অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব-২+৩

0
902

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

২.

‘বিহারিণী মহল’ এ বিচার বসেছে। বিচারের বিষয়বস্তু হলো অভদ্র মেয়েমানুষের চুল কাটা। অন্দরমহলে ছোটোখাটো একটা বৈঠক বসেছে। অন্দরমহলের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে অলকানন্দা। তাকে নিয়েই এই বৈঠক আয়োজন। বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে আছে অলকানন্দার কাকা শ্বশুর, খুড়তুতো দেবর, খুড়তুতো ননদদের স্বামীরা এবং তার বাবা। আর বাকিরা সবই মেয়ে। বিচার কার্যে সবচেয়ে অবদান বেশি লক্ষীদেবীর। তিনিই হৈহৈ করে রব তুলেছে বাড়ির বউ ‘বে শ্যা’। নাহয় স্বামী মারা যাওয়ার পরও কারো মনে রঙ থাকে? নিশ্চয় পর পুরুষের সাথে দেহ মিলানোর ধান্দা। রূপ না থাকলে পুরুষ মানুষ কী আর চেখে দেখবে? এমন আরও বিশ্রী বিশ্রী উদাহরণ দেখিয়েই এই বিচার কার্য সাজানো হয়।

অলকানন্দা চুপচাপ। যেন সুউচ্চ হিমালয় দাঁড়িয়ে আছে তার বিশালতা নিয়ে। মুখ খুললেন নন্দন মশাই। আপাতত বাড়িতে বড়ো বলতে সে-ই আছে তাই বিচারের ভার আজ তার কাঁধে। নন্দন মশাই আরাম কেদারা খানায় আয়েশি ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে অলকানন্দার দিকে দৃষ্টি ফেলে বললেন,
“তা বউ, তুমি না-কি চুল কাটবে না জানিয়েছ? নিজেকে তুমি কী ভাবো? বিরাট কিছু? নাকি সব তোমার পড়াশোনা জানো বলো অহংকার? নাকি অন্যকিছু?”

শেষের ‘অন্যকিছু’ কথাটা যে ভীষণ বাজে কিছু উল্লেখ করেছে তা বুঝতে বাকি রইলো না কারো। তার উপর কথাটা বলার সময় নন্দন মশাইয়ের ঠোঁটের কোণে ক্ষুধার্থ হাসির এক রেখা দেখা গিয়েছিল। তা গোপন হয়নি অলকানন্দার দৃষ্টিতে। যা তাকে ভেতর থেকে আরেকটু কঠোর করলো। সে শক্ত কণ্ঠে বললো,
“আমি কেবল আমার পছন্দকে মূল্য দিচ্ছি। তাই আমি চুল কাটতে চাচ্ছি না।”

ভরা বৈঠকে মেয়েদের এমন শক্ত কণ্ঠ অবশ্যই বেমানান। পুরুষের গালে তা চ ড়ের ন্যায় লাগে। যা রাগিয়ে দিল নন্দন মশাইকে। সে বিরাট এক ধমক দিয়ে বলল,
“তোমার আবার কিসের পছন্দ হ্যাঁ? স্বামীর জন্য নারীরা সাজে। যেখানে স্বামী মরে গেছে সেখানে তোমার এমন শখের কারণ দেখছি না বউ।”

“কে বলেছে নারীরা স্বামীর জন্যই সবসময় সাজে? কখনো কখনো তারা নিজের জন্যও সাজে। আর আমি তো কেবল আমার চুল গুলোই রাখতে চাচ্ছি যা একান্তই আমার। তাতে এত সমস্যা কিসের কাকামশাই?”

অলকানন্দার কথাটা আগুনে ঘি ঢালার মতন কাজ করলো। তেড়ে এলেন লক্ষীদেবী। বেঠক খানার একদম মাঝামাঝি এসে সে যেন উৎপাত শুরু করলেন। জ্ব ল ন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে অগ্নিঝড়া কণ্ঠে প্রায় চেঁচিয়ে বলল,
“এটা নিশ্চয় বে শ্যা হবে। অল্প বয়সে স্বামী মরেছে তো শরীরের জ্বালা মেটাতে হবে না, তাই এমন রূপ ধরে রাখতে চাচ্ছে। মা গী মেয়েমানুষ। তোর এত শোয়ার শখ?”

“আপনি তো রূপ ধরে রাখেননি, তবুও তো কত বিছানাতেই….”

বাকি কথা আর সম্পূর্ণ করলো না অলকানন্দা। বরং খিলখিল করে হেসেই বুঝিয়ে দিলো অসম্পূর্ণ বাক্যের বাকি অংশের গীতিকাব্য। সকলে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো অলকানন্দার দিকে। এই মেয়েটা যে এমন জবাব দিতে পারে কেউ কল্পনাতেও বোধহয় ভাবেনি। সুরবালা বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে নিজের সদ্য বিধবা পুত্রবধূর দিকে। এইতো, সেদিন যখন মেয়েটাকে ঘরে তুলে আনলো, চারপাশে তুমুল শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনির শব্দে এক বিশাল আয়োজন যেন। মেয়েটা চোখ তুলে তাকালো না অব্দি। মাথা নত করে একহাত ঘোমটা টেনে কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। শুভরাত্রির পরেরদিন মেয়েটা দিন দুনিয়া ভুলে শাশুড়ির কাছে এসে বায়না জুড়লো, তাকে যেন তার বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কারণ স্বামীর সোহাগ নামক ব্যাপারটা তার কাছে ভীষণ অদ্ভুত আর যন্ত্রণাদায়ক লেগেছে। এমন সোহাগ তার চাই না। সুরবালা লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে অবুঝ পুত্রবধূকে স্বামী সোহাগের তাৎপর্য বুঝালেন, স্বামীর মর্ম বুঝালেন। অথচ সেই অবুঝ মেয়েটা কেমন যেন বুঝদার হয়ে গেলো এক মাসে।

সুরবালার ভাবনার মাঝে খেঁকিয়ে উঠলের নন্দন মশাই। যতই হোক, তার সামনে তার বোনকে কেউ বিশ্রী ইঙ্গিত করলে সে কী আর চুপ থাকবে! লক্ষীদেবী হকচকিয়ে যান। দ্রুত প্রস্থান করেন সেখান থেকে। বৈঠক আয়োজন শেষ হয়ে যায়। বিচার কার্য সম্পন্ন হয়না। অলকানন্দার বাবা এগিয়ে এলেন। মেয়ের দিকে অগ্নি দৃষ্টি ফেলে ভয়ঙ্কর রকম ধমকে বললেন,
“শোন নন্দু, স্বামী মারা গেছে, বেধবা হইছিস, কথা হজম করতে শেখ।”

“বাবা, বিধবাই তো হয়েছি তাহলে মানুষ বে শ্যা বললে সে দায়ও কী মাথা পেতে নিবো? মুখের কালি ধুয়ে ফেলা যায়। চরিত্রে কালি লাগলে কী উপায়ে তা উঠাবো বলো?”

“তোকে কিন্তু তোর বাপের ভিটেতে ফেরত নেওয়া হবে না। ঘরে তোর আরও দুইটা বিয়ের উপযুক্ত বোন আছে, সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। একে তো বিয়ের এক মাসের মাথায় স্বামীটা গেলো তার উপর তোর এমন বেহায়াপনার কথা শুনলে তোর বোন গুলার বিয়ে দেবো কীভাবে আমি? বেধবা মেয়েছেলের জন্য আমার ঘরের দোর বন্ধ। অলক্ষী মেয়েমানুষ।”

কথা শেষ করেই ভদ্রলোক বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। অলকানন্দা বাবার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। কারো মৃত্যু কী কারো হাতে লিখা থাকে? অথচ তার স্বামীর মৃত্যুর জন্য পুরো সমাজ তাকে দায়ী করছে।

সুরবালা এগিয়ে এলেন। পুত্রবধূর পিঠে হাত রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“তোমাকে চুল কাটতে হবেনা। আমার ছেলে মারা গেছে তাই বলে তোমার শখ তো আর গলা টিপে মারতে পারিনা।”

অলকানন্দা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শাশুড়ির দিকে। বিয়ের পর শাশুড়ি তাকে দিয়ে মাছ কাটিয়েছে। অলকানন্দা মাছ কাটতে পটু ছিলো না তবুও ধমকে কাটিয়েছে মাছ। রান্না করিয়েছে। হাত পুড়ে গিয়েছে বলে দু চার কথাও শুনাতে ভুলেননি। অথচ সে মানুষ আজ হৃদয় পুড়ছে বলে মলম লেপে দিচ্ছে যেখানে নিজের বাবা অব্দি পুড়ানোর কাজ করেছে!

_

সময়টা ঠিক গভীর রাত। দূর হতে বন্যপ্রাণীর গা ছমছমে ডাক রাতের বুকে কেমন রহস্যপট সৃষ্টি করছে! অলকানন্দা ছোটো, অগোছালো কাছারি ঘরটায় মাটিতে শুয়ে আছে। খিদেয় পেট মুচড়ে আসছে। মাটি থেকে ঠান্ডা উঠছে। অলকানন্দা গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে সেই ঠান্ডা ঘরটায়। পুরোপুরি ঘুমটা যখন লেগে এলো ভীষণ বিশ্রী রকমের একটা অনুভূতি হলো শরীর জুড়ে। ঘনিষ্ঠ এক অনুভূতি। অলকানন্দার ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠলো। এমন ঘনিষ্ঠ অনুভূতি সুদর্শন বেঁচে থাকাকালীন হতো। কিন্তু মানুষটা তো আর নেই, তবে এমন ছোঁয়া কার? তৎক্ষণাৎ চোখ খুলে ফেলল সে। চোখের সামনে আবছা আলোয় ভেসে উঠলো তার খুড়তুতো দেবর মনোহরের কামুক চেহারাটা।

অলকানন্দা দ্রুতগতিতে উঠে বসে। অবাক কণ্ঠে বলে,
“ঠাকুরপো, তুমি আমাকে এভাবে ছুঁয়েছো!”

মনোহর ক্ষুধার্থ বাঘের ন্যায় জাপটে ধরলো অলকানন্দাকে। যেন বহুদিন পর মনমতো শিকার করতে পারবে। অলকানন্দা তাজ্জব, ভীত। ঠিক এই সময়ে কেমন প্রতিক্রিয়া করা উচিৎ তা ভুলে গেছে অলকানন্দা। মনোহর ততক্ষণে হাত রেখেছে মেয়েটার আঁচলে। অলকানন্দার সম্বিত ফিরে এলো। তৎক্ষণাৎ সে চিৎকার দিয়ে উঠলো। মনোহর ভাবতেই পারেনি অলকানন্দা এত জোরে চিৎকার দিবে। ভেবেছিলো বিধবা হওয়ার সাথে সাথে হয়তো কণ্ঠ উঁচু করার ক্ষমতাও হারিয়েছে। অথচ মনোহরের ভাবনাটাকে মেয়েটা মুহূর্তেই মিছে করে দিয়েছে।

ঘুমিয়ে থাকা বাড়িটা মুহূর্তেই সজাগ হয়ে উঠলো। চারপাশে জ্বলে উঠলো কৃত্রিম আলোর রশ্মি। সকলে ছুটে এলো চিৎকারের আত্মকাহিনী জানতে। মনোহরের হাতে অলকানন্দার সাদা ধবধবে শাড়ির আঁচলটা। সকলের চক্ষু ছানাবড়া। রাত-বিরেতে এমন দৃশ্য দেখতে হবে কল্পনাও করেনি কেউ।

সুরবালা ছুটে এলো, মনোহরের হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নেয় শাড়ির আঁচল খানা। মনোহরের স্ত্রী কৃষ্ণপ্রিয়া নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে মৃ ত চোখে। পুরুষের চরিত্র নারী দেখলেই বোধহয় গলে যাওয়া!

লক্ষীদেবী যেন মোক্ষম সুযোগটা পেলো। ছিঃ ছিঃ করে একদলা থুথু নিক্ষেপ করলো মাটিতে। যেন অলকানন্দার চরিত্র এটারই যোগ্য। অলকানন্দার চোখ জুড়ে উপচে আসে অশ্রুর স্রোত। শাশুড়ির গলা জড়িয়ে নবজাতক শিশুর ন্যায় অভিযোগ করে বলে,
“ও আমার সাথে খারাপ কাজ করেছে, মা। ও বাজে ভাবে আমার গায়ে ধরেছে।”

সুরবালা নিজের সন্তানের ন্যায় দেবরের ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটার চরিত্র একদম বাপের মতন হয়েছে। বাপেরও যেমন এই বয়সে ছুঁকছুঁক স্বভাব ছেলেটারও তা-ই।

সুরবালা কিছু বলার আগে হামলে পড়ে লক্ষীদেবী। মুখ ঝামটি মেরে বলে,
“আমার ভাইপোর তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই রাত বিরাতে সধবা বউ ফেলে বেধবার কাছে আসবে। নিশ্চয় তুই ডেকেছিস, বউ। এই জন্যই তো চুল কাটতে চাসনি, রূপ ধরে রেখেছিস। পুরুষ মানুষকে সুযোগ দিয়েছিস তাই এসেছে। এখন অত ন্যাকামো করছিস কেন, বাছা?”

নারী হয়েও পিসি মা’র এহেন কথা নিত্যান্তই হাস্যকর। একজন নারী কত সহজেই আরেকজন নারীর গায়ে কালি ছেঁটা করছে! অলকানন্দা বিস্মিত ভঙ্গিতে তাকালো পিসি মা’র দিকে। অবাক কণ্ঠে বলল,
“আজ চুল কাটিনি বলে আমার সাথে ঠাকুরপো’র করা অন্যায়ের বিচার হবেনা পিসিমা?”

“না বউ, হবেনা।”

মনোহর বিজয়ী ভঙ্গিতে বাঁকা হাসলেন। যেন কোনো রাজ্য জয় করে এসেছে। কৃষ্ণপ্রিয়া স্বামীর সে হাসির দিকে তাকায় ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিয়ে। একজন মানুষকে ঠিক কতটা ঘৃণা করা উচিৎ তা জানা নেই ওর। কিন্তু ও পৃথিবী সমান ঘৃণা ঢেলে দিয়েছে স্বামীর নামে। একজন স্ত্রীই জানে তার স্বামীর চরিত্র কেমন।

সুরবালাও কিছু বলতে পারলেন না। কিছু বললে, হৈচৈ হলে ঘরের কথা বাহিরে যাবে। বদনামটা লেখা হবে বিধবা মেয়েটার নামেই। কারণ এই মাটিটা নরম। আর মানুষ নরম মাটি খামচে ধরতে পছন্দ করে।

অলকানন্দা শাশুড়ির পানে তাকায় বিচারের আশায় অথচ মানুষটা নির্জীব। অলকানন্দার ভেতর কেমন কঠোর একটা সত্তা জেগে উঠে। নরম, কোমল মেয়েটা কঠোর হয়ে উঠে নিমিষেই। কেমন শক্ত কণ্ঠে আবার জিজ্ঞেস করে,
“ঠাকুরপো’র বিচার হবেনা, তাই তো পিসিমা?”

“না।” লক্ষীদেবীর তৎক্ষণাৎ উত্তর।

লক্ষীদেবীর উত্তর দিতে দেরি, অলকানন্দা ছুটে বেড়ালো ঘর জুড়ে। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই কোথা থেকে একটা মাঝারি আকারের কেঁচি এনে কেটে ফেললো গভীর রহস্য মাখা বিরাট চুলের গোছাটা। ঘাড় অব্দি চলে এলো অসম্ভব সুন্দর সেই চুল গুলো। যেই চুলের ভাঁজে একসময় মুগ্ধ হতো কতশত পুরুষ এমনকি নারীও, সে চুল আজ ভীষণ অবহেলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটিতে। সবাই হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে।

সব গুলো চুল ঘাড় অব্দি করে শান্ত হলো মেয়েটা। দূরে ছুঁড়ে মারলো হাতের ধারালো কেঁচিটা। যা মাটিতে পড়ে বিরাট শব্দ তুললো। অলকানন্দার চোখে তখন আগুন ঝরে পড়ছে। পিসিমা’র দিকে র ক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো। কণ্ঠ প্রয়োজনের তুলনায় শীতল করে বললো,
“এবার বিচার হবে তো, পিসিমা?”

লক্ষীদেবীর গলা যেন শুকিয়ে এলো। অলকানন্দার শীতল কণ্ঠ কাঁপিয়ে দিলো তার শিকড়। ভুল করেও মুখ ফুটে সে ‘না’ শব্দটা উচ্চারণ করতে পারলো না।

#চলবে….

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৩.
প্রকৃতিতে তখন ভারী বর্ষণ। গাছ, পাতা সব ভিজে একাকার। বৃষ্টির ফোঁটা যেন নৃত্য করছে দু’হাত তুলে। ঘন ঘন বজ্রপাতও হচ্ছে। কী বিকট শব্দ! কী বিকট ঝংকার সেই বজ্রপাতে! প্রকৃতি থেকে শুরু করে মানুষসহ ভীত হচ্ছে এমন হুঙ্কারে। মধ্য রাত্তিরে বিহারিণী মহলের বিরাট বৈঠকখানা জুড়ে আবার শুরু হয়েছে বিচারকার্য। এখন আর নন্দন মশাই আরাম করে আরাম কেদারায় বসে নেই, এখন তার কপালে চিন্তাদের গাঢ় ভাঁজ। বৈঠকখানার এদিক থেকে ওদিক হাঁটছে গুরুগম্ভীর ভাবে। দু-হাত পেছনে নিয়ে। সবাই দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে। যেন এখানে নীরবতায় শ্রেয়। নন্দন মশাই বোধহয় হাঁটতে হাঁটতে কিছু ভাবলেন, অতঃপর কণ্ঠ কঠিন করে বলল,
“বউ, তোমার অভিযোগ, আমার পুত্র মনোহর তোমার শয়নকক্ষে গিয়েছিল তাই তো?”

অলকানন্দা শক্ত কণ্ঠে জবাব দিলো, “হ্যাঁ।”

“তুমি তোমার কক্ষের দোর দেওনি কার আশাতে?”

এতক্ষণ দৃষ্টি নিচের দিকে সীমাবদ্ধ থাকলেও উক্ত কথা কর্ণগোচর হতেই চোখ তুলে তাকালো অলকানন্দা। এত বাজে রকমের প্রশ্ন তার পিতৃতুল্য শ্বশুর করতে পারে সে বোধকরি কল্পনাতেও ভাবেনি।

ভাইয়ের মোক্ষম সময়ে মোক্ষম প্রশ্নে খুশি হলেন লক্ষ্মী দেবী। মাথায় ঘোমটা টানা আঁচলটা দুলাতে দুলাতে বলল,
“পুরুষের ছোঁয়া পাওয়ারও শখ আবার ছুঁতে গেলে সমস্যা! তা বউ, নন্দনের প্রশ্নের জবাবটা দে। দোরটা খুলে রেখেছিলি কার জইন্য?”

অলকানন্দা শাশুড়ির পানে তাকালো। সুরবালার দৃষ্টিও কঠিন। অলকানন্দা চোখ ঘুরিয়ে চাইলো কৃষ্ণপ্রিয়ার দিকে। স্বামীর আচরণে মেয়েটাও যে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে তা তার চোখে-মুখে স্পষ্ট। বাড়িতে রয়েছে ননদ-ননদাইরা। এমন ভরা সম্মানের বাজারে নিজের সম্মানহানিতা বড্ড গায়ে লাগলো অলকানন্দার। সে শক্ত চোখে নিজের পিসি শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“যে যেমন, অন্যকে তেমন ভাবা মনুষ্য জাতির স্বভাব পিসিমা। তবে যাই বলুন, দুধ আর ঘোল যেমন এক জিনিস না তেমন আপনার চরিত্র আর আমার চরিত্রও এক নয়।”

লক্ষ্মীদেবী হজম করতে পারলেন না এমন চিরন্তন সত্য কথাটা। তেড়ে এলেন বউয়ের দিকে। বাহু খামচে ধরে বললেন,
“স্বামীটা মারা গেছে একটা দিনও কাটেনি এখনই এত কথা এ বেধবা মেয়েমানুষের, এই মেয়ে এ বাড়ি থাকলে ঘোর অনর্থ যে ঘটবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা নন্দন। খুব শীগ্রই এ মেয়েরে ওর বাপের বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা কর।”

নন্দন মশাই বিজ্ঞ মানুষের মতন উপর-নীচ মাথা নাড়ালেন। যেন সে লক্ষ্মীদেবীর প্রস্তাবটাই এতক্ষণ ভাবছিলেন। অলকানন্দা শূন্য চোখে তাকালো পিসির দিকে। ক্ষীণ স্বরে বলল,
“এতক্ষণ তো আমার চুলের দোষ ছিলো, পিসিমা। চুল কেটেছি তবুও বিচার পাবোনা তা তো মানা যায় না।”

লক্ষ্মীদেবী ভ্রু কুঁচকালো এহেন কথায়। সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
“তাহলে তুই কি চাস বউ?”

“বিচার করুন। ঠাকুরপো ঘরে স্ত্রী রেখে কোন কারণে আমার ঘরে এসেছিল সেই কৈফিয়ত নিন। তাহলে আপনাদের সংশয় ঘুচবে।”

মনোহর এগিয়ে এলো। ব্যস্ত কণ্ঠে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য বলে উঠলো,
“আমি মোটেও আপনার ঘরে যেতে চাইনি বউরাণী। আপনিই তো আমাকে ডাকলেন। কৃষ্ণপ্রিয়াও শুনেছে সে ডাক। তাই না গিন্নী?”

শেষের প্রশ্নখানা সে নিজের স্ত্রী কৃষ্ণপ্রিয়ার দিকে তাকিয়েই করলো। মেয়েটা আকস্মিক প্রশ্নে হতবিহ্বল হলো। চারপাশ হাতড়ে খুঁজে বেড়ালো উত্তর। অথচ শূন্য হাতে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে নিয়তি। সে উত্তর না পেয়ে নিস্তব্ধ চোখে কেবল চেয়ে রইলো।

উত্তর দিলো অলকানন্দা,
“আমি তোমাকে ডাকিনি, ঠাকুরপো। কৃষ্ণপ্রিয়ার মুখই সেই উত্তর দিচ্ছে। মিছে কথা বলার কোনো প্রয়োজনই নেই।”

“ডেকে ছিলে তো দিদি, তুমি.. তুমি তো ডাকলে। ঝড় আসছে তাই ভয় করছে বলে ডাকলে। সেজন্যই তো উঠে এসেছিলেন তিনি।”

বাহিরের ভয়ঙ্কর বজ্রপাতের চেয়েও নির্মম ছিলো কৃষ্ণপ্রিয়ার মিছে এই স্বীকারোক্তি। বিস্ফোরিত নয়নে অলকানন্দা তার জা’র পানে চাইলো। এই একমাসে মেয়েটার সাথে তার দারুণ সক্ষতা গড়ে উঠেছিল। তার বয়সের চেয়ে দু বছরের ছোটো কৃষ্ণপ্রিয়া হয়ে উঠেছিল তার গল্পের ঝুলি। অথচ মেয়েটা কি-না এতটাই স্বামী ভক্ত যে আরেকটা মেয়েকে মুহূর্তেই চরিত্রহীন প্রমাণ করতে এক মুহূর্তও ভাবলো না!

লক্ষ্মীদেবীর মুখে দেখা দিলো আনন্দ উৎসব। সাথে পানকৌড়ি আর মনময়ূরীও বেজায় খুশি হলো। পানকৌড়ি তো বলেই উঠলো,
“বউরাণী! শরীরের এত খিদে, বললেই তো পারতে।”

“বললে কী তুমি তোমার স্বামীকে পাঠাতে শালিকা?”

পানকৌড়ির কথায় হাস্যরসিক ভাবে মারাত্মক উত্তরটা দিলেন মনময়ূরীর স্বামী প্রসাদ। পানকৌড়ির ঠাট্টা যেন মাঠেই মারা গেল। মনময়ূরী নিজের স্বামীকে কিছু বলতেও পারলো না। কারণ মানুষটা বড্ড গম্ভীর এবং রাগী। তার বাড়ির এমন তামাশা যে মানুষটার মোটেও পছন্দ হচ্ছেনা তা সে জানে। তাই তো স্বামীর সামনে দু’টো কটু কথা বলতে চেয়েও বলতে পারলো না।

“তুমি মিথ্যে কথা বলে স্বামীকে লুকাচ্ছো ছোটোজা? তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ কী জানে তার চরিত্রের কথা?”

অলকানন্দার প্রশ্নের উত্তর দিলো না কৃষ্ণপ্রিয়া। মাথা নত করে রাখলো কেবল। নন্দন মশাই বিজয়ী হাসি হেসে বললেন,
“তোমার চরিত্র ঠিক করো বউ। তোমার জন্য পুরুষ মানুষ খারাপ হচ্ছে। স্বামী মরেছে, এখন এক মনে ধ্যান করো স্বামীর জন্য। এসব কেচ্ছা কাহিনী করো না।”

অলকানন্দা উত্তর দিলো না সে কথার। ধীর গতিতে এক-পা দু’পা করে এগিয়ে গেলো মনোহরের কাছে। মনোহরের চোখে-মুখে তখনও দেখা মিলেনি অনুশোচনার। সে রাজার ন্যায় গোঁফ গুলো ঘুরচ্ছিল। অলকানন্দা স্থান, কাল, পাত্র বিচার না করেই তার চেয়ে বারো বছরের বড়ো পুরুষটার গালে বসিয়ে দিলো সপাটে চ ড়। একটা চ ড়েই ক্ষান্ত রইলো না সে। পর পর আরও একটা চ ড় বসিয়ে তবেই নিরব হলো।

উপস্থিত সকলে স্তব্ধ হয়ে গেলো মুহূর্তেই। তুমুল বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে চ ড়ের শব্দটা ভয়াবহ শুনালো। লক্ষ্মীদেবী যে-ই না তেড়ে আসতে নিলেন, অলকানন্দার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ালো সুরবালা। বিধবার সাদা আস্তরণে ঘেরা শক্ত খোলশের নারীটা থামিয়ে দিলো তার ননাসকে। অতঃপর তার দেবর নন্দন মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে রুক্ষ কণ্ঠে বললেন,
“ঠাকুরপো, এই বিচার কার্য এখানেই সমাপ্তি টানলে সকলের মঙ্গল হবে। আশাকরি কি বলতে চেয়েছি বুঝতে পেরেছ?”

“বউ ঠাকুরণ, আপনি আপনার চরিত্রহীনা পুত্রবধূরই পক্ষ ধরছেন!”

“আমি সত্যের পক্ষ ধরছি। আর তুমিও জানো আমার সত্যিটাই রত্ন?”

নন্দন মশাই আর কথা আগানোর সাহস পেলেন না। হাত গুটিয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরে। একে একে বিদায় নিলো সকলে। বিশাল ঘরটাতে কেবল দাঁড়িয়ে রইলো অলকানন্দা ও সুরবালা। সকলে প্রস্থান নিতেই শক্ত পাহাড়ের ন্যায় অলকানন্দা ভেঙে পড়লো। শাশুড়ির পা জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। বাঁচতে চাওয়ার তুমুল তৃষ্ণা নিয়ে বলল,
“মা, আমি কিন্তু সত্যিই ঠাকুরপোকে ডাকিনি। আমাকে বাঁচান। ওরা বাঁচতে দিবেনা আমায়।”

সুরবালা পুত্রবধূর মুখ চেপে ধরে। শক্ত কণ্ঠে বলে,
“কান্নার শব্দ যেন বাহিরে না যায়। ওদেরকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা তোমারও কান্না পায়। তাহলে কিন্তু তোমাকে ওরা আর হাসতে দিবেনা। আর আমি জানি তুমি সত্যি বলছো। মনে রেখো তুমিই সত্যি, তুমিই সুন্দর। আর সত্যির সৌন্দর্যতা তোমার ভেতর আছে যা এ বাড়ির বাকিদের ভেতর তেমন দেখা যায় না।”

_

বিহারিণী মহলটার সাথেই লাগোয়া ঘাট। রাজকীয় সেই ঘাট কারুকার্য শোভিত মনোমুগ্ধকর। সেই ঘাটের শেষ সিঁড়িটায় পা ডুবিয়ে বসে আছে অলকানন্দা। সাদা শাড়িটা কাঁধ গলিয়ে টলটলে জলে ভাসছে। মনে হচ্ছে সাদা পদ্ম! অথচ এই সাদা শাড়িরই এত শক্তি যে একটা নারীর শখের চুল অব্দি বিসর্জন দিতে হয়েছে। মনে হয় যেন জীবিত মানুষের কাফন এ শাড়ি!

অলকানন্দা চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার বৈবাহিক রঙিন জীবন। রঙিন জীবনটা নাম-ডাকেই রঙিন ছিলো, বাস্তবিক অর্থে সেখানেও ঠাঁই মিলেছিল বিষণ্ণতার। প্রথম যেদিন স্বামীর ঘরে এলো, বাবার নড়বড়ে কুঁড়েঘর রেখে যেন মনে হলো রাজপ্রাসাদে এসেছে। চারপাশে কতো আলোকসজ্জা! সেই আলো দেখেই ভেবেছিল তার জীবন বোধহয় আলোকিত হয়ে গেছে। কিন্তু তার ভাবনা বেশিক্ষণ স্থায়ীত্ব পেলো না। স্বামী তাকে কেবল ভোগ্যবস্তু ছাড়া কিছুই ভাবেনি। সারাদিন নতুন বধূর কোনো খোঁজ না নিলেও রাতে সোহাগের নামে করেছে নির্মমতা। সবটাই মুখ বুজে নিয়েছে সে। কিন্তু তবুও তো সে থাকতে চেয়েছিল সে যন্ত্রণা নিয়েই। কিন্তু ভাগ্য তার বেলাতেই নিষ্ঠুর।

অপরাহ্নের শেষ ভাগ সময়টা। আবারও আবহাওয়া জানান দিচ্ছে বৃষ্টি আসবে বোধহয়। বাড়ির অন্দরমহলে জ্বলে উঠেছে কৃত্রিম আলোর রশ্মি। অলকানন্দার দৃষ্টি স্থির জলের পানে। হঠাৎই তার পিঠে শীতল হাতের ছোঁয়া পেলো। অলকানন্দার শরীর কেঁপে উঠলো অপরিচিত ছোঁয়ায়। সে তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালো। পেছনে ফিরতেই হালাকা আলো আঁধারের রঙ মিশেলে দেখতে পেলো মনোহরের কামুক চেহারাখানা। কী বিশ্রী তার হাসি। অলকানন্দার লতার মতন অঙ্গখানা কেঁপে উঠলো সেই দৃষ্টিতে।

মনোহর অলকানন্দার ডান হাতের বাহুটা শক্ত মুঠে ধরলো। অলকানন্দার বাহু গলে পড়ে থাকা আঁচলে দৃষ্টি দিয়ে মিষ্টি কণ্ঠে বললো,
“বউ ঠাকুরণ, দাদা চলে গিয়েছে তিনদিন তো হলো, তোমার তৃষ্ণা জাগে না সোহাগ পাওয়ার?”

“ঠাকুরপো, তোমার দুঃসাহস দেখে আমি হতভম্ব। সেদিন চ ড়ের কথা ভুলে গিয়েছো?”

অলকানন্দার অগ্নি ঝড়া কথার বিনিময়ে মনোহর শীতল। অলকানন্দার ভিজে আঁচলটা তুলে নিজের নাকের সামনে ধরলো। বেশ জোরে শ্বাস নিলো, যেন আঁচল থেকে নিংড়ে নিলো সকল অমৃত। অলকানন্দা প্রতিবাদ করলো না। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
“আঁচলে কিসের ঘ্রাণ পাচ্ছো, ঠাকুরপো?”

মনোহর বড্ড অবাক হলো। এত নিবিড় তো অলকানন্দার আচরণ হওয়ার কথা ছিলো না! মনোহরকে চুপ থাকতে দেখে অলকানন্দা আবারও বললো,
“কিসের ঘ্রাণ পেলে ঠাকুরপো? আমার মৃত স্বামীর অস্তিত্বই এই আঁচল জুড়ে। আমার শখের মৃত্যুর শ্মশান এখানে। পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব পুড়ে যাওয়ার ঘ্রাণ?”

মনোহর তৎক্ষণাৎ ছেড়ে দিলো আঁচলটা। তন্মধ্যেই ঘাটে উপস্থিত হলো কৃষ্ণপ্রিয়া। আঁচল ছাড়ার দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়নি তার। তাই তো ভীষণ অবাক কণ্ঠে বললো,
“দিদি! তোমরা! এখানে?”

অলকানন্দার দৃষ্টি শীতল। খিলখিল করে হেসে বললো,
“তোমার স্বামী তো আমার দেহের তৃষ্ণা মেটায়। সেদিন তো তুমিই বললে ভরা সভায়, আমিই তোমার স্বামীকে ডাকি। দোষ না করে দোষের ভাগিদার হলাম তাই ভেবেছি আজ ডেকেই ফেলি। তোমার তো আর সমস্যা নেই তোমার স্বামী কোথায় গেলো না গেলো তা নিয়ে। তাই ভাবলাম আমার তৃষ্ণাও মিটিয়ে ফেলি। কী বলো?”

কথা শেষ করে মনোমুগ্ধকর ভাবে হাসলো অলকানন্দা। সে যেন কোনো গভীর রহস্য! কোমল কিন্তু ভয়ঙ্কর।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে