আকাঙ্খিতো প্রণয় পর্ব-০৪

0
947

#ধারাবাহিকগল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী

রাতে খাবার টেবিলে আমার শাশুড়ি মা সোহেলকে বললো,
—–কিরে, কপালটা এভাবে আলুর মতো ফুলে উঠলো কেন?
——কারেন্ট চলে যাবার সময় অন্ধকারে ধাক্কা খেয়েছি।
আমার শ্বশুর খেতে খেতে সোহেলকে বললো,
—–আল্লাহ তো চোখ দিয়েছে। দেখে চলতে পারিস না। নাকি কোনো অকাম করতে গিয়েছিলি?
সোহেল রেগে খাওয়া থেকে উঠে বললো,
—–যার তার সামনে যা মুখে আসো তাই বলো। কোনো কিছু মুখে আটকায়না তোমার।
—–ভুল তো কিছু বলিনি। প্রতি পরীক্ষায় সাপ্লি খাও। পড়তো প্রাইভেট মেডিকেলে। কত টাকা খরচ হয় সে খেয়াল রাখো। অকামের সাথে জড়িত না থাকলে অন্তত তোমার রেজাল্ট ভালো হতো।
——কিছু হলেই বাবা তুমি টাকার খোঁটা দাও।
এই কথা বলে ও গটগট করে ওর রুমে গিয়ে জোরে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিলো।
আমার শাশুড়ি মা রেগে গিয়ে বললেন,
—— আমার ছেলের খাওয়া দিলে তো নষ্ট করে?এবার তুমি খুশী তো?
——শোনো রাসেলের মা সোহেলকে বলবে রুহীকে সম্মান করে কথা বলতে? ও কিন্তু সম্পর্কে বড় ভাইয়ের বউ। কথাটা যেন ও মনে রাখে। যার তার বলতে ও কি বুঝাতে চায়?
——তুমিও তো সোহেলকে অপমান করলে।
——বাবা হিসাবে শাসন করেছি এখানে অপমানটা কোথায় দেখলে? আসল অপমানতো ওকে এখনও করিনি।
সাবাও রেগে গিয়ে আমার শ্বশুরকে বললো,
——বাবা সম্মান পেতে গেলে যোগ্যতা লাগে। ওর কি যোগ্যতা আছে সম্মান পাওয়ার?
——যেদিন ও এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে সেদিন ওকে সম্মান দিয়ে তোমার ভাইয়ের বউ করে আনা হয়েছে।
——তুমি জানো না বাবা, ভাইয়া কেন ওকে বিয়ে করেছে? ফারাহ্ আপুর উপর প্রতিশোধ নিতে ওকে বিয়ে করেছে। ভাইয়া নিজেই তো ওকে পরিপূর্ণ স্ত্রীর মর্যাদা দেয়নি।
——রাসেল যদি রুহীকে স্ত্রীর মর্যাদা না দেয় তাহলে ও রুহীর উপর অন্যায় করেছে। কারণ ও রুহীকে নিজে দেখে পছন্দ করে বিয়ে করেছে। ওতো কচি খোকা নয়। কেউ ওকে এই বিয়ে চাপিয়ে দেয়নি। আর ফারাহ তো নিজের পছন্দের পাত্রকেই বিয়ে করেছে। এতে রাসেলের এতো ব্যথিত হবার কি আছে?
—–কিন্তু ফারাহ্ আপুর সাথে ভাইয়ার চার বছরের রিলেশন ছিলো। আর বিয়ে করলো অন্য একজনকে। সেই শোধ নিতেই ভাইয়া ভাবিকে বিয়ে করেছে।
——রুহীর সাথে রাসেল অন্যায় করছে বলে তোমরা সেই অন্যায়ের প্রতিকার না করে আর একটা অন্যায় করে যাবে এটা কি ঠিক? তবে এটা জেনে রাখো কারো উপরে অন্যায় করলে সেই শাস্তি দুনিয়াতে বেঁচে থেকেই পেতে হয়।
তারপর আমার শ্বশুর শাশুড়ী মায়ের উপর রাগ ঝেড়ে বললেন,
—–আমি না হয় হাসপাতালে ডিউটি করি। তারপর চেম্বার করি। কিন্তু তুমি বাসায় থেকে ছেলেমেয়েদের কি শিক্ষা দিয়েছো? এই এদের শিক্ষার নমুনা। এদের কথাবার্তা শুনলে পিত্তি জ্বলে যায়। রাত এগারোটা বাজে। তোমার গুনধর বড় সন্তান এখনও বাসায় ফিরেনি। কোথায় যায় কি করে খোঁজ খবর রাখো কিছু। নাকি নাকে তেল দিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমাও।

আমার শাশুড়ী মা আর কথা বাড়ালেন না। আমার গলা দিয়ে খাবার নামলো না শুধু শাশুড়ী মায়ের সামনে খাবার নাড়াচাড়া করে উঠে পড়লাম। উনিও অল্প কিছু ভাত খেয়ে উঠে পড়লেন। উনার ভাব দেখে এটুকু বুঝেছি উনি আমার উপর প্রচন্ড রেগে আছেন। ঝড়ের আগে যেমন প্রকৃতি গুম মেরে থাকে অনেকটা সেরকম।

আমি নিজের রুমে এসে জেগে বসে থাকলাম। রাসেল এখনোও ফেরেনি। আজকে আমার উপর করা সোহেলের নোংরা আচরণ আমাকে ভীষণ আহত করেছে। শুধু বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি এখনও এ বাড়িতে রয়ে গেছি। মাঝে মাঝে মানুষের জীবন সময়ের হাতে বন্দী থেকে যায়। কিছুই যেন করার থাকে না। বাবামায়ের ভুল ধারণা আমি কিভাবে ভাঙ্গাবো ভেবে পাই না। উনারা ভাবছেন এতো বড় বাড়িতে আমার বিয়ে হয়েছে, মেয়ের জামাই বড় চাকরি করে, আয় রোজগার ভালো করে সুতরাং তাদের মেয়ের তো মহা সুখে থাকার কথা। এ বাড়িতে না আসলে বুঝতাম না প্রকৃত সুখটা আসলে কি? আমার এখন মনে হয় এর থেকে বিয়ের আগে আমি বেশি সুখে ছিলাম। হয়ত অনেক অভাব ছিলো কিন্তু মনে শান্তি ছিলো। এখন অভাব নেই কিন্তু শান্তিটা চিরজনমের মতো হারিয়ে গেছে। সোহেলকে নিয়ে নতুন এক অশান্তির পালক আমার জীবনের সাথে যুক্ত হলো। এ বাড়িতে সোহেলের প্রসঙ্গটা কিভাবে বলবো সেটাও বুঝে পাই না। ভয় হয় বলতে গেলে যদি আমার উপর কলঙ্ক চাপিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয় তাহলে এই মুখ আমি সমাজে কিভাবে দেখাবো? আর বসে থাকতে পারলাম না। এতো অপমানও নিতে পারছি না। অপমানের ভারে শরীরটা ভরশুন্য হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। দুচোখ দিয়ে শ্রাবনের তুমুল বর্ষণে আমার চোখ মুখ গলা সমস্ত শরীর বেয়ে কষ্টের স্রোত বয়ে গেল। কলিং বেলের শব্দে অবসন্ন দেহটাকে টেনে মাটিতে ভর দিয়ে বসালাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত বারোটা বাজে। মনে হয় রাসেল এসেছে। তারপর কোনরকমে উঠে দাঁড়িয়ে মেইন দরজাটা খুলে দিলাম।

রাসেলকে টলতে টলতে ঘরে ঢুকতে দেখলাম। আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই আমার শ্বশুর লিভিংরুম থেকে বের হয়ে এসে বললো,
—–রাসেল তোমার অফিস কি আজকাল মাঝরাত অব্দি চলে।
—–সারাদিন অফিস করে এই মাঝরাত্রিতে কৈফিয়ত দিতে ভাল লাগে না।
——তা লাগবে কেন? তোমার শরীর থেকে মদের উৎকট গন্ধ বের হচ্ছে। অধঃপতনের চুড়ান্ত সীমায় চলে গেছো। কথায় আছে “অতি বড় হইয়োও না ঝড়ে পড়ে রবে,
অতি ছোটো হইও না ছাগলে মুরোবে”। নিজেকে কি ভাবো তুমি? খুব কেউকেটা হয়েছো মনে হয়? সাবধান হয়ে যাও। নয়তো তোমার ধ্বংস অনিবার্য।

রাসেল গটগট করে সামনে থেকে চলে গেল। আমার শ্বশুর আমাকে লিভিংরুমে ডেকে নিয়ে বললো,
—–রুহী, আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই। তুমি আমার ছেলের বউ হলেও আমি তোমাকে আমার মেয়ের চোখে দেখি। বিয়ের পর থেকে তুমি প্রতিনিয়ত এ বাড়িতে অপমানিত হচ্ছো।তার উপর আমি ভেবেছিলাম রাসেল যেহেতু তোমাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে সুতরাং ও হয়তো সব কিছু নতুন করে শুরু করতে চায়। কিন্তু ও যে ফারাহ্ উপর শোধ তুলতে তোমাকে বিয়ে করেছে এ আমি ঘুর্ণাক্ষরে ভাবতে পারিনি। এই মতলব যদি আমি বুঝতে পারতাম তাহলে কিছুতেই ওকে বিয়ে দিতাম না। আর আজকে সোহেল তোমাকে যে অসম্মান করলো ওকে আমার সন্তানের পরিচয় দিতে ঘৃণা হচ্ছে। তুমি আমাকে মাফ করে দিও মা।
আমি শকড হয়ে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম,উনি কি সোহেলের আচরণটা জানতে পেরেছেন? কিন্তু কিভাবে জানবেন? আমি তো এখনও কারো কাছে কিছু বলিনি। আমার শকড খাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে বললেন,
——তুমি ভাবছো, আমি একথা কেন বলছি? তাই না। সোহেল যখন কিচেনে তোমাকে বলছিলো তোমার এমন হাল করবে এই মুখ তুমি কাউকে দেখাতে পারবে না, তখনি আমি বুঝে গিয়েছি ও তোমার সাথে কি আচরণ করেছে। তোমাকে চায়ের কথা বলতে আমি তখন কিচেনে আসছিলাম। সেই মুহুর্তে এই কথাগুলো আমার কানে এসেছে। আমার সন্তানদের আমি ভালো করে চিনি। মাসাবা ছাড়া সবগুলোই হয়েছে একেকটা নর্দমার কীট। শুধু তোমার শাশুড়ীর প্রশ্রয় পেয়ে ওদের আজ এই অধঃপতন। অবশ্য তোমার শাশুড়ীকে একা দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। বাবা হিসাবে আমাকেও এর দায়ভার বহন করতে হবে। আমি শুধু অর্থের পিছনে ছুটেছি। অর্থ আমার ঘরে এসেছে কিন্তু আমার ঘর থেকে নীতি আদর্শ হারিয়ে গেছে। হাড়ে হাড়ে আজ বুঝতে পেরেছি “অর্থই সব অনর্থের মূল”।

শ্বশুরের কথা শুনে বড় বড় ফোঁটায় আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আমার শ্বশুর আমাকে কাঁদতে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
——কেঁদোনা মা, কান্না কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে না। তুমি তোমার জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করতে পারো।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে