আকাঙ্খিতো প্রণয় পর্ব-০৫

0
909

#ধারাবাহিকগল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী

——বাবা আমার কি সে উপায় আছে? আমার মনে হয় আমার পিছনের রাস্তাও বন্ধ আবার সামনের দিকে এগুনোর পথও রুদ্ধ।
——ইনশাআল্লাহ তুমি যদি চাও সব বাধা ডিঙ্গিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে। এটা সম্পূর্ণ তোমার উপর নির্ভর। তুমি তোমার জীবনের ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নিবে তাতেই আমার মত থাকবে। কারণ জীবনটা তোমার।
আমার মাথায় তখন কিছু কাজ করছিলো না। ভাবছি আমি যদি এখন আমার বাবার বাড়ি চলে যাই সেখানে আমার লেখাপড়ার খরচ চালানোর ইচ্ছা আমার বাবা মায়ের নেই। হয়ত সামর্থ ও নাই। আর আমি এও জানি এ সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হলে লেখাপড়ার কোনো বিকল্প নাই। তাই শ্বশুরকেই জিজ্ঞাসা করলাম,
——বাবা আপনি আমার জায়গায় থাকলে কি করতেন?
—–আমি তোমার জায়গায় থাকলে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতাম। যেখানে স্বামীর কাছে স্ত্রীর মর্যাদা নাই, এমনকি মানুষ হিসাবে প্রাপ্য সম্মানটুকু পাওয়া যায় না তার উপর রয়েছে নিরাপত্তাহীনতা এসব কারনে এখান থেকে চলে যাওয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত। ভুল তো মানুষেরই হয়। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হয়। জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হয়। রেলগাড়ি যেমন লাইনচুত্য হলে তাকে আবার মেরামত করে সঠিক লাইনে চালাতে হয় তেমনি জীবনের রেলগাড়িটাও যদি লাইনচুত্য হয় তাকে মেরামত করে সঠিক লাইনে চালাতে শিখতে হয়। আর তুমি এখন ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছো সুতরাং অনেকটা পথ তুমি এগিয়ে এসেছো। সামনে তোমার সুন্দর ভবিষ্যত পড়ে আছে। এটা তোমার প্রতি আল্লাহপাকের বিশাল রহমত। আল্লাহপাক কখনও তার বান্দাদের সব দরজা একসাথে বন্ধ করেন না। কোনো না কোনো রাস্তা আল্লাহপাক ঠিক খোলা রাখেন।
—-বাবা আমি এখান থেকে চলে গিয়ে কোথায় দাঁড়াবো? আমার বাবা মায়ের সামর্থ নাই আমাকে দেখভাল করার।
—–তোমার বাকী দুই ভাইকে তো তোমার বাবা মা
দেখভাল করছেন? তোমাকে তেমনি উনারা দেখভাল করবেন।
—–ওরা ছেলে সন্তান। ওদেরকে কষ্ট করে দেখভাল করলেও আখেরে আমার বাবা মায়ের লাভ আছে। এটা আমার বাবা মায়ের ধারণা। আর আমি তো মেয়ে সন্তান। আমাকে দেখভাল করলে আমার লেখাপড়ার পিছনে টাকা খরচ করলে সেটা জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। তাদের ধারণা তাদের আমও যাবে ছালও যাবে। আমার তো এই বিয়েতে মত ছিলো না। বাবা মাকে কত বললাম আমি লেখাপড়াটা করি তারপর ও উনারা আমার বিয়ে দেন। কিন্তু আমি উনাদের কাছে এতটাই ভারী বোঝা ছিলাম যে উনাদের আর তর সইল না। কার ঘাড়ে বোঝাটা চাপিয়ে দিচ্ছে সে খেয়ালও করলো না। আমার ও কিছু বুঝে উঠার আগেই বিয়েটা হয়ে গেল। এতোটুকু মেয়ে ঐ বাড়িতে কি করে মানিয়ে নিবে এটা নিয়ে আব্বু আম্মুর ও কোনো চিন্তা চেতনা দেখলাম না। ভাবলাম দুঃখ দিয়ে যার জীবন মুড়িয়ে থাকে আর কতটা দুঃখ তাকে আঘাত করবে।
—-এতো ভেঙ্গে পড়ো না। শোনো তোমার জীবন তো কেবল শুরু। তুমি চাইলে আল্লাহর রহমতে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। ধরো তুমি যদি এখন তোমার বাবার বাড়ি চলে যাও এবং আর যদি ফিরে না আসো তাহলে রাসেল তোমাকে একসময় ডিভোর্স দিয়ে দিবে। এর মাঝে তুমি লেখাপড়াটা সুন্দরভাবে শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তোমার পছন্দমতো কাউকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিলে তখন তোমার কোনো কষ্ট থাকবে না।
—–সবই তো বুঝলাম বাবা। কিন্তু এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে অনেক অর্থের দরকার। সেই টাকাটা আমায় কে দিবে?
——আমি তোমায় দিবো। তোমার মতো একটা নিরপরাধ মেয়েকে আমার ছেলে এবং আমার পরিবারের সদস্যদ্বারা চরম নির্যাতন করলো। এতে আমারও দায়ভার আছে। আমি নিজেও ওদের পাপের অংশিদার । আমি আমার সন্তানদের সুশিক্ষা দিতে পারিনি। তোমার প্রতি এই দায়িত্বটুকু পালন করে আমি কিছুটা হলেও আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। তবে এই ব্যাপারটা
দুই পরিবারের কাছে গোপন থাকবে। তুমি কারো সাথে এসব বিষয় শেয়ার করবে না।
——আমার বাবা মা যদি ও বাড়িতে আমায় থাকতে না দেয়? আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করে পড়ালেখার খরচ কিভাবে যোগাড় করছি তখন আমি উনাদের কি বলবো?
—–তোমাকে একটা টিউশনি আমি ঢ়োগাড় করে দিবো। আর আমার মনে হয় না তোমার বাবা মা এতোটা নিষ্ঠুর হবেন। এখন তোমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা।
—–বাবা কাল আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ও বাড়ি চলে যাবো।
——ঠিক আছে। আমিও তোমার সাথে যাবো। কোনোদিন চলার পথে নিজেকে একা মনে করো না। বাবা বলে যেহেতু আমায় ডেকেছো আমার ছেলের সাথে তোমার সম্পর্ক থাক বা না থাক তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু আমাদের বাবা মেয়ের সম্পর্ক আজীবন রয়ে যাবে।
উনার কথাগুলো শুনে চোখের কার্ণিশটা জলে ডুবে টইটম্বুর। মনে হয় এতোদিন বরফ জমে ছিলো। আজ ভালবাসার উষ্ণছোয়ায় বরফটা গলে জলে পরিনত হলো। উনার সামনে চোখের জলের বড়বড় ফোঁটাগুলি ফেলতে চাইলাম না। তাই রাত হয়েছে শুয়ে পড়ার বাহানায় আমার ঘরে চলে আসলাম।

সে রাতে আমার দুচোখে ঘুম এলো না। নিজেকে এই বলে সান্তনা দিলাম আল্লাহপাক হয়ত এই মানুষটার সাথে আমার ভাগ্যকে বেঁধে দিয়েছেন তাই হয়ত আমাকে এভাবে এবাড়িতে আসতে হয়েছে। জন্মদাতা বাবা মা যখন আমার দায়িত্ব নিতে চাইলেন না তখন এই পৃথিবীর কারো উপরে আমার কোনো অভিযোগ নাই। পাশের খাটে রাসেল গভীর নিদ্রায় মগ্ন। জুতো পরে বিছানায় শুয়েছে। মাতাল অবস্থায় শরীরের টাল রাখতে পারেনি। আমি অনেকক্ষণ ওর মুখ পানে চেয়ে ভাবলাম দু মাস হলো এই মানুষটার সাথে এক ঘরে বাস করেছি। আমার নারী জীবনের সব কিছু ওর কাছে তুলে দিয়েছি। তারপরও আমি যখন ওকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম ওর জন্য আমার এতোটুকু কষ্ট হলো না। কোনো টান অনুভব করলাম না। বরং এই সম্পর্কটাকে ভারী বোঝার মতো মনে হলো। যত দ্রুত সম্ভব এই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে যেতে মন চাইছে। আসলে শরীর ছুলেই ভালবাসাকে ছোয়া যায় না। ভালবাসাকে ছুঁতে হলে মনটাকে ছুঁতে হয়।
পরদিন খুব ভোরে উঠে আমি ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। যেভাবে শুন্য হাতে বাবার বাড়ি থেকে এ বাড়িতে এসেছি তেমনি বাবার দেওয়া একজোড়া সোনার চুড়ি আর একজোড়া কানের দুল পরে নিলাম। আমার বাবার বাড়ি থেকে আনা একটা থ্রীপিছ পরে রেডী হয়ে শাশুড়ীর মায়ের ঘরে গিয়ে বললাম,
—-মা আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হতে যাচ্ছি। আমায় দোয়া করবেন।
আমার শাশুড়ী মা চিৎকার দিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে বললেন,
—-রাসেল তোমাকে অনুমতি দিয়েছে?
—-ওকে আমি জিজ্ঞাসা করিনি।
—–ভালো উন্নতি হয়েছে তোমার। স্বামীকেও এখন আর পরোয়া করো না।
এই কথা বলে চিৎকার করে রাসেলকে ডেকে বললো,
—–দেখ রাসেল ফকিন্নীর মেয়ে তোকে এখন আর স্বামী হিসাবে মানতে চায় না। তাই তোর কাছে অনুমতি নেওয়ারও এখন আর প্রয়োজন মনে করে না।
আমার শাশুড়ীর চিৎকার চেঁচামেঁচিতে আমার শ্বশুর এসে বললেন,
—–তুমি ষাঁড়ের মতো সাত সকালে চেঁচাচ্ছো কেন?এতে অনুমতি নেওয়ার কি আছে। রুহী ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। ভর্তি হবে। এটাই তো স্বাভাবিক।
রাসেল ওর মায়ের ডাকে দৌড়ে এসে আমায় বললো,

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে