#অস্পষ্টতা
শেষ পর্ব
লেখা : শঙ্খিনী
তারিফ বলল, “আশফা? তোমার মনে কখনো প্রশ্ন জাগেনি, নিজের বাড়ি, নিজের কোম্পানি, নিজের মাকে ফেলে আমি এখানে চলে এসেছি কেন? কেন এসেছিলাম জানো? তোমার থেকে দূরে থাকার জন্য। তোমাকে ভালোবাসে, তোমার থেকে অল্প দূরত্বে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই দূরত্বটা কয়েক শ গুন বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু দেখো, তুমি নিজেই আবার সেই দূরত্ব কমিয়ে দিয়ে আমার কাছে চলে এলে।”
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, “ভালোবেসে?”
“ভালোবেসে। মনে আছে ডিভোর্সের সময় তোমাকে কি বলেছিলাম? বলেছিলাম আমি একটু শান্তিতে বাঁচতে চাই, ভালোভাবে বাঁচতে চাই। সত্যিটা কি ছিলো জানো? আমি চেয়েছিলাম তোমাকে ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ করে দিতে। ভেবেছিলাম আমি এক বিরক্তির বিষয় তোমার কাছে। আমি আশেপাশে থাকলে তুমি অশান্তিতে থাকো। তোমাকে শান্তি দিতেই ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি। সেদিন বলছিলে না, দেশের মাটি ছেড়ে বেশিদিন দূরে থাকলে তোমার অস্বস্তি লাগে। অস্বস্তি কিন্তু আমারও লাগে আশফা। কিন্তু একটা বছর ধরে, তুমি শান্তিতে আছো ভেবে আমিও আমেরিকায় ভালো ছিলাম।”
আমি নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি তারিফের দিকে। জীবনের সকল অস্পষ্টতা এক নিমিষেই দূর করে দিলো ছেলেটা!
তারিফ আবার বলতে লাগলো, “খেয়াল করেছ? এখানে আসার পর থেকে একবারও তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি, যে তুমি কেমন আছো? আমি জানি তুমি ভালো নেই আশফা। জানো কবে বুঝতে পেরেছিলাম, তুমি ভালো নেই? যেদিন বাংলাদেশে বসে আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলে তুমি। মুখে বলোনি, কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম।”
আমি বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে অবাক গলায় বললাম, “কিভাবে? থট রিডার তুমি?”
“না আমি থট রিডার না। কিন্তু তোমার মন পড়ার ক্ষমতা কিন্তু এখনো আমার আছে।”
এই কথাটা শুনে আবার আমার চোখ বেয়ে অঝরে জল পরছে।
তারিফ বলল, “প্রথম যেদিন জানতে পারলাম আমি কোভিড পজিটিভ, জানো তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াই কাজ করেনি আমার মধ্যে। মনে হয়েছিল, বাঁচলে বাঁচবো মরলে মরবো। এ আর এমন কি? কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমাকে বাঁচতেই হবে। মরে যাওয়া যাবে না। এই ঝরের দিন সমস্ত বাধা উপক্রম করে যে মানুষটা আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে, তার জন্যে হলেও বাঁচতে হবে। আশফা জানি না, কোনোদিনও এই দরজার বাইরে বেরিয়ে মুক্ত আকাশের নিচে দাড়াতে পারবো কিনা। যদি পারি, তবে তোমার হাতদুটো ধরেই দাড়াবো। তুমি আমাকে গ্রহণ করো বা না-ই করো। আমি সারাটাজীবন তোমার হয়েই থাকবো। তোমার ভালোবাসা, তোমার যত্ন, তোমার শাসন ছাড়া আমার যে কোনো অস্তিত্বই নেই।”
আমি আবার অনেক্ষণ চুপ করে থেকে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “একটু বেশি জ্বর এসেছে বলে এতগুলো ইমোশনাল কথা বলতে হয় কেন তোমার?”
এই কথাটা শুনে তারিফ হেসে দিলো। আমি কাচের দরজাটার ওপর হাত রাখলাম। ওপাশ থেকে সেও দরজার ঠিক একই জায়গায় হাত রাখলো। এই দরজাটাই এখন এখন আমাদের মধ্যকার একমাত্র দূরত্ব। এ দূরত্বকে কেটে যেতেই হবে।
এই ঘটনার পর দুদিন কেটে গেল। তারিফের জ্বরটা একেবারে সেরে গেল।
আজ খুব ভোরে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। এত ভোরে তারিফের সঙ্গে দেখা করতে গেলে কোনো লাভ হবে না। স্যার নিশ্চয়ই এখনো ঘুমাচ্ছেন। তাই চলে গেলাম বাগানের ফুল গাছ গুলোতে পানি দিতে। আমার মায়ের নিজ হাতে লাগানো গাছ। গাছগুলোর সঙ্গে নিশ্চয়ই তার ভালোবাসা জড়িয়ে আছে।
ফোনটা ঘরেই ফেলে এসেছিলাম।
সুইটি ভেতর থেকে চিৎকার করে আমাকে বলল, “আপা! আপনার ফোন বাজে!”
আমি দৌড়ে গেলাম ফোনের কাছে। আমার এই নম্বরে এই সময়ে একটা মানুষই ফোন করতে পারে, সে হলো তারিফ। তারিফের নাম দেখে আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোন তুললাম।
ব্যস্ত গলায় বললাম, “হ্যাঁ তারিফ, বলো!”
তারিফ শুকনো গলায় বলল, “একটা খারাপ খবর আছে।”
“খারাপ খবর? কি?”
“দ্বিতীয়বার টেস্ট করলাম না?”
“হ্যাঁ!”
“রেজাল্ট এসেছে এইমাত্র!”
আমি চিন্তায় অস্থির হয়ে বললাম, “সব ঠিক আছে তো তারিফ?”
“বুঝতে পারছি না।”
“কি এসেছে রেজাল্ট?”
“নেগেটিভ।”
আমি আনন্দে আত্নহারা হয়ে হাসতে হাসতে বললাম, “এই ছেলে, এটা খারাপ খবর?”
“আমার জন্য তো খারাপ খবর!”
“কেন?”
“এখন আর তোমার আদর যত্ন পাবো না।”
“খুব জেনে বসে আছো না? কোথায় তুমি এখন?”
“আপাতত বাসায়। তোমাকে একটা অ্যাড্রেস পাঠাচ্ছি। এক ঘণ্টার মধ্যে সেখানে চলে যাও!”
তারিফ যে জায়গাটার ঠিকানা পাঠিয়েছে, সেটা আসলেই অনেক সুন্দর। লেকের পাড়ে গাছপালায় ঘেরা এক পার্ক। জনমানবশূন্য এই পার্কে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষা করছি স্যারের জন্য। ঢাকা থেকে একটাই মাত্র শাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। সেই লাল শাড়িটাই পরেছি আজ।
অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ দেখতে পেলাম তাকে। সেই চিরচেনা হাসি ঠোঁটে নিয়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বিগত একটা বছর ধরে শুধুমাত্র এই মুহূর্তটার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না-কি? কিছু একটা তো করা উচিত।
এরই মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে এসে আমার মুখোমুখি দাড়ালো।
আমি থেমে থেমে বললাম, “তোমাকে জড়িয়ে ধরতে পারি তারিফ?”
কথাটা বলার পর আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারিফ আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম তাকে।
প্রাণশক্তি ফিরে পেলাম যেন। নতুন করে বেঁচে থাকার শক্তি এলো আমার প্রাণে। তারিফ আমার কাছে এক ভয়ঙ্কর আসক্তি। যে আসক্তি থেকে কখনো নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে না।
অনেকটা সময় এভাবে থাকার পর তারিফ কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমাকে বলল, “আশফা? আমাকে দেশে নিয়ে চলো।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “হুঁ!”
“মায়ের কাছে নিয়ে চলো।”
“হুঁ!”
“তোমার কাছে নিয়ে চলো।”
“তারিফ? আমাকে ক্ষমা করতে পারবে আমায়?”
“ক্ষমা করার মতো কোনো অপরাধ কি তুমি করেছো?”
“করিনি?”
“না তো!”
“তাহলে করিনি। এখন একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হুঁ!”
“উইল ইউ ম্যারি মি অ্যাগাইন?”
তারিফ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “না!”
আমি মন খারাপ করে বললাম, “না?”
“না মানে, অফকোর্স আই উইল ম্যারি ইউ। কিন্তু তোমার প্রপোজাল একসেপ্ট করতে পারবো না। আগেও আমি প্রথমে প্রপোজ করেছিলাম এবারো আমি প্রথমে করবো।”
আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম।
আজকের দিনটা আমাদের দুজনের জীবনেরই শ্রেষ্ঠ দিন। স্বপ্নেরও কখনো ভাবতে পারিনি আমার ভালোবাসাকে আবার ফিরে পাবো। আমাদের মধ্যে যতই মান অভিমান, যতই ভুল বোঝা বোঝি থাকুক না কেন দিন শেষে পরস্পরকে অসম্ভব ভালোবাসি। জগতের সকল সত্য মিথ্যা প্রমানিত হলেও, এই ভালোবাসার সত্যতা কখনো হারিয়ে যাবে না। এই দুর্যোগকালীন সময়টা আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে থাকবে আজীবন।
আজকে সারাদিন খোলা আকাশের নিচে প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিবো, তারিফের হাত ধরে ঘুরে বেড়াবো এই স্বপ্নের শহরে। আর সবশেষে, মনে এক রাশ ভালোবাসা নিয়ে ফিরে যাবো আমাদের সেই পুরনো নীড়ে, জীবনের নতুন এক অধ্যায় লিখতে।
(সমাপ্ত)