অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গার মতো বিরক্তিকর ব্যাপার এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। ছোটবেলায় আপা আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলতো। এরপর আপার বিয়ে হয়ে গেল, অনেকটা সময় পার হয়ে গেল। আমার জীবনে আসলো সে, আমাকে ঘুম থেকে টেনে তোলার দায়িত্বটাও হলো তার। ইশ, জীবনটা যদি আগের মতো হতো! এখনো যদি তার ডাক শুনে ঘুম থেকে উঠতে পারতাম! যাইহোক, এখন তার কথা ভেবে কাজ নেই। বিছানা থেকে নেমে পরি।
ওয়াশরুমে গিয়ে দেখি নতুন একটা টুথব্রাশ, সম্ভবত বিদেশি। মা আমার ভীষন স্বাস্থ্য সচেতন। প্রতি মাসে নিয়ম করে সবার জন্যে নতুন টুথব্রাশ বের করেন।
বেশ অনেকক্ষণ ধরেই ব্রাশ করলাম, ব্যাপারটার মধ্যে অদ্ভুত এক শান্তি লুকোনো। এরকম ছোট ছোট শান্তি উপভোগ করতে ভালোই লাগে।
আজ পরেছি গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি। টিপ দেওয়া যেতে পারে। নাহ্! আমি কি ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট না-কি , যে টিপ দিয়ে ঘুরে বেড়াবো!
তৈরি হয়ে ঘর থেকে বাইরে এসে দেখি মা টেবিলে নাস্তা দিচ্ছে।
আমি শান্ত গলায় বললাম, “গুড মর্নিং মা!”
মা আমাকে দেখে কিছুটা চমকে উঠে বলল, “ও উঠেছিস? গুড মর্নিং!”
“মৌসুমী কোথায়?”
“একটু ছাদে পাঠিয়েছে। ফুলের চারাগুলো মরে যাচ্ছে। তাই বললাম, যা ছাদে গিয়ে টবগুলোতে পানি দিয়ে আয়!”
“ভালো করেছো। জবা উঠেছে?”
“তোর জবা কি আর বেলা দুইটা তিনটার আগে ঘুম থেকে উঠবে?”
“ঘুমাক, উঠেই বা করবে কি? আচ্ছা মা তোমাকে যেটা বলবো বলবো ভাবছি, মৌসুমী ঠিকমতো কাজ করে তো? একা সামলাতে পারে সবকিছু? না পারলে বলো, আমি আরেকটা লোক ঠিক করি।”
“কোনো দরকার নেই। মৌসুমী একাই সবদিক সামলে রাখে। আর আরেকটা লোকের দরকার হলে তো তোকে বলবোই!”
“বলবে কিন্তু!”
“ঠিকাছে বলবো। এখন তাড়াতাড়ি নাস্তা করে নে! অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।”
“ওহ্ হ্যাঁ, সাড়ে আটটা তো বেজেই গেলো!”
আমাদের জীবনটা এখন অনেক গোছানো, শান্তিময়। অথচ একটা বছর আগেও এতটা গোছানো ছিলো না। একটু একটু করে গুছিয়ে নিয়েছি, এখনো গোছাচ্ছি।
অফিসে পৌঁছে দেখি আমার পিএস মিস. নায়লা, আমার কেবিনে বসে আছে। আমাকে দেখেই সে ব্যস্ত ভঙ্গিমায় উঠে দাঁড়ালো।
ভদ্রভাবে বলল, “গুড মর্নিং ম্যাডাম।”
“গুড মর্নিং।”
“ম্যাডাম, আজকে কিন্তু আপনাকে অতিরিক্ত সুন্দর লাগছে।”
আমি মুখে বিচিত্র হাসির আভাস নিয়ে বললাম, “এই একই কথাটা প্রতিদিন বলো। টায়ার্ড লাগে না?”
“আপনি তো সুন্দরই। সুন্দরের প্রশংসা প্রতিদিন না করে কি উপায় আছে? আপনি জানেন, অফিসের সবাই আড়ালে আপনাকে কি ডাকে?”
“জানি। বিউটি বস!”
নায়লা চমকে উঠে বলল, “জানলেন কিভাবে?”
“একই অফিসে কাজ করি, এতটুকু জানবো না? আচ্ছা সেসব বাদ দাও। এখন বলো এত সকালে আমার কেবিনে কি করছো? কিছু বলবে?”
“ম্যাডাম, নেক্ট প্রজেক্টের ফাইল রেডি হয়ে গেছে। আপনাকে দিতে এসেছি।”
“কোন প্রজেক্ট বলো তো।”
“উনিশ তারিখে যেটা সাবমিট করার কথা।”
“ও আচ্ছা। ফাইলটা কে রেডি করেছে?”
“খোরশেদ ভাই।”
“তাহলে ফাইলটা রেখে যাও। খোরশেদ সাহেব যেহেতু রেডি করেছে, নিশ্চই অনেক কারেকশন বের হবে। আমি ধীরেসুস্থে দেখে জানাচ্ছি।”
এই হলো আমার কর্মজীবন। নামী দামী এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির আমার। আমার নামে লেখা হলেও শুরু থেকে এর মালিক আমি ছিলাম না।
অফিসের সবাই আমাকে ‘বস’ ডাকে। এই ডাকটা শুনলেই মনে হয়, বিরাট কিছু অর্জন করে ফেলেছি। কিন্তু ঠিক পরের মুহূর্তেই আবার মনে হয়, কিসের অর্জন! জীবনের সবথেকে বড় অর্জনটাই তো হাতছাড়া করে ফেললাম।
অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি, জবা আমার বিছানার ঠিক মাঝখানে বসে বসে। বাইরের মানুষের কাছে জবা একটা কুকুরছানা হলেও, আমার কাছে সে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন। জবা যে জাতের কুকুর, সে জাতটার নাম পোমেরানিয়ান। এই জাতের কুকুরগুলো দেখতে সুন্দর হলেও, চেহারায় কোনো মায়া থাকে না। তবে আমার জবার চেহারা যথেষ্ট মায়াবী।
আমাদের বাসায় ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির নষ্ট হওয়া লেগেই থাকে। ফ্যানের রেগুলেটর, বাল্বের সুইচ, মাইক্রোওয়েভের সুইচ, ফ্রিজের লাইট – এগুলো নষ্ট হওয়া আমাদের কাছে সাধারন ব্যাপার। শুক্র এবং শনিবার, এই দুইটা দিন আমি বাসায় থাকি। রাজ্যের যত মেকানিক-মিস্ত্রী আছে, সবাইকে এই দুই দিনেই খবর দেওয়া হয়। আমি বাসায় না থাকলে আবার আমার মা আবার বাইরের লোক ঢোকান না। মাঝে মাঝে চিন্তায় পড়ে যাই, সে আমার গুরুজন না-কি আমি তার গুরুজন।
বর্তমানে আমার ঘরের টিভি নষ্ট, স্ক্রিন ঝিরঝির করছে। আগামীকাল শুক্রবার, মেকানিক আসবে। আমাদের বসার ঘরে আরেকটা টিভি আছে। সেখানের সোফায় জবা কোলে নিয়ে বসে টিভি দেখছি।
ওদিকে মা ডাইনিং টেবিলে বসে সবজি কাটাকাটি করছে। মৌসুমী মায়ের ফোনটা হাতে নিয়ে দৌড়ে এসে তাকে ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “খালাম্মা, ভাইজান ফোন করছে!”
মাও ব্যস্ত ভঙ্গিমায় ফোনটা রিসিভ করলেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম। মা যখন ওর সাথে ফোনে কথা বলে, তখন আমি চারপাশে ঘুরঘুর করি। জানি, সে কখনো আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইবে না, কিন্তু তাও। যদি একবার মনের ভুলে কথা বলতে চায়, এই আশায়!
বেশ অনেকটা সময় ধরে মা তার সঙ্গে কথা বলল। “তুই কেমন আছিস?”, “রান্নাবান্নার কি করেছিস?” – এ ধরনের নানান প্রশ্ন করলো তাকে। সে কি উত্তর দিলো, কে জানে!
কথা শেষ হলে আমি মায়ের সামনের চেয়ারটাতে বসতে বসতে বললাম, “তারিফ কেমন আছে মা?”
“যেমনটা থাকে সবসময়।”
কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “খুব ভালো আছে না?”
মা কিছু বলল না। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করার চেষ্টা করেও পারলো না।
আমি ঠোঁটে কৃত্রিম এক হাসি নিয়ে বললাম, “ভালো থাকা তো ভালোই! এতে এতো মন খারাপ করার কি আছে?”
মা আহত গলায় বলল, “একটা মানুষকে কষ্ট দিয়ে ভালো থাকা কি ঠিক?”
“তুমি কিন্তু ভুলে যাচ্ছ মা, কষ্ট আমি ওকে দিয়েছিলাম ও আমাকে দেয়নি।”
“কিন্তু তারপরও, শেষ পর্যন্ত কষ্ট তো তুই-ই পেয়েছিস।”
“আমি কষ্ট পাইনি মা, প্রতিদান পেয়েছি।”
অর্জনের কথা বলছিলাম না? তারিফ, আমার জীবনের সবথেকে বড় অর্জন। ছেলেটার সাথে প্রথম দেখা হয় চার বছর আগে, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরীতে। দিনটা ছিল, শুক্রবার। এই দিনটায় লাইব্রেরীতে যথারীতি বসার কোনো জায়গা নেই। বহু কষ্টে একটা সিট যোগাড় করলাম। আমার পাশের সিটটাতে বসে ছিল সে। অতি মনোযোগ সহকারে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বইয়ের পাতার দিকে।
আমি বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেটা উঠে চলে গেল। ভাবলাম, এই বুঝি তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। প্রথম দেখায় আমি তার প্রেমে পড়িনি, তবুও উঠে চলে গেল বলে বেশ খারাপই লাগলো। আমি বই পড়ায় মনোযোগী হলাম।
লাইব্রেরীর বই ছাড়াও আমার সঙ্গে আরেকটা বই ছিল। সেই বইটা আমার নিজের। বইয়ের নাম, ‘কলিকাতায় নবকুমার’। পঞ্চম জন্মদিনে বাবা উপহার দিয়েছিলেন। সেটাই ছিল বাবার সঙ্গে উদযাপন করা আমার শেষ জন্মদিন।
বইটার দিকে তাকিয়ে দেখি, বেশ চকচকে লাগছে। আমার পুরোনো ছেড়া বইটাকে নতুন মনে হচ্ছে কেন?
বইয়ের কভার উল্টে প্রথম পাতায় চোখ পড়তেই আমার চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল।
প্রথম পাতায় লেখা, “প্রিয় তারিফ, তোমাকে বইমেলার শুভেচ্ছা।”
সর্বনাশ! এতো আমার বই না। আমি ব্যস্ত হয়ে বইটার পাতা উল্টাতে লাগলাম। অবশেষে শেষ পৃষ্ঠায় একটা ফোন নম্বর পেলাম। ফোন নম্বরের নিচে ব্র্যাকেট দিয়ে লেখা, ‘আমার ২য় নম্বর’। তৎক্ষণাৎ সেই নম্বরে ফোন করলাম।
প্রথমবারে স্যার ফোন তুললেন না। দ্বিতীয়বারে তুললেন।
তারিফ ওর অপূর্ব কণ্ঠে বলল, “হ্যালো? কে বলছেন?”
আমি এক মুহূর্তের জন্যে চিন্তায় পড়ে গেলাম। এত সুন্দর পুরুষ কণ্ঠ কি এর আগে কখনো শুনেছি? নাহ্! শুনিনি।
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, “হ্যালো, আমার নাম আশফা।”
“স্যরি এই নামে আমি কাউকে চিনি না, রং নাম্বার।”
“না, না রং নাম্বার না। রাইট নাম্বার! আপনি ভুল করে আমার বই নিয়ে গেছেন!”
“কখন? কোন বই?”
“আরে, এই মাত্র আপনি যখন লাইব্রেরীতে বসে ছিলেন তখন ভুল করে আমার কলিকাতায় নবকুমার বইটা নিয়ে গেছেন। আমার কাছে এখন আপনার বই!”
“ওহ্, এই বই আপনার? আমিও তখন থেকে ভাবছি আমার নতুন বইটা ছিড়ে গেল কিভাবে?”
“দেখেন, আমি অত কিছু বুঝি না। আমার বইটা লাগবে।”
“আপনার কাছে যা আমার কাছেও তো তাই! বরং আমার বইটা নতুন এবং অক্ষত, আপনার পড়তে সুবিধা হবে।”
“সুবিধা অসুবিধা দিয়ে আমার কোনো কাজ নেই! আমার নিজের বইটাই লাগবে। ওই বইটার সাথে আমার কতো স্মৃতি জড়িত আপনি জানেন?”
“তো কি হয়েছে? নতুন বইয়ের সঙ্গে নতুন স্মৃতিও জড়িয়ে নেবেন!”
“আমি আপনাকে আমার বইটা ফেরত দিতে বলছি, আপনি দেবেন! এত কথা বলছেন কেন?”
তারিফ অসহায় কণ্ঠে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। আজকে তো আর সম্ভব হবে না, কালকে না হয় একই জায়গায় আপনার বইটা নিয়ে যাবো।”
পরের দিন আবার গেলাম লাইব্রেরীতে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। ছেলেটা আসবে কি আসবে না, এই নিয়ে মনে শঙ্কা তৈরি হলো।
অবশেষে তিনি এলেন। আমি তাকে খেয়াল করিনি, আমার হাতে বইটা দেখে সে-ই আমাকে শনাক্ত করলো।
আমার কাছে এসে শান্ত গলায় তারিফ বলল, “আপনি আশফা?”
আমি চমকে উঠে বললাম, “জি? জি।”
তারিফ আমার বইটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই নিন আপনার বই!”
আমি দ্রুত ওর হাত থেকে বইটা নিয়ে বললাম, “থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ সো মাচ! এই বইটা যে আমার কাছে কতটা প্রেশিয়াস, আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো।”
“বোঝাতে হবে না, বুঝতেই পারছি।”
আমি ওর বইটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “আপনার বই!”
তারিফ আমার হাত থেকে তার বইটা নিল।
আমি আবার বললাম, “এখন কোথায় যাবেন?”
“আমার অফিসে। আপনি?”
“আমি বাসায় যাবো কিন্তু বৃষ্টিই তো থামছে না।”
“এখানে কিন্তু অনেক ভালো লেবু চা পাওয়া যায়, খাবেন?”
“হুঁ!”
আমি চা পছন্দ করি না। তবু যে কেন হুঁ বলেছিলাম কে জানে! হয়তো বা তার সঙ্গে আরেকটু বেশি সময় কাটানোর জন্য।
মিনিট কয়েকের মধ্যেই জনাব প্লাস্টিকের গ্লাসে চা নিয়ে হাজির।
আমি তার হাত থেকে চা নিতে নিতে বললাম, “তা, আপনি কি করেন?”
“আমার বাবার কোম্পানির বর্তমান মালিক আমি। বিজনেস দেখাশোনা করি। বেকার বলতে পারেন।”
“ওমা, বেকার বলবো কেন?”
“সে মানুষটা বাইশ তেইশ বছর লেখাপড়া করে বাবার বিজনেস সামলায়, তাকে বেকারই বলে।”
আমি চুপ করে রইলাম।
তারিফ আবার বলল, “আপনি কি করেন?”
“আমি ঢাকা ইনিভার্সিটি থেকে এম.এ করছি। বিজনেস ডিপার্টমেন্টে, লাস্ট ইয়ার। আর কয়েকদিন পর আমিও বেকার হয়ে যাচ্ছি।”
“আপনার বাবার আবার বিজনেস আছে না-কি? থাকলেও খবরদার! সেই বিজনেসের দায়িত্ব নিতে যাবেন না!”
“আমার বাবা নেই, আর বাবার বিজনেসও নেই।”
তারিফ লজ্জিত কণ্ঠে বলল, “আই অ্যাম স্যরি। আমি আসলে বুঝতে পারিনি।”
“ইটস ওকে, বুঝতে পারার কথাও না।”
তারিফ চুপ করে আছে। আমিও চুপ করে আছি।
নীরবতা ভঙ্গ করে আবার বললাম, “আপনার বাসায় কে কে আছে?”
“আমি আর আমার মা। আপনার বাসায়?”
“আমি ছোটবেলা থেকে মামার কাছে মানুষ হয়েছি। আমার বয়স যখন পাঁচ, তখন আমার বাবা মারা যায়। বাবার মৃত্যুতে মা খুবই বিষন্ন হয়ে পরে। সংসারধর্ম থেকে তার মন উঠে যায়। এরপর একদিন আমাদের দুই বোনকে মামার কাছে রেখে তিনি আমেরিকায় চলে যান। সেখানে নিজের ক্যারিয়ার গরেছেন, বাড়ি করেছেন, নতুন এক জীবন শুরু করেছেন। এ বছর সেও মারা যায়।”
মাত্র দুদিনের পরিচয়ে তারিফকে এতগুলো কথা কেন বলেছিলাম, কে জানে! এতটুকু বলতে পারি, তার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগছিলো। এতটা মনোযোগ দিয়ে এর আগে কেউ আমার কথা শোনেনি।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত দুটো বাজে। তারিফের কথা একবার ভাবা শুরু করলে সময় সে কিভাবে কেটে যায়, বুঝতেই পারি না।
রবিবার অফিসে ফিরে দেখি, সবার মধ্যে একধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। সবাই প্রাণপন চেষ্টা করছে নিজেদের স্বাভাবিক রাখার, কিন্তু পারছে না। কেবিনে গিয়ে নায়লাকে কল করলাম।
নায়লা আমার কেবিনে আসলে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি মেইল চেক করেছ?”
নায়লা বলল, “না মেইল তো চেক করা হয় নি। কেন ম্যাডাম?”
“করোনার কারনে কালকে থেকে আমাদের অফিস বন্ধ। ম্যানেজমেন্ট সাথে বসে ডিসিশন নিয়েছি, এখন থেকে বাসায় বসেই অফিস করবো। ওয়ার্ক ফ্রম হোম। ভালো হলো না?”
“বাহ্! বেশ ভালো হলো। আমি তো আমার মাকে নিয়ে টেনশনে ছিলাম, বয়স্ক মানুষ!”
“আচ্ছা, আজকের মধ্যে কি আমরা ওই এর প্রজেক্টটা শেষ করতে পারবো?”
“একটু বেশি সময় লাগবে, কিন্তু মনে হয় পারবো।”
“ঠিক আছে তাহলে প্রেজেক্টে যারা যারা কাজ করছে তাদের নিয়ে ইমিডিয়েট একটা মিটিং কল করো।”
প্রজেক্টের কাজ সেরে বাসায় ফিরতে ফিরতে বেজে গেল রাত আটটা। সাধারনত এত দেরি কখনো হয় না। বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই মায়ের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়ে গেলো।
মা চিন্তায় অস্থির হয়ে বলল, “কিরে এত দেরি হলো কেন? আমি কতবার ফোন করলাম, ফোনটাও তো ধরলি না।”
“আমাদের অফিস ছুটি আজকে থেকে। হাতে শেষ যে প্রজেক্টের কাজ ছিল, সেটা একবারে শেষ করে আসলাম। তাই দেরি হয়ে গেল। আর ফোনের চার্জটাও শেষ, তাই তোমার ফোনটা ধরতে পারিনি।”
“অফিস ছুটি দিয়েছিস? ভালো হয়েছে। তোকে নিয়েই চিন্তায় ছিলাম।”
“হুঁ, হয়েছে। আর চিন্তা করতে হবে না। শোনো, কালকে থেকে কিন্তু আমি বাইরে বের হবো না। তুমিও যাবে না। আর যদি খুব দরকার হয়, তাহলে মাস্ক পরে বাইরে যাবে।”
“মাস্ক?”
“হুঁ! মাস্ক।”
মা অসহায় গলায় বলল,“মা শোন না, মাস্ক পরলে না আমার গরম লাগে। দম বন্ধ হয়ে আসে।”
“ঠিক আছে তোমাকে মাস্ক পরতে হবে না, বাইরেও যেতে হবে। জরুরী দরকার হলে আমিই যাবো বাইরে।”
“আচ্ছা। জানিস আজকে দুপুরে তারিফ ফোন করেছিলো। ওর অফিসেও না-কি ছুটি দিয়ে দিয়েছে।”
আমি হেসে বললাম, “মিস্টার আনস্টপেবেল তাহলে এখন চব্বিশ ঘণ্টা বাসায় বন্দী হয়ে থাকবে?”
“হ্যাঁ! করোনা সবাইকে শিক্ষা দিয়ে ছাড়লো।”
“দেখো, তোমার ছেলে শেষ পর্যন্ত বাসায় থাকে কিনা। একবার যদি ঠিক করে বাসা থেকে বাইরে যাবে, তাহলে সেটা করেই ছাড়বে।”
“একদম ঠিক বলেছিস! ওকে নিয়েই তো আমার যত ভয়!”
“মা?”
“হুঁ?”
“তারিফ আমার কথা জিজ্ঞেস করে?”
মা লজ্জিত ভঙ্গিমায় চুপ করে বসে রইলেন।
কিছুক্ষণ পর মুখ খুলে বললেন, “আসলে হয়েছে কি…”
আমি মাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “থাক মা, বলতে হবে না আর।”
(চলবে)