#অহেতুক_অমাবস্যা
পর্ব – ৪ (অনুরোধ)
লেখা : শঙ্খিনী
ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগ খুঁজে বের করতে খুব একটা অসুবিধা হলো না অর্থের। দূর থেকেই বারান্দায় বসে থাকা জাহানারাকে দেখা যাচ্ছে। মেয়েটার বসে থাকার ভঙ্গিমা অত্যন্ত স্বাভাবিক। দেখে বোঝার উপায় নেই, তার জীবনে এত বড়ো একটা ঘটনা ঘটে গেছে।
অর্থ এগিয়ে যেতেই জাহানারা উঠে দাঁড়ালো।
স্বাভাবিক গলায় বলল, “অর্থ, স্যরি এত রাতে এভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য। আসলে এখানে একা একা বসে থাকতে ঠিক ভরসা পাচ্ছিলাম না। বাড়ীওয়ালার ছেলেটা ছিল এতক্ষণ, কিন্তু কাল আবার তার পরীক্ষা। তাই চলে গেছে।”
“আপনি ঠিক আছেন জাহানারা?”
“হ্যাঁ, ঠিক আছি আমি।”
“কখন হলো এসব?”
“জানি না, একেবারেই জানি না। ঘুমের মধ্যে সুখের মৃত্যু হয়েছে আমার মায়ের। সব মানুষই এমন মৃত্যু চায়। কিন্তু আমার মা মৃত্যু চায়নি, চেয়েছিল অমরত্ব। সেটা কি আর সম্ভব বলুন?”
“ওনাকে কখন ছাড়া হবে?”
“ছেড়ে তো সেই কখন দেওয়া হয়েছে। যেটা আটকে রাখা হয়েছে, সেটা হলো তার লাশ।”
স্বাভাবিক গলায় অস্বাভাবিক কথা বলছে জাহানারা। সে কাঁদতে চাইছে, চিৎকার করে কাঁদতে চাইছে। কিন্তু কাঁদতে পারছে না। অদ্ভুত একটা ব্যাপার!
অর্থ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “ওইতো, কখন ছাড়া হবে?”
“সময় লাগবে, ডাক্তারি ব্যাপার আছে। লাগুক সময়! আপনি আমার সঙ্গে বসে থাকতে পারবেন না?”
জাহানারার এই প্রশ্নকে উপেক্ষা করে অর্থ বলল, “দাফন কোথায় হবে?”
“গ্রামের বাড়িতে, মায়ের গ্রামের বাড়িতে। নানাজানের কবরের পাশে। আমার মামাকে খবর দিয়েছি। তার গাড়িতে করেই যাবো।”
অর্থ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। হড়বড় করে কথা বলে যাচ্ছে সে। মনের এক তীব্র অস্থিরতাকে গোপন করতেই এই চেষ্টা জাহানারার।
মামা এসে গেছেন। তার ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক। দুঃখ বা আনন্দ কোনো ভাবই নেই তার চেহারার মধ্যে। তবে আসার পর থেকে জাহানারার সঙ্গে একটা কথাও বলেননি। যেন মেয়েটাই তার বোনের মৃত্যুর একমাত্র কারণ।
জাহানারাও আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাচ্ছে না। লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করা হয়েছে, ভাড়াটা মামাকেই দিতে হবে। আবার তার গাড়িতে করেই সে নারায়নগঞ্জে যাবে। এই মুহূর্তে মামাকে রাগিয়ে দেওয়া যাবে না।
মাকে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়েছে। গাড়িতে হিমবাহের মতো ঠান্ডা। বাজার থেকে মাছ এনে যেমন ফ্রিজে রাখা হয়, ঠিক তেমনি ভাবেই মানুষটাকে রাখা হলো গাড়িতে। ভীষণ মায়া লাগছে জাহানারার। আহারে! আর কয়েকটা দিন বাঁচলে কী এমন ক্ষতি হতো! কান্না তার গলা পর্যন্ত চলে এসেছে। প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে সামলাতে।
অর্থ নিচু গলায় বলল, “জাহানারা?”
“উঁ?”
“কিছু মনে না করলে, আমিও কি আপনাদের সঙ্গে যেতে পারি?”
জাহানারা বিস্মিত গলায় বলল, “আপনি যাবেন?”
“হ্যাঁ!”
“সত্যি?”
“সত্যি।”
“আপনার কোনো অসুবিধা হবে না? কাল অফিস আছে তো!”
“একদিন অফিসে না গেলে কিছু হবে না। আপনাদের আবার কোনো সমস্যা হবে না তো?”
“না, না! চলুন রওনা দেই। ক’টা বাজে? আমার হাতে ঘড়ি নেই।”
“এগারটা।”
অর্থের সঙ্গে যাওয়া নিয়ে কোনো আপত্তি করলেন না জাহানারার মামা রকিবুল সাহেব। ছেলেটাকে বেশ পছন্দই হয়েছে তার। নম্র-ভদ্র, দারুন কণ্ঠস্বর! ছেলেটাকে পছন্দ করার আরও একটা কারণ হলো তার উচ্চতা। রকিবুল সাহেব নিজে বেঁটে মানুষ হলেও, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে লম্বাদের অত্যন্ত পছন্দ করেন।
রকিবুল সাহেব বসেছেন ড্রাইভারের পাশে। তার চোখেমুখে চাপা এক অস্বস্তি। পেছনের সিটে অর্থ এবং জাহানারা পাশাপাশি বসেছে। অস্বস্তি বোধ করা উচিত তাদের। কিন্তু তাদের ভাবভঙ্গিতে এক ফোঁটাও অস্বস্তি লক্ষ করা যাচ্ছে না।
গাড়ি চলছে, লাশের গাড়িটা পেছন পেছন আসছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। এভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়। রকিবুল সাহেব একবার গাড়ির রেডিও চালাতে গিয়েও থেমে গেলেন। এমন একটা পরিস্থিতিতে রেডিও শোনা ঠিক হবে না।
জাহানারা অস্পষ্ট গলায় বলল, “অর্থ?”
“হুঁ?”
“আপনাকে শেফালীর কথা বলেছিলাম। মনে আছে?”
“হুঁ।”
রকিবুল সাহেব চোখদুটো বন্ধ করলেন। ভাবটা এমন যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু ঘুমোনো যাবে না। মনোযোগ দিয়ে এদের কথা শুনতে হবে।
জাহানারা গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “শেফালী আমাকে অনেকবার বলেছিল, কীভাবে প্রতিদিন ওকে হয়রানির শিকার হতে হয়। আমি ওর কোনো কথা কানেই নেইনি। তবে উচিত ছিল। ওই কথাগুলোকে গুরুত্ব দিলে বোনটা আমার আজ বেঁচে যেত। ও বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই আজ মাকে এভাবে মরতে দিতো না।”
অর্থ শুকনো গলায় বলল, “এভাবে বলবেন না জাহানারা। জন্ম-মৃত্যু সব প্রকৃতির হাতে।”
“না। সম্পূর্ণটা প্রকৃতির হাতে না। প্রকৃতি তো আর বলেনি, সুইসাইড করো! মানুষকে খুন করো! নিজেকে একজন খুনি বলে মনে হচ্ছে আমার।”
“নিজেকে দোষী ভাবাটা বন্ধ করুন।”
“আচ্ছা মানুষ পৃথিবীতে কেন আসে বলুন তো? চলে যাওয়ার জন্যে? তাহলে আসার দরকারটাই বা কী ছিল?”
অর্থ জবাব দিলো না।
“জানেন অর্থ, অনেকগুলো মৃত্যু দেখেছি আমি। প্রথমে বাবা, এরপর শেফালী, আজ মা। তবে বাবার মৃত্যুর কারণ কিন্তু আমি ছিলাম না। ছিলো মাসুদ। মাসুদ না-কি মামুন! কী যেন নাম ছিল ওর! মামা? ওর নাম যেন কী ছিল?”
রকিবুল সাহেব চোখ বুঁজে রইলেন। ঘুম ভাবটা এখনো ধরে রাখতে হবে।
“মামা?”
“হুঁ?”
“ওর নাম কী ছিল? মামুন না মাসুদ?”
রকিবুল সাহেব ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “মাসুম।”
“মাসুম! দেখেছেন, নামটাই ভুলে গেছি।”
অর্থ শুকনো গলায় বলল, “মাসুমটা কে?”
“আমার বড়ো ভাই। আমাদের তিন ভাইবোনের মধ্যে সবথেকে বড়ো ও। আমার থেকে দু-এক বছরের বড়ো হবে হয়তো। আমি না কখনোই আমার বাবা-মায়ের প্রিয় হয়ে উঠতে পারিনি জানেন। বাবার সবথেকে ভালোবাসতেন মাসুমকে আর মা শেফালী। অথচ দেখুন, প্রিয় সন্তানেরাই তাদের ছেড়ে সবার আগে চলে গেল। মাঝে পড়ে রইলাম অপ্রিয় আমি।”
“এভাবে বলছেন কেন? কোনো বাবা-মায়ের কাছেই তাদের সন্তান অপ্রিয় না।”
“হয়তো না। যাইহোক, মাসুমের ঘটনাটা শুনুন। ওর বয়স তখন সম্ভবত পনের কিংবা ষোলো। মাসুম বরাবরই ইংরেজিতে দুর্বল ছিল। এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজিতে পেল বাইশ। রেজাল্টের দিন বাবা তেমন কিছু বললেন না। পরদিন রাজ্যের সব আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে ডাকলেন। সবার সামনে চাবুক দিয়ে মারলেন আমার ভাইটাকে। সবাই মিলে থামানোর চেষ্টা করেও পারলো না। বেচারার হাত-পা কেঁটে একাকার অবস্থা! এখনো মনে পড়ে, আমি আর শেফালী মিলে সারারাত বরফ লাগিয়ে দিয়েছিলাম। ওটাই ছিল আমাদের তিন ভাইবোনের একসঙ্গে কাটানো শেষ রাত। পরদিন সকালে উঠে দেখি, মাসুম নেই। এত লজ্জা, অপমান সহ্য করে কি থাকা যায় বলুন। তবে ও তো আর শেফালীর মতো বোকা নয়। নিজেকে মেরে ফেলেনি। ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।”
অর্থ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কখনো খোঁজার চেষ্টা করেননি?”
“করেছি। হাসপাতাল, বাসস্ট্যান্ড, স্টেশন, বন্ধুদের বাড়ি – কোথাও ছিল না মাসুম। বাবা যতই অপমান করুক না কেন, অনেক ভালোবাসতেন ওকে। ছেলের কোনো খোঁজ না পেয়ে, সেই রাতেই স্ট্রোক করেন।”
গাড়ির মধ্যে ভয়াবহ এক ভারী আবহাওয়া বিরাজ করছে। জাহানারা নিঃশব্দে কাঁদছে। কান্না গোপন শাড়ির আঁচল দিয়ে লম্বা এক ঘোমটা টেনে রেখেছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। গাড়িতে থাকা প্রত্যেকটি মানুষ তার কান্না টের পাচ্ছে।
এই কান্না কীসের? প্রিয় মানুষগুলো হারানোর না-কি নিঃসঙ্গতার?
ভোর পাঁচটা। জাহানারার নানাবাড়ি আর মাত্র কিছু দূরে। রকিবুল সাহেব গাড়ি থামিয়েছেন এক চায়ের দোকানের সামনে। দোকান খুলতে না খুলতেই কাস্টমার দেখে চাওলায়ার চোখেমুখে খানিকটা বিরক্তিই ফুটে উঠলো।
জাহানারা গাড়ি থেকে নামলো না। তার দেখাদেখি অর্থও গাড়ির মধ্যে বসে রইল। দোকানের ছেলেটা গাড়ির মধ্যেই চা দিয়ে গেছে।
জাহানারা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, “অর্থ?”
“হুঁ?”
“আপনি কি জানেন, একটা মানুষ যখন মারা যায় তখন তাকে ঘিরে যতগুলো স্মৃতি আমাদের মস্তিকে জমা থাকে, সেগুলো একেক করে মনে পড়তে থাকে?”
“জানি।”
“মাকে ঘিরে এমন অনেক স্মৃতি আছে, যেগুলো বছরের পর বছর মনে পড়ে না। আজ পড়ছে। শুনবেন এমন একটা স্মৃতি?”
“শুনবো, বলুন।”
“এক ঈদের ছুটিতে, আমার সব বান্ধবীরা এলো আমাদের বাড়িতে বেড়াতে। ঠিক হলো, পুতুলের বিয়ে দেওয়া হবে। নিতান্তই বাচ্চামি, তবুও সবাই উৎসাহ পেলাম আমরা সবাই। কোনো একটা বইয়ে পড়েছিলাম, বান্ধবীরা যখন অনেকদিন একসঙ্গে হয়, তখন না-কি তাদের বয়স কমে যায়। আমাদের বেলায়ও তাই হয়েছিল। পুতুলের বিয়ের জন্যে আমার ঘরটা ফুল-টুল দিয়ে সাজিয়ে একাকার। এই অবস্থা দেখে মা বলল, তোদের কান্ড দেখে আমারই আবার বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে। কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে মা বেশ লজ্জা পেয়ে গেল। মজা পেলাম আমরা। সেই মজার সূত্র ধরে ঠিক হলো, পুতুল নয় বিয়ে দেওয়া হবে মাকে। একদম নতুন বউদের মতো করে সাজানো হলো তাকে। এরপর মা আর বাবাকে পাশাপাশি বসানো হলো। বাবা পুরো বিষয়টাতে প্রচণ্ড রাগ করেছিলেন, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারেননি। বিয়ে তো আর দেওয়া যায় না, তাই স্টুডিও থেকে লোক নিয়ে এসে তাদের কয়েকটা ছবি তোলা হলো। কী অসাধরণ ছিল সেই দিনগুলো!”
হড়বড় করে কথাগুলো বলে গেল জাহানারা। অর্থ তার চোখেমুখে প্রবল এক অস্থিরতার চাপ লক্ষ করল। যে মেয়েটার মা গতকাল রাতে মারা গেছেন, তাকে সান্ত্বনা দেওয়া যায় না। সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো মানেও হয় না।
অর্থ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। রকিবুল সাহেব চায়ের দোকানের সামনে থাকা বেঞ্চে বসে রয়েছেন। চায়ের প্রথম কাপটা ছিল অখাদ্য! দ্বিতীয় কাপ চায়ের অর্ডার দেওয়া হয়েছে।
অর্থ গিয়ে বসল তার পাশে।
রকিবুল সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, “দোকানের চা এমন আহামরি কিছু না যে গাড়ি থামিয়ে খেতে হবে। তাও কাজটা কেন করলাম বলো তো?”
অর্থ বলল, “কেন?”
“জাহানারার ভ্যানভ্যান অসহ্য লাগছিল। যেন পৃথিবীতে ও-ই প্রথম যার মা মরেছে। আর মরেছেও তো ওর অসাবধানতার কারণে। পাগল-ছাগল মানুষ, একটু সাবধানে রাখবে না?”
“থাক না! যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।”
“আল্লাহর রহমতে টাকা-পয়সার কোনো কমতি আমার নেই। চাইলেই শিউলির চিকিৎসার দায়িত্বটা নিতে পারতাম। কিন্তু নেইনি। ওদের সঙ্গে সম্পর্ক কোনো কালেই ভালো ছিল না।”
“কেন?”
“দুলাভাই, মানে জাহানারার বাবা লোক ভালো ছিল না।”
“তাই না-কি?”
“অবশ্যই তাই! কোনো ভালো মানুষ নিজের ছেলেকে দুনিয়ার আত্মীয়-স্বজনের সামনে চাবুক দিয়ে মারতে পারে?”
“আপনার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ ছিল, শুধুমাত্র এই কারণে?”
“মোটামুটি এই কারণেই। আমি শিউলিকে অনেকবার বলেছি, ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমার বাড়িতে স্থায়ী হয়ে যেতে। ওই পরিবার অভিশপ্ত!”
“অভিশপ্ত?”
“হুঁ! ওই পরিবারের বেশির ভাগ লোক হয় অল্প বয়সে মারা গেছে, না হয় পাগল হয়ে গেছে। দুলাভাইয়ের মা অল্প বয়সে মারা গেছে, বাবা পাগল হয়ে হারিয়ে গেছে। জাহানারার ভাইবোনদের হিস্টোরি তো তুমি জানোই!”
“তা আবার হয় না-কি? জাহানারা তো ঠিকই আছে।”
“একটা গোপন কথা বলি?”
“কী?”
“আগে বলো কাউকে বলবে না?”
“আচ্ছা বলবো না।”
“আল্লাহর কসম?”
“ঠিক আছে, আল্লাহর কসম।”
“জাহানারা ওদের মেয়ে না।”
অর্থ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “মানে কী?”
“আমাদের এক বোন ছিল, রাবেয়া। জাহানারা রাবেয়ার মেয়ে।”
“আপনার কোনো কথাই আমার মাথায় ঢুকছে না।”
“রাবেয়া ওকে জন্ম দিতে গিয়ে মরে গেছে। মেয়ে সন্তান হয়েছে বলে, রাবেয়ার শ্বশুরবাড়ির লোকজন এসে ওকে আব্বার কোলে বসিয়ে রেখে চলে যায়। শেষে শিউলি এগিয়ে আসে।মেয়েটাকে মানুষ করার দায়িত্ব নেয়। শিউলি মূলত জাহানারার খালা।”
“বলেন কী?”
“ঠিকই বলছি। জাহানারা কিন্তু এই খবর জানে না। তুমি খবরদার ওকে বলবে না!”
জীবনের কিছু কিছু সত্য অজানা থাকাই ভালো। পৃথিবীতে আসতে না আসতেই জন্মদাত্রী মাকে হারানোর গভীর কষ্ট জাহানারাকে কখনো বুঝতে দেওয়া হয়নি। শিউলি বেগম এক মুহূর্তের জন্যেও মেয়েটাকে পর ভাবেননি। পরম মমতায় মানুষ করেছেন। জন্ম না দিতে পারলেও ভালোবাসা দিয়ে ঠিকই অর্জন করছেন মাতৃত্ব।
দাফনের কাজ চলছে। জাহানারা দাঁড়িয়ে আছে নদীর পাড়ে। এই মুহূর্তে নদীটাকে ভীষণ আপন মনে হচ্ছে তার। সারাটা জীবন যদি এই নদীর পাড়েই কাটিয়ে দেওয়া যেত!
বেশ অনেক্ষণ পর অর্থ এসে দাঁড়ালো তার পাশে।
জাহানারা বলল, “কাজ শেষ?”
“হুঁ। ওনাকে শেষ বারের মতো দেখতে এলেই পারতেন।”
জাহানারা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, “আমি মাকে ওই অবস্থায় দেখতে পারতাম না!”
“জাহানারা?”
“হুঁ?”
“আপনার মামা কয়েকটা দিন এখানে থাকবেন। আমরা যাতে ঢাকায় ফিরে যেতে সেজন্যে গাড়িটা দিয়ে দেবেন।”
“ও আচ্ছা।”
“আপনিও কিন্তু কয়েকটা দিন এখানে থেকে যেতে পারেন।”
“না, না। আমি আজই ফিরে যাবো।”
“আমি এসেছি বলে ভ্রদ্রতা দেখিয়ে আমার সঙ্গে ফিরে যেতে হবে না। আমি একাই যেতে পারবো।”
জাহানারা কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অর্থের দিকে। তার চোখের কোণে জল জমে রয়েছে, তবুও ঠোঁটে যেন এক বিচিত্র হাসির আভাস ফুটে উঠলো।
“অর্থ?”
“হুঁ?”
“আমাকে তুমি করে ডাকবেন প্লিজ?”
(চলবে)