18.8 C
New York
Sunday, October 5, 2025

Buy now







অহেতুক অমাবস্যা – পর্ব – ৭ (সমাজের পক্ষে হানিকারক)

#অহেতুক_অমাবস্যা
পর্ব – ৭ (সমাজের পক্ষে হানিকারক)
লেখা : শঙ্খিনী

খুব ছোটবেলায় বাবা জাহানারাকে বলতেন, “তোর ভাবসাব এমন, যেন ভাজা মাছটা উল্টাতে পারিস না!”। জাহানারা আসলেই ভাজা মাছ উল্টাতে পারে না। উল্টাতে গেলেই মাছটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যায়।

জাহানারা খুব সাবধানে মাছ উল্টাতে চেষ্টা করলো। লাভের লাভ কিছুই হলো না, আজও মাছ তিন টুকরো হয়ে ভেঙে গেল। বছরের পর বছর ধরে এমন তিন টুকরো মাছই খেয়ে আসতে হচ্ছে তাকে।

জাহানারা ঠিক করে রেখেছে বিয়ের পরদিনই তার স্বামীকে বলবে, “শোনো, আমি কিন্তু মাছ ভাজতে পারি না। তোমার কাছে দুটো উপায় আছে। হয় আমার হাতের ভাঙা মাছ খাবে, নাহলে নিজে মাছ ভাজবে।”। মানুষটা যদি ভালো করে মাছ ভাজতে পারে, তাহলে তো হয়েই গেল।

কেউ একজন অনবরত দরজায় কড়া নাড়ছে। কলিংবেলটা চোখে পড়ে না না-কি? যতক্ষণ ইচ্ছে করে, কড়া নাড়ুক! কলিংবেল চাপা না পর্যন্ত জাহানারা দরজা খুলতে যাবে না।

অবশেষে বাইরে থাকা মানুষটাকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই কলিংবেলে চাপ দিতে হলো। জাহানারা চুলা বন্ধ করে রেখে এগিয়ে গেল দরজা খুলতে।

বাড়িওয়ালী শামীমা বেগম এসেছেন। দরজা খুলতেই জাহানারা দেখতে পেলো তার মুখভর্তি হাসি। সাধারনত মানুষের মুখে হাসি দেখতে সবসময় ভালোই লাগে, নিজের ঠোঁটেও খানিকটা হাসির আভাস ফুটে ওঠে। তবে ওনার হাসি দেখে মোটেও ভালো লাগছে না, বরং বিরক্ত লাগছে। পান খেয়ে দাঁতগুলো রং একদম লাল করে ফেলেছেন। কী বিশ্রী একটা ব্যাপার!

শামীমা বেগম আন্তরিক গলায় বললেন, “ভালো আছো জাহানারা?”

জাহানারা খানিকটা চমকে উঠলো। এই প্রথম তাকে দেখে শামীমা বেগম বললেন না, “ভালো আছে জামিলা?”। এর মানে কী? ব্যাপারটা এতদিন তিনি ইচ্ছা করেই করতেন?

“খালা ভেতরে আসুন!”
“শোনো মা, বেশিক্ষণ বসতে পারবো না কিন্তু। আমার আবার আজ দুপুরে দাওয়াত আছে।”
“সে ঠিক আছে, কিন্তু চা খাবেন তো?”
“এইমাত্র চা খেয়ে এসেছি। আমার বড়ো ভাই গতমাসে গিয়েছিল দার্জিলিংয়ে। সেখানকার ফ্রেশ চা পাতার চা!”

চা খেয়ে এসেছিস ভালো কথা, তাই বলে চা পাতার ইতিহাস বলতে হবে! অসহ্যকর!

শামীমা বেগম বললেন, “তুমি একটু আমার পাশে বসো তো, জরুরী কথা আছে।”
জাহানারা বসতে বসতে বলল, “কী জরুরী কথা?”
“কীভাবে যে বলি, ঠিক বুঝতে পারছি না।”
“যেভাবে ইচ্ছে বলুন। আমার কোনো সমস্যা নেই।”
“দেখো মা, আমরা তো একটা সমাজে বাস করি তাই না?”
“হুঁ।”
“সমাজের নিজস্ব কিছু নিয়ম-কানুন আছে। আছে না?”
“আছে।”
“আমি আর সামিনের আব্বা যখন তোমাকে এই বাসাটা ভাড়া দিয়েছিলাম, তখন তোমরা ছিলে একটা পরিবার। কিন্তু এখন তুমি একা। একা একটা মেয়েকে বাসা ভাড়া দেওয়াটা… বুঝতেই তো পারছো। এমনিতে আমরা তোমাকে বিশ্বাস করি, তুমি খুব লক্ষ্মী একটা মেয়ে। কিন্তু তারপরেও, চারিদিকে কত রকমের ঘটনা ঘটে। সংবাদে প্রায়ই দুঃসংবাদ শুনি। তাই…”
“তাই?”
“তুমি যদি এই বাসাটা ছেড়ে অন্য একটা বাসা ভাড়া নাও, তাহলে… তাহলে আমাদের সবার জন্যেই ভালো হয়।”

জাহানারা লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চিৎকার করে, “এটা কী ঘটে গেল? সর্বনাশ! সর্বনাশ!” – বলার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। তবুও সে চুপ করে রইল।

বেশ অনেক্ষণ চুপ করে থাকার পর জাহানারা বলল, “কবে নাগাদ ছাড়তে হবে?”
“এক মাসের মধ্যে ছাড়তে পারলে ভালো, তবে কোনো তাড়াহুড়ো নেই। তুমি আগে ভালো একটা বাসা পেয়ে নাও।”
“ঠিক আছে।”
“দেখো মা, কিছু মনে করো না। বুঝতেই তো পারছো।”
“খালা আমি বুঝতে পেরেছি।”

একা একটা মেয়েকে বাসা ভাড়া দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ – বললেই হলো! তাহলে তো একা একটা ছেলেকে বাসা ভাড়া দেওয়া আরও ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যাচেলর ছেলেরা যদি সহজেই বাসা ভাড়া পেয়ে যেতে পারে, তবে মেয়েরা পাবে না কেন!

ঢাকা শহরে কিছুতেই সহজে বাসা ভাড়া পাওয়া যাবে না। একা একটা মেয়েকে কেউ ভাড়া দিতে রাজি হবে না, আর যদি হয়েও যায় তবে ভাড়া বাড়িয়ে দেবে। ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া ওই বাড়িওয়ালাকে যদি জাহানারা বিনীত গলায় বলে, “দেখুন আমার বাবা, মা, ভাই, বোন সবাই মরে ভূত হয়ে গেছে। আমি একা না, ভূত হয়ে তারা আমার সাথেই আছে। আমরা সবাই একসাথে আপনার বাড়িতে থাকবো। দয়া করে ভাড়া বাড়াবেন না।” তাহলে কি আজ হবে?

এখন বাজে বারোটা দশ। মাছ ভাজা কার্যক্রম আপাতত স্থগিত রেখে, বাসা খুঁজতে গেলে কেমন হয়? শুভ কাজে দেরি করতে নেই। যদিও এটা তেমন একটা শুভ কাজ না। তবে শুভ-অশুভ কোনো কাজকেই ফেলে রাখতে নেই।

মিনিট দশেকের মধ্যে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো জাহানারা। উদ্দেশ্য, রিকশায় চেপে বাসা থেকে ঢাকা মেডিকেল পর্যন্ত যাবে। রাস্তায় যে কয়বার টু-লেট চোখে পড়বে, ততবারই রিকশা থেকে নেমে টু-লেট সম্পর্কে খোঁজখবর করবে।

রিকশায় চেপে বসতেই জাহানারার মাথাটা ভনভন করে উঠলো। তীব্র একা ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে নাকে। গন্ধটা কীসের হতে পারে?

বেশ কয়েকটা বাড়ির সামনে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ‘টু-লেট’ শব্দটা তার চোখে পড়ল। কিন্তু এই মুহূর্তে নেমে গিয়ে খোঁজখবর করার মতো শক্তি তার নেই। শারীরিক শক্তি নয় কিন্তু। শক্তিটা মনের।

আচ্ছা এই মুহূর্তে রিকশা ঘুরিয়ে অর্থের অফিসে চলে গেলে কেমন হয়? যদিও হুট করে কারও অফিসে গিয়ে উপস্থিত হওয়াটা ঠিক না, তবুও জাহানারা এই ভুল কাজটা করবে। ভুল কাজ করার পেছনে একটা কারণ রয়েছে। জাহানারার অত্যন্ত বাজে স্বভাব হলো, জীবনে বড়ো কিছু ঘটে গেলে সঙ্গে সঙ্গে অর্থকে জানানো। কেন যে এই বাজে স্বভাবটা তার মধ্যে আছে,সে নিজেও জানে না। তবুও সমস্যার কথা অর্থকে বলতে তার ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে মনের ছোট ছোট এই ভালো লাগাগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া দোষের কিছু না।

সাধারনত চাকরি চলে যাওয়ার পর কোনো কর্মচারী যখন অফিসে আসে, তখন তার প্রতি অন্যান্য কর্মচারীদের অদ্ভুত এক কৌতুহল সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ করুণার দৃষ্টিতে তাকায়, কেউ আবার কাছে এসে সমবেদনা জানায়। তবে জাহানারার ক্ষেত্রে ঘটল ব্যতিক্রম। অফিসের সবাই তার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করছে। যেন জাহানারা এখনো এই অফিসেরই একটা অংশ।

মতিন মিয়া জাহানাকে দেখে হাসিখুশি গলায় বলল, “আপা ভালো আছেন?”
“হুঁ। আপনি ভালো আছেন মতিন মিয়া?”
“গরীব মানুষের আর থাকা!”

জাহানারার বলতে ইচ্ছে হলো, “আপনি গরীব হলে আমি তো মহাগরীব। চাকরি নেই, থাকার জায়গা নেই। আছে শুধু ইন্সুরেন্সের কয়েকটা টাকা।”। কিন্তু এসব কথা বলা যায় না। তাই চুপ করেই রইল জাহানারা।

“অর্থ সাবের কাছে আসছেন তো?”

সর্বনাশ! জাহানারা অর্থের কাছে এসেছে, এই লোক জানলো কী করে? কিছু টের পেয়েছে না-কি? টের পেলেও অবশ্য খুব অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই।

জাহানারা অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ।”
“যান, ঘরেই আছে।”

দু’জনে আগে যে কেবিনটায় বসে কাজ করতো, জাহানারা ভুলবশত সেই কেবিনে চলে গেল। দুজন তরুণটাইপ ছেলে গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন লিখছে। জাহানারা কেবিনে এসেছে এই নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।

একটা মানুষ যখন খুব বেশি আনন্দিত হয়, তখন সেটা তার চেহারায় স্পষ্ট ফুটে ওঠে। জাহানারাকে দেখে অর্থের চোখেমুখে প্রবল আনন্দ ফুটে উঠলো।

চোখ দুটো উজ্জ্বল করে বলল, “জাহানারা তুমি!”
“আপনার ম্যানেজারী দেখতে এলাম। আর সেই সাথে ফ্রীতে এসির হওয়াও খেতে এসেছে।”
“খুব ভালো করেছো। এখন কী খাবে বলো!”
“আপনি ম্যানেজার, এখন তো চা-কফি, শরবত-পানি সবই খাবো।”
“তাহলে চলো বাইরে গিয়ে খাই!”
“না, না! এসির হওয়া ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। আপনি এখানেই আনতে বলুন।”

অর্থ টেলিফোন করে কী কী যেন আনতে বলল। বাহ্! ম্যানেজারের ভঙ্গিতে বেশ ভালোই মানিয়েছে তো ছেলেটাকে। অর্থের দিকে তাকিয়ে থাকলে এমন কেন হয়? কেন মনে হয়, তার দিকে তাকিয়ে থেকে এক’শ বছর কাটিয়ে দেওয়া যাবে? আসলেই কি জাহানারা তার দিকে তাকিয়ে থেকে এক’শ বছর কাটিয়ে দিতে পারবে? নিশ্চয়ই পারবে।

অর্থ জাহানারার দিকে তাকিয়ে বলল, “কোথাও গিয়েছিলে?”
“বাসা খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। পরে আর ইচ্ছে করলো না, তাই আপনার এখানে চলে আসলাম।”
“বাসা খুঁজতে মানে?”
“আমার বাড়িওয়ালী সকাল সকাল এসে বলল বাসা ছেড়ে দিতে হবে। এক মাসের আল্টিমেটাম দিয়েছে।”
“কেন?”
“আপনার মাথায় তো অনেক বুদ্ধি, আপনি বলুন তো কেন?”
“আমি না ঠিক বুঝতে পারছি না।”
“আমি বুঝিয়ে বলছি। একা একটা মেয়েমানুষকে বাসা ভাড়া দেওয়া সমাজের পক্ষে হানিকারক।”
“মানে? একা মেয়েমানুষ বাসা ভাড়া দেওয়া যাবে না বললেই হলো! আর তুমিও চট করে মেনে নিলে? তর্কাতর্কি করলে না?”

জাহানারা মুগ্ধতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্থের দিকে। তার ছোট ছোট এই সমস্যাগুলো মানুষটাকে এত ভাবায় কেন? এই অনুভূতিটাকে কী নামে ডাকা যায়?

(চলবে)

শঙ্খি নী
শঙ্খি নীhttps://www.golpopoka.com
গল্প বলতে ভালোবাসি

Related Articles

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Stay Connected

20,625ভক্তমত
3,633অনুগামিবৃন্দঅনুসরণ করা
0গ্রাহকদেরসাবস্ক্রাইব
- Advertisement -spot_img

Latest Articles