অস্পষ্টতা – পর্ব : ১৩

0
1349

#অস্পষ্টতা
পর্ব – ১৩

লেখা : শঙ্খিনী

সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ দেখি ফোনটা বেজে উঠলো আমার। ‘এ সময়ে আবার কে ফোন করলো’ ভেবে খানিকটা চমকে গেলাম। আরও বেশি চমকে গেলাম, যখন দেখতে পেলাম ফোনটা করা হয়েছে আমেরিকান নম্বর থেকে।

আমি ভয়ে ভয়ে ফোনটা তুললাম।

কাঁপা গলায় বললাম, “হ্যালো? হু’স স্পিকিং?”

শুনতে পেলাম আমার অতি পরিচিত এক কণ্ঠ। আমার তারিফের কণ্ঠ।

“থ্যাংক ইউ।”
আমি চমকে উঠে বললাম, “তারিফ? এই নম্বর তুমি কোথায় পেলে?”
“ভুলে যেও না, এখন কিন্তু আমি তোমার প্রতিবেশী। নম্বর জোগাড় করাটা কোনো ব্যাপার না।”
“মা দিয়েছে না?”
“হুঁ।”
“আমি মানা করলাম তোমাকে বলতে, কিন্তু কোনো কথাই শুনলো না!”
“কেন? মানা করেছিলে কেন?”
আমি অস্পট গলায় বললাম, “না, মানে… আচ্ছা এসব বাদ দাও! তুমি কেমন আছো?”
“কোভিড নাইনটিন পজিটিভ, ভালো থাকি কিভাবে?”
“শরীর যে ভালো নেই সেটা কিন্তু আমিও জানি। আমি জিজ্ঞেস করছি মনের কথা। মন কেমন আছে?”
বেশ অনেক্ষণ চুপ করে থেকে শুকনো গলায় তারিফ বলল, “আমি জানি না আশফা।”

আমি আবার চমকে উঠলাম। আজ অনেকদিন পর আমাদের স্বাভাবিক ভাবে কথা হচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো, আবার বুঝি আগের জীবনে ফিরে এসেছি।

কথা ঘোরানোর জন্যে আমি বললাম, “তোমার সিমটমস কেমন?”
“তেমন একটা সিমটমস নেই। সারাদিন অল্প কাশি-টাশি থাকে, রাতের দিকে আবার জ্বর আসে। তাও আবার আলতু ফালতু টাইপের জ্বর। নিরানব্বই এক’শর মধ্যেই থাকে।”
“তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো তারিফ। মিস্টার উনস্টপেবেলকে যেন এই ভাইরাস থামাতে না পারে। আমি রাতে খাবার দিয়ে যাবো।
তারিফ আবার অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “দূর থেকে একটু দেখা করে যেও প্লিজ।”
আমি ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি নিয়ে বললাম, “যাবো।”

কী পরিমান আনন্দ যে হচ্ছে, ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারবো না। আজ আবার বন্ধুর মতো কথা বলল ছেলেটা আমার সঙ্গে। তারিফ যে আমাকে ভুলে যায়নি, আমার নামটা মনে রেখেছে, ভেবেই ধন্য মনে হচ্ছে নিজেকে।

রাতে খুব ভয়ে ভয়ে আবার গিয়ে দাঁড়ালাম তারিফের বাড়ির দরজার সামনে। আমি চিন্তায় অস্থির হয়ে আছি। ওর মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য, খুব কষ্ট করে নিজের ভেতরে সাহস সঞ্চয় করেছি।

একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলিংবেল চাপলাম।

বাড়ির দরজাটা কাচের। তাই বাইরে কেউ দাড়িয়ে থাকলে ভেতর থেকে খুব সহজেই দেখা যায়।

আমার হাত পা শক্ত হয়ে এসেছে, পা দুটো ঝিমঝিম করছে, নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। আর একটু হলেই জ্ঞান হারাবো আমি।

চোখ দুটো বন্ধ করে দাড়িয়ে আছি। একটু পরে চোখ খুলে দেখতে পেলাম, দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে তারিফ।

আমার চোখ থেকে অনবরত জল পরছে। অনেক চেষ্টা করছিলাম চোখের জল ধরে রাখতে, পারলাম না।

তারিফ আমাকে দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।

বেশ অনেক ক্ষণ পর নীরবতা ভঙ্গ করে তারিফ বলল, “একটুও বদলাওনি তুমি।”
আমি চোখের জল মুছতে মুছতে গলার স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললাম, “তুমিও।”
“চলে আসলে তাহলে আমার জন্য।”
আমি ইতস্তত হয়ে বললাম, “তোমার জন্য আসিনি তো। এখানে একটা জরুরী কাজ ছিল, তাই এসেছি।”
তারিফ হেসে বলল, “আশফা, তুমি মিথ্যা বলতে পারো না। চেষ্টাও কেন করো বলো তো!”
“আচ্ছা, ওসব বাদ দাও। তুমি ঠিক আছো? জ্বর টর আসেনি তো?”
“বুঝতে পারছি না।”
“বুঝতে পারছি না মানে? জ্বর মাপোনি?”
“না।”
“থার্মোমিটার নিয়ে আসো!”
“হুঁ?”
“থার্মোমিটার নিয়ে আসো, এখনি জ্বর মাপতে হবে।”
“আমি পরে মেপে নিবো…”
“তোমার কোনো কথা আমি শুনবো না, এখনি নিয়ে আসো!”

তারিফ অসহায়ের মতো থার্মোমিটার আনতে চলে গেল।

মিনিট কয়েকের থার্মোমিটার মুখে নিয়ে ফিরে এলো। জ্বর মাপা শেষ হলে যেই তারিফ মুখ থেকে থার্মোমিটার বের করলো,

আমি ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বললাম, “এই, আগে আমাকে দেখাও!”

তারিফ বাধ্য ছেলের মতো থার্মোমিটার আমার দিকে ঘুরিয়ে ধরলো।

তারিফ বলল, “কত জ্বর?”
আমি ভালো করে খেয়াল করে বললাম, “আটানব্বই পয়েন্ট… না, না! নিরানব্বই পয়েন্ট তিন।”
“দেখলে, বলেছিলাম না আলতু ফালতু টাইপের জ্বর আসে।”
“আলতু ফালতু বলো আর যাই বলো, ঠিকমতো নিজের যত্ন নিবে কিন্তু। নিয়ম গুলো প্লিজ একটু ফলো কোরো। আর ভিটামিন সি বেশি করে খাবে। ভিটামিন সি কিন্তু শরীরে জমা থাকে না, তাই বারবার খেতে হবে। আমি লেমনেড নিয়ে এসেছি, পুরোটা খাবে!”
তারিফ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, “এতকিছু করে লাভ কি? মরেই তো যাবো!”
“বাজে কথা বলা বন্ধ করো তারিফ। কোভিড পজিটিভ হওয়া মানেই মরে যাওয়া না।”
“কি আজব একটা রোগ না! একটা মানুষকে শারীরিক মানসিক দুভাবেই নিঃসঙ্গ করে দেয়।”
“আর নিজেকে নিঃসঙ্গ ভাবতে হবে না! আমি চলে এসেছি, এখন প্রতিদিন দু তিন বার করে এসে তোমাকে বিরক্ত করবো।”

আমার যে আজ কতটা আনন্দ হচ্ছে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারবো না। অনেক দিন পর আজ রাতে শান্তির একটা ঘুম হবে। তারিফকে দেখে, ওর সঙ্গে কথা বলে – সত্যিই প্রাণশক্তি ফিরে পেলাম আমি।

পরদিন বিকেলে, হঠাৎ মনে পড়লো বিকেলে কফি খাওয়ার অভ্যাস ছিল তারিফের। এখনো আছে কিনা কে জানে! ছেলেটার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে গেলে কেমন হয়?

ভাবনা অনুযায়ী তারিফের প্রিয় এসপ্রেসো বানিয়ে নিয়ে গেলাম। শুধু তার একার জন্যেই নয়, আমার জন্যেও এক কাপ বানিয়েছি। অনেক দিন পর তারিফের সঙ্গে বসে কফি খাওয়ার একটা সুযোগ হতে যাচ্ছে।

আমি ওর বাড়ির দরজার সামনে কফি রেখে, কলিংবেল চেপে বেশ অনেকটা দূরে সরে গেলাম। কলিংবেলের আওয়াজে দরজার ওপারে এলো তারিফ। আমাকে এত দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকালো।

আমি কিছুটা চিৎকার করে বললাম, “কফি! দরজার সামনে!”

তারিফ দরজা খুলে বেরিয়ে কফি নিয়ে আবার ঘরের ভেতরে চলে গেল।

আমি এবার ওর দরজার সামনে গিয়ে বললাম, “বসলাম!”

ওর উত্তর দেওয়ার আগেই দরজার সামনে মাটিতে বসে পরলাম। আমার দেখাদেখি স্যারও দরজার ওপাশে ঘরের মেঝেতে বসলো।

কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “কফি? বাব্বাহ! আচ্ছা, তুমি কি বাই এনি চান্স, আমার সাথে আবার প্রেম ট্রেম করার চেষ্টা করছো?”
আমি হাসলাম।
তারিফ সামান্য ভ্রু কুঁচকে বলল,“হাসলে কেন?”
“হাসি পেল তাই!”
“হাসি পেল কেন?”
“উফ তারিফ, তোমার কথা পেঁচানোর অভ্যাসটা আর গেলোনা!”
“ওর আচ্ছা, কথা আমি পেচাতাম না?”
“আবার? কফিটা ভালো হয়েছে না?”
“হুঁ, একদম আগের মতো।”
“আগের থেকেও ভালো হয়েছে।”
“শোনো,তোমার সব কিছুই আগের মতো আছে। যখন আমার ছিলে, তখনকার মত।”
“আমি এখন অন্য কারোর না তারিফ।”
“আমারও তো না।”
একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে, কথা ঘোরাতে বললাম, “নিউইয়র্ক সিটি কতো সুন্দর! ভালোভাবে ঘুরে দেখার সুযোগই পেলাম না।”
“ঘুরে নাও আশফা, ঘুরে নাও। জীবনটা অনেক ছোট বুঝছো। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায়!”

তারিফের এই কথাটা শুনে বেশ অনেক ক্ষণ চুপ করে থাকলাম। চোখের কোণে কখন যে দু এক ফোঁটা জল জমে গেলো, খেয়ালই করিনি।

অস্পষ্ট গলায় বললাম, “সেই ছোট জীবনে তুমি এলে কেন তারিফ? আমার জীবন তো এখন দেখতে দেখতে শেষ হবে না।”
তারিফ চুপ করে রইলো।
আমি আবার বললাম, “প্রতিটা মানুষের পাশে সারাজীবন একটা নির্দিষ্ট মানুষের হাত প্রয়োজন। যে হাতটা ক্লান্ত দিনে কাধেঁর ওপর থাকবে, দুঃখের দিনে চোখের জল মুছে দিবে, চলার পথে হোচট খেয়ে পড়ে গেলে টেনে তুলবে। আমি তোমার জীবনে সেই হাতটা হতে চেয়েছিলাম।‌ কিন্তু কখনো বুঝতেই পারিনি যে, সেই হাতটা হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই।”
“কে বলেছে নেই? যোগ্যতা আছে বলেই তো এই ঝরের দিনে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছো। এই বাড়িটাতে বন্দী থেকেও, শুধুমাত্র তোমার জন্যে আমি একটা নই।”
“নিজেকে বন্দী ভেবোনা তারিফ। আজ তুমি অসুস্থ, বন্দী। কিন্তু কাল তো তুমি আবার সুস্থ হয়ে যাবে, আবার সারা শহর দাপিয়ে বেড়াবে।”
“আর যদি সেই সুযোগ না পাই? যদি কাল, আমার মধ্যে থাকা এই বিদেশি পরজীবী, আমাকে সেই সুযোগ না দেয়?”
“তাহলে কিন্তু প্রকৃতির কাছ থেকে আরও একটা মানুষ নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ হারাবে।”

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে