#ধারাবাহিকগল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-আট
মাহবুবা বিথী
আম্মুর ডাকে অনেক বেলা করে আমার ঘুম ভাঙ্গলো।
—–কিরে এতো বেলা করে ঘুমাচ্ছিস কেন? শরীর ঠিক আছে তো?
—–হুম ঠিক আছি।
ঘুম ভাঙ্গার পর আমার শরীরটা গুলিয়ে উঠতে লাগলো। মাথাটা ঘুরছে। আমি দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে বমি করে ফেলি। তারপর হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে এসে আম্মুকে বললাম,
—–আব্বু কি অফিসে চলে গেছে?
—–হুম। তোর বমি কদিন থেকে হচ্ছে?
—–এখনি হলো। এর আগে তো হয়নি। শোভন আর প্লাবনকি স্কুলে?
—–হুম।
আমি মাথা নিচু করেই বুঝতে পারছি আম্মু তার অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে আমাকে খুঁটিয়ে দেখছে। ইচ্ছে করেই আম্মুকে মিথ্যা বললাম। তা না হলে নানা প্রশ্ন করে আমাকে জর্জরিতো করবে। এমনিতেই আমি নিজেও বুঝতে পারছি আমার পেট বড় হচ্ছে। তিন মাস থেকে পিরিয়ড বন্ধ ছিলো। আমার তো অনিয়মিত পিরিয়ড হয়। তাই বিষয়টা গুরুত্ব দেইনি। আমি তো আবার একটু হেলদি। আম্মু আমার পেটের দিকে তাকিয়ে বললো,
—–তুই কাল থেকে আসার পর তোর শ্বশুরবাড়ির কেউ তো ফোন দিলো না। আমার কাছে তোর এভাবে আসাটা ভালো ঠেকছে না।
আমার একটু রাগ হলো। তাই তেতে উঠে আম্মুকে বললাম,
—–তোমার মেয়েকে একবেলা খাওয়াতে কি তোমার সংসারের ভাঁড়ার ঘর শুন্য হয়ে গেল? চিন্তা করো না যদি বেশিদিন তোমার এখানে থাকি তাহলে আমার খরচটুকু দিয়েই থাকবো।
—–তুই রাগ করছিস কেন? মা হলে বুঝবি সন্তানের ভালো মন্দ নিয়ে কত চিন্তা হয়। নাস্তা নিয়ে আসবো?
—–না আমার এখন খেতে রুচি নেই।
আমার কথা শুনে আম্মু মুখ কালো করে উঠে চলে যায়। আসলে আম্মুকে এই রুম থেকে উঠানোর জন্য আমি এভাবে কথা বলতে বাধ্য হলাম। আমার এই অবস্থার জন্য বাবা মায়ের উপর আমার অনেক অভিমান জমে আছে। ভার্সিটিতে ভর্তির দিন দেখলাম আমার বয়সি ছেলে মেয়েরা মুক্ত বিহঙ্গের মতো ক্যাম্পাসে ঘুরছে। তাদের দুচোখে কত স্বপ্ন। জীবন নিয়ে ওদের কত পরিকল্পনা। আর আমি এক রাশ দুশ্চিন্তা আর হতাশা নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পানে তাকিয়ে আছি। যদিও শ্বশুর টাকার সংস্থান করতে চেয়েছেন কিন্তু বাচ্চাটা হওয়ার পর একা হাতে আমি ওকে কিভাবে বড় করবো? আমার পড়ালেখাটা কিভাবে চলবে? মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অতলান্তিক গহ্বরে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছি। এর জন্য আমার বাবা মাই দায়ী।
আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখি এই কয়মাসে আমার বয়স যেন অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। হয়ত মানুষের জীবনে যা ঘটার তা অবশ্যই ঘটবে। এতে কারো মনে হয় করার কিছু থাকে না। তখন নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করতে ইচ্ছে হয়। এইজন্য ক্ষুধা তৃষ্ণার অনুভূতী হয় না। যেমন এই মুহুর্তে আমার সবকিছু লোপ পেয়েছে। আম্মু চলে যাওয়ার পর আলগোছে আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে। আমিও চোখের পানিটাকে অঝোরে ঝরতে দিলাম। বুকের ভিতর দলা পাকানো কষ্টগুলো ঝেড়ে ফেলতে চাইলাম। এতে ভার হয়ে যাওয়া বুকটা যেন একটু হালকা হয়।
কদিন থেকে গুমোট গরম পড়েছে। বাতাস যেন থেমে আছে। আকাশটা কালিগোলা হয়ে আছে। যে কোনো মুহুর্তে প্রলয়ঙ্কারী ঝড় শুরু হবে। একটু পরেই গুমড়ে থাকা বাতাসটা বইতে শুরু করলো। আম্মু এসে জানালাগুলো লাগিয়ে দিলো। তা না হলে ধুলোতে পুরো ঘর ভরে যাবে। আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভাণ করে বিছানায় শুয়ে আছি। আম্মু মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
—–খেতে চল। বমি করেছিস। শরীরটা এমনিতেই দুর্বল হয়ে আছে। তুই নিজে সুস্থ না থাকলে পেটেরটাকে বাঁচাবি কিভাবে?
আম্মুর কথা আমি শকড খাওয়া মানুষের মতো তড়াৎ করে বিছানায় বসে আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
——তোমাকে কে বললো?
——সকালে তোর শ্বশুর ফোন দিয়েছিলো। তোর রিপোর্ট হাতে পেয়ে বেয়াই জানালো। বাচ্চাটার বয়স আঠারো সপ্তাহো হয়েছে। তুই কিছুই টের পাসনি?
——আমারতো ইরেগুলার পিরিয়ড হতো তাই বুঝতে পারিনি।
কারেন্ট চলে গেল। আশে পাশে কোথায় যেন বাজ পড়েছে। বিকট শব্দ হলো। আম্মুও আমার জন্য নাস্তা আনতে কিচেনে গেল। রুটি সবজি আর চা নিয়ো এসে আম্মু আমায় বললো,
—–চল খেয়ে নেই। রাজ্যের কাজ পড়ে আছে।
খেতে খেতে আম্মু আমায় বললো,
—–তোর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কি খুব দরকার?রাসেল যদি পড়াতে না চায় তাহলে ঝামেলা করে শ্বশুর বাড়ির সাথে অশান্তি বাড়িয়ে লাভ নেই। বিয়ে হয়ে গেছে দুদিন পর বাচ্চাও হয়ে যাবে। তোর পূর্ণ সংসার। এখন বাচ্চাটাকে মানুষ কর। স্বামীর মন যুগিয়ে চল দেখবি একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
আম্মুর কথা শুনে আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। খাবারগুলো কোনোরকমে নাকে মুখে গিলে খেলাম। তারপর রেগে গিয়ে আম্মুকে বললাম,
——তোমার আর কিছু বলার আছে? আমাকে এখন একটু একলা থাকতে দাও। আমার জীবনের যা সর্বনাশ হওয়ার তাতো হয়েই গেছে। আমার বাকীটা জীবন আমি আমার মতো করে গড়তে চাই।
——রুহী মাথা গরম করে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে না। অনেক সময় একটা ভুল সিদ্ধান্ত সারাজীবনের কান্না বয়ে আনতে পারে। দুদিন পরে বাচ্চাটার জন্ম হবে। এই সময় তোকে অনেক ভেবে চিন্তে জীবনের পথে পা ফেলতে হবে।
——তুমি ঠিকই বলেছো আম্মু। যা ভুল হওয়ার ইতিমধ্যে তা আমার জীবনে ঘটে গেছে। আমার মনে হয় না আর নতুন করে আমার জীবনে আর কোনো সর্বনাশ ঘটার বাকী আছে। আর একটা কথা তোমাদের বলি আমার আর ঐ সংসারে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা নাই। আমি কি ও বাড়ির ক্রীতদাস? যে বড় আশা নিয়ে তোমরা ও বাড়িতে আমায় বিয়ে দিয়েছিলে তার কিছুই আমি পাইনি। একরকম ও বাড়ির কাজের লোক আর আমার মাঝে কোনো তফাৎ নেই। তুমি কি জানো বিয়ের দিন থেকে আমি দমবন্ধ একটা পরিবেশে ছিলাম। এই কয়মাসে আমার জীবনে কোনো আনন্দ ছিলো না। বুকের ভিতর শুধু কষ্ট বেদনা আর অপমানগুলো দলা পাকিয়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ছিলো। তুমি বা আব্বু কেউ জানতে চাওনি তোমাদের মেয়েটা ও বাড়িতে কেমন আছে। তোমাদের ঘাড়ের থেকে বোঝা নামিয়ে ফেলে আমার ঘাড়ে সংসার সমুদ্রের বোঝা চাপিয়ে দিলে। কিন্তু একবার ভেবে দেখোনি এই বোঝা বইবার মতো শক্তি আমার আছে কিনা।
——গরীবের মেয়েদের অতকিছু ভাবতে নেই। তোমার বাবা তোমাকে রাজ্যপাঠ লিখে দিয়ে শ্বশুর বাড়িতে পাঠাননি। যাতে উনারা তোমাকে রানীর আসনে বসিয়ে রাখবে। গরীবের এতো বাছ বিচার থাকলে হবে না। যে পাত্রে রাখা হবে সেই পাত্রেই আকার ধারণ করতে হবে। গরীবের চরিত্র এমনই হওয়া উচিত।
আম্মু আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শেষ করে আমার রুম থেকে বের হয়ে গেল। ঝড়টা অনেকটা থেমে এসেছে। আমি জানালা খুলে দিলাম। এক রাশ শীতল হাওয়া আমার নাক মুখ ঠোঁট এমনকি শরীর ছুঁয়ে গেল। আমি আর চেপে রাখতে পারলাম না। আজ সব এক নিঃশ্বাসে উগড়ে দিয়ে নিজেকে খুব হালকা লাগছে।
এ ভাবে মাসখানিক সময় পার হয়ে গেল। এর মাঝে একদিন বিকালে আমাদের এক প্রতিবেশী আন্টি আমাদের বাসায় বেড়াতে আসলেন। উনাকে মহল্লায় সবাই ডলির মা বলে চিনে। উনার তিন মেয়ে। ডলি, মলি, পলি। ডলি আমার সাথেই পড়তো। পড়াশোনায় মোটামুটি ছিলো। আমি ওর থেকে বরাবর ভালো রেজাল্ট করতাম।ও ইডেন কলেজে ডিগ্রীতে ভর্তি হয়। এখনও বিয়ে হয়নি। তবে ছোটোবেলায় আমার সাথে বেশ সখ্যতা ছিলো। আমরা পাশাপাশি বাড়িতে থাকি। কিন্তু যতই আমরা বড় হতে লাগলাম আমাদের মাঝে প্রতিযোগীতা বেড়ে যায়। আমি ছাত্রী ভালো, দেখতে ওর থেকেও সুন্দরী ছিলাম বলে আমাদের মাঝে আস্তে আস্তে দুরত্ব তৈরী হয় । তাই বলে ঝগড়াঝাটি কোনোদিন হয়নি। কালেভদ্রে আম্মু ও বাড়ি যায়। ওর আম্মুও আমাদের বাড়ি আসে। আন্টি একটু বেশী আসেন। আন্টিকে এলাকায় সবাই রয়টার বলে। উনার কাজ হচ্ছে সবার বাড়ির খবর সংগ্রহ করা। আমি একমাস থেকে আমাদের বাসায় আছি। এর মধ্যে রাসেল একবারও আসেনি। বিয়ের পর প্রথম এসেছি। অথচ রাসেল আমার সাথে আসেলো না। এই নিয়ে মহল্লায় কানাঘুষা চলছে। আমাকে দেখেই আন্টি বললেন,
——রুহী কবে আসছো? সেই যে বিয়ের সময় গেলে তারপর এই আসলে। জামাই আসলো না। ভাবলাম তোমাদের দুজনকে দাওয়াত করবো।
——এই তো কিছুদিন হলো আসছি। আন্টি ওর তো অফিসে অনেক ব্যস্ততা। এখন আবার অফিসের কাজে থাইল্যান্ড গিয়েছে।
——এর মাঝে আসবে তো?
—–হুম। আসার কথা আছে।
——তুমি কি কনসিভ করেছো?
আমি একটু কাষ্ট হাসি হেসে মাথাটা হ্যাঁ বোধক নাড়লাম। আম্মু তখন আন্টিকে বললো,
——এই কারণে ওর শ্বশুর শাশুড়ি কিছুদিন থাকার জন্য পাঠিয়ে দিলেন।
——ভালো হলোই ভালোরে বইন। কারণ বড় লোকের খেয়ালখুশী অন্যরকম। ওদের আবার এক জিনিস বেশীদিন মুখে রুচে না।
আমি কথা ঘুরিয়ে বললাম,
——আন্টি আমার আর একটা সুসংবাদ আছে। আমি ঢাকা ভার্সিটিতে ইতিহাসে চান্স পেয়েছি।
সাথে সাথে আন্টির মুখটা কালো হয়ে গেল। দেখে মনে হবে কেউ মনে হয় কালি মাখিয়ে দিয়েছে। আন্টি আর একমুহুর্ত অপেক্ষা না করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে আম্মুকে বললেন,
——রুহীর মা, এখন যাই। একটু পরেই মাগরিবের আযান হবে। বাসায় গিয়ে নামাজ পড়তে হবে।
এসব নানাবিধ কারনে আব্বু আম্মুও আমাকে নিয়ে চিন্তায় আছেন। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসাবে আমার শাশুড়ি একদিন আম্মুকে ফোন দিয়ে বললো,
চলবে