#ধারাবাহিকগল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী
—–তোমার এতো বড় সাহস হয় কি করে? আমার বোনের নামে অভিযোগ করার? নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেছো। তোমার পিছনদিকটা দেখলে মনে হয় দুই বাচ্চার মা। আর এতে মন খারাপ করার কি আছে? যে যেমন ক্যাটাগরি তাকে সেভাবেই সম্বোধন করা হয়েছে। লাইট অফ করো,আমি এখন ঘুমাবো।
আমি দেখতে সুন্দরী কিন্তু একটু হেলদি। রাসেল আমার স্বাস্থ্য নিয়ে আমাকে কটাক্ষ করলো।আসলেই আমার রাসেলের উপর এতো ভরসা রাখা ঠিক হয়নি। ওর কাছে আমার জায়গা তো ওর জুতোর তলায়। তারপরও ভেবেছিলাম সাবার বন্ধুর আমার প্রতি নোংরা কটুক্তি কিছুটা হলেও রাসেলকে নাড়া দিবে। আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমানিতো হলো। আজ থেকে শপথ নিলাম জীবনে আর কখনও কোনদিন আমি রাসেলের কাছে কোনো কিছু আশা করবো না। আমিও আর আমাকে কারো হাতের পুতুল হতে দিবো না। বাইরে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়েছে। বাতাসের গতির শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। মেঘের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে। একটু পরেই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামলো। আমিও যদি মেঘের হুঙ্কারের মতো আমার ক্ষোভ গুলো চিৎকার করে বের করতে পারতাম হয়ত আমার ভিতরের বজ্রপাতের জ্বালাটা নিভে যেতো। তখন হয়তো আমার বুকের অনলটা শীতল হয়ে পড়তো। আমাকে রাসেল আবারও ধমকের সুরে ডেকে বললো,
——কি ব্যাপার খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? রাত দুপুরে নাটক না করে বিছানায় শুয়ে পড়ো।
আমার ওর পাশে শুয়ে ঘুমানোর রুচিবোধ নাই। বিয়ের পর থেকে প্রতি রাতে ওর শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়। তারপরও মানসিকভাবে আবার অত্যাচার করে। আর নয় অনেক হয়েছে। যার কাছে মানুষ হিসাবে আমার কোনো মুল্যায়ন হয় না তার হাতে নিজের শরীরকে তুলে দিয়ে অসম্মানের দহনে জ্বলতে চাই না। আমি একটা কাঁথা নিয়ে মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে পড়লাম। রাসেল রেগে গিয়ে বললো,
—–তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিলাম এর মধ্যে বিছানায় না আসলে মনে রেখো, নিজে থেকে যেহেতু বিছানা আলাদা করলে কখনও আমার পাশে শুয়ে ঘুমানোর আশা করবে না।
আমার উনার কথার উত্তর দিবার কোনো অভিপ্রায় হলো না। জানি, চোখে ঘুম আসবে না। তবুও কিছুটা ভালো লাগা নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। আমি যে আমার মতো করে প্রতিবাদ করতে পেরেছি এখানেই আমার এতো অশান্তির মাঝে একটু হলেও শান্তি অনুভব করলাম।
বিয়ের মাসখানেক সময় পার হলো। আমার রেজাল্ট দিয়ে দিলো। আমি প্রথমবিভাগে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাশ করলাম। সেদিন দুপুরে খাবার টেবিলে শাশুড়ী মাকে বললাম,
—–মা আমি পড়তে চাই। ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিবো।
——তোমার বাবা মায়ের কাছে পড়ানোর চুক্তি দিয়ে তোমাকে বউ করে আনা হয়নি। তুমি আবার পড়াশোনা শুরু করলে সংসারের সব দায় দায়িত্ব সামলাবে কে?
——মা রান্নার লোক রেখে দিলেই সমস্যা সলভ হয়ে যায়।
রাসেল রেগে গিয়ে বললো,
——তোমার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কি আমার মায়ের সংসার চলবে? মা যখন চাইছে না সুতরাং তোমার পড়াশোনা করার দরকার কি?
আমার শ্বশুর রাসেলকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
—–রাসেল তুমি মাথা গরম করে কথা বলছো কেন? রুহি তো অন্যায় কিছু বলেনি। ও পড়তে চেয়েছে। এটাতো আমাদের এপ্রিশিয়েট করা উচিত। সংসার সামলিয়ে ও যদি পড়তে পারে তাতে কারো সমস্যা হওয়ার কথা না।
আমার ননদ সাবা বললো,
——পড়শোনা করে আর কি হবে? তুমি তো চাকরি করছো না। শুধু শুধু তোমার পিছনে এতো ইনভেস্ট করার কোনো মানে নেই।
——আমি তো চাকরিও করতে পারি। মানুষের মন কখন কি চায় হয়তো ঐ মুহুর্তে জানা হয় না। কিন্তু লেখাপড়ার ডিগ্রী থাকলে আমার মন চাইলে ভবিষ্যতে আমি চাকরীও করতে পারি।
মাসাবা বিরক্ত হয়ে বললো,
——তোমরা সবাই এই সাধারণ ব্যাপারটাকে টেনে হিঁচড়ে নর্দমায় কেন নামাচ্ছো। ভাবি ভালো রেজাল্ট করেছে। আবারও পড়তে চাওয়াতো দোষের কিছু নয়। বাবা যখন মত দিয়েছে সেখানে কারো দ্বিমত থাকা উচিত নয়।
——তবে আমার শেষ কথা জানিয়ে দিচ্ছি আমার এতে কোনো মত নেই। বাবা পড়াতে চাইলে পড়াতে পারে।
এ কথা বলে রাসেল খাওয়া থেকে উঠে পড়লো।
আমার শাশুড়ী মা এতে আমার উপর রেগে গিয়ে বললেন,
—–দিলে তো আমার ছেলের খাওয়াটা বরবাদ করে? ও যখন চাইছে না কেন ঝামেলা পাকাচ্ছো। বিয়ে হয়ে গেছে। এখন তোমার স্বামীর মন বুঝে চলা উচিত। স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত। কথাটা মনে রেখো।
——মা,এই কথাটা কোথায় লেখা আছে। শুধু একটা ভ্রান্ত কথা বলছেন যার কোনো ভিত্তি নাই। এই পৃথিবীতে শুধু মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশত। এটাই আমাদের ধর্মে বলা আছে।
——-মুখে মুখে ভালই তর্ক করো। তোমার মা এই শিক্ষাটা ভালো মত দিয়েছেন। বিয়ের মাসখানিক পার হতে না হতেই মুখ দিয়ে তর্কের খই ফুটছে।
কথায় কথা বাড়ে। আমার শ্বশুর যেহেতু আমাকে পড়াতে রাজি হয়েছেন তাই আর কথা না বাড়িয়ে এঁটো বাসন তুলে কিচেনে চলে গেলাম।
যাক অবশেষে ইতিহাসে ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেলাম। শ্বশুর খুব খুশী। রাসেল শুধু ঢাকা ভার্সিটিতে আইবিএ পড়েছে। আমি আবার চান্স পেলাম। মাঝখানে আমার ননদ আর দেবর দুজনেই প্রাইভেটে পড়ছে। ঐ সময় ঐ দুটো প্রাইভেট ভার্সিটিতে খরচের মাত্রাটা সবার কাছে অনেক বেশী মনে হতো। এখন চারিদিকে এতো প্রাইভেট ভার্সিটি থাকায় খরচটা সবার সয়ে গেছে। তাই আমি পাবলিকে চান্স পাওয়াতে আমার শ্বশুর খুব খুশী।
রাসেল আমার উপর আরোও চটে গেল। ওর ধারণা ছিলো আমি হয়তো হার মেনে আবার ওর সাথে স্বামী স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখবো। এতো কিছুর পরও আমি আবার লেখাপড়া শুরু করেছি। এটা ও মেনে নিতে পারছে না। আমরা যে একরুমে থেকে দুজন আলাদা শুই এটা মনে হয় আমার শাশুড়ী আন্দাজ করেছে। রাসেল এখন বেশ রাত করে বাড়ী ফেরে।
আমার শ্বশুর শাশুড়ীকে ডেকে বললো,
——ছেলে যে উচ্ছনে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল আছে তোমার?
——-ছেলে যদি নষ্ট হয় এই দায়ভার তোমার। ছেলের অমতে গিয়ে বউকে আবার লেখাপড়া করানোর তোমার কি দরকার ছিলো?
এর মাঝে একদিন রাতে আমি কিচেনে রান্না করছিলাম। হঠাৎ কারেন্ট চলে যায়। তখন মনে হলো কেউ একজন আমাকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম জড়িয়ে ধরা ব্যক্তিটি আমার স্বামী। কিন্তু শরীরের গন্ধে বুঝতে পারলাম ও আমার স্বামী নয়। আমাদের দুজনের ধস্তধস্তিতে এক সময় কারেন্ট চলে আসে। আমি তাকিয়ে দেখি ঐ নিকৃষ্ট শয়তানটা হলো আমার দেবর। আমার মাথার চাঁদিটা এমন গরম হলো ওকে কষে থাপ্পড় লাগালাম। ও আমার থাপ্পড়ে তাল রাখতে না পেরে কিচেনের ওয়ালে ধাক্কা খায়। এতে ওর কপালটা ফুলে উঠে। আসলে গরীবের হাত বলে কথা। কাজ করতে করতে হাত আর নরম তুলতুলে নেই। এ যেন লোহার মুগুরে পরিনত হয়েছে। সোহেল কিচেন থেকে বের হওয়ার সময় আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি বর্ষণ করে বললো,
——কাজটা তুই ঠিক করলি না। এর প্রতিশোধ আমি নিবো। তোর এমন হাল করবো এ সমাজে কোথাও মুখ দেখাতে পারবি না।
চলবে