আকাঙ্খিতো প্রণয় পর্ব-০৬

0
965

#ধারাবাহিকগল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী

—–আজ যদি তুমি মায়ের অবাধ্য হয়ে ভার্সিটি ভর্তি হতে যাও তাহলে এ বাড়ির দরজা তোমার জন্য চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে যাবে। হাজার বার দরজায় মাথা ঠুকলেও তোমার জন্য এ দরজা কোনোদিন খোলা হবে না। আমি তো জানি তোমার বাপের বাড়িতেও তোমার ঠাঁই হবে না। তখন দেখবে রাস্তার শেয়াল শকুন তোমাকে কি করে খুবলে খায়?
—–এই বন্দী কারাগারে আমি আর নাইবা ফিরলাম।যেখানে নিজেকে ক্রীতদাস বই আর কিছু মনে হয় না। নিজে বন্দী হয়ে গৃহপালিত শেয়াল শকুনের খাবার আমি আর হতে চাই না। কারণ এখানে আমার পালানোরও পথ বন্ধ। আর রাস্তায় শেয়াল শকুন তাড়া করলে অন্তত আমি পালিয়ে নিজের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারবো।
সোহেল সেদিন বাসায় ছিলো। ওর মনে হয় আমার কথা গুলো খুব গায়ে লেগেছে। তাই ওর রুম থেকে বের হয়ে এসে ভাইয়ের সাথে সুর মিলিয়ে বললো,
—–ভাইয়া নষ্টা মেয়েদের স্বামীর সংসার ভালো লাগে না। এক পুরুষে তাদের মন ভরে না।
আমি কিছু বলার আগেই আমার শ্বশুর এসে ধমক দিয়ে বললো,
—-সোহেল অন্যের চরিত্রের ব্যবচ্ছেদ করা বাদ দিয়ে নিজের নষ্ট চরিত্রের সংশোধন করো। তোমার কাছে নিজের ভাইয়ের বউও নিরাপদ নয়। কি নোংরা মানসিকতার মানুষ তুমি! তোমাকে আমার সন্তান ভাবতেও লজ্জা হয়।
এ কথা শুনে আমার শাশুড়ী চিৎকার করে বললো,
——ঐ ছোটোলোকের মেয়ের কথা বিশ্বাস করে আমার ফুলের মতো পবিত্র ছেলেটার চরিত্রে কলঙ্ক দিতে তোমার এতোটুকু বাঁধলো না।
আমার শ্বশুরআব্বা শাশুড়ীমায়ের কথা শুনে চিৎকার করে বললো,
—–চুপ করো। তুমি এখানে আর কোনো কথা বলবে না। সারাজীবন বাচ্চাদের শাসন করোনি। তাই ওদের মনুষ্যত্বটা বিকশিতো হয়নি। সেখানে পশুত্ব বিকাশ লাভ করেছে। যা তুমি মা হয়েও টের পাওনি।
সোহেল আমার শ্বশুরের কথা শুনে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।
শ্বশুর আমায় বললেন,
—–চলো রুহী, তোমার দেরী হয়ে যাচ্ছে? এখানে এদের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করো না। আমি তোমাকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে হাসপাতালে যাবো।
আমার শাশুড়ী আহত বাঘিনীর মতো ছটফট করে বললো,
—–রাসেল ওর ব্যাগ চেক কর। দেখ আবার গয়নাগাটি টাকা পয়সা নিয়ে পালাচ্ছে কিনা?
শাশুড়ী কথায় রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে আমার শ্বশুর বললো,
—–আসলে তুমিই তো নোংরা মানসিকতার মানুষ। তোমার সন্তানদের মানসিকতা আর কতো উন্নত হবে?
সাবা ঘুমিয়েছিলো তাই সেদিন ওর নোংরা কথা শোনার ভাগ্য আমার হয়নি। তবে মাসাবা এসে ওর মাকে বললো,
—–আম্মু বাড়াবাড়িটা তোমাদের একটু বেশী হয়ে যাচ্ছে না?
—–তুই আবার এর মাঝে ঢুকছিস কেন?
—–কি করবো বলো তোমার আর ভাইয়াদের আচরণ আমায় চুপ থাকতে দিলো না।

আমিও ভাবলাম এখান থেকে চলে যাওয়ার পর যদি এরা মা ছেলে মিলে আমার নামে চুরির মামলা দেয় তাই শ্বশুরকে বললাম,
—–বাবা আপনি আমার ব্যাগ চেক করুন।
——তুমি ওদের কথায় কেন এমনটা ভাবছো। আমার বাড়ি আমার ঘর। আমি যদি ওদের বঞ্চিত করে সব সম্পত্তি তোমায় লিখে দেই তখন ওরা শুধু বিষহীন সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করতে পারবে। এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা ওদের নাই।
তারপরও আমি জোর করে আমার শ্বশুরকে দিয়ে ব্যাগ চেক করালাম। আসলে বিয়ের দু,মাস এতো চাপ নিয়েছি আর বাকি জীবনে কোনো চাপ নিতে ইচ্ছা হচ্ছে না। জানি না ভাগ্যে কি লেখা রয়েছে। যাবার আগে রাসেলকে শেষ কথাটা বলে গেলাম,
—–শুনুন রাসেল সাহেব, কথায় কথায় মেয়েদের নষ্টা বলবেন না। কারন পুরুষের স্পর্শ ছাড়া কোনো নারী নষ্টা বা ভ্রষ্টা হয় না। কথাটা আপনার ভাইকেও বলে দিবেন।
চলে যাওয়ার সময় মাসাবা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললো,
——তুমি সত্যিই চলে যাচ্ছো ভাবি? মনে হচ্ছে তোমার সাথে আমার বন্ডিংটা শুরু না হতেই শেষ হয়ে গেল।
এ কথা বলে মাসাবার চোখদুটো জলে ভরে গেলে। আমিও আর দেরী না করে ও বাড়ি থেকে চিরজীবনের মতো বের হয়ে শ্বশুরের সাথে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ মাথাটা চক্কর দুয়ে গা গুলিয়ে বমি আসতে চাইলো। ব্যাগ থেকে একটা চুইংগাম বের করে মুখে দিয়ে চিবাতে লাগলাম। আর ভাবলাম আজ বাবা মায়ের দরজায় দাঁড়ানোর পর কি পরিস্থিতির মুখোমুখি হবো আমি জানি না।
ঢাকা ভার্সিটির সামনে এসে শ্বশুর আমায় বললেন,
—–আবারও তোমায় বলছি। বাবা হিসেবে যখন আমায় ডেকেছো কোনোদিন নিজেকে একা ভেবো না। এই বুড়ো ছেলেটা সব সময় তোমার পাশে আছে।
কথাগুলো বলতে বলতে উনার চোখ ছলছল করে উঠলো। আমার উনার দিকে তাকিয়ে মনটা বিষাদে ভরে গেল। শরীরটা এমনিতেই অনেক খারাপ লাগছিলো। বিদায় নেওয়ার শেষ মুহুর্তে আমি হড়হড় করে শ্বশুরের সামনেই বমি করে ফেললাম। তাল রাখতে না পেরে আমার মাথা ঘুরে পড়ে যাবার উপক্রম হলো। শ্বশুর আব্বা আমায় সাথে সাথে ধরে ফেললেন। ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিলাম। তারপর উনার চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—–আমি ঠিক আছি বাবা। আসলে সকালে কিছু খাইনি তো সে কারণে বমিটা হলো।
ডাক্তার মানুষ। তার অভিজ্ঞ চোখে আমার অসুস্থতার কারণটা লুকিয়ে থাকতে পারলো না। তাই উনি আমাকে বললেন,
——তোমাকে এ অবস্থায় আমি একা ফেলে যাবো না। আমি তোমার পেরেন্টস হিসাবে ভর্তির কার্যক্রমে অংশ নিতেই পারি। ভর্তিটা হয়ে গেলে আমার হাসপাতালে গাইনি ডাক্তার দেখিয়ে তোমাকে তোমার বাবার বাড়ি পৌঁছে দিবো।

তারপর উনি আমাকে নিয়ে গাওসিয়ার কাছে স্টার কাবাবে বসলেন। সেখানে আমরা দুজন নাস্তা করে আবার ভার্সিটির দিকে রওয়ানা হলাম। এই দু,দিনে আমি আমার শ্বশুরকে যতই দেখছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি। রাসেলের সাথে আমার শ্বশুরের কত তফাৎ। আমার শ্বশুর যেন মায়া মহব্বত নামক গুপ্তধনের খনি। অপরদিকে রাসেলকে আমার কাছে খুব নির্মম মনে হয়েছে।
ভর্তির কার্যক্রম শেষ করে শ্বশুরের সাথে হাসপাতালে গেলাম। নিজেকে একটু হালকা বোধ হলো। নিজের স্বপ্নের কিছুটা পূরণ হওয়াতে কষ্টগুলোর ভার অনেকটা কমে গেল। উনি আমাকে উনার পরিচিত এক গাইনি ম্যাডামকে দেখালেন। ম্যাডাম আমাকে স্টিক দিয়ে প্রেগনেন্সি টেস্ট আগে করিয়ে নিলেন। সেখানে পজিটিভ আসায় মুহুর্তে আমার পৃথিবীটা আবারও দুলে উঠলো। মনের ভিতরটা একধরণের মিশ্র অনুভূতীর অনুভব হলো। যে আমি এখন নিজেকেই ভালমতো দেখভাল করতে পারি না সেই আমি আর একটা মানুষের দেখভাল কিভাবে করবো? আবার এই পৃথিবীতে সম্পূর্ন আমার নিজের অংশ আসছে যে আমার সবচেয়ে আপনার এটা ভাবার সাথে সাথে একটা সুখের পরশ যেন আমাকে ছুঁয়ে দিলো।
ম্যাডাম আমার সব ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে শ্বশুরকে বললেন,
—–এতো ভালো সুসংবাদ খালি মুখে দিতে চাই না। মিষ্টি খাওয়ান তারপর বলবো।
শ্বশুরও বুঝতে পেরে পিয়ন দিয়ে মিষ্টি কিনে হাসপাতালের সবাইকে খাওয়ালেন। আমি ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে থাকলাম। নিজেকে খুব অসহায় বোধ হলো। জীবনকে নিয়ে যতই আমি একরকম ভাবি ততই যেন আমার জীবন নদীর স্রোতটা উল্টোদিকে বইতে লাগলো। আমার নিজেকে মনে হচ্ছে অকূল দরিয়ায় আমি ভাসছি। যার কোনো কূল কিনারা নেই। সংসারের অনলে আমি যেন সর্বদা পুড়ে অঙ্গার হচ্ছি। তবে ভেঙ্গে পড়ার মেয়ে আমি নই। জীবন আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে হোঁচট খেতে খেতে কি করে উঠে দাঁড়াতে হয়।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে