অস্তিত্বের সন্ধানে

0
770

(উপলক্ষ্য: মা দিবস)

‘হ্যালো নেহাল চৌধুরী বলছেন?’

– জ্বি বলছি।

হ্যালো স্যার আমি আপনার দারুন ফ্যান। আপনার এমন কোন লেখা নেই আমি পড়িনি। আপনি এতো ভালো কলাম লেখেন যে কোন শব্দ দিয়েই বুঝি আমার ভাল লাগার বর্ণনা দেয়া সম্ভব না।

– ধন্যবাদ। আর কিছু বলবেন?

‘মা দিবসে আপনার একটা লেখা চাই আমাদের পত্রিকার জন্য। প্লিজ স্যার না করবেন না।’

– আচ্ছা দেখি কি করা যায়।

………….

অনুরোধে ঢেঁকি গেলা আমার স্বভাবে নেই কিন্তু ফোনের ওপারে লোকটা এতোই নাছোড়বান্দার মত ঝুলে ছিল তাকে ছোটাতে আচ্ছা দেখি বলা ছাড়া আর কোন উপযুক্ত শব্দও খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

আমি লেখালেখি করি মনের আনন্দে। দিবস উপলক্ষ্যে রুটিন করে কিছু লেখা আমার সেভাবে আসেনা কখনোই। আর মা দিবস উপলক্ষ্যে তো আরো না। কারণ আমার জীবনে ঐ সম্পর্কটা যে একটা জটিল ধাঁধার মত।

আমি যেদিন জানতে পারি আমি যাকে মা বলে ডাকি তিনি আসলে আমার মায়ের মা অর্থ্যাৎ আমার নানী সেদিন আমার পৃথিবী যেন দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল। কোন ক্লাসে পড়ি তখন, বড়জোর থ্রি বা ফোর। শুনেছি আমার জন্মের আগে আমার বাবা মারা গিয়েছেন। কাজেই বাবা নিয়ে আমার তেমন মাথাব্যথা ছিল না। আর আমাদের ছোটবেলায় এখনকার মত বাবাদের সাথে সন্তানের এতো মাখামাখি কখনোই ছিলনা। বাবারা ছিলেন একটু দূরের মানুষই। আমার মামা খালাদের আমি মামা খালা বলে ডাকলেও তারা যে আমার মা কে মা বলে ডাকে সেই নিয়েও আমার কোন সমস্যা ছিল না যতদিন আমি জানতামনা সম্পর্কের সংজ্ঞাগুলো।

নানীকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলাম, আমার মা কোথায়? নানী কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দিয়েছিলেন কি এক অজানা অসুখে মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। নিজের মন্দভাগ্যে যতটা না দুঃখ পেয়েছিলাম তারচেয়ে বুঝি বেশী কষ্ট লেগেছিল নানী কেন আমায় সত্যটা আগে বলেনি তা নিয়ে। তারপর থেকে নানীকে আর কখনো মা বলে ডাকিনি। কেন যেন ডাকতে পারিনি। কি যে এক অজানা সংকোচ! আমার বেড়ে ওঠা নিয়ে আমার কখনো ভাবতে হয়নি। নানা নানী অকপটে যুগিয়ে গেছেন আমার বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সব কিছুর খরচ। শুধু সেদিনের পর থেকে এক অজানা সম্পর্কের দূরত্বের বেড়াজাল কেউই আর ডিঙ্গোতে পারিনি।

আর তাই আমার কাছে মা শব্দের মানে সেই শৈশবের কয়েকটা বছর নানীর কাছ থেকে পাওয়া স্নেহমাখা হাতের পরশ, নানীর শরীরের মিষ্টি একটা গন্ধ যার ওপরে অভিমানের প্রলেপ জমে শুধু পাহাড় হয়েছে আর মা নামক সম্পর্কটা হয়েছে কেবলই একটা অজানা সম্পর্কের নাম। মৃত্যুশয্যায় নানী আমাকে হাত ধরে বলেছিলেন, ‘আমায় তুই মাফ করে দিস নেহাল। আমি তোকে একটা সত্য লুকিয়েছি। নিজের মাতৃত্বের দায়িত্ব পূরণ করতে যেয়ে আমার নিজের আত্মজাকে তার মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করেছি।’ আর কিছু বলার আগেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন আর আমাকে রেখে যান এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি। তাহলে কি আমার মা বেঁচে আছেন? যদি বেঁচে থাকে তাহলে কেন আমায় কখনো দেখতে চাননি? অভিমানগুলো একলা বুকে পুষে একটা জীবন খুঁজে গেছি লুকিয়ে থাকা মা কে।

নিজের শৈশবের সেই আদরমাখা সময়কে উপজীব্য করেই লিখে গেছি মাকে নিয়ে কিছু কথা। অনুরোধ করা সেই দৈনিকে লেখাটা প্রকাশিত হওয়ার সপ্তাহখানেক পরে একটা চিঠি আসে আমার নামে।

‘বাবা নেহাল,

তোমাকে বাবা সম্বোধন করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত হচ্ছে জানিনা, কিন্তু এভাবেই বলতে ইচ্ছে হলো। তুমি মা নামে কাউকে এখনো খোঁজো সেটা তোমার লেখায় জানতে পেরেই মনে হলে তোমায় একটু বলি আমার ফেলে আসা জীবনের কথা।
আমার একটা জীবন কেটে গেছে দুঃখ নামক এক গোলকধাঁধার মধ্যে। তবে আমি হাল ছেড়ে দেইনি, এই জীবনের শেষ আমি দেখতে চাই বলে।

যেদিন তোমার বাবার মৃত্যু সংবাদ আসে তোমার বয়স তখন দেড় বছর। আমি তোমায় নিয়ে আমার মায়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলাম। আমাদেরকে নিতে আসার পথেই সে মারা যায়। আমার বয়স তখন বাইশ। আমার বাবা মেয়েলোকের পড়াশোনা করা তেমন একটা পছন্দ করতেন না। আর তাই কলেজের গন্ডি পেরোতেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। বছর দুয়েকের মাথায় তোমার জন্ম। আমি যেন এক নতুন পৃথিবীর অংশ হই তোমাকে পেয়ে। সারাদিন যেন চোখের নিমিষে চলে যেত তোমার পিছু ঘুরে। তোমার বাবার মৃত্যু আমার সেই জীবনটাকে পুরোপুরি স্থবির করে দিল।

মেয়েলোকের একলা জীবন পার করা কতটা বিভীষিকার সেটা শুধু যে এর মধ্য দিয়ে যায় সে ছাড়া আর কেউই বুঝি জানেনা। আমার ভবিষ্যত নিয়ে দারুন উৎকন্ঠিত বাবা মা আবার আমার বিয়ে ঠিক করলেন। তবে ঐ পক্ষের একটাই শর্ত আমাকে একলা যেতে হবে। আমার বাবা মা তাতেও রাজী। তাদের চোখে আমাকে বিদায় করার যে উদগ্রীব দৃষ্টি ছিল তা আমি এখনো ভুলতে পারিনা। আমি জানি তারা আমার ভালো চেয়েছে বলেই এমন করেছে। তুমি হয়তো বলতে পারো আমি কেন রাজী হলাম? কেন তোমায় নিয়ে আলাদা হয়ে গেলাম না? ভেবেছিও অনেকবার। কিন্তু বাইরের পৃথিবীতে তোমাকে একাকী আগলে রাখার মতো সাহস, শক্তি, ক্ষমতা কোনটাই আমার ছিল না।

আমাকে সুখে রাখার নিমিত্তে বাবা মা আমাকে বিয়ে দিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু আমার আত্মার যে অংশটুকু আমি পিছু ফেলে এসেছিলাম তাকে উপেক্ষা করে নতুন সংসারে মনোযোগ দিতে পারিনি কখনোই। অদ্ভুত হলেও সত্যি আমি আর কখনোই মা হতে পারিনি। আমার দ্বিতীয় স্বামী আবার বিয়ে করেন, বংশরক্ষা তো করতে হবে। আমাকে অবশ্য ফেলে দেননি আস্তাকুঁড়ে। ঘরের আসবাবপত্রের মতো থাকতে দিয়েছিলেন এক কোণে। বাবা মায়ের সাথে করা এক অজানা অভিমানে ফিরে যাইনি কখনোই ঐ বাড়িতে আর এমনকি মায়ের মৃত্যুর খবরেও হাসপাতাল থেকে এক পলক দেখে চলে এসেছি। কতবার যে তোমায় দেখতে গিয়েও ফিরে এসেছি নিজের কাছে করা শর্ত রাখতে গিয়ে।

তোমার লেখা আমি সবসময় পড়ি। সবগুলো পেপার কাটিং জমা করে রাখি একাকী সময়ে বারবার পড়ার জন্য। তোমার সাথে আমার যে আর কোন সম্পর্কের সুতো টানা নেই। সন্তান জন্ম দিলেই নাকি মানুষ মা হয়না। দিনে দিনে একে অপরকে বোঝার মধ্য দিয়ে মাতৃত্বের স্বাদ বুঝে নিতে হয়। সে হিসেবে আমি তোমার মা নই। তবু তোমার লেখাগুলো পড়ে আমার ভাবতে ভালো লাগে আমার অস্তিত্বের একটা অংশ লিখেছে ঐ শব্দগুলো। ওগুলো তো মতান্তরে আমারো খানিক অংশ। বলতে পারো এক নিরুপায় মানুষের আপন মনে খানিক সুখ খুঁজে নেয়ার চেষ্টা। আমার অপারগতাকে পারলে ক্ষমা করো।

ভালো থেকো। তোমার নতুন লেখার অপেক্ষায় থাকবো।

ইতি

তোমার জন্মদাত্রী।’

…………..

এখানে রেবেকা খানম বলে কেউ থাকেন?

– জ্বি। কিন্তু আপনি কে?

আমি নেহাল। নেহাল চৌধুরী। এই যে আমার কার্ড। একটু দেখা করতে চাচ্ছিলাম ওনার সাথে।

দরজায় দাঁড়ানো লোকটির ঠিক পিছু এসে দাঁড়ানো নারীটিই যে রেবেকা খানম সেটা কেউ আমায় বলে দিতে হয়নি। কারণ তিনি অবিকল আমার নানীর মতো দেখতে।

‘আমার চেয়েও বাবা মায়ের ওপর করা আপনার জেদ, আপনার শর্তই কি এতো বেশী মূল্যবান ছিল? একবারো আমার কথা ভাবলেন না।’ (নেহাল)

– জীবনের গল্পগুলো যিনি লেখেন তিনি আমাকে কতোটা পরীক্ষা নিতে চান তাই দেখতে চেয়েছি বলেই কখনো যোগাযোগ করিনি। তুমি যদি ফিরিয়ে দাও সেই ভয়টুকুও যে মনে ছিল।

আপনি আমার মা, আমি আপনাকে ফিরিয়ে দেব এটা কেন ভাবলেন?

– আমার নিজের বাবা মা ই তো আমাকে মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। তুমিও করবেনা সেটা কিভাবে নিশ্চিত হই বলো?

যাবেন আমার সাথে, বাকীটা জীবন আমাকে আগলে রাখতে?

– যাবো বাবা। একটা জীবন অভিমান বুকে পুষে শুধু দুঃখ ভরা জীবন কাটিয়ে গেছি। কয়টা দিন না হয় একটু আনন্দ নিয়ে নিজের অস্তিত্বের কাছাকাছি থাকি।

পৃথিবীর সব মায়েরা ভালো থাকুক তাদের সন্তানদের অপার মায়ায় আগলে রেখে, সন্তানের ভালবাসায় বেঁচে থেকে। পূর্ণতা পাক প্রতিটি মায়ের মাতৃত্বের স্বাদ।

#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে