#অহেতুক_অমাবস্যা
পর্ব ৩ – (ছুটির দিনে ঝড়)
লেখা : শঙ্খিনী
আজ মে দিবস, অফিস ছুটি। একই সপ্তাহে দু’দিন ছুটি, জাহানারার কাছে এ যে সোনার হরিণ। ঘরে অনেকগুলো কাজ পড়ে আছে। আলমারির কাপড়গুলো গোছাতে হবে, নতুন চারাগুলোকে টবে লাগাতে হবে, কাচের আলমারি থেকে নতুন দু’টো গ্লাসও বের করতে হবে। কাজগুলো আজকের মধ্যে শেষ করে ফেলতে পারলে ভালো হয়, কিন্তু কিছুতেই যেন কাজ এগোচ্ছে না।
জাহানারা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। আকাশটা আজ মেঘাচ্ছন্ন। তার মানে কোনোমতেই বৃষ্টি নামবে না। জাহানারা খেয়াল করেছে, যেদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে সেদিন বৃষ্টি হয় না। রোদে পুড়ে মরে যাওয়ার মতো অবস্থার দিনে নামে ঝুম বৃষ্টি।
শিউলি বেগম এসে বারান্দায় দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলেন।
জাহানারা ক্লান্ত গলায় বলল, “মা?”
“উঁ?”
“কাল অফিস থেকে ফেরার পথে তরমুজ এনেছিলাম। কেটে দেই?”
“না।”
“কেন মা? ঠিকমতো ভাতও খেলে না দুপুরে!”
“ভয় করে রে মা।”
“ভাত খেতে ভয় করে?”
“কয়টা বাজে রে মা?”
“সাড়ে তিনটা।”
“ঘড়ি দেইখা বল!”
জাহানারা মোবাইলের দিকে তাকিয় বলল, “তিনটা বাইশ।”
“শেফালী তো এখনো আসলো না।”
জাহানারা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “শেফালী আসবে না মা।”
“কালকে তো বলে গেল আসবে। আনারস খাইতে মন চায়, ও বলল নিয়ে আসবে।”
“তোমার অনারস খেতে ইচ্ছে করে আমাকে বলোনি কেন?”
শিউলি বেগম অসহায় গলায় বললেন, “তোরে বললে, তুই বলতি জিনিসপত্রর দাম বাড়ছে।”
“আচ্ছা দাঁড়াও, একটু পরে গিয়ে আনারস নিয়ে আসবো।”
“দরকার নাই, শেফালী আনবে তো।”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি ঘরে গিয়ে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করো তো!”
“না রে মা। ভয় করে।”
“মা!”
শিউলি বেগম লজ্জিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন।
জাহানারা বিরক্ত গলায় বলল, “মা, তুমি একটু ঘুমাও। শেফালী এলে আমি ডেকে দেবো।”
“দিবি তো?”
“হুঁ।”
“সত্যি দিবি?”
“উফ মা! যাও!”
শিউলি বেগম লম্বা লম্বা পা ফেলে শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
বেলা হয়ে এসেছে, আকাশের মেঘাচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেছে। মাথার ওপরে এখন কড়া রোদ। চোখ মেলে তাকানো কষ্টকর হয়ে উঠেছে। একটা সানগ্লাস থাকলে ভালো হতো।
গত মাসে অর্থ চিটাগং থেকে একটা সানগ্লাস এনে দিয়েছিল। সেটা নিয়ে ঘরে আসার সঙ্গে সঙ্গে শিউলি বেগম দু টুকরো করে ভেঙে ফেললেন।
জাহানারা হতভম্ব হয়ে বলেছিল, “ওটা ভাঙলে কেন মা?”
“ভয় করে রে মা।”
একপ্রকার বাধ্য হয়েই মাথার ওপরে ছাতা মেলে ধরে নিচে নেমেছে জাহানারা। মোড়ে এক লোক ঝুড়িতে করে আনারস নিয়ে বসে।
আনারসওয়ালার ঝুড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছেন শামীমা বেগম, জাহানারাদের বাড়িওয়ালী।
জাহানারাকে দেখেই উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন, “আরে জামিলা! কী খবর?”
মহিলার এই এক বাজে স্বভাব। বারবার নাম ভুলে যাওয়া। প্রত্যেকবার জাহানারার সঙ্গে দেখা হলে বলে ওঠেন, “কেমন আছ জামিলা?”। আর প্রত্যেকবারই রাগে গা জ্বলে যায় জাহানারার।
জাহানারা শুকনো গলায় বলল, “জামিলা না চাচী, জাহানারা।”
“দেখছো, একেবারেই ভুলে গেছি। বয়স হয়ে যাচ্ছে তো, কিছু মনে রাখতে পারি না।”
“ও।”
“তুমি কেমন আছো?”
“এইতো। আপনি?”
“তোমাদের দোয়ায় অনেক ভালো আছি।”
জাহানারা বিড়বিড় করে বলল, “আমার দোয়ায় তো আপনার ভালো থাকার কথা না।”
“কিছু বললে?”
“জি না।”
“তোমার মা আছে কেমন?”
“ভালো আছে।”
“তার সমস্যাটা ঠিক হয়েছে?”
“উঁহুঁ।”
“মাকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করবে। সারাদিন তো অফিসেই পড়ে থাক। বাসায় বসে মায়ের সঙ্গে সময় কাটালেও তো পারো। এতে তার ভয়টা একটু দূর হয়।
মুখ আছে বলেই যে কথা বলতে হবে, এমনটা ঠিক নয়। অফিসে না গিয়ে বাসায় বসে থাকলে, টাকাগুলো উড়ে উড়ে আসবে না। কঠিন গলায় কিছু একটা বলতে ইচ্ছে হলো জাহানারার।
তবুও বহুকষ্টে নিজেকে সামলে বলল, “চেষ্টা করবো।”
“তারপর? তোমার ভবিষৎ পরিকল্পনা কী?”
“কী নিয়ে?”
“বুঝতে পারছো না কী নিয়ে?”
“না।”
“বয়স তো কম হলো না, বিয়ে-শাদি কবে করছো?”
“কী বলছেন এসব চাচী? আমি এখন বিয়ে করলে আমার মাকে দেখবে কে?”
“বিয়ের পর একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। তাই বলে বিয়েই করবে না?”
“ওসব নিয়ে না হয় পরে ভাবা যাবে।”
“আর কত পরে? আমি বলি কী, এবার সবাই মিলে উদ্যোগ নিয়ে তোমার বিয়ের কাজটা সেরে ফেলি।”
“সবাই মিলে মানে?”
“তোমার বাবা তো বেঁচে নেই, মা বিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। আত্মীয়-স্বজনও তো তেমন একটা নেই। আমি আর সামিনের আব্বা মিলে তোমার জন্য ভালো একটা ছেলে খুঁজে বের করি।”
জাহানারা বিব্রত গলায় বলল, “কোনো দরকার নেই খালা।”
“কেন? তোমার কোনো পছন্দ আছে না-কি?”
“তোমার কোনো পছন্দ আছে না-কি?” – আবার কেমন ধরনের প্রশ্ন? পছন্দ আছে, অবশ্যই আছে। পছন্দের কথা এভাবে মুখের ওপর বলা যায়?
“খালা এখন আপাতত বিয়ে নিয়ে ভাবছি না।”
জাহানারা বাড়ি ফিরেছে, মুখটা তার ফ্যাকাশে হয়ে আছে। খুব ছোটোবেলায় তার দাদিজান বলতেন, “বড়োদের কথা না শুনলে, বিয়ে দিয়ে দেবো।”। বিয়ের কথা শুনতেই দুশ্চিন্তায় তার মনটা অস্থির হয়ে পড়ত। মনে হতো যেন পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে।
এখন আর সে সুযোগ নেই। কেউ চাইলেই জাহানারাকে ধরে বিয়ে দিতে পারবে না। তবুও ছোটোবেলাকার সেই অভ্যাস এখনো রয়ে গেছে। বিয়ের কথা শুনলেই মনের মধ্যে দিয়ে এক অদৃশ্য ঝড় বয়ে যায়।
জাহানারা আনারস কাটল। শিউলি বেগম হাত পা ছড়িয়ে বিছানার ওপর ঘুমিয়ে আছেন। ঘরের বাতি নেভানো।
জাহানারা বাতি না জ্বালিয়েই বলল, “মা, উঠে পড়ো! তোমার আনারস এনেছি।”
শিউলি বেগমের কোনো সাড়া-শব্দ নেই। জাহানারা এবার বাতি জ্বালানো। বাতির আলো এসে পড়লো মায়ের মুখে ওপরে। অপূর্ব মায়াবী লাগছে তাকে। যেন বহু বছর ধরে ঘুমন্ত ছিলেন তিনি। আহারে! ঘুমোক আরেকটু।
জাহানরার ফোন বেজে উঠলো। মোবাইলে ভেসে উঠলো অর্থের নাম।
জাহানারা ফোন তুলে স্বাভাবিক গলায় বলল, “হ্যালো অর্থ? কেমন আছেন?”
“খুবই ঝামেলায় আছি।”
“সে কী, কেন?”
“আর বলবেন না, আমার এক মামাতো ভাই ফোনের দোকান দিয়েছে। একদিন আমার বাসায় এসে হাজির। কথায় কথায় ষোলো হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেল আমার কাছ থেকে। বলে কি-না, পরদিনই লেটেস্ট স্মার্ট ফোন পাঠিয়ে দেবে। অথচ দেখুন, আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেল, ফোনের কোনো খবর নেই।”
“বলেন কী! ফোন করেছেন তাকে?”
“ফোন বন্ধ।”
“ষোলো হাজার টাকা জলে তাহলে?”
“বুঝতে পারছি না, কীভাবে যে টাকাগুলো উদ্ধার করি! আচ্ছা, আমার জায়গায় থাকলে আপনি কী করতেন?”
“যতই মামাতো ভাই হোক না কেন, টাকা-পয়সার ব্যাপারে কাউকে ছাড়া উচিত না। আপনার জায়গায় আমি থাকলে তার কাছে গিয়ে চেঁচামেচি করে টাকা আদায় করতাম।”
“তাহলে আমারও কি এখন তার কাছে গিয়ে চেঁচামেচি করা উচিত?”
“না, না। আপনি তো ভদ্রলোকের ছেলে। মানুষের কাছে গিয়ে চেঁচামেচি করাটা আপনাকে মানায় না।”
“আপনাকে মানায়?”
“না, কাউকেই মানায় না। আমি বরং একটা পরামর্শ দেই। আপনার ভাইয়ের কাছে গিয়ে তার সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় কথা বলুন। একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে।”
“থ্যাংক য়্যু জাহানারা।”
অর্থ মনে মনে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বানিয়ে বানিয়ে আরও একটা মিথ্যা বলা হলো আজ। তার কোনো মামাতো ভাই নেই। থাকলেও কথায় কথায় ষোলো হাজার টাকা দিয়ে দেওয়ার মতো মানুষ অর্থ না। ছুটির দিনগুলোতে জাহানারার সঙ্গে কথা বলার জন্য এমনই নানান অজুহাত খুঁজে বেড়াতে হয় তাকে।
কাটায় কাটায় নয়টা বাজছে। মায়ের ওঠার কোনো নামগন্ধ নেই। মাঝে মাঝে ডান তার পা কেঁপে উঠছে। জ্বর-টর বাঁধিয়েছে কি-না কে জানে। গত বর্ষাকালে প্রচন্ড জ্বর বাঁধিয়ে বসেছিলেন শিউলি বেগম, এক’শ চার। একটু পর পরই তার ডান পা কেঁপে উঠছে, বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন।
জাহানারা যতবারই বলে, “এখন কেমন লাগছে মা?”
তিনি ততবারই অস্পষ্ট গলায় উত্তর দিয়েছেন, “শেফালী!”
তখন বর্ষাকাল, আশপাশ পানিতে থৈ থৈ করছে। কোনো ডাক্তারকে খবর দিলে আসবেন না। হাসপাতালে নেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। শেষ পর্যন্ত বাড়ীওয়ালার ছেলেটা এসে রক্ষা করলো। ছেলেটা মেডিকেল পড়ছে, চেহারা দেখেই তার পড়ুয়া স্বভাবের খানিকটা টের পাওয়া। চোখে ভারী চশমা, আঁচড়ানো চুল।
আজও বোধ হয় তাকে ডেকে আনতে হবে। জাহানারা অসহায় ভঙ্গিতে বাড়ীওয়ালাদের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
দরজা খুললেন আজিজুল সাহেব। জাহানারার মুখটা চিন্তিত, তবুও তার ভালো লাগলো। যতগুলো ভাড়াটিয়া আছে, তার মধ্যে একমাত্র এই মেয়েটাকেই পছন্দ তার।
আজিজুল সাহেব হাসিখুশি গলায় বললেন, “কেমন আছো মা? ভেতরে এসো!”
“ভেতরে যাবো না চাচা। মায়ের শরীরটা খারাপ। জ্বর-টর এসেছে বোধ হয়। ঘরে থার্মোমিটারও নেই। আপনি একটু সামিনকে বলবেন গিয়ে দেখে আসতে?”
“তুমি যাও, আমি দশ মিনিটের মধ্যে সামিনকে নিয়ে তোমাদের বাসায় যাচ্ছি।”
ঠিক দশ মিনিটের মধ্যেই ছেলেকে নিয়ে উপস্থিত হলেন আজিজুল সাহেব। তার আসার কোনো প্রয়োজন ছিল না, সামিনকে পাঠিয়ে দিলেই হতো। তবুও এসেছেন, একনজরে নিজের বাড়ির এই অংশটাকে দেখে যেতে। আহারে! নিজের ফ্ল্যাট, তবুও অন্যের হয়ে আছে।
শিউলি বেগমের মাথার কাছে বসে সামিন বেশ অনেক্ষণ যাবত ঘাটাঘাটি করছে। তার চোখেমুখে বিচিত্র এক বিস্ময়ের আভাস দেখা দিচ্ছে।
বেশ অনেকটা সময়ের পর জাহানারার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “নিঃশ্বাস পড়ছে না।”
জাহানারা আতঙ্কিত গলায় বলল, “নিঃশ্বাস পড়ছে না মানে কী? ঠিক হয়ে যাবে তো না?”
“হসপিটালে নিতে হবে।”
“অ্যাম্বুলেন্স?”
“আমার কাছে নম্বর আছে, আমি খবর দিচ্ছি।”
মানুষে মানুষ গাথা
গাছে যেমন আলকলতা।
জাহানারার মাথার মধ্যে গানের এই দু’টো লাইন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। পরের লাইনটা যেন কী! মনে না পড়া পর্যন্ত এই ঘুরপাক থামবে না। কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই পরিস্থিতি নেই। তার মাকে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করা হয়েছে। কী সব যেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। করুক বসে!
গানের পরের লাইনটা মনে করতে যাবে, এমন সময়ে দাঁড়ি-গোঁফওয়ালা একজন ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। তাকে বেরিয়ে আসতে দেখে জাহানারা উঠে দাঁড়ালো।
ডাক্তার সাহেব গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, “আই অ্যাম স্যরি, শী ইস নো মোর।”
জাহানারা নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মাথাটা কেমন যেন ভনভন করে উঠলো। মনে হচ্ছে যেন এক টুকরো অদৃশ্য মেঘ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, দূরে কোথাও।
গানের পরের লাইন মনে পড়েছে, “জেনে শুনে মুড়াও মাথা জাতে উঠবি। মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”। একসঙ্গে অনেক চিন্তা ঘুরছে মাথার মধ্যে। মস্তিষ্ককে কে যে এই আজব ক্ষমতা দিয়েছে!
(চলবে)