#অস্পষ্টতা
পর্ব – ১৪
লেখা : শঙ্খিনী
একটা মানুষ যখন কঠিন কোনো রোগ থেকে সেরে ওঠে, তখন চারপাশের সকল কিছুই তাকে মুগ্ধ করে। আমিও এক কঠিন রোগ থেকে সেরে উঠেছি, মনের রোগ। শরীরের রোগের মতো, মনের রোগটাও কিন্তু বড় এক রোগ। তারিফের সঙ্গে কথা না বলতে পারা, চাইলেই ওকে দেখতে না পারা আমার কাছে এক বিশাল রোগ। তবে এখন সেই রোগ থেকে আমি মুক্ত। তাই নিউইয়র্ক সিটির রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আর মুগ্ধ হচ্ছি।
হেঁটে হেঁটে তারিফের জন্য খাবার নিয়ে ওর বাসায় যাচ্ছি। ওর বাসার সামনে গিয়ে খানিকটা চমকে উঠলাম। এক আমেরিকান ভদ্রলোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তারিফের সঙ্গে।
আমি অনিশ্চিত মুখে ছোট ছোট পা ফেলে সেদিকে এগিয়ে গেলাম।
আমাকে দেখে তারিফ হাসিমুখে লোকটাকে বলল, “এন্ড্রু মিট মাই ওয়াইফ, আশফা।”
আমি একটা মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। তারিফ কি বলল? ওয়াইফ! আমাকে এখনো নিজের স্ত্রী মনে করে তারিফ! আনন্দে আমার চোখে জল চলে আসার উপক্রম।
লোকটা আমাকে বলল, “নাইস টু মিট ইউ!”
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি মুখে বললাম, “নাইস মিটিং ইউ টু!”
লোকটা এবার তারিফকে বলল, “ইউ বেটার টক টু ইউর ওয়াইফ, তারিফ। এই উইল সি অনাদার ডে। টেক কেয়ার।”
তারিফ বলল, “থ্যাংক ইউ, সি ইউ লেটার।”
লোকটা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বললাম, “এই তুমি তখন কি বললে?”
“সি ইউ লেটার!”
“না, না তার আগে। আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময়। আমি তোমার কে হই?”
“ওহ্, আচ্ছা। কেন ওয়াইফ বলে পরিচয় দিয়েছি বলে মাইন্ড করেছো না-কি?”
আমি ইতস্তত হয়ে বললাম, “মাইন্ড করবো কেন? আসলে… আচ্ছা বাদ দাও! লোকটা কে ছিলো?”
“এন্ড্রু। আমার কলিগ। বেচারার আপন বলতে কেউ নেই। তার বাবার সঙ্গে থাকে, কিন্তু বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত।”
“পক্ষা হোয়াট?”
“পক্ষাঘাতগ্রস্ত।”
“সেটা আবার কী?”
“প্যারালাইজড।”
“ওহ্! কি আজব! এত কমন একটা শব্দের বাংলা অর্থই জানতাম না এতদিন। কি করলাম জীবনে!”
“করোনাটা আসাতে এক দিক দিয়ে ভালোই হলো। মানুষ নিজের জন্যে সময় পাচ্ছে, পৃথিবীর জন্য সময় পাচ্ছে, চারপাশের পরিবেশের জন্য সময় পাচ্ছে। কালকে সারারাত বসে, ডিকশনারি ঘেটে ঘেটে এ ধরনের শব্দগুলো বের করেছি। করোনা না হলে আমার মতো মানুষ ডিকশনারি হাতে বসে আছে, দৃশ্যটা দুর্লভ।”
আমি মৃদু হেসে বললাম, “তোমার সেকেন্ড টেস্ট করতে কবে আসবে?”
“আসবে। দুই সপ্তাহ হয়নি তো এখনো।”
“ও হয়নি? আচ্ছা, মা তোমাকে ফোন করেছিল আজকে?”
“হুঁ।”
“খুব টেনশন করে না?”
“করত। তুমি এখানে আসার পর থেকে আর করে না। বলে, আমার মেয়ে এখন ওখানে আছে, দেখবি ঠিকই তোকে সুস্থ করে তুলবে!”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “এখানে কিভাবে যে এতদিন ধরে আছো কে জানে! নিজের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও থাকতে ভালো লাগে?”
“কেন তোমার ভালো লাগছে না?”
“নাহ্, অল্প কিছুদিন হলো এখানে এসেছি। এরমধ্যেই অস্বস্তি লাগছে। দেশের মাটিতেই আলাদা একটা ব্যাপার আছে। এখানকার মাটিতে সেটা নেই।”
“কারন এখানে মাটিই নেই, সব কংক্রিট। আসলে…”
আমি হঠাৎ তারিফকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “এক সেকেন্ড!”
“কি?”
“কালকে সারা রাত তুমি ডিকশনারি নিয়ে বসে ছিলে?”
“হ্যাঁ।”
“তার মানে সারা রাত ঘুমাওনি?”
তারিফ ইতস্তত হয়ে বলল, “না, না। আসলে হয়েছে কি…”
“আচ্ছা, তোমার এই ফালতু অভ্যাসটা কবে যাবে একটু বলো তো? আমি শুধুমাত্র একটাই রিকুয়েস্ট করেছিলাম, প্লিজ নিয়ম গুলো ফলো করে! কিন্তু না, রাত না জাগলে স্যারের চলবে কিভাবে?”
তারিফ অসহায় গলায় বলল, “আচ্ছা আমাকে বকাঝকা না করলে কি তোমার দিনটা ভালো কাটে না?”
আমি রাগী দৃষ্টিতে তাকালাম ওর দিকে। কিন্তু রাগটা ধরে রাখতে পারলাম না। খিলখিল করে হেসে উঠলাম।
আমি আবার বললাম, “আচ্ছা এই ফুলের টবগুলো কি তোমার পছন্দ করা?”
“হুঁ।”
“তোমার চয়েজ খুবই খারাপ।”
“তুমিও কিন্তু আমার চয়েজ ছিলে?”
“আমি কি খুব ভালো ছিলাম?”
আমরা দুজন আবার হেসে উঠলাম। ছোট ছোট ব্যাপার নিয়ে ঠাট্টা করা আমাদের বন্ধুকালীন অভ্যাস।
আমাদের দিনগুলো এভাবেই কেটে গেল। তারিফের ভালোবাসা কোনোদিন ফিরে পাবো কিনা জানি না, তবে এর মধ্যে আমার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি। বন্ধুত্ব হলো অসাধারন একটা সম্পর্ক। আমার আর তারিফের মধ্যে এই অসাধারন সম্পর্কটা ছিল।
এয়ারপোর্টের পিছনের পার্কে দেখা করা, গল্প করা, হাত ধরা, কাধে মাথা রাখার দিনগুলোর একটা আভাস পেতে শুরু করেছি।
আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। কি যেন মনে করে তারিফকে এমএমস পাঠালাম, “আজকে কেমন লাগছে?”
কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যারের রিপ্লাই এলো, “জানি না।”
আমি চিন্তায় অস্থির হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ওকে ফোন করলাম।
তারিফ ফোন তুলতেই আমি ব্যস্ত গলায় বললাম, “তারিফ? ঠিক আছে তুমি?”
“ঠিকই আছি, হালকা জ্বর জ্বর লাগছে।”
“আমি এখনি আসছি।”
“এত ব্যস্ত হতে হবে না আশফা…”
তারিফ কথা বাড়ানোর আগেই আমি ফোন রেখে দিলাম। তারিফের একটা বাজে স্বভাব হলো, নিজে হাজার কষ্ট পেলেও মুখে বলবে “তেমন কিছু হয়নি।”
আমি প্রায় ছুটে গেলাম ওর বাড়িতে। কলিংবেল চাপতেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো তারিফ। তবে আজ তাকে খুব অন্যরকম লাগছে। অনেক বিপর্যস্ত বলে মনে হচ্ছে।
আমি ব্যস্ত গলায় বললাম, “জ্বর কি অনেক বেশি? জ্বর মেপেছো তুমি? এখনি থার্মোমিটার নিয়ে আসো!”
“আশফা, আশফা শান্ত হও। মেপেছি।”
“কত? কত জ্বর?”
তারিফ অস্পষ্ট গলায় বলল,“এক’শ দুই।”
“হায় আল্লা!”
“তেমন কিছু না, এখনি ঠিক হয়ে যাবে।”
“তুমি চুপ করো তো! পালস্ চেক করছো? পালস্ কত?”
“পালস্ ঠিক আছে।”
“কত?”
“ছিয়ানব্বই।”
“এই তুমি ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও তো! আর ওই ওষুধটা তো শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কালকেই শেষ হয়ে গিয়েছিল না? তুমি আমাকে বলোনি কেন?”
“ওষুধ আছে আশফা। তুমি একটু শান্ত হবে?”
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “কিভাবে শান্ত হবো আমি? কিভাবে হবো? বলতে পারো? এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও রেস্ট নাও!”
তারিফ অসহায় গলায় বলল,“আশফা, শান্ত হয়ে আমার একটা কথা শুনবে প্লিজ?”
“কী কথা?”
(চলবে)