#ধারাবাহিকগল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-সাত
মাহবুবা বিথী
আমার শ্বশুর চেহারা দেখে আমার মনের অবস্থা হয়তো বুঝতে পেরেছেন। তাই ম্যাডামের চেম্বার থেকে বের হয়ে উনি একটু ইতস্তত করে আমাকে বললেন,
——তুমি যদি রাখতে না চাও বাচ্চাটা এবরশন করে ফেলতে পারো। তবে একটু দেরী হয়ে গেছে।
আমি যেন কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। পথহারা পথিকের মতো এখন আমার অবস্থা। এই কয়েক মাসের ব্যবধানে আমার জীবনটা কেমন পাল্টে গেল। আমার বর্তমানকে ছেড়ে ভবিষ্যতকে আলিঙ্গন করার মতো সাহস আমি এই মুহুর্তে খুঁজে পাচ্ছি না। এক লহমায় আমার জীবনটা নৈরাশ্য বেদনা আর শঙ্কায় ডুবে গেল। আবার যে আসছে তাকেও আমি চাইছি। যে কোনো মুল্যে তাকে আমার চাই। এখন তাকে পাওয়ার সাহস এবং শক্তি দুটোই আমাকে অর্জন করতেই হবে। এসব হিজিবিজি ভাবতে ভাবতে শ্বশুরের ডাকে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম।
—–রুহী এভাবে মুষড়ে পড়লে হবে না। এমনিতেই দেরী হয়ে গেছে। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার চটজলদি নিতে হবে।
—–বাবা আমি এবরশন করাবো না।
—–যা বলছো তুমি ভেবে বলছো তো মা।
—–হ্যা বাবা, আমি ভাবনা চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
——আমিও তোমার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। মা আমি তোমার সঙ্গে আছি। এই বুড়ো ছেলেটা তোমার বেবিকে ঠিক সামলে নিবে। তুমি খাবে আর পড়াশোনা করবে। আর কোনো ব্যাপারে মাথায় টেনশন নিবে না। তোমার ও তোমার বেবির খরচের জন্য কারো কাছে হাত পাততে হবে না। যে আসছে সে আমার বংশের অংশ। আমার রক্তের অংশ। ওর এই দাদাভাই বেঁচে থাকতে ইনশাআল্লাহ ও খুব ভালভাবে এই পৃথিবীতে আসবে।
এই কথা বলে আমার শ্বশুর আমার খরচ বাবদ হাতে দশ হাজার টাকা তুলে দেয়। গাড়ি থামিয়ে পথ থেকে মিষ্টি কিছু ফলফলাদি কিনে নেয়। তারপর শ্বশুরের সাথে আমি বাড়ির পথে রওয়ানা দেই। গাড়ি চালাতে চালাতে উনি আমায় বললেন,
——তুমি যে ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছো তোমার বাবা মা জানেন?
——না, বাবা উনাদের বলা হয়নি। কারণ উনাদের বললে উনারা আমাকে পরীক্ষা দিতে দিতেন না। ঝামেলা আরো বেশী হতো। উনারাই তো চাননি আমি পড়াশোনাটা চালিয়ে যাই। তাই জানাইনি। বাবা আমি যে কনসিভ করেছি এই খবরটা এই মুহুর্তে আমি দিতে চাইছি না।
শ্বশুর অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়ত তার কন্যাদের সাথে আমার জীবনটা মেলাতে চাইছেন। আমি তো জানি, সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম হওয়া যাকে বলে আমার ননদদের লাইফস্টাইল অনেকটা সেরকম। সেখানে আমার জীবনের সাথে ওদের কোথাও মিল হবে না।
আমাদের বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল পাঁচটা বেজে গেল। আমি ভাবছি আমার ভাগ্য নিয়ে। বিয়ের পর মেয়েরা যখন বাপের বাড়ি আসে একরাশ আনন্দ নিয়ে স্বামীর ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে। আর আমি এসেছি রিক্ত হস্তে ঘর ভেঙ্গে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে নিজেকে মুড়িয়ে নিয়ে আর একরাশ শঙ্কাকে সঙ্গী করে। যদিও আমার শ্বশুর বলছেন উনি আমার সাথে আছেন তারপরও আমি আমার জীবনের এই ঘোর অমানিশায় দাঁড়িয়ে আল্লাহপাক ছাড়া কারো উপর ভরসা রাখতে পারছি না। আমার শ্বশুর যদি মাঝপথে সহযোগীতার হাত ছেড়ে দেয় তাতেও আমার কিছু করার নেই। তবে ও বাড়িতে আমার আর ফেরার ইচ্ছে নেই। ঘরের দরজায় পৌঁছে দুরু দুরু বুকে ডোর বেলটা চাপ দেই। শোভন এসে দরজা খুলে বললো,
—–আপু তুই এসময়?একা এসেছিস?দুলাভাই আসেনি?
—–এতোগুলো প্রশ্ন একসাথে করলে আমি কোনটার উত্তর দিবো।
আমাদের ভাইবোনের কথপোকথনে আমার শ্বশুর ততক্ষণে গাড়ি লক করে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। শোভন আমার শ্বশুরকে বললো,
——আঙ্কেল আসসালামুআলাইকুম। আঙ্কেল ভালো আছেন?
——আছি বাবা একরকম।
এর মাঝে আব্বু আম্মু চলে এসেছে। উনারাও আমার শ্বশুরকে সালাম দিয়ে বললেন,
——কোনো খবর না দিয়ে আসলেন বেয়াই। সব ঠিক আছে তো?
—–আসলে রুহী মায়ের এতো বড় সুসংবাদ ভাবলাম আপনাদের সাথে শেয়ার করি।
এই কথা বলে আমার শ্বশুর ফল মিষ্টিগুলো শোভনের হাতে তুলে দেয়। আব্বু একটু অবাক হয়ে বললেন,
——আসলে আমরা তো কিছুই জানি না। আর বুঝতেও পারছি না সুংসংবাদটা কি?
—–রুহী তো ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে।
এই কথা শুনে আমার আব্বু আম্মুর মুখটা অন্ধকারে ঢেকে গেল। আম্মু একটু গম্ভীর হয়ে বললেন,
—–রুহীর লেখাপড়া চালিয়ে নিতে রাসেল কি মত দিয়েছে?
—–আশ্চর্য বেয়াইন আপনি কোথায় খুশী হবেন মেয়ে আপনার কত ভালো রেজাল্ট করেছে আবার সংসার সামলিয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। ইনশাআল্লাহ ও লেখাপড়াটা ঠিকমতো করতে পারলে ওকে কারো উপর নির্ভর হতে হবে না। বরং আপনার সংসারের হাল ও কিছুটা হলেও ধরতে পারবে। তাই আপনাদের উচিত ওকে সহযোগীতা করা।
আব্বুও গম্ভীর হয়ে বললো,
——রাসেল এলো না? বিয়ের পর একবার এক রাতের জন্য এসেছিলো। আর তো আসেনি। ও রুহীর সাথে আজকে আসতে পারতো?
—–আসলে কর্পোরেট সেক্টরে জব করার কারণে ওর ব্যস্ততা অনেক বেশী। তারপর কদিনের জন্য অফিসের কাজে থাইল্যান্ড যাবে। আর রুহীরও আপনাদের এখানে আসা হয় না। তাই এই সুযোগে আমি নিয়ে আসলাম। আপনাদের বেয়াইনও বলছিলো কটাদিন ও বাপের বাড়ি বেরিয়ে আসুক।
—–রুহীর মা যাও বেয়াইয়ের জন্য চা নাস্তার ব্যবস্থা করো। বিয়ের পর এই প্রথম বেয়াই আসলেন।
—–না বেয়াই আর একদিন এসে জমিয়ে আড্ডা দিবো আর বেয়াইনের হাতের মজার রান্না খাবো। আজ আমার চেম্বার আছে। রুগীরা অপেক্ষা করে বসে থাকবে। রুহী মা তুমি আমাকে একটু শরবত বানিয়ে দাও তাতেই চলবে।
আমি শরবত বানিয়ে দিলাম। শ্বশুর আব্বা খেয়ে সবার কাছে বিদায় নিয়ে রওয়ানা দিলেন। আমি ঘরে গিয়ে পোশাক চেঞ্জ করে নিলাম। আম্মু আমাকে বিয়ের আগের জামা পড়তে দেখে একটু বিরক্ত হয়ে বললো,
——বিধবার বেশে শ্বশুর বাড়ি থেকে আসছিস কেন? কোনো লাগেজ ও তো আনিসনি। আমি বুঝতে পারছি না। সব ঠিক আছে তো?
——আম্মু তুমি শুধুই টেনশন করছো। আমার শ্বশুর তো বলে গেলেন। আমি কটাদিন এখানে থাকবো। তাই কাপড় চোপড় আনা হয়নি। আর আজকে ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। এইজন্য ব্যাগও গুছাতে পারিনি।
——সব ভালো থাকলেই ভালো। নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায় তাদের সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় হয়।
মাগরিবের আযান হচ্ছে। আম্মু চিন্তিত মুখে ওজু করতে ওয়াশরুমে গেল। আমিও ওজু করে নিলাম। যদিও আমার শ্বশুর কিছু সত্য কিছু মিথ্যা দিয়ে গল্প সাজিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু আমি জানি এই পরিস্থিতি সামলে নেওয়া অনেক কঠিন হবে। আম্মু আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জানতে চাইবে। যদি জেনে যায় আমি কিভাবে পরিস্থিতি সামলে নিবো বুঝতে পারছি না। তারউপর কনসিভ করছি শুনলে ওদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়বে।
মাগরিবের নামাজ পড়ে নিলাম। কলিং বেলের শব্দ শুনলাম। শোভন দরজা খুলে দিয়ে বললো,
—–ভাইয়া আপু এসেছে।
——তাই নাকি?
প্লাবন মনে হয় কোচিং থেকে ফিরেছে।
ওর রুমে ব্যাগটা রেখে দৌড়ে আমার কাছে ছুটে আসলো।
—–আপু কেমন আছিস। কতদিন পর তোর সাথে দেখা।
——হুম এখন আমাকে দেখে আহ্লাদ করা হচ্ছে। যাসনি কেন ও বাড়িতে। ভাই হয়ে আমার খোঁজটা নিতে যেতে তো পারতি?
—–আমি যেতে চেয়েছিলাম। আব্বু আম্মু বলে তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজন অনেক বড়লোক। যখন তখন ও বাড়িতে যাওয়া তোর শ্বশুর বাড়ির মানুষ পছন্দ নাও করতে পারে।
—–বাদ দে ওসব কথা। এখন বল তোর পড়ালেখা কেমন চলছে। সামনে তো এসএসসি পরীক্ষা। প্রিপারেশন কেমন চলছে।
—–ভালই।
——টাকা পয়সা লাগলে বলিস। যতটুকু পারি সাহায্য করবো।
—–আপু রাসেল ভাই আসলো না।
—–নারে, ওর অফিসে অনেক ব্যস্ততা।
শোভন এসে আমাকে আর প্লাবনকে বললো,
—–আম্মু তোমাদের ডিনার করতে ডেকেছে?
আমি আর প্লাবন খাবার টেবিলে গিয়ে বসলাম। আম্মু আব্বু আর শেভন ও খেতে বসেছে। চিংড়ী মাছ আর কাঠালের বিচির সাথে পটল দিয়ে আম্মু তরকারী রান্না করেছে। সাথে পেপে ভর্তা আর বেগুনভাজি। আমার কাছে অমৃতের মতো লাগলো। কতদিন পর আম্মুর হাতের রান্না খেলাম।
খাওয়া শেষ করে রুমে এসে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঘুম যেন আমার চোখের কার্ণিশ থেকে বিদায় নিয়েছে। আমার ঘুম না আসলে গল্পের বই নিয়ে পড়তে বসলে মুহুর্তে চোখে ঘুম এসে যায়। গল্পের বইয়ের মাঝে ডুবে যেতে যেতে নিজের ভুত ভবিষ্যত সব ভুলে গেলাম। নিশুতি রাত কখন যে গভীর হয়েছে আমি টের পাইনি। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত তিনটা বাজে। একটু পরেই এই রাত শেষ হয়ে নতুন দিনে সূর্যটা জেগে উঠবে। কারো জীবনের আঁধার কেটে যাবে, দুঃখের অবসান হবে কিন্তু আমার জীবনের ঘোর অমানিশা কবে কাটবে আমি জানি না।
চলবে