#অস্পষ্টতা
পর্ব – ১১
লেখা : শঙ্খিনী
মাস খানেকের মধ্যেই হয়ে গেল আমাদের ডিভোর্স। চোখের সামনে আমার গোছানো জীবনটা তছনছ হয়ে যাচ্ছিল। যা ঘটছিল, তা একদমই বাস্তব মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল এটা কোনো এক দুঃস্বপ্ন, একটু পরেই ঘুম ভেঙে যাবে।
ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর, ডিভোর্স লয়াড়ের অফিসে বসেই
মা কঠিন গলায় তারিফকে বলে দেয়, “আশফা ছিল এতদিন আমার ছেলের বউ। কিন্তু আজকে থেকে সে আমার মেয়ে। আমার মেয়ে আমার সঙ্গেই থাকবে। তোর যদি ইচ্ছে হয় তাহলে ওখানে থাকতে পারিস, আর না হলে এখন যেখানে আছিস সেখানেই থাকবি।”
কথাটার কোনো উত্তর না দিয়ে তারিফ চলে গেলো।
বিষন্নতা যে কি জিনিস আমি তখন বুঝতে পেরেছিলাম। আমার কাছে তারিফকে ছাড়া বেঁচে থাকাটাই একটা বিষন্নতা। পৃথিবীর কোনো কিছুই আর ভালো লাগছিল না। বারবার শুধু মনে হচ্ছিল, আমার সাথেই কেন এমন হলো?
এভাবেই কেটে গেল মাসখানেক। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন আমাদের বাসায় এলো তারিফ।
ওকে একঝলক দেখে যেন হারানো প্রাণশক্তি ফিরে পেলাম আমি।
তারিফ বসার ঘরে বসল। মাকে কি যেন জরুরী কথা বলতে এসেছে। আমি আড়াল থেকে শুরু ওকে দেখছিলাম।
তারিফ শুকনো গলায় মাকে বলল, “মা আমি নিউইয়র্কে যাচ্ছি।”
মা বলল, “ও! কতদিনের জন্য?”
“সবসময়ের জন্য।”
“কি?”
“ওখানকার এক কোম্পানি থেকে জব অফার পেয়েছি। এত বড় একটা সুযোগ হাতছাড়া করবো না।”
মা অবাক হয়ে বলল, “অফারটা কবে পেলি?”
“এইতো কিছুদিন আগে।”
“কবে যাচ্ছিস?”
“আগামী মাসের তিন তারিখে।”
“যেতেই হবে?”
তারিফ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “হ্যাঁ।”
আমার কান গরম হয়ে এলো কথাটা শুনে। চারপাশের সবকিছু যেন ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরছিল। তারিফ আমার কাছ থেকে এতটা দূরে চলে যাবে!
আমি যে আড়াল থেকে ওর কথা শুনছিলাম, এটা বুঝতে পেরে যায় তারিফ। হঠাৎ উঠে আমার কাছে আসে।
স্বাভাবিক গলায় আমাকে বলে, “মায়ের খেয়াল রেখো।”
দায়িত্বটা খুব ভারি না হলেও আজ পর্যন্ত মন দিয়ে পালন আরে আসছি।
তারিফ আমেরিকায় চলে যাওয়ার পর অফিসে ওর জায়গাটা আমি নিই। ওর হয়ে দায়িত্ব পালন করছি।
মানুষের মস্তিক কত অদ্ভুত তাই না? আমরা যে স্মৃতিগুলো মনে রাখতে চাই, মস্তিস্ক সেগুলো মনে করিয়ে দেয় না। অথচ যে স্মৃতিগুলো ভুলে যেতে চাই, সেগুলোই বারবার মনে করিয়ে দেয়। আমাদের এই স্মৃতিগুলো আমি কখনোই ভুলতে চাই না। আবার বারবার মনেও করতে চাই না।
আজ প্রায় এক বছর পর তারিফের সঙ্গে কথা হলো, তাই এ স্মৃতি গুলো মনে পড়ে গেল।
আজ যখন ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলাম, তখন চিৎকার করে ওকে বলতে ইচ্ছা করছিল “আমি ভালো নেই তারিফ! আমি ভালো নেই।”
আমাদের এই স্মৃতিগুলো মনে আছে বলেই আমি বেঁচে আছি। কিন্তু ভয় হয়, যদি কোনো দিন এগুলো ভুলে যাই? নতুন স্মৃতি তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগই যে আর নেই।
এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পরলাম। সকালে উঠে দেখি মায়ের মুখটা শুকনো হয়ে আছে। কোনো একটা বিষয় নিয়ে হয়তো ভীষন চিন্তিত সে।
আমি মায়ের কাছে গিয়ে বললাম, “কী হয়েছে মা?”
“কিছু না।”
“কিছু একটা তো হয়েছে। বলো তো কী হয়েছে!”
“না থাক, বললে আবার তুই মন খারাপ করবি।”
“আমি মন খারাপ করতে পারি, এমন কোনো বিষয় থেকে থাকলে তো আমার সবার আগে জানা উচিত। এখন বলো তো কী হয়েছে!”
“শোন না, তারিফ ফোন করেছিল আজকে সকালে। ওর না-কি শরীর খারাপ লাগছে।”
আমি চমকে উঠে বললাম, “বলো কি? বাইরে-টাইরে যাইনি তো?”
“বলে তো না। কিন্তু ভাবে মনে হলো গিয়েছে।”
“মা ও কোভিড টেস্ট করছে?”
“না মনে হয়।”
“তুমি এখনো তারিফকে ফোন করো তো। ফোন করে বলো আজকেই টেস্ট করাতে!”
“করোনা-টরোনা কিছু হয়নি তো?”
“না, না! কী আর হবে? মনের শান্তির জন্য টেস্ট করানো আর কি। তুমি ফোন করো তো!”
মা সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলো তারিফকে। কোভিড টেস্ট করানোর ব্যাপারে তারিফ প্রথমে কিছুটা আপত্তি করলেও শেষে ক্ষীণ গলায় বলে, “ঠিক আছে, করাবো টেস্ট!”
এরপর কেটে গেল তিন দিন। আজ অনেক দিন পর আগে আগে ঘুম আসছিল। তাই ঘুমিয়ে পরি। কিন্তু সে ঘুম বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মাঝ রাতেই মায়ের ডাক শুনতে পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল।
মা আমাকে ধীরে ধীরে ধাক্কা দিয়ে বলছেন, “আশফা, এই আশফা! মা একটু ওঠ না!”
আমি লাফ দিয়ে উঠে বলি, “কি হয়েছে মা? কয়টা বাজে?”
“একটা।”
“তুমি কাঁদছো কেন মা?”
“তারিফ…”
আমি ব্যস্ত হয়ে বলি, “কী হয়েছে তারিফের?”
মা থেমে থেমে বলল, “করোনা।”
আমি চমকে গিয়ে বললাম, “কি?”
“একটু আগে রেজাল্ট দিয়েছে। তারিফ করোনা পজিটিভ।”
আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। চারপাশের সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
আমি তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ালাম।
বিপর্যস্ত গলায় মাকে বললাম, “মা আমার ফোনটা একটু দাও তো!”
মা খাটের পাশে থাকা টেবিল থেকে ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি দ্রুত তার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে শিমুল ভাইকে ফোন করলাম। শিমুল ভাই আমার এক আত্মীয়, পেশায় একজন ট্রাভেল এজেন্স।
এবার রিং হওয়াতেই তিনি ফোন তুললেন।
আমি ব্যস্ত গলায় তাকে বললাম, “শিমুল আমার ঢাকা টু নিউইয়র্ক ফ্লাইটের টিকিট লাগবে। খুব ইমারজেন্সি।”
তিনি বললেন, “আশফা তুমি শান্ত হও। টিকিট তো এখন পাওয়া যাবে না। সব ফ্লাইট তো বন্ধ।”
“কোনো ইমার্জেন্সি ফ্লাইটও নাই?”
“ইমার্জেন্সি ফ্লাইট দু একটা থাকলেও থাকতে পারে। তোমার আমেরিকান ভিসা আছে?”
“হ্যাঁ আছে।”
“ভিসা থাকলে সহজেই ইমার্জেন্সি অ্যাপ্লাই করা যায়।”
“কিভাবে অ্যাপ্লাই করবো?”
“তোমার পাসপোর্ট আর ভিসার ডিটেইলস আমাকে মেইল করে পাঠিয়ে দেও, আমি ব্যাবস্থা করছি। আর তোমার কবের টিকিট লাগবে?”
“যত দ্রুত সম্ভব।”
ফোন রেখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মা হতভম্ব হয়ে আমাকে বলল, “এই সময়ে ফ্লাইটের টিকিট দিয়ে কি করবি।”
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “আমি তারিফের কাছে যাবো মা! মা ওর কিছু হবে না তো না? ওর কিছু হলে আমি কী করবো? আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না!”
“তুই শান্ত হ। কিচ্ছু হবে না তারিফের। আবার আগের মতো ভালো হয়ে যাবে।”
মা আর আমি দুজনেই সারা রাত জেগে রইলাম। ঘুম আসবেনা, তাই ঘুমানোর চেষ্টাও করলাম না।
ভোর রাতে মা ক্লান্ত গলায় আমাকে বলল, “এত কিছু হয়ে ঘটে যাওয়ার পরও তারিফকে নিয়ে এত চিন্তা করছিস কেন?”
আমি ছোট্ট এক দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম, “ওইযে, ফালতু একটা জিনিস, ভালোবাসা। সেটার কারনে। আমি তারিফকে প্রচন্ড ভালোবাসি মা।”
“এখনো?”
“সত্যিকারের ভালোবাসা বাড়তে কমতে পারে, কিন্তু কখনো ধ্বংস হতে পারে না।”
দিনটা খুবই এলোমেলো ভাবে কাটল আমাদের। সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ শিমুল ভাইয়ের ফোন! আমি ব্যস্ত হয়ে ফোন তুলতেই শুনতে। পেলাম তার উৎফুল্ল গলা।
শিমুল ভাই বলল, “কাজ হয়ে গেছে আশফা!”
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “পারমিশন পেয়ে গেছেন?”
“হ্যাঁ। পরশু রাতে তোমার ফ্লাইট।”
“শিমুল ভাই, আপনার এই উপকার আমি কোনো দিন ভুলতে পারবো না। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”
“থ্যাংক ইউ বলার কিছু নাই, এটা তো আমার দায়িত্ব। আচ্ছা এত তাড়াহুড়ো করে নিউইর্য়ক যেতে হচ্ছে কেন বলোতো!”
“আমার অনেক আপন একজন অসুস্থ। তাকে সুস্থ করে তুলতে যাচ্ছি।”
(চলবে)