#অস্পষ্টতা
পর্ব – ১০
লেখা : শঙ্খিনী
দুটো দিন কেটে গেল। ওই দুটো রাতে আমার চোখ থেকে ঘুম চলে গেল। আমি যে কত বড় ভুল করেছি তা উপলব্ধি করতে এই দুটো দিনেই যথেষ্ট। সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ কথাটা আমার ক্ষেত্রেই ফলে। মালা ভাবীর কতগুলো অযৌক্তিক অ্যাসাম্পেশনসকে সত্যি মনে করে যে কতটা দুঃখ দিয়েছি আমার তারিফকে, এটা ভেবেই আমার চোখ মুখ রক্তশূন্য হয়ে উঠলো।
ঠিক করলাম, ক্ষমা চাইতেই হবে তারিফের কাছে। না হলে কোনোদিনও শান্তি পাবো না আমি।
গুলশানে আমাদের দুটো ফ্ল্যাট আছে। তার একটাতে তখন থাকছিল তারিফ। সেদিন সকালে উঠেই অমি সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করি।
নিজ হাতে তারিফের পছন্দের সব খাবারগুলো রান্না করি। তারিফের পছন্দের নীল শাড়িটা পরে ওর মনের মতো করে সাজি।
আমি যখন তৈরি হচ্ছিলাম, তখন মা আমার ঘরে আসে।
আমি বললাম, “কিছু বলবে মা?”
“হুঁ। তোর নামে একটা পার্সেল এসেছে।”
“আমার নামে? কি পার্সেল।”
“জানিনা। তবে একটা খাম।”
“খামটা কোথায়?”
মা খামটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই নে।”
আমি মায়ের হাত থেকে খামটা নিই। খামটা খুলে যা দেখি, তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি।
খামের ভেতরে থাকা কাগজে বড় বড় করে লেখা, ‘স্বামী কর্তৃক তালাকের হলফনামা’। আমার পুরো পৃথিবীটা এক মুহূর্তের মধ্যে এলোমেলো হয়ে গেল। এমন একটা আকস্মিক ঝরের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি।
আমি সোজা চলে গেলাম তারিফের কাছে।
ওর মুখোমুখি হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তারিফ? আমার আর তোমার মধ্যে কি এমন হয়েছে যার আমাকে ডির্ভোস লেটার পাঠাতে বাধ্য হয়েছ তুমি?”
তারিফ স্বাভাবিক গলায় বলল, “কেন ডিভোর্স নেওয়ার মতো সিচুয়েশন কি আমার মধ্যে তৈরি হয়নি?”
“না হয়নি।”
“ঠিক আছে, মেনে নিলাম হয়নি। আমি সজ্ঞানে, স্বইচ্ছায় তোমাকে ডির্ভোস দিতে চাই।”
আমি স্তম্ভিত হয়ে বললাম, “কেন?”
“কারন আমি শান্তিতে বাঁচতে চাই। আমার স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করুক এটা আমি চাই না।”
“আমি যদি তোমার কাছে ক্ষমা চাই?”
“আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। প্লিজ, আমাকে মুক্তি দাও!”
আমার চোখ বেঁয়ে অনবরত জল পরছে। কোনো কিছুর বলার মতো ভাষা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম।
বহু কষ্টে নিজেকে সামলে বললাম, “শুধুমাত্র তোমার বন্ধুদের ইনসাল্ট করেছি বলে আমাকে এত বড় শাস্তি দিবে?”
“শুধুমাত্র আমার বন্ধুদের ইনসাল্ট করোনি তো। আমাকে ইনসাল্ট করেছ, আমার লাইফস্টাইলকে ইনসাল্ট করেছ। সবকিছুরই তো একটা সীমা আছে। আমার সহ্যের সীমাটা না ছাড়িয়ে গেছে। আমি আর তোমাকে নিতে পারবো না। আই অ্যাম স্যরি।”
“তারিফ বিশ্বাস করো, আমি নিজের ইচ্ছায় কোনো কিছু করিনি। আমাকে আসলে…”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে তারিফ বলল, “এখানে তোমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার, বললাম তো! আমি নিজের ইচ্ছায় তোমাকে ডিভোর্স দিচ্ছি।”
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। এসেই মায়ের কাছে সবকিছু বলতে শুরু করলাম। আমাদের মধ্যকার মন অভিমান; দূরত্ব, তারিফকে নিয়ে করা আমার অহেতুক সন্দেহ; তার সহ্যক্ষমতা, আজকে সকলের ডিভোর্স লেটার; তারিফের কথা – সব।
সবকিছু শুনে মা সামান্য ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুই তো বিয়ের পর থেকেই ওর বন্ধুদের চিনিস, জানিস ওরা কেমন মানুষ। তাহলে কেন অযথা সন্দেহ করতে গেলি?”
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “আমি জানি না মা। আমার সত্যিই মাথা কাজ করছিল না। তবে বিশ্বাস করো, এসব কোনো কিছুই আমার মাথায় আগে আসেনি। মালা ভাবী, মালা ভাবী আমাকে এগুলো শিখিয়ে দিয়েছে।”
“মালা? আশফা, তোকে কতবার মানা করেছি মালার সঙ্গে না মিশতে। শুনলি না তো আমার কথা! মনে আছে বলেছিলাম, মালার সঙ্গে একটা বিষয় নিয়ে আমার মান অভিমান ছিল। বিষয়টা তোকে কখনো বলিনি। ভেবেছিলাম, বললে তুই মন খারাপ করবি। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে আগে বলে দিলেই ভালো হতো।”
“তাহলে এখন বলো!”
“মালা বিয়ের পর থেকেই ঠিক করে রেখেছিল ওর আপন ছোট বোনের সঙ্গে তারিফের বিয়ে দিবে। আমার তাতে কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু, হঠাৎ করে তারিফের সঙ্গে তোর বিয়ে হওয়ায় মালা খুব ক্ষেপে যায়।
আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল যে তারিফ কখনো তোর সঙ্গে সুখী হতে পারবে না।”
আমি স্তম্ভিত হয়ে বলি, “দোষটা তো আমারই ছিলো মা। তারিফের নামে একজন যাতা বাজে কথা বলেছে আর সেগুলো আমি সত্যি বলে মনে করেছি।”
“তুই শান্ত হ। কোনো ভুল সিদ্ধান্ত আমি নিতে দেব না তারিফকে।”
সেদিন সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি। ডিভোর্স লেটারটা দুহাতে ধরে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লেখা অক্ষরগুলো অনবরত পড়তে থাকি।
পরদিন বিকেলে মা তারিফকে বাসায় ডাকল।
মা আর তারিফ ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি বসে ছিল। আর আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুটা দূরে।
তারিফ ক্লান্ত গলায় বলল, “মা কেন ডেকেছ বলো।”
মা গম্ভীর গলায় বলল, “তোর নিজের বাসায় তোকে ডাকতে হয় কেন?”
“কি বলবে বলো তো!”
“ডিভোর্স মানে কি ছেলেখেলা না-কি? আশফা না হয় রাগের মাথায় তোকে কয়েকটা কড়া কথা বলেছে। তুই তাই বলে সাথে সাথে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবি?”
“কিছুক্ষণের জন্য মনে করো আশফা আমাকে কোনো কড়া কথা বলেনি। তারপরও আমি ওকে ডিভোর্স দিচ্ছি।”
“কেন?”
“প্রতিটা সম্পর্কের ফাউন্ডেশন হলো বিশ্বাস, ট্রাস্ট। যে মানুষটা আমাকে বিশ্বাসই করতে পারে না, তার সঙ্গে সারা জীবন কী করে কাটাবো আমি?”
“তুই ভুল বুঝছিস। আশফা নিজের ইচ্ছায় ওসব করে নেই। ওর ব্রেইনওয়াশ করা হয়েছে। তুই আমার কথাটা শোন…”
মাকে থামিয়ে দিয়ে তারিফ বলল, “কিচ্ছু শুনতে ইচ্ছা করছে না মা আমার। আমি তো বলেই দিয়েছি সব দোষ আমার, ওর কোনো দোষ নেই। নিজের স্বাধীনতা, শান্তি ধ্বংস করে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না।”
মা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই আমি শুকনো গলায় বললাম, “থাক মা। তারিফ ঠিকই বলেছে। ওর সুখ শান্তি নষ্ট করে একসাথে থেকেও ভালো থাকতে পারবো না আমি।”
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার দায়িত্ব নিজের মন নয়, মস্তিষ্কের উপর ছেড়ে দিতে হয়। এই সিদ্ধান্তটা জানানোর আগ পর্যন্ত আমার মন চাইছিলো, সব ভুলে তারিফের কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু মস্তিষ্কের তাতে সায় ছিল না। মস্তিষ্ক চাইছিল তারিফকে ছেড়ে দিতে। আমাকে ছেড়ে যদি ও ভালো থাকতে পারে, তাহলে ওর ভালো থাকাটাই হবে আমার ভালো থাকা। আমি শেষমেষ আমার মস্তিষ্কের কথাই শুনেছি।
আমি তারিফের জীবনটাকে স্বর্গরাজ্য করে তুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কখন যে ওর জীবনটাকে নরকে পরিণত করলাম, বুঝতেই পারিনি। তারিফ একদম ঠিক কাজ করেছে। আর আমি, আমি যা ডিজার্ভ করি তাই পেয়েছি।
(চলবে)