অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৩

0
986

#অলক্ষ্যে_তুমি #তৃতীয়_প্রহর #Yasira_Abisha (#FATHA)

সকাল ৮টায় অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি। আর ভাবছি বিয়েটা যখন ভেঙেই গেলো তাহলে আমার আর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে কোনো কাজ নেই। আজকে ছুটির আবেদন করার কথা ছিলো, ব্যাগ থেকে কাগজটা বের করে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিলাম। তবে বাসা থেকে বের হতেই ইচ্ছে করছিলো না কিন্তু অফিসে না গেলে এতো ভালো চাকুরিটা আমার ভেস্তেও যেতে পারে। আর এভাবে আমার জীবনের একটা কালো অধ্যায়ের কারণবশত সাজানো গোছানো আমার মায়ের আমার জন্য ড্রিমজবটা নষ্ট হওয়া যেটায় শুধু মা না আমার পুরো পরিবারের ও সুখ মিশ্রিত আছে তা আমি হতে দিতে পারি না।
জানি অফিসে গেলে যখন বলবো
“স্যার ছুটিটা আর লাগছে না।”
তখনই সবার অনেক প্রশ্ন শুরু হবে কারণ আমার যে বিয়ে সামনেই এটা মোটামুটি সবারই জানা ছিলো। প্রশ্ন গুলোর উত্তর কি করে দিবো?
কি বলবো? সবাই জানতো ইরাদ আমাকে প্রচুর ভালোবাসে আর আমার কোনোদিন সন্তান হবে না দেখে সে আমাকে বিয়ে করবে না সাফ মানা করে দিলো? এই কথা গুলো মানুষকে বললে তারা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে? নাকি করুণা করবে? আমি তো জোকার না যে কারো হাসির পাত্রী হবো? আর না হতে চাই কারো করুণার পাত্রী। ব্যাপার গুলো নিয়ে কি বেশি বেশি ভেবে ফেলছি কি না বুঝতে পারছি না কিন্তু এতোটুকু ভালোভাবে জানি যে ইরাদকে ঘিরে এসব কথা আমার নিত্ব খুব কষ্ট হবে। ও কঠিন সিদ্ধান্তটা না নিলেও আমি নজেই নিতাম।

.

অনেক চিন্তাভাবনা করতে করতে অফিসে আসলাম আর সারাদিন অফিস করলাম অবাক করার বিষয় আমার বিয়ে নিয়ে যে কাছের কিছু বান্ধুবীও এক্সাইটেড ছিলো তারা পর্যন্ত এই ব্যাপারে কোনো কথা বলছে না। বস নতুন কিছু প্রজেক্ট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন
” দেখো রুহি আমাকে এই কাজ গুলো আগামী ৩৫দিনের ভেতর রেডি করে দিবে।”
অথচ উনি জানতেন আমি ১৭ দিন পর থেকেই ছুটি নিতাম আমার বিয়ে উপলক্ষে। তাহলে সবাই এরকম আচরণ করছে কেনো? আমি সারাদিন এসব কিছুই ভাবছিলাম। আমার প্রতিটা কলিগ আমার সাথে একদম স্বাভাবিক আচরণ করছিলো বিয়ে নামক শব্দটা কারো মুখে উচ্চারিত হলো না পুরোটা দিনের মধ্যেও।
কিন্তু কেনো? এমন প্রশ্ন গুলো আমার মাথায় ঘুরঘুর করছে। এই ব্যাপারটা কি ইরাদ কোনোভাবে হ্যান্ডেল করেছে? কিন্তু ও তো বলেছিলো আমার কোনোকিছুতেই আর ও নেই।
হঠাৎ মনে পড়লো পুরোনো স্মৃতি গুলোর কথা। ওইজে প্রথম দিন ইরাদ আমার বাসায় এলো?
ঠিক সেই দিন থেকেই ও আমাকে আগলে রেখেছিলো। নাহ সেদিন বললে আবার ভুল হবে। সেদিন থেকে না তার ও ২মাস আগে থেকে সে আমাকে আগলে রেখেছে।
দাদু যখন আমাকে ডাক দিলো
-রুহি এখানে আসো।
ইরাদকে দেখে তখন আমি বের হলাম ওকে আচ্ছা মতো বকার জন্য কিন্তু দাদু আমাকে কিছু বলতে দেওয়ার আগেই বলে দিলেন।
-আজকে থেকে ইরাদের কাছে তুমি পড়বে।
আমার তো চোখ কপালে উঠে গেলো,
এই ছেলের কাছে আমি পড়বো যে আমাকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখে? একে তো দেখেই আমার রাগ উঠে গেছে। আমি দাদুকে বললাম।
– না আমি কোচিং-এই পড়বো। এর কাছে পড়ার কোনো দরকার নেই আমার।
আমি কপাল কিঞ্চিৎ কুচকে কথা গুলো বললাম
এর মধ্যে মা এসে আমাকে বললো,
– রুহি এমন করে না। এখন ইরাদই তোমার জন্য বেস্ট টিউটর হবে ও কিন্তু অনেক ব্রিলিয়ান্ট আর আমার রিকুয়েষ্টেই তোমাকে পড়ানোর জন্য এসেছে।
আর এর মধ্যে ইরাদ নিজে কিছুই বলছে না, আমার দিকে তাকিয়ে শুধু মিটমিট করে হাসছে। মায়ের কথার ওপরে আর কিছুই বলতে পারলাম না। তখনই মাথায় এলো
-কিন্তু মা এই ছেলে তো…
তখনই মা আমার দিকে কঠিন নজর দেয়।
আমি তখন ঢোক গিলে বলি
-মানে উনি তো ডাক্তার হবে আর আমি তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাচ্ছি তাহলে কিভাবে হবে?
আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বলে
– ইরাদ ৪বছর আগে বুয়েটে ভর্তি পরিক্ষায় ২য় হয়েছিলো। আর এসব জানার পরই আমি ওকে রিকুয়েষ্ট করে বললাম যদি সময় থাকে তাহলে যেনো তোমাকে এসে একটু পড়ায়।

মায়ের কথা শুনে আমি তখন খানিকটা অসহায় হই। এখন আর বাচার উপায় নেই। আড় চোখে তার দিকে তাকালাম দেখি সে এবার আমার দিকে তাকিয়ে একভ্রু নাচিয়ে মজা নিচ্ছে। মেজাজটা গরম থেকে গরম হচ্ছে।

তখনই মা বললো তবে আজকে তোমার পড়তে হবে না।
হাফ ছেড়ে বাচলাম।
আর মনে মনে ভাবলাম মায়ের আর দাদুর সাথে তোমার ভাবটা আমি কমিয়েই ছাড়বো যদিও একটু সময় লাগবে। তবুও কোনো ব্যাপার না।

ইরাদকে আমি চাচ্ছিলাম তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে যেটা হসপিটালেই আমার করানো উচিত ছিলো কিন্তু পারি নি। এর মধ্যে ইরাদ বললো,
-আন্টি আজকে নাহলে নাই পড়ালাম কিন্তু ভর্তি পরিক্ষায় বেশিদিন বাকি নেই তাই আজকে ওর পড়ার কি অবস্থা জেনে নেওয়া উচিত।
-আচ্ছা বাবা তবে তুমি বসো আগে নাস্তা করো একটু।
– আন্টি এখন তো প্রতিদিন আসবো নাস্তা নাহয় কাল করি আমি খেয়ে এসেছি একটু আগেই আজকে আর খাওয়া সম্ভব না।
সে এগুলো বলছিলো আর আমি মনে মনে ওকে ভাগানোর প্ল্যান করছিলাম।

-তাহলে বসো বাবা আমি জুস করে দিই তোমাকে? এটা না করো না।
– আচ্ছা আন্টি।
সবচেয়ে রাগ লাগছিলো আমার পরিবারের লোকেরা একে এতো মাথায় উঠাচ্ছিলো। আর এদিকে একে আমার তো দেখেই গা জ্বলছিলো। অতিসুন্দর ছেলে এর এভাবে তাকানোটাও বিরক্ত লাগছিলো। তার ওপরে তার বেশভূষায় ও এতো দামী গাড়ি দেখে বুঝেছিলাম তার তো টিউশানির কোনো দরকার নেই তবে কেনো এই ছেলে আমাকে পড়াতে আসলো বুঝতে পারছিলাম না।
মা- রুহি ইরাদকে তোমার পড়ার টেবিলে নিয়ে বসো।
রুহি- আচ্ছা মা।

ছেলেটা আসার পর থেকে দেখছিলাম আমাদের পাশের বাড়ির আরিফা ও সামিয়া চুপি দিয়ে গেছে। সে যখন আসলো মুটামুটি সব মানুষ তাকিয়ে দেখছিলো তাকে। যারা ওকে দেখছে ওদের কাছেই যাক। আসছে আমাদের বাসায় শান্তি নষ্ট করতে।

একা ইরাদের সাথে বসে আছি পড়ার টেবিলে আর ভাবছি দাদু থাকলেও পারতো। প্রায় ২-৩ মিনিটের মতো আমার বইগুলো ইরাদ খুটিয়ে দেখলো আমিও কোনো কথা বলছিলাম না। নিরবতা ভেঙে সে বললো,
-তো মিস রুহি। পাড়েন কিছু?
তার মুখে প্রথম এমন কথা শুনে রাগটা আরো বেড়ে গেলো।
তখন আমি মুখ বাকিয়ে বললাম
– নাহ পারি না কিছু। আপনি আসতে পারেন।
এবার দেখি সে হেসে দিয়ে বললো,
-গ্রেট। সো ইউ আর ট্যালেন্টেড।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– এক্সকিউজ মি?
– হুম এসএসসি এইচএসসি তে কপি করে ইউ গট বৃত্তি। তো এটা বিশাল ব্যাপার।
কথাটা বলে সে আমার বই গুলো দেখা শুরু করলো।
– হ্যাঁ আর ভর্তি পরিক্ষায় কপি করা যাবে না। তো আমাকে পড়ালে আপনার মানসম্মান যাবে তাই দয়া করে আপনি আসতে পারেন এখন।
– সেটা নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না। আমার মানসম্মান ঠিক রাখার জন্য আমি যা যা দরকার ওটা আমিই করতে পারবো। এছাড়া গাধা টাইপ স্টুডেন্ট মানুষ করতে পারি আমি সুইটহার্ট।
– কি কি? কি বললেন আপনি?
-রিপিট করতে হবে?
– কথা বার্তা মুখ সামলে বলবেন।
– আমি ওইসব মেয়েদের মতো না মোটেও।
সে মুখে হাসি রেখেই আমাকে পালটা প্রশ্ন করছে বইয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে।
– কোন সব মেয়ে?
– আপনি যেমন ভাবছেন সেইসব মেয়ে।
এবার ইরাদ বইটা বন্ধ করে আমার চোখের দিকে চোখ রেখে বললো।
– আমি তো আপনাকে যেসব মেয়েদের মতো ভাবার দরকার তেমনি ভাবছি। সো মিস রুহি, ডোন্ট ওয়ারি।
কথাটা চেহারা একদম সিরিয়াস করে বললেন উনি।
পরক্ষণেই এক চোখ টিপ দিয়ে সে বললো,

নাহলে এই অল্প বয়সেই চেহারায় রিংকেল পরে যাবে।

তার কথা শুনে আমি চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে তাকাতে দেখে সে বলে,
-এনিওয়েস আই নো আই এম টু হ্যান্ডসাম কিন্তু আপনার এখন পড়ালেখায় মনোযোগ দেওয়া উচিত।
– আপনি কিন্তু বেশিইইই….
– বেশি হ্যান্ডসাম আমি জানি সুইটহার্ট।
– আপনি এভাবে কথা বললে কিন্তু আমি মা কে বলে দিবো।
পেছন থেকে তখন মা জুস নিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে,
– মা উনি আমাকে পড়াতে পারবে না এটা বলছে।
মা- কি হলো বাবা?
ইরাদ- না আন্টি ও বলছিলো সকাল বেলা পড়ার কথা। আমি বললাম বিকেলে আসবো কারণ সকালে তো আমার ক্লাস থাকে।
– না বাবা তুমি তোমার সময় করে এসো। ওকে আন্টি, আপনি কোনো টেনশন নিবেন না। আই উইল হ্যান্ডেল এভরিথিং। আপনার মেয়ে বুয়েটেই পড়বে ইনশাআল্লাহ।
আমি মনে মনে বললাম
(ইশশ! এখন এর কাছে নাকি আমার পড়তে হবে বুয়েটের ভর্তির জন্য।)
ইরাদ তখন আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– হুম পড়তে হবে।
আমি যেনো ঝটকা খেলাম একটু। মনে মনে বলা কথা কিভাবে বুঝে গেলো উনি।
ইরাদ – আচ্ছা আন্টি আমি আসি আজকে। রুহি এটা বুক লিস্ট আপনার কাছে আলরেডি আছে এগুলো কালকে সব বেড় করে রাখবেন। আমরা প্রথম থেকে শুরু করবো।
যাওয়ার সময় ও আমার দিকে তাকিয়ে একটা দুষ্ট হাসি দিয়ে চলে গেলো।

ইরাদ যাওয়ার পর পরই আমি মা কে বললাম,
-মা ওই ছেলেকে তুমি না করে দিবা। আমার একটুও পছন্দ না। তোমার মতামত আমি জিজ্ঞেস করেছি?
– কিন্তু মা প্লিজ…
– রুহি তুমি কিভাবে ইরাদকে নিয়ে এসব বলছো? এই ছেলেটা তোমার জন্য এতো করলো আর তুমি কি না।
– কি করেছে?
-আজকে ইরাদের কারণেই তুমি সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছো। আমি বলে শেষ করতে পারবো না এই ছেলেটা আমার জন্য কি করেছে। আমার জীবনের শেষ সম্বল আমার মেয়েটাকে ও সময় মতো হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলো। আর আমার সেই মেয়েই একে এমন করে বলছে কি জন্য? কারণটা কি আমি জানতে পারি?

আমি এবার বুঝতে পারলাম তাহলে এই ছেলেটাই সে যাকে আমি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার সময় আধো আধো চোখে দেখেছিলাম। এই ছেলেটা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো। এবার আমি আর কিছু বললাম না।
– না মা কিছু না।
– ওকে ভালো মতো পড়বে।
– আচ্ছা মা।

এবার তার ওপরে রাগ লাগলেও কিছুটা কম লাগছে। ছেলেটা আমার অনেক বড় উপকার করেছে কিন্তু সব ঠিক থাকলেও আমাকে সুইটহার্ট কেনো বলে? এই কথাটা তো শুনে তার ওপরে রাগ কিছুটা বহাল ঠিকি রয়ে গেছে আমার।
এতো অপ্রিয় মানুষটা আমার একদম প্রিয় মানুষে পরিণত হবে তা সে মুহূর্ত পর্যন্ত ঘুনাক্ষরে ও আমি জানতাম না।

.

(বর্তমানে ইরাদ)
– আতিফ আমি বেস্ট ছেলে চাই, তুমি বুঝতে পারছো রাইট?
-ইয়েস স্যার।
– সো ফাইন্ড আর্লি। রুহি নিডস টু গেট ম্যারিড সুন।
– স্যার আমি চেষ্টা করছি।
– আমি রেজাল্ট চাই, চেষ্টা না।
কথা গুলো ইরাদ ওর ম্যানেজারকে বললো,
বলেই আবার পাবে চলে গেলো ড্রিংক করতে। এই ড্রিংক করাটা আপাতত ইরাদকে কিছুক্ষণের জন্য পুরোনো সব কথা বার্তা ভুলে থাকতে সাহায্য করছে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে