18.8 C
New York
Sunday, October 5, 2025

Buy now







অহেতুক অমাবস্যা – পর্ব ২ (সাশ্রয়ী)

#অহেতুক_অমাবস্যা
পর্ব ২ – (সাশ্রয়ী)
লেখা : শঙ্খিনী

এই মুহূর্তে জাহানারার হাতে আছে মোট দুহাজার তিন’শ তেত্রিশ টাকা। এই টাকার মধ্যে মায়ের জন্যে একটা শাল এবং বারান্দায় রাখা যায় এমন কয়েকটা ফুলের টব কিনতে হবে। কিছু টাকা নিশ্চয়ই বেঁচে যাবে, তা দিয়ে না হয় নিজের জন্যে কিছু একটা কেনা যাবে। বহুদিন হয়ে গেল জাহানারা নিজের জন্যে কিছু কেনে না।

জাহানারার ইচ্ছা ছিল কাশ্মীরি শাল কেনার। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা আর সম্ভব হবে না। এর অবশ্য দুটো কারণ রয়েছে। প্রথমত, কাশ্মীরি শালের অস্বাভাবিক দাম। আর দ্বিতীয়ত, কাশ্মীরি শালের দোকানটায় অর্থ দাঁড়িয়ে আছেন। জাহানারা খেয়াল করলো, চাকরি পাওয়ার পর যতবারই সে মার্কেটে এসেছে কাকতালীয়ভাবে অর্থের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ব্যাপারটা কী শুধুই কাকতালীয়?

কোনোভাবেই ছেলেটার সামনে পড়া যাবে না।
সামনে পরলেই জিজ্ঞেস করবে, “আজ হঠাৎ এখানে?”
জাহানারা তখন বলবে, “মায়ের জন্যে শাল কিনতে এসেছি।”
অর্থ বলবে, “তাহলে চলুন, একসঙ্গে দেখি।”

দু’জনে একসঙ্গে শালের দোকানে যাবে, জাহানারা একটা শাল পছন্দও করে ফেলবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দাম দেবে অর্থ। জাহানারা হাজার চেষ্টা করেও থামাতে পারবে না তাকে। এমন ঘটনা এর আগেও বহুবার ঘটেছে।

ছেলেটা তার থেকে বেশি বেতন পায় না-কি? কে জানে! যদিও তারা দু’জনে একই পোস্টে, তবুও অর্থ বেশি বেতন পেলে এত খুব অবাক হওয়ার মতো বিষয় হবে না। পুরুষমানুষ, বেশি বেতন তো পাবেই।

স্বাধীনতার এতগুলো বছর হয়ে গেল, অথচ নারীদের বেতন এখনো পুরুষের তুলনায় কম! ‘নারীই সকল শক্তির আঁধার’ – এ ধরনের যুক্তি দেখালে বেতন কখনো বাড়বেও না। ‘যেসব মেয়েরা চাকরি করে, তাদের বেশির ভাগই নিজের ইচ্ছায় করে না। এক প্রকার বাধ্য হয়ে বা অভাবে পড়ে করতে হয়। পুরো পরিবারটাই নির্ভয় করে সেই মেয়েটার ওপরে।’ – বেতন বাড়াতে হলে এ ধরনের যুক্তি দেখাতে হবে। তবে যদি কাজ হয়!

অসম্ভব বিরক্ত লাগছে জাহানারার। এই গরমের দিনেও মায়ের শাল লাগবে। রাতে না-কি শুধু চাদর টেনে ঘুমোতে ভয় লাগে। এত ভয় যে কোত্থেকে আসে কে জানে!

অনেক ঘোরাঘুরি করেও সুবিধামত শাল পেলো না জাহানারা। কোনটার দাম বেশি তো কোনটার ডিজাইন একেবারেই ডাল-ভাত। যদিও তার মা ডিজাইন নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। তবুও, পাগল বলে কি কোনো শখ-আহ্লাদ থাকতে পারে না?

জাহানারা ঠিক করলো শাল কেনার দরকার নেই। পুরনো সোয়েটার নামিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে।

মার্কেট থেকে বের হবে, এমন সময়েই সেই অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে গেল। অর্থের সঙ্গে দেখা!

অর্থ দূর থেকে উঁচু গলায় বলল, “এই জাহানারা! এই! এই!”

জাহানারা দেখল দূর থেকে ছেলেটা ছুটে আসছে। তার চোখেমুখে গভীর বিষ্ময়, ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। যেন নোবেল পুরস্কার জয় করে ফেলেছে সে।

অর্থ জাহানারার কাছে এসে বলল, “কেমন আছেন?”
জাহানারা হাসিখুশি গলায় বলল, “এইতো, আপনি?”
“আছি, মোটামুটি। তা এখানে কী করছেন?”
“নতুন চশমার ফ্রেম কিনতে এসছি।”

কথাটা মিথ্যা। ইচ্ছা করেই মিথ্যা বলা। নিজের জন্যে কিছু কিনতে এসেছে শুনে, অর্থ নিশ্চয়ই আগ্রহ করে দাম দিতে যাবে না। যদি যায়, তবে ধরে নিতে হবে ব্যাপারটা আলাদা।

অর্থ বলল, “আপনার জন্যে?”
“হুঁ।”
“কিনেছেন?”
“এখনো না।”
“একটা ছোট্ট পরামর্শ দিয়ে রাখি, অবশ্যই চিকন ফ্রেমের চশমা কিনবেন।”
“কেন? মোটা ফ্রেমের চশমায় আমাকে বয়স্ক লাগে?”
অর্থ বিব্রত গলায় বলল, “না, ঠিক তা না।”
জাহানারা হেসে বলল, “চিকন ফ্রেমের চশমায় আমাকে আরও বাজে দেখায়। চলুন আমার সঙ্গে চশমার দোকানে, নিজেই দেখতে পাবেন।”

সর্বনাশ! এটা কী বলল জাহানারা! অর্থের সাথে চশমার দোকানে গেলে, সে তো আর দাম না দিয়ে ছাড়বে না। আবার যদি কোনো কারণে দাম না দেয়, তাহলেও তো বিপদ! জাহানারার চশমার ফ্রেম কেনার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। নতুন চশমা মানেই তো একগাদা খরচ। কী দরকার!

চশমার দোকানে অর্থ খেয়াল করল, আসলেই মেয়েটাকে চিকন ফ্রেমের চশমায় ভালো লাগছে না। মেয়েটা যে রূপবতী, তা প্রকাশ পায় চশমা না পরে থাকলে। অর্থ একবার বলতে চাইল, “চশমা কেনার দরকার কী? চশমা ছাড়াই আপনি অনেক সুন্দর।”

কিন্তু কথাটা বলা যাবে না। কলিগকে এসব কথা বলা যায় না। বললে যে তেমন কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হবে, তাও না।

চশমার দোকানে বেশ অনেক্ষণ ঘাটাঘাটি করে জাহানারা বলল, “নাহ্! কোনোটাই পছন্দ হচ্ছে না। এগুলোর থেকে আমার চশমাটাই ভালো।”
অর্থ বলল, “তাহলে অন্য দোকানে যাই?”
“আজ আর না। চশমা কেনার ইচ্ছাটাই মরে গেছে।”
“তাহলে চলুন, কোথাও একটা বসে কফি খাই।”

জাহানারা মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এ যাত্রায় বাঁচা গেল তাহলে।

“হ্যাঁ, তবে আমি খাওয়াবো কিন্তু!”
অর্থ কিছুটা হেসে বলল, “আচ্ছা, দেখা যাবে।”

কফিটা ভালো বানিয়েছে। যদিও মেশিনে বানানো, তবুও ভালো লাগছে। এমন কফি একসঙ্গে দু কাপ না খেতে পারলে, তৃপ্তি হয় না। কিন্তু দু কাপ খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এক কাপের দাম এক’শ ত্রিশ টাকা। কোনো মানে হয়! জাহানারা কাপে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে, যাতে দীর্ঘ সময় ধরে খাওয়া যায়।

জাহানারা হাসিখুশি গলায় বলল, “আচ্ছা, আপনার নাম কোন অর্থ? টাকা অর্থ না-কি মানে অর্থ?”
“মানে অর্থ। আমার নামের পেছনে কিন্তু এক ইতিহাস আছে?”
“কী ইতিহাস?”
“আমার জন্ম হয় ময়সিংয়ে, আমাদের গ্রামের বাড়িতে। আমার বড়ো মামা তখন ঢাকায় চাকরি করতেন। ভাগ্নের জন্মের কথা শুনে ছুটে গেলেন সেখানে। আমাকে প্রথম দেখেই না-কি বলেছেন, নাম রাখলাম স্বর্ণচম্পক।”
“স্বর্ণচম্পক? সেটা আবার কী?”
“সেটা যে কী, মামা নিজেও জানতেন না। এদিকে আমার বাবা-মায়েরও বেশ পছন্দ হয়ে গেল নামটা। কিন্তু পছন্দ হলেই তো হয় না, নামের একটা অর্থ থাকতে হয়। সেই অর্থ খুঁজে বের করতে কত ছোটাছুটি! দুটো মোটা মোটা ডিকশনারি কেনা হলো কিন্তু স্বর্ণচম্পকের কোনো দেখা নেই। শেষ পর্যন্ত নামের অর্থ খুঁজে না পেয়ে নামটাই অর্থ রেখে দেওয়া হলো।”

জাহানারা খিলখিল করে হেসে উঠলো। যেন বহুদিন কোনো হাসির কথা শোনেনি।

হাসতে হাসতেই বলল, “পরে পেয়েছিলেন স্বর্ণচম্পকের অর্থ পেয়েছিলেন?”
“হুঁ! স্বর্ণচম্পক আর কিছুই না, চাঁপা ফুল।”

জাহানারা আবারও খিলখিল করে হেসে উঠলো। নিজের নামের এই ইতিহাস এর আগেও অনেককে শুনিয়েছে অর্থ। কিন্তু জাহানারার মতো এত মজা বোধ হয় কেউ পায়নি।

অর্থ কৌতুহলী গলায় বলল, “আপনার নামের ইতিহাস কী?”
“আমার নামের কোনো ইতিহাস নেই। মেয়ে হয়েছে বলে এমনিতেই সবার মন-মেজাজ খারাপ ছিল। তাই বাবা কিছু না ভেবেই একটা নাম রেখে দিয়েছিলো।”
“এমনভাবে বললেন, যেন নিজের নামটা পছন্দের নয় আপনার।”
“মোটেই পছন্দের নয়! আমারও ইচ্ছে করে গল্প-উপন্যাসের নায়িকাদের মতো নাম পেতে। মৃণালিনী, শকুন্তলা কিংবা নীলাঞ্জনা।”
“এই, নাম পরিবর্তন করা কিন্তু খুব একটা কঠিন না। আপনি চাইলেই করতে পারেন।”
“দরকার নেই বাবা! সারাজীবন জাহানারা জাহানারা শুনে এসে, এখন মৃণালিনী শুনতে হবে!”

জাহানারা তৃতীয় দফায় খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসলে অসম্ভব সুন্দর লাগে মেয়েটাকে। সবসময় হাসিখুশি থাকে না কেন কে জানে!

অর্থ সিগারেট ধরালো। পৃথিবীর যেকোনো সিগারেট গন্ধ সহ্য হয় না জাহানারার। তবে অর্থ যখন সিগারেট ধরায়, তখন যেন কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে এই গন্ধ সহ্য করতে বাধ্য করে।

জাহানারা সরল গলায় বলল, “এত সিগারেট খান, মরে যাবেন তো!”
“মরে তো একদিন যেতেই হবে, তাই বলে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করবো না-কি?”
“তা অবশ্য ঠিক। জানেন, আমারও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মন খুলে খরচা করি। একদিন তো মরেই যাবো।”
“আপনি মন খুলে খরচা করতে পারেন না-কি? শেষ কবে করেছেন বলুন তো!”
জাহানারা কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “মনে নেই।”
“এজন্যেই তো অফিসে হাড়কিপ্টে হিসেবে বিশেষ সুনাম আছে আপনার।”
“আমি নিজেকে হাড়কিপ্টে মনে করি না, আমি সাশ্রয়ী।”
“সাশ্রয়ী?”
“হুঁ। অপ্রয়োজনে খরচ করার থেকে টাকাটা যদি ব্যাগেই পড়ে থাকে, তাহলে ক্ষতি কী?”

(চলবে)

শঙ্খি নী
শঙ্খি নীhttps://www.golpopoka.com
গল্প বলতে ভালোবাসি

Related Articles

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Stay Connected

20,625ভক্তমত
3,633অনুগামিবৃন্দঅনুসরণ করা
0গ্রাহকদেরসাবস্ক্রাইব
- Advertisement -spot_img

Latest Articles