অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব-১০+১১+১২

1
888

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

১০.

বাহিরের আলতো বাতাসে প্রদীপ শিখা প্রায় নিভু নিভু, ফুরিয়ে এসেছে তার আয়ু তবুও বেঁচে থাকার তার তীব্র ইচ্ছে যেন বিহারিণী মহলের অবহেলার বিধবা অলকানন্দার মতন তার তেজ! অলকানন্দা সেই নিভু নিভু প্রদীপ শিখায় দৃষ্টি মেলে নবনীলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“আপনাকে কেন অপছন্দ করব বললেন না?”

“আমাকে অপছন্দ করার অনেক কারণ আছে আপনার, তার মাঝে একটি হলো আমি আপনার প্রিয় শত্রু লক্ষ্মী দেবীর আদরের পুত্র।”

অলকানন্দা হয়তো এমন একটা কথার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তার চোখে মুখেই সেই চমক ভাব পরিলক্ষিত হলো। সে বিশ্বাসই করতে পারল না যে নবনীল ঐ মহিলার ছেলে। অলকানন্দার হাবভাব দেখে হাসল নবনীল। ডান ভ্রু ক্ষানিকটা উঁচু করে বলল,
“কী? অবাক হচ্ছেন?”

অলকানন্দা মাথা নাড়াল। অস্পষ্ট স্বরে বলল, “হ্যাঁ।”

“অবাক হওয়ার কিছু নেই, আপনি হয়তো শুনেননি লক্ষ্মী দেবীরও যে একটা পুত্র সন্তান আছে। তাছাড়া অবশ্য এ বাড়িতে আমাকে তেমন কেউ পছন্দ করেনা তাই হয়তো আলাদা ভাবে কেউ আমার কথা বলারও প্রয়োজনবোধ করেনি। আর যে পছন্দ করতো সে হয়তো বলার সুযোগ পায়নি।”

“আপনার মতন একটা ছেলেকে অপছন্দ করার কারণ কী! কত মিশুক!”

“সব কথা একদিনে বলে দিলে পরে তো কথা বলার জন্য আরকিছুই থাকবে না। কিছু কথা নাহয় পরের জন্য থাকুক।”

অলকানন্দা হালকা মিঠে আঁধারে নবনীলের দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটাকে তার বোধগম্য হলো না যেন। লক্ষীদেবীর ছেলে কিনা এত ভালো! এতটা আকাশ পাতাল তফাত মা ছেলের মাঝে হয়?

“মা আর ছেলের মাঝে মিল খুঁজে পাচ্ছেন না বুঝি? মিল থাকতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কোথাও?”

নবনীল অলকানন্দার মনের কথা ধরে ফেলেছে দেখে অলকানন্দা আরেক ধাপ বেশি অবাক হলো। ছেলেটার মাঝে কিছু তো একটা আলাদা আছে। নাহয় এমন ভাবে সব জেনে যায় কীভাবে? একটা অন্যরকম ব্যাপার।

ওদের ভাবনার মাঝেই বৈঠকখানা থেকে ডাক ভেসে এলো৷ কিসের একটা হৈচৈ হচ্ছে যেন! দু’জনই প্রায় বিস্মিত ভঙ্গিতে ছুটে গেল বৈঠকখানায়।

অন্দরমহলে বেড়েছে কোলাহল। গ্রামের মানুষ অনেকেই ভীড় করেছে এখানে। হৈচৈ হট্টগোলে দিশেহারা বাড়ির সকলে। অলকানন্দা এগিয়ে এলো পিছে পিছে নবনীলও এলো। তাদেরকে খুব গভীর দৃষ্টিতে পরোখ করল প্রসাদ। দু’জনকে একসাথে দেখেই সে চোখ বাঁকালো। বিরক্ত হলো। বাহিরের হৈচৈ তখন তীব্রতর। হৈচৈ ছাঁপিয়ে গ্রামের একজন মুরব্বির কণ্ঠ ভেসে এলো,
“নন্দনমশাই, সুদর্শন বাবা জমিদারিতে থাকার সময় তো গ্রামে এমন অনাসৃষ্টি হয়নি। যেই আপনার ছেলে মনোহর জমিদারীতে এলো তখনই গ্রামের মেয়ে-বধুরা এত অনিরাপদ হয়ে গেল! কেউ জল ভরতে একা যেতে চাচ্ছে না, মেয়েরা ইস্কুলে একা যেতে চাচ্ছে না। বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। এ কেমন বিচার?”

“মেয়ে মানুষের ধর্মই বাড়িতে থাকা, তাহলে সমস্যা কোথায়?”

নন্দন মশাইয়ের উত্তরে হৈচৈ সমাগম থেমে গেল। বৃদ্ধ বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি এখানে সমস্যা খুঁজে পাচ্ছেন না! আপনার পুত্র যদি গ্রামের মেয়ে বৌদের সাথে এমন অনাসৃষ্টি ব্যবহার করতে থাকে তবে তো গ্রামে টিকে থাকা মুশকিল হবে।”

“মুশকিল হলে অন্য কোথাও চলে যাবেন, সমস্যা কোথায়? এখন কী আমার পুত্রকে আমি ঘরে বসিয়ে রাখব? ছেলেদের ঐ একটু সমস্যা থাকেই, আপনারা নিজেদের বৌকে সামলে রাখলেই তো হয়।”

ভীড়ের মাঝ থেকে একজন মধ্যবয়স্ক লোক এবার সামনে এগিয়ে এলো, চোখে মুখে তার রাগ লেপ্টানো। সে কঠিন স্বরে বলল,
“আপনার ছেলে আজ আমার ইস্কুল যাওয়া কন্যার সাথে খুব বাজে ব্যবহার করেছে। মেয়েটার জামার একাংশ ছিঁড়েও ফেলেছে। এত বাজে আচরণ করেছে যে আমার মেয়েটা এখন ঘরে পড়ে আছে। আমার মেয়ের আর বিয়ে হবে? এই কলঙ্ক কীভাবে মুছবো আমি?”

“মেয়ে মানুষদের এত ইস্কুলে পাঠানোর প্রয়োজনই বা কী? তোমাদের আদিখ্যেতা দেখলে আমারই গা জ্বলে যায়।”

এতক্ষণ শুভ্রা রাঙা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনছে অলকানন্দা। বাড়ির বাকি মহিলারাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অলকানন্দা ঘুরে কৃষ্ণপ্রিয়ার দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখ-মুখ শুকনো, মাথা নতজানু। যেন স্বামীর সকল পাপের দায়ভার তার।

“ছোটো বউ, তুমি কী বলবে তোমার স্বামীর এমন কীর্তির কথায়?”

কৃষ্ণপ্রিয়া ঘাড় উঠিয়ে তাকাল অলকানন্দার পানে। কিন্তু সে জবাব দেওয়ার আগেই জবাব দিল লক্ষ্মী দেবী,
“ও কী বলবে হ্যাঁ? ও কী বলবে? মেয়েছেলেদের সব ব্যাপারে কথা বলা সাজে না।”

“তাহলে আপনি কেন এ ব্যাপারে কথা বলতে আসছেন? অন্যকে যেটা বলেন, নিজে সেটা মানতে পারেন না?”

অলকানন্দার জবাবের বিপরীতে ধমকে উঠে লক্ষ্মী দেবী, “বউ!”

“বড়ো বউ ঠিকই বলে দিদি। আমার ছেলেটার এমন অবনতি সত্যিই লজ্জার কারণ। এমন ছেলে বুঝি গর্ভে ধরে ছিলাম! এরচেয়ে সন্তান ছাড়া থাকতাম তাও বোধকরি সম্মানের ছিল।”

“মা, অমন কথা বলবেন না।”

কৃষ্ণপ্রিয়ার কথার বিপরীতে হাসল অলকানন্দা। অতঃপর মেয়েটার থুতনি কিছুটা উপরে উঠিয়ে বলল,
“যে স্বামীর জন্য সারাজীবন মাথা নিচু করে চলতে হয় তার প্রতি এত মায়া তোমার? ভালোবাসা ভালো তবে সেটা অন্ধ ভালোবাসা হলে পরিহার করতে হবে।”

“তুমি কী বুঝবে বড়দি স্বামীর মর্ম! বিয়ের এক মাসেই তো সাদা শাড়ি পড়েছ।”

কৃষ্ণপ্রিয়ার কথায় দাম্ভিকতার ছাঁপ। মেয়েটার এমন উত্তরে হতভম্ব অলকানন্দা। এমন ভাবে মেয়েটা কথা বলবে সে যে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। তাই উত্তর দেওয়ার ভাষা সে প্রায় হারিয়ে বোকা চোখে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু ততদিনে অলকানন্দার লড়াইয়ে হয়তো নিবিড় ভাবে যোগ দিয়েছে অনেকে। তার ফলস্বরূপই তরঙ্গিণী জবাব দিল,
“তোর লাল শাড়ির এত গর্ব কৃষ্ণা? অমন শাড়ি পরেও কী লাভ যদি সম্মানই না থাকে? তোর লাল শাড়ি তো কোনো কিছুই করতে পারল না। না তোর মাথা উঁচু রাখতে পারল আর না তোর শরীরে থাকা মারের চিহ্ন লুকাতে পারল। তবে এত বড়ো বড়ো কথা কিসের? এর চেয়ে অলকানন্দা ঢেড় সম্মানে আছে। তার সাদা শাড়িতে তার সম্মান আছে।”

অলকানন্দা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো তরঙ্গিণীর পানে। মেয়েটাকে বুঝতে পারা দায়। কখন কী বলবে ধারণা করা অসম্ভব।

এর মাঝেই বিচারকার্যে হাহাকার শোনা গেল। মেয়েটার বাবা কেঁদে কেটে লুটিয়ে পড়েছে নন্দন মশাইয়ের পায়ের কাছে৷ দু-হাত জোর করে বলছে,
“আপনি এর একটা বিহীত করুন নন্দন মশাই। আমাদের যে আপনি ছাড়া কেউ নেই। আপনি বিচার না করলে আমরা কার কাছে যাবো? আমার মেয়েটার ভবিষ্যত কী?”

লোকটার প্রশ্নে গম্ভীর দেখাল নন্দন মশাইকে। সবাই ই তার উত্তরের অপেক্ষায় রইলো। সবার অপেক্ষার ছুটি দিয়ে অতঃপর নন্দন মশাই বললেন,
“ঠিকাছে, তোমার মেয়ের ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিব। কী চাই বলো? জমিজমা না টাকা-কড়ি?”

অলকানন্দা হতভম্ব চোখে চাইল তার খুড়োশশুড়ের দিকে। লোকটা কী আদৌও মানুষ! সে নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে না পেরে পর্দা থেকে বেরিয়ে এলো। কণ্ঠ উঁচু করে বলল,
“জমি দিয়ে কলঙ্ক ঢাকবেন? তা কোন জমির এত ক্ষমতা যে নারীর কলঙ্কের দাঁগ মুছে? আমিও দেখতে চাই সে জমি।”

উপস্থিত সকলেই বিস্মিত নয়ন জোড়া মেলে তাকিয়ে রইলো সাদা শাড়িতে আচ্ছাদিত একটি পবিত্র কিশোরীর পানে। যার চক্ষু কথা বলছে যুগ বদলের, যার অস্তিত্ব রচিত করতে চাইছে ইতিহাস। কিন্তু আদৌও এমন একটা পিছিয়ে পড়া সমাজ মানবে নারীর আধিপত্য? দূর থেকে বিজয়ীর হাসি হাসছে নবনীল। নারী শক্তিকে মূলত সামান্য ভেবে যে সমাজ ভুল করছে তাদের হয়তো এখন সেই নারীর ক্ষমতাই চলতে হবে। অলকানন্দার এই কতৃত্ব পুরুষ সমাজের কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ মনে হবে নাকি তাদের দম্ভ মেয়েটাকে আরও নিচে নামাবে?

#চলবে

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

১১.

বিচারের আসন খানায় নতুন মুখ দেখে গ্রামবাসীরা হয়তো অমান্য করবে ভেবেছিল সকলে কিন্তু সকলের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে গ্রামবাসীরা অলকানন্দার কাছে হাত জোর করল, অসহায় সেই বাবা অসহায় কণ্ঠে বলল,
“তাহলে তুমিই আমার মাইয়ার বিচার করবা বউ?”

অলকানন্দা এগিয়ে গেলো, মাথা তার উঁচু। পাহারের মতন উঁচু ব্যাক্তিত্ব নিয়ে বলল, “অবশ্যই।”

নন্দন মশাই যে বড্ড অপছন্দ করলেন অলকানন্দার এই কাজটা, সেটা তার চোখ-মুখ দেখেই বোঝা গেল। সে বেশ বিশ্রী রকমের ধমকে উঠলেন,
“বাড়ির মেয়েমানুষ হয়ে, এখানে কেন এসেছ তুমি? আবার বলছো বিচার করবে! ধ্যান জ্ঞান কী সব লোপ পেয়েছে তোমার? যাও এখনই ভেতরে।”

“আমি ভেতরে যাব না কাকাবাবু। আগে মেয়েটার সুষ্ঠু বিচার করুন আপনি।”

“তুমি ভেতরে না গেলে খারাপ হবে, বউ। বেধবা মেয়েমানুষের সব ব্যাপারে বাড়াবাড়ি তো মোটেও ভালো লাগছে না।”

“আপনি বিচার করুন কাকাবাবু, আমি এখানেই থাকব।”

নন্দন মশাই উত্তেজিত হলেন। যেই না তেড়ে আসতে নিবেন তখনই পর্দার আড়াল থেকে ভেসে এলো সুরবালার গম্ভীর কন্ঠ,
“খবরদার ঠাকুরপো, ভুলেও আমার বউমার দিকে এগুবে না। এখন আমার ছেলে বেঁচে নেই। আমার ছেলের অবর্তমানে আমার বউমাকেই আমি তার জায়গায় বসালাম। তুমি ভুলেও কিছু করবে না।”

নন্দন মশাই সুরবালার শীতল হুমকিতে বোধহয় কিছুটা দমে গেলেন। বিস্মিত নয়ন জোড়া মেলে বললেন,
“তাই বলে মেয়েমানুষ তাও আবার বেধবা, সে নাকি বসবে বিচারালয়ে! আপনি বৌঠান ভেবে বলছেন তো?”

“সঠিক বিচারের জন্য বিচারালয়ে যাকেই মানাবে আমি তাকেই বসাবো। আমার পুত্র এই গ্রামকে যেভাবে আগলে রেখেছিল সেভাবে যে আগলে রাখতে পারবে সে-ই বসবে আসনে। হোক সেটা আমার পুত্র বধূ কিংবা অন্যকেউ।”

নন্দন মশাই আর কথা বললেন না। অলকানন্দা কণ্ঠ কোমল করলো, ধীর কণ্ঠে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্য বয়স্ক লোকটাকে জিজ্ঞেস করল,
“আপনার মেয়ে কোথায় এখন?”

“বাড়িতে আছে, মা। যদি মেয়েটার কোনো গতি করতে না পারি তবে তাকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া ছাড়া যে আর উপায় থাকবে না।”

“দোষ তো সে করেনি, তবে তাকে কেন ভাসাবেন? দোষ যে করেছে ভাসাতে হলে তাকে ভাসাবেন।”

“বউ!”

“আমি কথা বলছি, কাকাবাবু। আমার বিচারকার্যে অন্য কারো বাঁধা আমি মানবো না।”

নন্দন মশাই হতভম্ব চোখে কেবল তাকিয়ে দেখল এই অলকানন্দাকে। দু’দিন আগেও মেয়েটার চোখে-মুখে ছিল অসহায়ত্ব। আজ কোথায় সব?

নন্দন মশাইয়ের ভাবনার মাঝেই অলকানন্দা কণ্ঠ দৃঢ় করল,
“ঠাকুরপো, ঠাকুরপো কোথায় তুমি? নিশ্চয় বাড়িতে আছো। দ্রুত নিচে নেমে আসবে নাহয় তোমার কপালে দুর্গতি আছে। ঠাকুরপো…”

জন সমুদ্রের ঢেউ নিশ্চুপ। অলকানন্দার চোখ-মুখে একটা দারুণ সাহসিকতার রেখা ভেসে বেড়াচ্ছে। এই পুরুষের বিচার করতে পারবে ভেবেই তার নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। এই যুগে এসে পুরুষদের বিচার হবে কথাটা কল্পনাতেও কেউ ভাবেনি অথচ আজ অলকানন্দা সেটা সত্যি করার জন্য মরিয়া প্রায়।

মনোহরের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে অলকানন্দা পর্দার দিকে দৃষ্টি দিল। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে অন্দরমহলের সকল মহিলা বৃন্দ। সেখানে তাকিয়েই ভরাট কণ্ঠ সে ডাক দিল নিজের জা’কে,
“ছোটোবউ…”

পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণপ্রিয়ার তখন বুক কাঁপছে। নিজের নামটা শুনতেই তার আত্মার পানি শুকিয়ে গেল। কোনো মতে বলল,
“বলো বড়দি?”

“এক্ষুনি তোমার পবিত্র স্বামীকে এখানে নিয়ে আসো। আর আমি যদি আনতে যাই তবে কিন্তু খারাপ হবে।”

অলকানন্দার সতর্কবার্তায় কপাল কুঁচকে ফেলল লক্ষ্মী দেবী, মুখ ঝামটি দিয়ে সুরবালার উদ্দেশ্যে বলল,
“তোর বউ বড্ড বাড়াবাড়ি করছে। শোন, বেধবা মেয়েমানুষকে এত মাথায় চড়িয়ে ফেলিস না। পুরুষমানুষের আগে মেয়েমানুষ পা বাড়ালে তাকে বাজারি মেয়েমানুষ বলে। জানিস তো?”

“দিদি, মুখ সামলে কথা বলুন।”

তাদের বাকবিতন্ডার মাঝেই অলকানন্দার কণ্ঠ ভেসে এলো,
“ছোটোবউ, এসেছে ঠাকুরপো?”

কৃষ্ণপ্রিয়া অসহায় চোখে তাকালো একবার। যেই পা বাড়াতে নিলো নিজের স্বামীকে ডাকার জন্য, তখনই দেখল মনোহর বৈঠকখানায় উপস্থিত হয়েছে। মনোহরকে দেখে শীতল জনমানব হৈচৈ করে উঠলো। একটা গমগমে ভাব সেখানে অনুভব হলো। অলকানন্দা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আপনারা থামুন, আমি কথা বলছি।”

অলকানন্দার কথায় থেমে গেল সব। ষোলো বর্ষীয়া যেই মেয়েটা বিধবা হয়ে গিয়েছে বলে তার ঠাঁই হয়েছিল নোংরা, স্যাঁতস্যাঁতে একটা ঘরে আজ সেই মেয়ে আসন পেয়েছে বিচারালয়ে। এটাই বোধহয় ভাগ্যের খেলা। যেই মেয়েটাকে সকলে মানুষ ভাবতেই ভুলে গিয়েছিল আজ তার এক বাক্যে স্থির জনমানবের শোরগোল।

অলকানন্দা মনোহরের দিকে এগিয়ে গেলো, শক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কী করেছ তার মেয়ের সাথে, ঠাকুরপো?”

মনোহরের চোখে-মুখ দিয়ে যেন ঝরে পড়ছে ক্রোধানল। সে নিরুত্তর। কিসের যেন একটা অহংকার তার ভেতরে। অলকানন্দা আবারও প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“তুমি কী করেছ তার সাথে?”

“কিছুই না।”

মনোহর উত্তর দিতে দেরি কিন্তু তার গালে সপাটে চ ড় পড়তে দেরি হলো না। পুরো বিচারকার্য থমকে দিয়ে অলকানন্দা কাজটা করে বসলো। মনোহর হিংস্র বাঘের ন্যায় খেপে উঠলো, তেড়ে গিয়ে কেবল বলল,
“বউ ঠাকুরণ আপনাকে….. ”

দ্বিতীয় চড়টা পড়তেও সময় নিলো না। সকলেই প্রায় হতভম্ব। অলকানন্দা দাঁত কিড়মিড় করে শীতল কণ্ঠে বলল,
“কী করেছ জানতে চেয়েছি। এত বিলম্ব করছো কেন?”

মনোহর তার বাবার দিকে তাকালো। নন্দন মশাইয় মাথা নত করা অবস্থা দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখেই মনোহরের রুদ্রমূর্তি থিতিয়ে গেল। গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“তাকে ইশকুল যাওয়ার পথে তুলে এনে আমাদের বাগান বাড়িতে রেখেছি। কেবল এক বেলা’ই ছিলাম তার সাথে। বেশি না।”

মনোহর কথাটা এমন ভাবে বলল যেন একবেলাতে তেমন কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়নি। অলকানন্দার ঘৃণায় শরীর শিউরে ওঠল। উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
“এবার বিচার করবেন আপনারা। বলুন ওর কী বিচার করবেন?”

অলকানন্দার আশকারা পেয়ে সবাই যেন সাহসী হয়ে ওঠল। কেউ বলল- বেত্রাঘাত করতে, কেউবা বলল- চাবুক দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করতে তার শরীর, কেউবা বলল- তার সম্পদ কিছু লিখে দেওয়া হোক মেয়েটার নাম। একেক জনের একেক মন্তব্যে এবার দিশেহারা হলো নন্দন মশাইসহ তার পুত্র, পুত্রবধূ সকলে। কেবল ভাবলেশহীন দেখা গেল তিনজনকে- অলকানন্দা, সুরবালা আর নবনীলকে। প্রসাদের কপালেও তখন চিন্তার গাঢ় ভাঁজ৷ কী দরকার ছিল মেয়েটাকে এসবে আসার?

জন সমাগমকে থামালো অলকানন্দা। ভুক্তভোগী কন্যার পিতাকে প্রশ্ন করল সে,
“আপনি কী চান?”

লোকটা জবাব দেওয়ার আগেই আরেক বৃদ্ধ ব্যাক্তি উত্তর দিল,
“মনোহর রায়কে বিয়ে করতে হবে। একমাত্র মেয়েটার বিয়েই মেয়েটার কলঙ্ক মুছতে পারবে। আর নাহয় তাকে তত টাকা-কড়ি দিতে হবে যত টাকাকড়ি থাকলে কলঙ্ক ঢাকা যায়। এবার আপনার উপর সে ভার।”

অলকানন্দার মুখ গম্ভীর। গম্ভীর কণ্ঠে ডাক দিল কৃষ্ণপ্রিয়াকে,
“ছোটোবউ, তুমি কী চাও?”

কৃষ্ণপ্রিয়ার অবস্থা তখন করুণ। অলকানন্দার উপর তার রাজ্যসম রাগ জমা হলো আর চোখে জমলো অশ্রুর স্রোত। তবুও কোনোমতে উচ্চারণ করল,
“আমার ঘর ভাঙার এত প্রয়োজন তোমার, বড়দি?”

অলকানন্দা হাসল। কৃষ্ণপ্রিয়া মেয়েটা কোনো কিছু বিচার করার ক্ষমতা হারিয়েছে। হারানোটাই স্বাভাবিক। দীর্ঘদিন যাবত পুরুষের পদতলে এই সমাজ শাসিত হয়েছে। সেই সমাজেই পুরুষকে শোষণ করা হবে সেটা কেউই মানতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। অলকানন্দা আবার ধীর কণ্ঠে বাক্য ছুঁড়লো,
“তোমার ঘর বেঁধেছো ভুল মানুষের সঙ্গে। এবার দোষ কার? আমার না তোমার?”

কৃষ্ণপ্রিয়া আর সে কথার উত্তর দিলো না বরং স্থির কণ্ঠে বলল,
“আমি সতীন আনতে রাজি তবুও আমার স্বামী যেন অক্ষত থাকে।”

“তোর কথায় সব হবে? আমি এই ছোটো লোকের মেয়েকে বিয়ে করব? কখনোই না। ওদের বংশ কত নিচ জানিস? তোর স্বামী কী করবে সেটা তুই বলবি? তোকে তো আজ….”

মনোহর যখন তেড়ে যেতে নিল অন্দরমহলের দিকে তখন তাকে থামিয়ে দিল অলকানন্দা। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“ছোটো বংশের মেয়ের শরীরে কালি লেপতে তো ভালোই পারলে এখন বিয়ে করতেই দোষ? সাবধান ঠাকুরপো।”

নিজের কথা শেষ করে সে মধ্য বয়স্ক লোকটার দিকে তাকালো, কোমল কণ্ঠে বলল,
“আপনি কী চান বলুন? তেমনই হবে। এই একটা অমানুষের সাথে বিয়ে দিলে যদি আপনি আপনার মেয়ের অন্যায়ের বিচার পান তবে তা-ই হবে।”

অলকানন্দার কথায় কিছু ইঙ্গিত ছিল যা হয়তো বুঝতে পারল অসহায় বাবা। তাইতো কেমন কঠিন স্বরে বলল,
“বিয়ে দিলেই অন্যায়ের বিচার হবে? বিয়ের পর মেয়েটার সাথে তো আরও অন্যায় হতে পারে। আমি কখনোই এমন পুরুষের সাথে আমার মেয়ে বিয়ে দিব না। আমি চাই ওকে কমপক্ষে পাঁচশো বেত্রাঘাত করা হোক৷ ক্ষত-বিক্ষত করা হোক ওর শরীর। যেন আর কেউ এমন করতে না পারে।”

লোকটার এহেন কথায় কেঁপে উঠলো সবাই। কেউ কেউ বলল এরচেয়ে বিয়ে দেওয়া ভালো হবে। কিন্তু শুনলো না লোকটা কারো কথা। অলকানন্দার ঠোঁটে ঝুলল বাঁকা হাসি। সে বজ্রকণ্ঠে ডাক দিল বাড়ির রক্ষাকারী কর্মচারীকে, আদেশ করলো পাঁচশ বেত্রাঘাতের তাও রাস্তায় বেঁধে লোক সমাগমের মাঝে।

মনোহর ভয় পেলো এবার। নন্দন মশাই ছেলের হয়ে কথা বলতে চেয়েও পারলো না। অলকানন্দার তেজের কাছে সব তুচ্ছ। ছুটে এলো কৃষ্ণপ্রিয়া, অলকানন্দার পা জড়িয়ে ধরে ভিক্ষে চাইল স্বামীকে। অলকানন্দা ভিক্ষে দিল না বরং তাচ্ছিল্য স্বরে বলল,
“এখন তোমার লাল শাড়ির গর্ব কই ছোটোবউ? এই আঁচল দিয়েই ঢেকো স্বামীর দাগ। তোমার শরীরের প্রতিটা দাগ আজ তার শরীরে পরবে। কী দিয়ে ঢাকবে সে লজ্জা?”

মুহূর্তেই এমন চোখ ধাধানো বিচারের খবর ছড়িয়ে গেলো গ্রাম ছেড়ে গ্রামান্তর। নবনীল মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,
“নারী নয় সে, যেন ছাঁই চাপা আগুন। ছুঁতে এলেই পুড়বে।”

#চলবে

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

১২.

গাঢ় সন্ধ্যা প্রকৃতির বক্ষ জুড়ে। বিহারিণী মহলের অন্দরমহলে আজ সকলের মাঝে লুকোচুরি ফিসফিস। বাড়ির গৃহ কর্মচারীরা একজনের সাথে আরেকজন ফিসফিস করে কি যেন বলে। অলকানন্দাকে ইশারা করে করে সে কথা বলে কিন্তু যেই অলকানন্দাকে দেখে তখনই ভয়ে চুপচাপ হয়ে যায়। কথা বলে না। লুকোচুরি কথাবার্তা থেমে যায়। অলকানন্দা ব্যাপারটা খেয়াল করেও যেন করছে না। গৃহ কর্মচারীদের এমন আচরণ করাটা তার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে না। এতদিনের প্রচলিত প্রথা থেকে বের হতে একটু তো সময় লাগবেই সকলের।

রান্নাঘরে একবার কৃষ্ণপ্রিয়াকে ছুটে আসতে দেখা যাচ্ছে আবার ছুটে নিজের ঘরে চলে যাচ্ছে। সাথে তার কাকী শাশুড়িরও ছুটোছুটি দেখা যাচ্ছে। লক্ষ্মীদেবীও আজ মনোহরদের ঘর। একটু পর পর তার হাঁক শোনা যাচ্ছে। অলকানন্দাকে ছলেবলে অভিশাপ দিচ্ছে অতঃপর আবার চুপ হয়ে যাচ্ছে হয়তো গোপন ভয়ে। মেয়েটা যা-কিছু করতে পারে। এই মেয়েকে বেশি রাগালে যে কপালে দুর্গতি আছে সেই কথা আর কারো বুঝতে বাকি নেই।

মনোহরের আর্তনাদ থেমে থেমে ভেসে আসছে। বেত্রাঘাতে বেত্রাঘাতে তার শরীরটা ক্ষত-বিক্ষত। আজকের মতন এত নিষ্ঠুর বিচারকার্য হয়তো এই গ্রামের মানুষ আগে কখনো দেখেনি। তবে সঠিক বিচার পেয়ে গ্রামবাসীদের মনে তৃপ্তির ছোঁয়া। যাক, যে বিচারে আপন পর ভেদাভেদ নেই সেই বিচারের চেয়ে উত্তম বিচার আর নেই। তার এমন বিচার পেয়ে গ্রামবাসীরা উৎসবমুখর পরিবেশে নিমজ্জিত। অথচ আজ অন্দরমহলে কেবল শুনশান নীরবতা। আর থেমে থেমে আর্তনাদ। পুরো পাঁচশ বেত্রাঘাত দেওয়ার আগেই মনোহর প্রায় আধমরা হয়ে গেছে। তাই তার বিচারকার্য সেখানেই থামানো হয়েছে। আর বিস্ময়কর একটি ব্যাপার হলো প্রথম পঞ্চাশটা বেত্রাঘাত করেছে ভুক্তভোগী সেই কন্যা। যে সারাদিন লজ্জায় ঘর ছেড়ে বের হয়নি সে কেমন দীপ্তিময় একটা উজ্জ্বলতা নিয়ে ভরা সভায় উপস্থিত হয়েছে। মনের প্রতিটা ক্ষোভ মিটিয়ে সে ইচ্ছেমতন বেত্রাঘাত করেছে। আর অলকানন্দা সবটা সময় দাঁড়িয়ে এই বিচারকার্য সম্পাদিত হতে দেখেছে। গ্রামের এমন কোনো মানুষ নেই যে আসেনি। ছেলে-মেয়ে, নারী পুরুষ, শিশু সকলেই ছুটে এসেছে সে বিচার দেখতে। অবশেষে কৃষ্ণপ্রিয়ার মাটিতে গড়াগড়ি করে স্বামীর প্রাণ ভিক্ষে চাওয়ার পর স্থগিত হলো সেই বিচার।

অলকানন্দা অন্দরমহলের আরামকেদারায় বসে আছে। মনোহরকে দেখতে ডাক্তার বৈদ্য সবই এলো। অলকানন্দা এ ক্ষেত্রে কোনো নিষেধ করেনি বরং সবচেয়ে ভালো চিকিৎসক আনার ব্যবস্থাই সে করেছে। বিচার কার্যের সময় সে ছিল বিচারক কারো আত্মীয় নয় কোনো আপন মানুষ নয় কিন্তু অন্দরমহলে সে অবশ্যই এ বাড়ির বউ, মনোহরের বৌঠান, কৃষ্ণপ্রিয়ার জা এবং এ বাড়ির পরম কাছের মানুষ। এখানে সে বিচারক নয়।

অলকানন্দার মুখোমুখি কেদারায় এসে বসলো প্রসাদ। বাড়ির সকলে যখন মনোহরকে নিয়ে ব্যস্ত তখন প্রসাদের নেই কোনো হেলদোল। সে বরং আয়েশ করেই বসলো কেদারায়। বসে বেশ প্রশংসা করে বলল,
“বাহ্, আজ কী রূপ দেখলাম আপনার অলকানন্দা! এমন তেজস্বী রূপও লুকিয়ে ছিল এত ছোটো একটা মেয়ের ভেতর!”

অলকানন্দা কথা বললো না তবে ক্ষীণ একটা হাসির রেখা টানলো নিজের ঠোঁটে। প্রসাদ আবারও বলল,
“কিন্তু আপনার কী এমন ঝামেলায় যাওয়া উচিত ছিল? যদি কোনো ক্ষতি হয়!”

“প্রসাদ, তোমার মতন মানুষ এমন ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করলে চলবে বলো তো? প্রতিটি মেয়েই প্রয়োজনে ধ্বংসকারী রূপ ধারণ করতে পারে কেবল তার প্রয়োজন একটু আস্থা। যে নারী সৃষ্টি করতে পারে সে নারী ধ্বংসও আনতে পারে তা সকলের অবগত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তোমার এমন সংশয়ের বাণ ছুঁড়লে নারীর তেজস্বী রূপ কী আর দেখতে পাবে বলো?”

নবনীলের প্রশ্নে প্রসাদের দীর্ঘ হাসির রেখাটা কিছুটা থিতিয়ে এলো। কিছুটা আমতা-আমতা করে বলল,
“যতই হোক, অলকানন্দা তো একা ওনার…..”

“অলকানন্দা একা! কোথায় একা? অলকানন্দার সাথে তো তার ছাঁই চাপা আত্মবিশ্বাস আছে। ওনি তো একা নয়।”

প্রসাদ হাসলো। তার হাতের মোটা মেটে হলদেটে রঙের খোলা বইটা বন্ধ করলো। বাঁকা হেসে বলল,
“নবনীল, শহরের সাথে গ্রাম গুলিয়ে ফেলো না। শহরে থেকে, দু একটা নারীর প্রতিবাদী চরিত্র দেখো তাই তোমার মুখে এমন কাব্য আসাটাই স্বাভাবিক কিন্তু শহরের তুলনায় গ্রাম কতটা পিছিয়ে আছে তোমার ধারণাও নেই। যে গ্রামে একটা মেয়ে বিধবা বলে আরেকটা মেয়ে তার পাশে বসে পরীক্ষা দিতে চায় না সেই গ্রামেই বৈধব্য নামক মনগড়া রোগ নিয়ে একটা মেয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারবে এত সহজে! সব কী এতই সোজা নবনীল? তোমার দুনিয়া দেখার দৃষ্টি এখনো অভিজ্ঞ নয়।”

“আর তুমিও বোধহয় নারীর প্রতিবাদী চরিত্র আর শাসনকার্য নিয়ে স্বস্তিতে নেই কিংবা অভ্যস্ত নও।”

নবনীলের ঠেস মারা কথাটা প্রসাদের বোধগম্য হলো অবশ্যই। অলকানন্দা চুপ করে দু’জনের কথা কাটাকাটি দেখছিল বেশ উপভোগও করছিল। তাদের মাঝে যে আড়ালে সাপে-নেউলে একটা সম্পর্ক আছে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না অলকানন্দার। কিন্তু সেই কথা কাটাকাটির দৃশ্য আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না তার আগেই বাহিরের পাহারাদার ছুটে এলেন, মাথা নত করে অলকানন্দাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“আসবো বউ ঠাকুরণ?”

অলকানন্দা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো পাহারাদারের দিকে। লোকটার মাথা নত করা। একদিন এই পাহারাদারই বলেছিল এ বাড়ির বউয়ের ভীমরতি হয়েছে যার জন্য স্বামী মারা যাওয়ার পরও সে চুল কাটতে চায়নি, সাদা শাড়ি পরতে চায়নি। অথচ আজ তার চোখেই অলকানন্দার জন্য সম্মান। আসলে কেউ কাউকে এমনেই অধিকার দেয়না। সেটা অর্জন করতে হয় আর না হলে ছিনিয়ে নিতে হয়। নিজের জায়গা নিজেকেই গড়তে হয়।

অলকানন্দার ধ্যানের মাঝেই প্রসাদ উত্তর দিল, “আসো।”

কিন্তু প্রহরী আগের জায়গায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলো। যেন এখান থেকে নড়েচড়ে গেলেই খারাপ কিছু হয়ে যাবে। অলকানন্দা বুঝলো, সে অনুমতি না দিলে এখন এই গ্রামের একটা কাজও যে হবে না। তাই ক্ষীণ স্বরে সে অনুমতি দিল,
“আসুন।”

প্রহরী এবার ভেতরে এলো। মিটমিট করে হাসল নবনীল। প্রসাদের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টা করে বলল,
“অলকানন্দা কিন্তু নিজের জায়গা পেয়ে গেছে। তুমি ঘর জামাই, তোমার জায়গা হেলাফেলাতেই থাকবে।”

প্রসাদ বিরক্ত চোখে চাইলো কিন্তু কিছু বললো না। তন্মধ্যেই প্রহরী ভেতরে এসে বিনীত স্বরে বলল,
“আপনার সাথে কয়েকজন দেখা করতে এসেছে। তাদের কী ভেতরে আসতে বলব এখন?”

অলকানন্দা ভ্রু কুঁচকালো। তার সাথে দেখা করার মতন মানুষ বর্তমানে নেই। যদিও কোনো কিছুর বিচারের জন্য আসে তবুও এখন তো আসার কথা না। মাত্রই বিরাট একটা বিচার তারা নিজ চোখে দেখলো। এটা হজম করতে অন্তত কয়েকদিন সময় তো লাগবেই। অলকানন্দা ধ্যানে মগ্ন হয়েই প্রশ্ন করল,
“তারা কারা?”

“একজন আপনার পিতা আর একটা হলো সাহেবদের গাড়ি। ইংরেজি সাহেব এসেছে নিজে আপনার সাথে দেখা করতে।”

অলকানন্দাসহ উপস্থিত সকলেই অবাক হলো। নবনীল বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“এই সন্ধ্যাবেলা সাহেব এসেছেন কেন!”

“উনি বলেছেন বউ ঠাকুরণের সাথে দেখা করবে।”

অলকানন্দা নিজেকে ধাতস্থ করলো। মূলত সে নিজেকে যতটা সাহসী দাবী করে ততটা সাহসী হয়তো সে হয়ে ওঠে নি আদতে। বুক তার কাঁপছে। কম্পনরত কণ্ঠে বলল,
“সাহেবদের ভিতরে আসতে বলুন এবং তার সাথের বাকি অন্যান্য মানুষকে বাহিরের ঘরে বসান।”

অলকানন্দার অনুমতি পেয়ে প্রহরী চলে যেতে নিলেই প্রসাদ দাঁড়াল। অবাক কণ্ঠে বলল,
“আর আপনার বাবা?”

“বাবাকে আসতে হবে না। এতদিন একটা খোঁজ নেয়নি তার মেয়ে বেঁচে আছে কি-না মরে গেছে৷ আজ আমার প্রাচুর্যের কথা শোনে মনে পড়লো আমি বেঁচে আছি। তাই বাবার দরকার নেই এখানে আসা।”

অলকানন্দার শক্ত জবাবে চুপ হয়ে গেল প্রসাদ। নবনীলের মুখে তখন রাজ্য জয়ের হাসি। অলকানন্দার তেজ সে জাগ্রত করতে সক্ষম।

প্রহরী যেতেই অলকানন্দা বিরাট ঘোমটা টানলো। ঢেকে গেল তার চাঁদের মতন মুখখানা। মিনিট পেরুতেই গাড়ির শব্দ স্পষ্ট হলো এবং এর কয়েক সেকেন্ড পেরুতেই অলকানন্দার বৈঠকখানায় দেখা গেল ধবধবে সাদা চামড়ার একজন পুরুষকে। অলকানন্দা আড়ষ্ট হলো। ধবধবে সেই বিদেশি পুরুষ এসেই ঝলমলে হাসি দিয়ে বলল,
“গুড ইভিনিং, শুভ সন্ধ্যা। আ’ম অ্যালেন। ভালো আছেন আপনি?”

সাহেবের এমন বাংলা উচ্চারণ শুনে কপাল কুঁচকালো সে। হাত জোর করে বলল,
“নমস্কার। ভালো আছি আমি৷ আপনি ভালো আছেন? বসুন এখানে।”

সাহেব বাক্যব্যয় না করেই বসে পড়লো। ততক্ষণে পর্দার আড়ালে এসে উপস্থিত হলো বাড়ির সকল মহিলাবৃন্দ। নন্দন মশাইও সাহেব আসার খবর শুনে হন্তদন্ত হয়ে এলেন। আহ্লাদে গদোগদো করে বললেন,
“সাহেব এসেছে আমায় ডাকলে না কেন? আর বউমা, তুমি এখানে কী করছো? যাও ভেতরে। পরপুরুষের সামনে কীভাবে দাঁড়িয়ে আছো লজ্জা ছাড়া?”

“আমি আপনার সাথে নয়, উনার সাথেই দেখা করিতে আসিয়াছি। আপনি বরং ভেতরে চলে যান।”

নন্দন মশাই বিস্মিত হলো সাহেবের কথায়। আমতা-আমতা করে বলল, “ওর সাথে কিসের কথা….. ”

কথা সম্পন্ন হওয়ার আগেই সাহেব ওঠে দাঁড়াল, অলকানন্দার কাছে এসে হাতের বিরাট ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“আপনার কথা আজ সকলের মুখে মুখে শুনিয়া আমি অবাক হইয়া ছুটিয়া আসিয়াছি। আপনার এমন সাহসিকতাকে ফুল দিয়ে প্রশংসা করিতেছি। আপনি এটা গ্রহণ করুন।”

অলকানন্দার অস্বস্তি হলো। ঘুরে সাহেবের থেকে ফুল নিতে গিয়ে তার ঘোমটা নড়চড় হলো। তার নিষ্পাপ পবিত্র মুখখানা দেখে মুগ্ধ হলো ভিনদেশী পুরুষ। বিমোহিত কণ্ঠে বলল,
“ইউ আর সাচ আ্য বিউটিফুল লেডি। আ’ম ইমপ্রেসড্! বঙ্গ নারীর যেন অঙ্গে শোভা ধরিতেছে না।”

#চলবে

1 মন্তব্য

  1. আপনার লেখা আরো একটা গল্প পড়ছিলাম,,,,, নাম মনে নাই, তবে লেখিকা আপনি ছিলেন,,,,, এটা মনে আছে,,,,,, You are great,,,,, মম আপু,,,all the best

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে