হয়। সেরকম হলে আমি ঐ সংসারের সব বৈরী পরিবেশ মোকাবেলা করে ওখানেই টিকে থাকার চেষ্টা করতাম। কিন্তু যেখানে আমাকে মানুষ হিসাবে গন্য না করে ক্রীতদাস হিসাবে গন্য করা হয়েছে, যে গর্ব করে বলে দয়া করে আমাকে তার জুতোর তলায় ঠাঁই দিয়েছে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আমি একটুও ভুল করিনি। আমি আম্মুর পায়ের শব্দ শুনতে পারছি। চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
—–রুহী মা ঘুমিয়ে পড়েছিস?
আমি চোখ খুলে দেখলাম আব্বু আম্মু দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বিছানায় উঠে বসে আম্মুর কথার প্রতু্্যত্তরে বললাম
——কিছু বলবে?
——তোর শরীর ভালো তো?
—–হুম
আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
——তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন?বসো।
——নিজের হাতে তোর জীবনটা নষ্ট করলাম। মারে তুই আমাদের ক্ষমা করে দিস। আসলে আমাদের এতো তাড়াতাড়ি তোর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি। আমারতো আসলে কোনো উপায় ছিল না। গরীবের মেয়ে সুন্দর হইলেও জ্বালা আবার কালো হইলেও জ্বালা। আমার কাছে কয়েকটা উড়োচিঠি আসছিলো তোরে উঠাইয়া নিবে নয়ত এসিড মেরে তোর মুখটা ঝলসে দিবে। আমি তোদের জানাইনি। তাই ভাবলাম তোরে বিয়ে দেই। তাহলে ঐ শয়তানগুলোর হাত থেকে তুই রক্ষা পাবি আর আমিও টেনশন মুক্ত হইতে পারবো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোরে আমি চোরাবালিতে ফেলে দিয়েছি।
——আমি বলি কি রুহী সংসার ভেঙ্গে ফেললে ফেলাই যায়। তবে আর একবার একটু চেষ্টা করে দেখলে হতো না। রাসেলের মা তো বললো তুই নিজে থেকে ও বাড়িতে ফিরে গেলে ওরা কোনো ঝামেলা করবে না। অন্তত বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে তুই এবারটা মানিয়ে নে।
——না,মা আমার পক্ষে ও বাড়িতে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয়। তোমরা তো ওদের সাথে থাকোনি। আমি থেকেছি। সুতরাং আমি জানি ওরা কি জিনিস? আমাকে তোমরা আর ও বাড়িতে যেতে বলো না। তোমরা আমাকে নিয়ে আর টেনশন ও করো না। আমার টেনশন আমার উপরে ছেড়ে দাও।
——তোর বাবার চাকরি আর দু,বছর আছে। তারপর কি হবে ভেবে দেখেছিস?
——শোনো মা কারো জন্য কেউ আটকে থাকে না। তবে কি জানো মা, মানুষের দুঃসময়টাকে সময়ের উপর ছেড়ে দিতে হয়। আর আল্লাহপাকের উপর ভরসা করতে হয়। সময় বলে দেয় তাকে কি করতে হবে?
——-ওরা তো বলেছে তুই ফিরে না গেলে তোর সন্তানের পিতৃপরিচয় রাসেল দিবে না।
—–মা এটা আমাকে ওরা হুমকি দিয়েছে। যাতে আমি ও বাড়িতে ফিরে যাই।
আব্বু আম্মুর কথায় বিরক্ত হয়ে বললো,
—–রুহী যখন ও বাড়িতে ফিরে যেতে চাইছে না তাহলে তুমি ওকে কেন জোর করছো? আমাদের এখন মানসিক সাপোর্ট দিয়ে রুহীর পাশে থাকা উচিত।
আম্মু আর জোর করেনি। তারপর আমার জীবনে যা ঘটার তাই ঘটলো। রাসেল ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিলো। আমি অবশ্য তখন ভেঙ্গে পড়িনি। আমি তো এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম। তাই খুব সহজে সামলে নিতে পেরেছি।
আমার ক্লাস জানুয়ারী থেকে শুরু হয়েছিলো। আমি সে সময় ক্লাসে যেতে পারিনি। আমার তখন এ্যাডভান্সড স্টেজ। তবে বেবি হয়ে যাবার পর মার্চ থেকে আমি নিয়মিত ক্লাস শুরু করি।
আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করি উনি যেন আমার শ্বশুরকে হেদায়াতের পথে রাখেন। উনি খুব ভালো মানুষ। আল্লাহপাক উনাকে নেক হায়াত দান করুন। ভালো মানুষগুলো বেঁচে থাকুক হাজার বছর। কারণ এই পৃথিবীতে ভালো মানুষ না থাকলে পৃথিবীটা নরক হয়ে যাবে। এই কথাগুলো বলার একটাই কারণ মানুষ হিসাবে উনার মতো ভালো মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। উনি আমার পাশে সবসময় ছিলেন। বাবার ছায়ায় আমাকে রেখেছিলেন। বেবিটা হওয়ার সময় আমি আমার শ্বশুরের তত্বাবধানে উনার পরিচিত হাসপাতালে অ্যাডমিট হই। যার ফলে আমার কোনো বিড়ম্বনা হয়নি। সিজারের সময় উনি ফর্ম ফিলাপ করেছে। স্বামীর জায়গায় উনি উনার ছেলের নাম বসিয়ে দিয়েছে। উনার আর একটা সিদ্বান্তে আমি খুব অবাক হয়ে ছিলাম। আমার চোখে সেদিন জলপ্রপাতের ঢেউ উথলে উঠেছিলো।
চলবে