অহেতুক অমাবস্যা – শেষ পর্ব (উত্তর)

0
2503

#অহেতুক_অমাবস্যা
শেষ পর্ব (উত্তর)
লেখা : শঙ্খিনী

বাসা খুঁজে পাওয়া নিয়ে বেশ ভালো ঝামেলাতেই পড়তে হয়েছে জাহানারাকে। গত তিন সপ্তাহ ধরে চলছে বাসা খোঁজা কার্যক্রম। সাধারনত ফ্ল্যাট বাড়ির টু-লেট সমন্ধে যাবতীয় তথ্য থাকে বাড়ির দারোয়ানের কাছে। প্রায় বেশির ভাগ বাড়িতেই যখন জাহানারা খোঁজ নিতে গেছে, দারোয়ান শুকনো গলায় বলেছে, “ভাড়া হয়ে গেছে আপা।”

এই কথার একটাই অর্থ – আপনি মেয়ে মানুষ, আপনাকে বাড়ি ভাড়া দেওয়া যাবে না। জাহানারার কঠিন গলায় বলতে ইচ্ছা হয়েছে, “ভাড়া যদি হয়েই থাকে তাহলে টু-লেট লেখাটা টানিয়ে রেখেছেন কেন?”। কিন্তু বলতে পারেনি। বলার প্রয়োজনও বোধ হয় নেই। দারোয়ান শ্রেণীর মানুষ, এদের সঙ্গে এত কথা কীসের!

খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে পাওয়া গেল এক মেস, মেয়েদের মেস। বেশির ভাগ মেয়েই চাকরিজীবী। ভাড়াটাও সাধ্যের মধ্যে। সবথেকে ভালো ব্যাপার কষ্ট করে রান্না করতে হবে না, রান্নার জন্যে আছে মেসের বুয়া। তবে সেখানে আর ওঠে হলো না। ন’শ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে থাকে এগার জন। জাহানারা গেলে হবে বারো। একটা পিঁপড়া পর্যন্ত দাঁড়াতে পারবে না। অমন গাদাগাদি অবস্থায় থাকা যায়!

গত সপ্তাহে আবার অর্থ এক বাড়ির খোঁজ নিয়ে এলো। ঢাকা থেকে একটু দূরে, গাবতলীতে। তিন তলায় বিশাল ফ্ল্যাট, আলো বাতাসের কোনো কমতি নেই। একদিন দু’জনে গিয়ে ফ্ল্যাটটা দেখেও এলো। কিন্তু হঠাৎ জাহানারা জানতে পারে, বাসা ভাড়া চল্লিশ হাজার! কোনো মানে হয়? জাহানারা যখন চাকরি করতো তখনই বেতন এত ছিল না। আর এখন তো প্রায় বেকার মানুষ!

এত বড়ো একটা শহর, অথচ মেয়েটার থাকার মতো কোনো জায়গা নেই। বাড়িওয়ালীর কাছ থেকে আরও একটা মাস সময় চেয়ে নেওয়া হয়েছে। যদিও জাহানারা খুব ভালো করে জানে, এতে কোনো লাভই হবে না।

আজ জীবনের অনেক বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে জাহানারা। নিতে যাচ্ছে বললে ভুল হবে, নিয়ে ফেলেছে। লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন করল নারায়ণগঞ্জের ছোটো মামাকে। ছোটো মামা মানুষটা ভালো। বড়ো মামার মতো টাকাপয়সা নেই তাই অহংকারও নেই।

মামা প্রথমবারে ফোন তুললেন না। তুললেন দ্বিতীয়বারে।

আন্তরিক গলায় বললেন, “জাহানারা? ফোনটা ধরতে যাবো, তখনই কেটে গেছে। কেমন আছিস রে মা?”
“ভালো আছি মামা। তোমরা কেমন আছো? শান্তি-বীন্তি কেমন আছে?”
“সবাই ভালো আছে, সবাই ভালো আছে।”
“মামা, আমি না একটা সমস্যায় পড়ে তোমাকে ফোন করেছি।”
“কী সমস্যা মা?”
“আমার বাড়িওয়ালী সামনের মাসের মধ্যে বাসা ছেড়ে দিতে বলেছে।”
“সে কী, কেন? তার জিনিসপত্রের কোনো ক্ষতি-টতি করেছিস? পানির কল ভেঙেছিস না-কি?”
“মামা কী যে বলো, পানির কল ভাঙতে যাবো কেন? আমি কি ছোট বাচ্চা? আর তাছাড়া একটা কল ভাঙার অপরাধে কেউ ভাড়াটিয়া উঠিয়ে দেয়?”
“তাহলে কী হয়েছিল?”
“আছে, কারণ আছে। সেসব জেনে আর কী করবে? তার’চে বরং আসল সমস্যার কথা শোনো। গত এক মাস খোঁজাখুঁজি করেও কোনো সুবিধামত কোনো বাসা পাইনি আমি। ধানমন্ডি, বাড্ডা, মিরপুর কোনো এলাকা বাদ রাখিনি, তন্ন-তন্ন করে খুঁজেছি। তাও পাইনি।”
“এখন তাহলে কী করবি?”
“বাড়ি চলে যাবো।”
“বাড়ি চলে আসবি? তাহলে তোর চাকরি?”
জাহানারা প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, “চাকরিটা আর নেই মামা।”
“সর্বনাশ!”
জাহানারা কঠিন গলায় বলল, “সর্বনাশের কিছু নেই মামা। চাকরি গেছে, আবার পেয়ে যাবো। থাকার জায়গা গেছে, কিন্তু নতুন জায়গা পাচ্ছি না। তাই আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি। তোমাদের কোনো অসুবিধা নেই তো?”

তাদের কোনো অসুবিধা থাকেলও জাহানারার কিছু আসে যায় না। নারায়ণগঞ্জে দশ কাঠা জমির ওপর তার নানাজানের বিশাল বাড়ি। নানাজান মৃত্যুর আগে ওই বাড়ির ছোটো একটা অংশ জাহানারার নামে লিখে দিয়ে গেছেন। জাহানারা নিজের বাড়িতে, নিজের জায়গায় থাকবে।

“কোনো অসুবিধা নেই, তুই কবে আসছিস?”
“সামনের সপ্তাহে?”
“মা-রে, আরেকটাবার ভেবে দেখবি না-কি?”
“ভেবে দেখার মতো আর কিছু নেই মামা।”

ফোন রেখে জাহানারা লক্ষ করল, তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। তবে কি তার কষ্ট হচ্ছে? কীসের কষ্ট? শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জাহানারা নিজে থেকে নিয়েছে। তবুও কি এই অতি চেনা শহর ছেড়ে যাবে বলে কষ্ট হচ্ছে তার? না-কি কষ্ট হচ্ছে ভিন্ন কারণে। এখন তো আর চাইলেই অর্থের সঙ্গে দেখা করা যাবে না। ভরদুপুরে ওর অফিসে হাজির হওয়া যাবে না।

জাহানারার খুব ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে অর্থকে ফোন করে বলতে, “শুনুন, বাসা না পেয়ে আমি ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমাকে ভুলে যাবেন না কিন্তু। আমি প্রতি শুক্রবার ঢাকায় আসবো, চাকরি খুঁজতে। আপনি কি থাকবেন আমার সঙ্গে?”

বেতের সোফার সেট, দু’টো আলমারি, ডাইনিং টেবিল, চুলা আর বুকশেলফ – সবমিলিয়ে তেইশ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। সমস্যা হয়েছে খাট দু’টো নিয়ে। পুরনো ধরনের খাট বলে কেউ কিনতে চাচ্ছে না। জাহানারা ধরে নিয়েছে, শেষ পর্যন্ত এই খাট দু’টোকে এখানেই ফেলে যেতে হবে।

জাহানারার মন খারাপ, শুধু খারাপ বললে ভুল হবে। ভয়াবহ ধরনের খারাপ। যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি ঠিকই নিচ্ছে, তবে মনটা এখানেই পড়ে আছে। চলে যেতে মন চাইছে না, আবার এছাড়া কোনো উপায়ও নেই। এক অদৃশ্য কষ্ট আষ্টেপৃষ্টে ধরে রেখেছে তাকে।

অর্থও কষ্ট পেয়েছে। জাহানারা চলে যাচ্ছে বলে কষ্ট নয়, যাওয়ার আগের দিন জানিয়েছে বলে কষ্ট। এইতো, কিছুক্ষণ আগেই অর্থের সঙ্গে কথা হয়েছে।

অর্থ ফোন তুলে স্বাভাবিক গলায় বলল, “কেমন আছো জাহানারা?”
“আছি! আপনি কেমন আছেন?”
“ভালো আছি তবে কাজের প্রচুর চাপ।”
“আপনাকে একটা কথা জানাবো বলে ফোন করলাম।”
“কী কথা?”
“আমি চলে যাচ্ছি অর্থ।”
“কোথায় চলে যাচ্ছ?”
“আমার গ্রামের বাড়িতে। শেষ পর্যন্ত তো আর কোনো বাসা পেলাম না। তাই…”

অর্থ অনেক্ষণ চুপ করে রইলো।

অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, “কবে যাচ্ছো?”
“কাল।”
অর্থ হতভম্ব হয়ে বলল, “কাল?”
জাহানারা চুপ করে রইলো।
“চলে যাবে কবে ঠিক করেছো?”
“গত সপ্তাহে।”
অর্থ আহত গলায় বলল, “আর আমি আজ জানতে পারছি? কেন?”

এই কেন’র উত্তর জাহানারার জানা নেই। অনেক আগেই এই খবর তাকে দিতে চেয়েছিল। একবার তো নম্বর ডায়ালও করে ফেলেছিল। তবুও বলতে পারেনি, গলা পর্যন্ত কান্না চলে এসেছিল তার। আজও বহুকষ্টে নিজেকে সামলে কথা বলতে হচ্ছে।

জাহানারা বলল, “অর্থ, আপনি তো কোনদিন আমার বাসায় আসেননি। আজ একবার অফিস থেকে ফেরার পথে আসবেন?”
“এখনি আসছি।”

জাহানারার খুব ইচ্ছে ছিল ঘর-টর সুন্দর করে গুছিয়ে, রান্নাবান্নার আয়োজন করে একদিন অর্থকে বাসায় ডাকা। অথচ আজ এমন একটা দিনেই ডাকতে হলো! পুরো ঘর অগোছালো হয়ে পড়ে আছে। চট করে কিছু একটা রান্না করে ফেলবে, সেই সুযোগও নেই।কিছুক্ষণ আগেই চুলাটা নিয়ে গেছে। ভাগ্যিস সোফার সেটটা এখনো নিয়ে যায়নি। না হলে মানুষটা এসে বসতো কোথায়? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলতে হতো তাকে।

কলিংবেলের শব্দ পেয়ে জাহানারা দরজা খুলতে এগিয়ে গেল। অর্থের চোখ-মুখ অসম্ভব ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে। তবুও জাহানারাকে দেখে কিছুটা হাসতে চেষ্টা করলো।

অর্থ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “বাহ্, সব গুছিয়ে ফেলেছো?”
“ওই একা একা যতটুকু পারি। আপনি বসুন!”

অর্থ বসল। জাহানারাও তার মুখোমুখি থাকা সোফাটায় বসে পড়ল।

অর্থ বলল, “কখন যাচ্ছো কাল?”
“সকাল সকালই চলে যাবো।”
“একা একা?”
“হ্যাঁ, একা একা।”
“পারবে?”
“পারবো।”
“কষ্ট হবে না?”
“হ্যাঁ?”
“এত চেনা একটা জায়গা ছেড়ে চলে যেতে কষ্ট হবে না?”
যথাসম্ভব গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে জাহানারা বলল, “না, কষ্ট হবে কেন?”
“সত্যি?”
“সত্যি।”
“সত্যি না জাহানারা। তোমার ভয়ংকর কষ্ট হচ্ছে, তোমার চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।”
জাহানারা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “কষ্ট কি আবার চোখে দেখা যায় না-কি?”
“চাইলেই যায়। তুমি খেয়াল করে দেখো তো, আমার চোখে কোনো কষ্ট দেখতে পাচ্ছো কি-না!”

জাহনারা নির্বিকার ভঙ্গিতে অর্থের চোখের দিকে তাকালো। তার চোখ দু’টো ছলছল করছে, প্রবল কষ্ট তার মধ্যে। জাহানারা আর বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না।

“পেলে?”
জাহানারা হাসল।
“আমি কিন্তু সিরিয়াস। বলো, পেয়েছো?”
জাহানারা এবারও চুপ করে রইলো।
“আমি জানি পেয়েছো। আমাকে এই কষ্ট থেকে মুক্ত করতে পারবে জাহানারা?”
“হুঁ?”
বেশ অনেক্ষণ চুপ করে থেকে অর্থ বলল, “বিয়ে করবে আমাকে?”

অর্থের আকস্মিক এই প্রশ্নে স্তম্ভিত হয়ে রইল জাহানারা। এর আগে যতবার নিজের বিয়ের কথা শুনেছে, ততবারই মনের মধ্যে দিয়ে এক
অদৃশ্য ঝর বয়ে গেছে। আজও বইছে, তবে এই ঝরের জাত ভিন্ন। আগের ঝরগুলোর সাথে এর কোনো মিল নেই।

জাহানারা অস্পষ্ট গলায় বলল, “দয়া করছেন?”
অর্থ না-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “ভালোবাসছি।”

এই কথাটায় আরও বেশি স্তম্ভিত হয়ে উঠলো জাহানারা। আনন্দ হচ্ছে, অসম্ভব আনন্দ হচ্ছে তার। এই আনন্দের কোনো সীমা না। জাহানারার চোখ বেয়ে টপটপ করে জল বেয়ে পড়ছে। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্থের দিকে।

একপর্যায়ে নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ালো জাহানারা। ছোট ছোট পা ফেলে গিয়ে বসলো অর্থের পাশে।

অনিশ্চিত গলায় বলল, “আপনার হাতটা একটু ধরতে পারি?”

অর্থ সঙ্গে সঙ্গে জাহানারার ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। পুরো ব্যাপারটাকে একটা স্বপ্নদৃশ্য বলে মনে হচ্ছে জাহানারার কাছে। জীবনে একবারের জন্যে হলেও মানুষটাকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করেছে তার। বহুবার সেই সুযোগ খুঁজেও পায়নি জাহানারা, আজ পাচ্ছে।

অর্থ বলল, “একটা প্রশ্ন করেছিলাম বোধ হয়। উত্তরটা এখনও পাইনি।”
জাহানারা হেসে বলল, “এই যে হাতটা ধরেছেন, এটাই আপনার উত্তর।”

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে