#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
২৬.
হেমন্তের সমীরণে পাকা ধানের সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। কৃষকদের তৃপ্তির হাসির আনন্দ যেন আকাশ জুড়ে। ঝলমলে তারাদের বসেছে মহোৎসব। কৃষদের ক্ষুধার্থ গৃহে যে লক্ষ্মী তার দু’হাত ভরে দান করেছে এবার। আর কয়েকদিন, তারপর চলবে ক্ষেত থেকে ধান উঠানোর মেলা। তা দিয়ে আবার নবান্ন উৎসব। ইংরেজদের নিল চাষ করতে গিয়ে যেখানে কৃষকদের জমি হারিয়েছে উর্বরতা সেখানে এ বছর দারুণ ফলনে কৃষক শ্রেণি আনন্দিত। বহুদিন পেট ভরে খাওয়া হয়নি। এইবার বোধহয় তৃপ্তি করে অন্তত খাওয়া যাবে।
অলকানন্দা সেই আনন্দ প্রকৃতিতে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। স্নান করে এসেছে বিধায় চুল ভিজে সেখান থেকে ভোরের শিশির বিন্দুর ন্যায় জল গড়িয়ে পড়ছে। বাড়ির ভেতরের এত উচ্চশব্দের গান বাজনাটা তার কাছে অসহ্যকর ঠেকছে। তার স্বামী সুদর্শনও এসবে আসক্ত ছিল কিন্তু সেটা হতো তাদের কাছারি ঘরে। এখানে তো নিজেদের মহলেই এসব হচ্ছে। অলকানন্দা বিরক্ত হলো। স্টিফেনের মা কী শুনেনা এসব! উনিও কী কিছু বলে না?
অলকানন্দা ভেজা মাথায় ঘোমটা টানলো, দারুণ সজ্জিত সিঁড়ি গুলো অতিক্রম করে প্রথমে কাদম্বরী দেবী- স্টিফেনের মায়ের রুমে যেতে চাইলেও কি ভেবে যেন দাঁড়িয়ে গেল। সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে না গিয়ে উপরের দিকে ওঠা শুরু করল। কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরুতেই বাড়ির ছাঁদ দৃষ্টিগোচর হলো। ভীষণ সুন্দর একটি ছাদ। সিমেন্ট এবং রঙিন পাথর দিয়ে নকশা করা ছাঁদটাকে বিশাল মাঠের মতন মনে হলো। তার এক কোণায় আরেকটি তালাবদ্ধ কক্ষও আছে, অন্ধকারে চাঁদের জোছনায় যতটুকু বুঝা গেল।
অলকানন্দার অবসাদগ্রস্ত মন এত সুন্দর জায়গাটা পেয়ে বোধহয় উৎফুল্ল হলো। সে উঠে গেল ছাঁদে। খালি পদযুগল ফেলে ছাঁদের দক্ষিণ দিকটায় গেলো। চাঁদ সেখানে হেলে পড়েছে রূপোর থালার ন্যায়। বড়ো বড়ো তালগাছ ছাপিয়ে কেমন মিঠে আকাশের দোলাচল। মুক্ত বাতাসে ভারী মনটা মুহূর্তেই শীতল হয়ে গেলো। সে চোখ বন্ধ করে এই সুন্দর প্রকৃতি অনুভব করা আরম্ভ করল। তার এই শীতলতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ছাঁদের কোল থেকে ভেসে এলো শ্রুতিমধুর কণ্ঠ। কী সুন্দর! মিহি সুরে কেউ গাইছে রবীন্দ্র সংগীত,
“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
আমি বাইব না..
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে গো,
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে।
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা, মিটিয়ে দেব গো…
মিটিয়ে দেব লেনা দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই ঘাটে,
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে
তারার পানে চেয়ে চেয়ে,
নাইবা আমায় ডাকলে……
অলকানন্দা যেন মোহগ্রস্ত হয়ে গেলো মুহূর্তেই। এত মায়া মাখা কণ্ঠ, এত লুকায়িত করুণ আকুতি নিয়ে গাইছে কে! কার কণ্ঠে বিধাতা তার সকল আশীর্বাদ ঢেলে দিয়েছে? কার হৃদয়ে বিধাতা ঢেলেছে এত বিষাদ! কার বিরহে এই নারীর কণ্ঠে এত হাহাকার? কোন হতভাগা পুরুষ এই মায়াবী নারী কণ্ঠ উপেক্ষা করে চলে যেতে পেরেছিল? অলকানন্দার চঞ্চল মস্তিষ্ক বিমুগ্ধ, চিত্ত স্থির হয়ে গেল নিমিষেই।
এই মুগ্ধ পরিবেশ কেমন বিষাদময় ঠেকল নন্দার কাছে। তারপর, থেমে গেল গানটা। থেমে গেল সকল মুগ্ধতা, সকল বিরহ। কেটে গেল ঘোর। নন্দা চারপাশে তাকাতে লাগল। বারংবার তাকাল। কই, কেউ তো নেই, তবে কে গাইলো এমন মহা গীতি! কে ছড়ালো এমন বিমোহিত সমীরণ! অলকানন্দা চারপাশে তাকাতে থাকল। যখন সে এই মেয়েলী মিঠে স্বর শোনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো, ঠিক তখনই তার চোখ গেল ছাঁদের কোণার সেই ঘরটাতে। বাহির থেকে যাকে দারুণ দেখাচ্ছে। এ ঘর থেকেই কী কেউ গাইলো? এত সুন্দর করে! এত রাতে কেই-বা এই ঘরে আসবে? কেনই বা আসবে! তাছাড়া বাহিরে তালাবদ্ধ অবস্থায় ভেতরে কেইবা থাকবে?
অলকানন্দার মনে প্রশ্নের স্তূপ অথচ সবগুলো প্রশ্নই উত্তর বিহীন ক্ষণে ক্ষণে ছটফট ছটফট করছে। অলকানন্দা এগিয়ে গেল ধীর পায়ে। তার নুপুর তখন সুর তুলেছে মিহি, আকর্ষণীয়। সে দরজার কাছটাতে গিয়ে দাঁড়াল। কোনো শব্দ নেই সেখানে। দূর হতে ভেসে আসছে খেঁকশিয়ালের হাঁক। রাত হলেই এদের ডাক বেড়ে যায়। কিছুদিন আগেও একজন মানুষকে এরা ছিঁড়ে খেয়েছে। এত ভয়ঙ্কর প্রাণী। বাড়ির পাশের বিরাট বটগাছ যেন জ্যোৎস্নার আলোয় খেলছে অশরীরী খেলা। কেমন লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায় গাছটার দিকে তাকালেই! মনেহয় কে যেন দু’হাত বাড়িয়ে আহ্বান জানাচ্ছে। অলকানন্দার শরীর শিরশির করে উঠছে। এতক্ষণ ভয় না পেলেও এখন সে ভয় পাচ্ছে। পায়ে দেখা দিয়েছে মৃদু কম্পন। বাড়ির প্রাচীর ঘিরে ভয়েরা কেমন হামাগুড়ি দিয়ে পড়ছে। অলকানন্দার শরীরে বাতাস গুলোও অসহ্যকর লাগছে। সে ভয়ার্ত চোখে আশা পাশে চোখ বুলাতেই খেয়াল করল ঘরটার ডানদিকে একটি কাঠের জানালা খোলা অবস্থায় আছে। অলকানন্দার ভীত মনে কৌতূহলের পরিমাণ বাড়ল। নিশ্চয় জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরের অবস্থান বুঝা যাবে। এক বুক আশা নিয়ে সে জানালাটার সামনে যায়। জানালা ভেদ করে ভেতরে দৃষ্টি রাখতেই দেখে ঘরের এক কোণায় প্রদীপ জ্বলছে নিভু নিভু আলোয়। কিন্তু সে আলো বড়োই দুর্বল পুরো ঘরকে আলোকিত করতে। অলকানন্দা বেশ গাঢ় দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক চাইলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“কে আছো?”
অপর পাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। বাতাসের ঝাপটায় দুর্বল প্রদীপটা ক্ষানিক কেঁপে উঠল বোধহয়। অলকানন্দা আবার ডাকল,
“কেউ আছো?”
বিপরীত দিক তবুও নীরব। অলকানন্দার হৃদপিন্ডের গতি অস্বাভাবিক। হাত-পাও কাঁপছে আগের তুলনায় বেশি। তার মনে হলো তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, এই বুঝি কেউ তাকে ধরে ফেলল। মনের এই আকুলিবিকুলি ভয়কে প্রাধান্য দিয়েই সে পিছু ঘুরল। না, তেমন কেউ তো নেই। অলকানন্দার ভ্রু কুঁচকে এলো। মনের ভ্রান্তি ভেবে যেই আবার জানালায় দৃষ্টি দিল ঠিক তখনই ভেতর থেকে একজন আচমকা নন্দার সামনে এসে খিলখিল করে হেসে উঠল। নন্দা তৎক্ষণাৎ চমকে গেল। দৃষ্টির মাঝে ঘোলা হয়ে উঠল সেই অদ্ভুত মুখশ্রী। কপালে সিঁদুরের বড়ো ফোঁটা আঁকানো, মাঝ সিঁথিতে ভরাট করে সিঁদুর লেপা, শরীরে চকচকে শাড়ি ও ঝলমলে গহনা। অলকানন্দা দু কদম ছিটকে পেছনে চলে গেলো। চিৎকার করতে গিয়েও বেশ জোর করেই নিজের হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরল। তার পা কাঁপছে। মৃদু কম্পন ধারণ করেছে ভয়াবহ রূপ। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না আর। ছাঁদের মেঝেতেই বসে পড়ল। শরীর থেকে অস্বাভাবিক ভাবে ঘাম বেয়ে পড়ছে শিরদাঁড়া দিয়ে। অপ্রত্যাশিত উত্তেজনায় তার হৃৎপিণ্ডের কম্পন যেন আকাশ ছুঁয়েছে। সে ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল। মনে হচ্ছে কেউ যেন তার শ্বাসনালী ধরে রেখেছে। শ্বাস নিতেও সে কী কষ্ট! তার এই ভীত, উন্মাদিত শরীরটা যখন ভয়ে কাহিল ঠিক তখন আবারও মেয়েলি রিনরিনে হাসি ভেসে এলো। সাথে মিষ্টি স্বরের কণ্ঠ,
“ভয় পেয়েছিস নাকি?”
অলকানন্দা চমকালো। এই মেয়েলি কণ্ঠে কিছুতো একটা আছেই, নাহয় এত শ্রুতিমধুর শোনাবে কেন? সে চোখ ঘুরিয়ে আবারও দৃষ্টি রাখল বন্ধ ঘরের মুক্ত জানালার দিকে। অপরিচিত মিষ্টি মেয়েটা হাসছে। অবশ্য পুরোপুরি অপরিচিত নয় এই মুখমন্ডল। যেদিন প্রথম সে এই বাড়িতে এলো, সেইদিনই এই নারীর সাথে তার ভয়ঙ্কর সাক্ষাৎ পর্ব সমাপ্ত হয়েছিল। এরপর আর দেখেনি তাকে। সেদিনের মুখমন্ডলে যেই হিংস্রতাটা ছিল আজ তার ছিটেফোঁটাও নেই। নন্দা এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। কিছুটা ভয়, সংকোচ নিয়েই মেয়েটার কাছে গেল। মেয়েটা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আছে। অলকানন্দা সামনে যেতেই মেয়েটা নিজের দু’হাতের আদলে অলকানন্দার মুখটা নেয়। হাসি হাসি কণ্ঠে বলে,
“তুই তো ভীষণ সুন্দর! ”
অলকানন্দা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। অস্ফুটস্বরে বলে,
“তুমিও তো ভারী মিষ্টি!”
“তাই? অনেক মিষ্টি রে আমি?”
অলকানন্দা মাথা নাড়ায়। ধীর স্বরে জবাব দেয়,
“সত্যিই অনেক মিষ্টি।”
মেয়েটা আবার হাসে। মেয়েটার বোধহয় কারণে-অকারণে হাসার অভ্যাস। হাসলে তাকে দারুণ লাগে অবশ্য। এই কথা বোধহয় এই নারী জানে, তাই মুগ্ধতা ছড়াতেই বুঝি সে এমন কিশোরীর ন্যায় হাসতে থাকে।
“তোর নাম কী রে?”
মেয়েটার প্রশ্নে নন্দা মিহি স্বরে উত্তর দেয়,
“অলকানন্দা। তুমি তো বিহারিণী?”
অলকানন্দা নাম জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটা নন্দার মুখ চেপে ধরে। হুশিয়ারি কণ্ঠে বলে,
“চুপ, চুপ। কেউ যেন না শুনতে পায়।”
নন্দা মাথা নাড়ায়। ফিসফিসিয়ে বলে,
”আচ্ছা, শুনবে না।”
“আমাকে এখান থেকে বের কর না, পুষ্প।”
মেয়েটার এমন সম্বোধনে অবাক হয় নন্দা, সেই বিস্মিত ভাব কণ্ঠেও ধরে রেখে শুধায়,
“পুষ্প কেন ডাকছো? আমার নাম তো অলকানন্দা।”
মেয়েটা বোধহয় ভারী মজা পায় নন্দার এমন বোকা প্রশ্নে। তাই তো সে হেসে হয় খু ন। হাসতে হাসতে বলে,
“তুই কী জানিস না? অলকানন্দা হলো একটি ফুলের নাম। যে ফুল সচারাচর পাওয়া যায় না। তবে নামের মতন তত সুন্দর না ফুলটা কিন্তু তুই তোর নামের মতনই সুন্দর। যেহেতু তোর নাম ফুলের নামের সাথে মিলিয়ে রাখা তাই তোকে আমি পুষ্প ডাকবো। তুই জানিস নে? পুষ্প- ফুলেরই আরেকটা মৈত্রীয় শব্দ।”
অলকানন্দার অবাকের সীমা বাড়ে। মেয়েটাকে দেখে যদিও মনে হয় মানসিক ভারসাম্যহীন কিন্তু অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এই নারী। কথাবার্তায় শিক্ষিতের ছোঁয়া। নিশ্চয় সে পড়াশোনা জানা। এমন একটা মেয়ের এ দশার কারণ কী? আর তার নামের সাথে বিহারিণী মহলেরই বা এত মিল কেন? জিজ্ঞেস করবে কী মেয়েটাকে? পরে যদি মেয়েটা আবার রেগে যায়! নন্দা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে যায়। সে বুঝতে পারছে, মেয়েটার সাথে ভাব জমালেই বোধহয় সব প্রশ্নের উত্তর পাবে। ভাবনা অনুযায়ীই সে ভাব জমানো শুরু করে। নানান রকমের কথাবার্তা বলে। কথা বলতে গিয়ে নন্দা অনুভব করে যে, মেয়েটা অনেক কিছু সম্পর্কে অবগত। এমনকি রবী ঠাকুরের এত দারুণ দারুণ গান সে জানে! বিভিন্ন উপন্যাসের নামও বলে দিচ্ছে অকপটে।
_
হেমন্তের আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে কয়েক ঝাঁক খন্ড-বিখন্ড মেঘের দল। মনে হচ্ছে সাদা তুলো। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে প্রকৃতি মুখরিত। নন্দা তৈরী হয়েছে কলেজ যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রাতে অনেক দেরি করে ঘুমানোর ফলে তার চোখ জ্বালা করছে। মাথাটাও যন্ত্রণায় ভার হয়ে আছে। তবে, এত খারাপের মাঝে একটা ভালো হয়েছে, স্টিফেন নামক লোকটা কাল ঘরে আসেনি। নন্দা বেশ স্বস্তি নিয়েই ঘুমুতে পেরেছে। লোকটার সান্নিধ্য তার পছন্দ নয়। কেমন অস্বস্তি লাগে! এতদিন একসাথে থেকেও অপরিচিত লাগে মানুষটাকে। মনেহয় তাকে নন্দার জানা হয়নি আদৌও। একটা অপরিচিত মানুষ সে। একই বাড়িতে থেকেই দু’জন দুই প্রান্তের মানুষ।
নন্দার ভাবনার মাঝে তার কক্ষে উপস্থিত হয় কাদম্বরী দেবী। মহিলার মুখে সুপরিচিত মিষ্টি হাসি। এসেই নন্দার মাথায় হাত বুলিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে শুধায়,
“ভালো আছো, মা?”
নন্দা তাকায় মহিলাটার দিকে। কালো রঙের এই নারীকে হাসলে ফর্সা রঙের মানুষের থেকেও বেশি সুন্দর দেখায়। টান টান চোখ-মুখ। তবে গায়ের রঙের জন্য তার এই অকৃত্রিম সৌন্দর্য প্রকাশ পেতে পারেনি। সমাজের প্রচলিত নিয়মই তো এটা, গায়ের রঙ দুধে-আলতা না হলে সেই মানুষটাকে কিংবা তার আর কোনো অঙ্গভঙ্গিকেই সুন্দরের আওতায় আনা যাবে না। তার সব সুন্দর কেবল কালো রঙের জন্য অসুন্দর নামক স্বীকৃতি পাবে।
নন্দাকে চুপ থাকতে দেখে কাদম্বরী দেবীই বলল,
“তোমাকে ভীষণ মনে পড়েছে, জানো?”
নন্দা ভ্রু কুঁচকায়। অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“মনে পড়েছে!”
“হ্যাঁ, কয়েকদিন যাবত তোমাদের দেখিনা, মনে পড়বে না?”
নন্দা যেন মহিলার কথার আগাগোড়া খুঁজে পায় না। চোখে-মুখে তার সেই ভাব স্পষ্ট। তা দেখে হাসেন কাদম্বরী দেবী। বলেন,
“কয়েকদিন যাবত আমি তো বাড়িতে ছিলাম না, জানো না নিশ্চয় সেটা?”
নন্দা বিস্মিত হয়। হতভম্ব কণ্ঠে বলে,
“আপনি বাড়ি ছিলেন না!”
“না। একটু তীর্থক্ষেত্র দর্শন করতে বের হয়ে ছিলাম। তুমি জানতে না?”
মহিলার প্রশ্নে নন্দা ডানে-বামে মাথা নাড়ায়, অস্ফুটস্বরে বলে,
“না।”
“জানতে হবে তো সংসারের খবর তাই না? বিয়ে তো হয়েছেই, এবার কষ্ট করে নাহয় মানিয়ে নিলে। আমার ছেলে নিশ্চয় ততটাও খারাপ না।”
মহিলার কথায় নন্দা ভেতরটা তাচ্ছিল্য করে উঠল। উনার ছেলে খারাপ না! তাই বলেই কী কাল সারারাত বাইজিদের সাথে পড়ে ছিল! কিন্তু মুখ ফুটে সে আর কথাটা বলেনা। মহিলাটি আন্তরিক, তার ছেলের জন্য এই নারীকে মোটেও শক্ত কথা বলা তার সাজে না। বেমানান লাগবে।
_
নন্দা কলেজ যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হলেও শেষ পর্যন্ত সে কলেজ গেল না। গেল নিজের আগের শ্বশুর বাড়ি- বিহারিণী মহলে। বাড়ির গেইটে পা রাখতেই তার শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। এত সাহস নিয়ে তো চলে এসেছে এখানে কিন্তু আদৌও কী উচিত কাজ হয়েছে! নিশ্চয় বাড়ির মানুষ তার সাথে বাজে ব্যবহার করবে!
নন্দা তবুও সাহস করে পা বাড়ায়। অন্দরমহলে ঢুকতেই বাড়ির কর্মচারীদের চোখে পড়ে সে। তারপর কর্মচারীরাই খবর পাঠায় সবাইকে। মিনিট কয়েক পেরুতেই বাড়ির সকলে এসেই উপস্থিত হয়ে গেলো। সবার চোখে মুখেই অবাক ভাব। বিস্মিত নয়ন যুগল। নন্দা এগিয়ে যায় সুরবালার দিকে। মানুষটার মুখশ্রী শুকিয়ে গিয়েছে। অলকানন্দা মাথা নত করে প্রণাম করে। সুরবালা দেবীর মুখশ্রী আগের মতনই কঠোর। নন্দা তা দেখে শুধায়,
“আশীর্বাদও করবেন না, মা?”
সুরবালা দেবী মুখ ঘুরায়, শক্ত কণ্ঠে বলে,
“বেঁচে থাকো, আশীর্বাদ করি, স্বামী সোহাগি হও।”
“বেঁচে থাকবো! যেখানে মৃত্যুর পথে আমাকে একা ফেলে চলে এসেছিলেন, সেখানে বেঁচে থাকার আশীর্বাদটা হাস্যকর হলো না, মা?”
#চলবে
#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
২৭.
আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আবহাওয়া আজ ভীষণ গম্ভীর। ক্ষণে ক্ষণে আকাশ তার রাশভারি কণ্ঠে ডেকে উঠছে। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল তালগাছ গুলোও প্রকৃতির তান্ডবে আজ অশান্ত। মেঘমন্দ্র আবহাওয়ায় অলকানন্দার সুন্দর শরীরটাও আধো অন্ধকারে বেষ্টিত মনে হচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে আছে তাদের কলেজের মাঠে। শরীরে জড়ানো নীল মখমলের কাপড়। চোখ-মুখ শুকনো তার। চোখের সামনে ভেসে উঠছে কেবল বিহারিণী মহলের দৃশ্য। সব পরিচিত মানুষের শরীরে কেমন অপরিচিতের ছোঁয়া। সে অবশ্য বিহারিণী নামক মেয়েটা সম্পর্কে জানতে চাওয়ার জন্য সেখানে গিয়েছিল। অথচ সেখানে গিয়ে জেনে এলো অন্যকিছু। সূর্যাস্ত আইনে বিহারিণী মহলের জমিদারি নিলামে উঠতে চলেছে। তার উপর কোম্পানি থেকে নোটিশ এসেছে মোটা অঙ্কের কর পরিশোধ করার জন্য। সকলে তাই হিমশিম খাচ্ছে। মনময়ূরীর স্বামী প্রসাদও আজকাল এ বাড়িতে আর থাকে না। সে নিজ বাড়ি ফিরে গিয়েছে। পানকৌড়ি এবং তার স্বামী অবশ্য এখানেই আছে। তার দেবর মনোহরের চোখেমুখে অবশ্য কোনো শোক তাপের চিহ্ন পাওয়া গেল না। না আনন্দেরও রেশ ছিল। সে বরাবরের মতন ছিল নির্বাক। কোনো গালমন্দও করেনি কিংবা প্রশংসাও করেনি। চুপচাপ নিজের মতনই ছিল। মানুষ গুলোর মাঝে কেমন যেন একটা নিস্তব্ধতা ছিল যা নন্দার ভেতরে লেগেছে। সে হয়তো অনেক কথা শুনিয়ে এসেছে কিন্তু মানুষ গুলোর জন্য তার ভেতরটা কাঁদছে। তার উপর তার হাতে তরঙ্গিণী একটা ছোটো চিরকুটের মতন কিছু একটা দিয়ে ছিল লুকিয়ে। লক্ষ্মীদেবীর ঘর থেকে নাকি সে পেয়েছিল চিরকুটটা। যেখানে উল্লেখ করা আছে চিরকুটটা কেবল নন্দার জন্য। লক্ষ্মীদেবী সবাইকে ছেড়ে কেন তার জন্যই চিরকুট খানা লিখে গিয়েছিল? আর কেনই বা চিরকুট লিখে ছিলেন! সে কী তার মৃত্যু টের পেয়েছিলেন?
নন্দা চিরকুটটা আবারও পড়ল। কালো দোয়াতে ভারী ভারী অক্ষরে কিছু হেয়ালি মাখানো শব্দ লিখা,
“তোমার তরে রেখে গিয়েছি আমি, কিছু সত্যের সমাহার,
জীবনের উত্থান-পতনে যা তোমাকে দিকভ্রান্ত করবে বারংবার।
আপন মানুষের ছদ্মবেশে কে যেন ডাকে যমালয় থেকে সাজিয়ে ফন্দি ,
আমার প্রিয় কৌটায় সোনালী আস্তরণে রয়েছে কত গীতিকাব্য বন্দী।
তুমি জেনে নিও সব,
প্রিয় মানুষের মুখশের আড়ালের যত আছে মিছে কলরব।”
অলকানন্দার ভ্রু কুঁচকে আসে। কেমন ভাসা ভাসা, শক্ত শব্দগুচ্ছ। মনে হচ্ছে কত গোপনীয়তা প্রতিটি অক্ষরে। সে গোপনীয়তা ভেদ করে কেউ যেন ছুঁতে না পারে মানুষটার আড়ালের কিছু। কিন্তু সেই গোপনীয়তা কেন অপ্রিয় নন্দার তরে দান করে গেল সে! কী ভরসায়?
অলকানন্দার ভাবনার মাঝে তার পিঠে চাপড় মারলো কেউ। সে পিছু ফিরে তাকাকেই দেখল ললিতা। ঝলমলে হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নন্দা পিছু ফিরতেই সে শুধাল,
“ভালো আছো, নন্দা?”
নন্দা মাথা নাড়াল, মুচকি হেসে বলল,
“হ্যাঁ। তুমি ভালো আছো?”
“দারুণ আছি। নন্দা, একটা জায়গায় যাবে?”
অলকানন্দা ঘাড় নাড়াল, শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কোথায়?”
“আসোই না, শহরের জায়গা কী তুমি চেনো? আসো, তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাব।”
অলকানন্দা মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। ললিতা শক্ত হাতের মুঠোয় চেপে ধরল অলকানন্দার ডান হাতটা। প্রায় কিছুটা টেনেই নিয়ে গেল। তারা কলেজ থেকে বেরিয়ে ট্রামে চড়ল। নন্দা অবশ্য এর আগে কখনো ট্রামে চড়েনি। তাই আগ্রহ নিয়েই ললিতার কাছ থেকে ট্রাম সম্পর্কে জানল। কয়েকটা লোক আবার ওদের দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়েও রইল। ট্রাম নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতেই ললিতা অভিজ্ঞ পায়ে নেমে গেল। সমস্যা হলো নন্দার। ভীতু ভীতু পা যুগল ফেলতে হিমশিম খাচ্ছে। অথচ তার পেছনে বাকি যাত্রীরাও নামার জন্য উতলা। একজন তো প্রায় অসহ্য কণ্ঠে বলেই ফেলল,
“নামতে না পারলে উঠোই কেন বাপু! আজকালকার ছেলেমেয়ে গুলো না বেশি পাখনা গজিয়ে গেছে।”
নন্দা লোকটার দিকে তাকাল, কিছুটা শক্ত জবাব দেওয়ার আগেই ললিতা মুখ ঝামটি দিয়ে লোকটার উদ্দেশ্যে বলল,
“একজন মানুষের সমস্যা হতেই পারে, স্যার, আপনার এত তাড়া থাকলে উড়োজাহাজে চলাচল করতে পারেন না! তাহলেই তো আর পাখনা গজানো ছেলেমেয়ে গুলোকে দেখতে হয় না।”
লোকটা চুপ করে গেল। অলকানন্দার মুখে দেখা মিলল মুচকি হাসির রেখা। ললিতা মেয়েটাকে যেখানে সবার অপছন্দ, শিক্ষকরা প্রায় নিষিদ্ধ বস্তুর ন্যায় নিষিদ্ধ মানুষ বলে ঘোষণা করে দিয়েছে সেখানে নন্দার তাকে ভীষণ ভালো লাগে। কথায় আছে, নিষিদ্ধ সবকিছুর প্রতিই মানুষের বাড়াবাড়ি রকমের ঝোঁক থাকে। নন্দাও বোধকরি এর বহির্ভূত নয়। কিন্তু এখন দেখার পালা, বরাবরের মতন নিষিদ্ধ বস্তু সবচেয়ে বড়ো ক্ষতির কারণ হয় কিনা।
নন্দা রাস্তায় নামতেই ললিতা আবারও হাতটা জড়িয়ে ধরল। কেমন আদুরে শাসনের ভঙ্গিতে বলল,
“এই, তুই কী একটু রাগ দেখিয়ে লোকটাকে উত্তর দিতে পারলি না? এসব লোককে দু এক কথা শুনিয়ে দিতে হয়। বুঝেছিস?”
নন্দা হাসল। ললিতা মেয়েটা তাকে বেশ গুরুতর একটা আপন সম্পর্কে বাঁধছে তাকে। যেটা তার বেশ পছন্দও হয়েছে।
নন্দাকে চুপ থাকতে দেখে ললিতা আবার বলল,
“এভাবে হাসছিস কেন? শহরের মানুষদের তো চিনিস না, এরা বড়ো স্বার্থপর। মেয়ে মানুষ ট্রামে বাসে চড়লেই এরা ভাবে মেয়েদের চরিত্র খারাপ। তাই এদের সাথে কড়া আচরণ করতে হয়।”
“আচ্ছা। পরবর্তীতে খেয়াল রাখব।”
কথা শেষ করতে করতেই তারা একটি শহুরে গলিতে প্রবেশ করল। কেমন অপরিচ্ছন্ন সরু গলি! জায়গায় জায়গায় ময়লার স্তূপ, সেখানে বসে ক্ষুধার্থ কাক বিরহী সুরে গাইছে আহ্লাদী দুঃখের গান। অলকানন্দার ভীষণ ভাবতে ইচ্ছে করল- আচ্ছা, ক্ষুধার্থ কণ্ঠে কখনো বিরহ আসে?
“ক্ষুধার চেয়ে বড়ো বিরহ নেই, নন্দু। কারো পেটের ক্ষুধা, কারো বা ভালোবাসার ক্ষুধা। সবারই যে নিজস্ব একটা ব্যাক্তিগত ক্ষুধা থাকেই। শুধু পার্থক্য এখানেই, আমরা পেটের ক্ষুধাকে স্বাভাবিক ভাবি। আর ভালোবাসার ক্ষুধাকে ভাবি নেহাৎ বাড়াবাড়ি কিংবা অতিরঞ্জিত।”
ললিতার মনোমুগ্ধকর বাক্যে নন্দা বিস্মিত। মেয়েটা মন পড়ার দারুণ ক্ষমতা নিয়ে বোধহয় জন্মেছে। নাহয় নন্দার মনের খবর জানলো কীভাবে? নন্দার বিস্মিত মুখমন্ডল দেখে হাসল ললিতা। শুধাল,
“মন পড়ে ফেলায় অবাক হলে?”
নন্দা উপর-নীচ মাথা নাড়াল। অস্ফুটস্বরে বলল,
“হ্যাঁ।”
“জানো নন্দা, আমি খুব দ্রুত মানুষের অঙ্গভঙ্গি দেখে তাদের ভেতরটা পড়ে ফেলতে পারি। মানুষের চোখ-মুখ কী ইঙ্গিত করছে তা বুঝে ফেলি। যার জন্য মানুষকে খুব দ্রুত অবাক করে দিতে পারি। মানুষ আমার এই ব্যাপারটাকে দারুণ ভাবলেও আমার কাছে তা বিরক্তকর। এই যে মানুষকে বুঝে ফেলার পর মানুষের প্রতি আমার আগ্রহ হারিয়ে যায়। যার জন্য আমি খুব দ্রুতই বন্ধু হারিয়ে ফেলি।”
“আমারও তো মন পড়ে ফেলল, আগ্রহ হারিয়ে ফেলছ?”
নন্দার প্রশ্নে বেশ উচ্চস্বরেই হাসল মেয়েটা। অতঃপর নন্দার গাল টেনে বলল,
“উহু, বরং আগ্রহ জমেছে তোমাকে জানার।”
ললিতার কথার বিপরীতে হাসল নন্দা। ততক্ষণে তারা প্রায় গলিটার শেষ মাথায় চলে এসেছে। একটি সাদা পর্দা দেওয়া, রঙ খসে যাওয়া পুরোনো দালানে প্রবেশ করল তারা। কেমন অদ্ভুতুরে এবং কৌতুহল জাগানো জায়গাটা। অলকানন্দা প্রশ্ন করার জন্য মুখ খুলতে প্রস্তুত হওয়ার সাথে সাথেই একটা পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আরে, ললিতা যে? আজ এত দ্রুত এসেছিস!”
একটা ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি পরিহিত, চিকন ছিমছাম দেহটা, লম্বা সরু এক ছেলেই প্রশ্নটা করল। দেখতে আহামরি সুন্দর নয়, চাপা গায়ের রঙ। মেটে রঙের পাঞ্জাবিতে তাকে আরও রঙহীন লাগছে। বয়স ললিতার চেয়ে বেশিই হবে। হয়তো চব্বিশ কিংবা পঁচিশ। ললিতা এগিয়ে গেল, হাসিমুখে বলল,
“আজও এই পাঞ্জাবিটা পড়েছিস কেন? মানা করেছিলাম না পড়তে?”
“আবেগ বুঝিস না তুই। আর আমার বাপ তোর বাপের মতন বড়োলোকও না।”
“আরে বেটা, বাপ দিয়ে কী হবে? বাঁচতে হলো বন্ধুর মতন বন্ধু হলেই যথেষ্ট।”
কথাটা শেষ করেই ললিতা তার ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে এগিয়ে দিল ছেলেটার দিকে। মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,
“তোকে কালো রঙে ভালো মানায় কিন্তু, নে ধর। কালো পাঞ্জাবি তাই।”
ছেলেটা উৎফুল্ল মনেই পাঞ্জাবিটা নিল। আনন্দ চিত্তে বলল,
“আর তোকে ভালো মানায় উপহার হাতে। মাঝে মাঝে কাজটা করবি, বুঝলি?”
নন্দা তাদের এহেন বাচ্চামো দেখে হাসল। আর এতক্ষণে ছেলেটার দৃষ্টি তার দিকে পড়ল। নন্দাকে দেখেই সে কপাল কুঁচকালো। কৌতুহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“ললিতা, ও কে?”
ললিতা নন্দার দিকে তাকাল, নন্দার হাত ধরে কাছে টেনে পরিচয় করারোর ভঙ্গিতে বলল,
“ও অলকানন্দা। কলেজে এবার ফাস্ট ইয়ার। দারুণ মেয়ে।”
ছেলেটা কিঞ্চিৎ হাসল, হাত বাড়িয়ে বলল,
“আমি শতাব্দ। ললিতার বন্ধু।”
নন্দাও অনভিজ্ঞ হাতটা এগিয়ে হাত মিলিয়ে ভদ্রতা পালন করল। শতাব্দ নামের ছেলেটা ললিতার দিকে তাকিয়ে কিছুটা চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
“তুই যে ওকে এখানে আনলি, দীপকদা যদি কিছু বলেন?”
“কী বলবে! সামলে নিব। ও ভরসাযোগ্য।”
তন্মধ্যেই ঘরে প্রবেশ করল মধ্যবয়স্ক একজন লোক। চুলদাড়ি লম্বা লম্বা। ঢোলা ফতুয়া পড়নে। সে প্রবেশ করেই নন্দাকে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। রাশভারী কণ্ঠে বলল,
“ললিতা, কাকে নিয়ে এসেছিস এখানে?”
ললিতা চমকালো সাথে গম্ভীর কণ্ঠে চমকায় নন্দাও। শতাব্দ এগিয়ে যায়। আমতা-আমতা করে বলে,
“দীপকদা, ও ললিতার বন্ধু।”
দীপক নামের লোকটা এবার নন্দাকে পা থেকে মাথা অব্দি গম্ভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল। ললিতার উদ্দেশ্যে বলল,
“যাকে-তাকে এখানে আনবি না।”
নন্দার কথাটা বেশ খারাপ লাগল। কথার ধরণ খুব আলগোছে যে তাকে অপমান করেছে তা আর বুঝতে বাকি রইল না তার। সে শক্ত কণ্ঠে ললিতাকে বলল,
“আমি তো আসতে চাইনি ললিতা। শুধু শুধু আনলে। আমি বরং বাহিরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি, তুমি কাজ শেষ করে এসো।”
ললিতা হুড়মুড় করে এগিয়ে এলো, নন্দার এক বাহু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলল,
“দীপকদা, ও কিন্তু দারুণ মেয়ে। তুমি তো আমাকে চেনো, মানুষ চিনতে আমি মোটেও ভুল করিনা।”
দীপক নামের লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভারিক্কি কণ্ঠে বললেন,
“এসেই যেহেতু পড়েছ এবার বসো। ললিতার সাথে আমার কিছু কখা আছে। শেষ হলে একসাথে যেও।”
কথাটা বলেই লোকটা ভেতরে চলে গেলেন। ললিতাও নন্দাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ছুট লাগাল। কিন্তু নন্দার এই একাকীত্বে সঙ্গী হলো শতাব্দ। দারুণ আড্ডা দিতে পারে ছেলেটা। মুহূর্তেই মিশে যাওয়ার অসাধারণ গুনটি ছেলেটার মাঝে বিরাজমান।
_
অবশেষে গোটা একটি দিন ললিতার সাথে অতিবাহিত করে নন্দা এসে দাঁড়াল কলেজের সামনে। অবশ্য তার সাথে ললিতাও আছে। চারপাশে সূর্যের বিদায়ী সুর বাজছে। নন্দার মন আজ কিছুটা ঝরঝরে। শতাব্দ নামক ছেলেটা ভীষণ মজার। তার সাথে কথা বললে যে কেউ ফুরফুরে মেজাজে চলে যাবে।
নন্দার ভাবনার মাঝে নন্দার বাহুতে হাত রাখল ললিতা, ক্ষীণ স্বরে বলল,
“দীপকদা’কে খারাপ ভাবিস না, নন্দু। তিনি কিন্তু ভিষণ ভালো মানুষ।”
নন্দা মাথা নাড়াল। ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিল,
“খারাপ ভাববো কেন!”
“খারাপ ভাবার কারণ আছে দেখেই ভাববি। আর তোকে তো আমি বলেছিও, আমি কিন্তু মানুষের চোখ দেখে তার মনের কথা বলতে পারি। তাই কথা লুকাস না। আসলে দীপকদা সহজে মানুষকে বিশ্বাস করেন না। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। এই নশ্বর জীবনে মানুষকে বিশ্বাস করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। আর কঠিন কাজটা সাবধানেই করা উচিৎ। কিন্তু দীপকদা সত্যিই ভালো মানুষ। যখন পুরোপুরি মিশবি তখন বুঝবি।”
“আচ্ছা! তুমি আর কী কী বুঝতে পারো মানুষ দেখে?”
নন্দা প্রশ্ন করল ঠিকই কিন্তু তার উত্তর দেওয়ার আগেই কোথা থেকে যেন স্টিফেন ছুটে এলো। ঘর্মাক্ত মুখশ্রী, চিন্তায় টইটুম্বুর তার শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। তার কণ্ঠ কাঁপছে। কম্পনরত কণ্ঠেই সে শুধাল,
“কোথায় গিয়াছিলে, সানশাইন! আমি কতটা ভয় পাইয়া গিয়া ছিলাম জানো! তোমাদের কলেজ পুরোটাই আমি খুঁজিয়া আসিলাম।”
নন্দা কাঠ কাঠ কণ্ঠে জবাব দিল, “আপনি এখানে কেন?”
“তোমাকে নিতে আসিয়াছি।”
“আমি কী একা যেতে পারি না?”
“একা তো সবাই ই যাইতে পারে। কিন্তু সঙ্গী পাইলে যাইতে দোষ কোথায়? পথ আর দীর্ঘ মনে হইবে না।”
স্টিফেনের ঠোঁটে মোহনীয় হাসি। ললিতা অপলক তাকিয়ে রইলো সে হাসির পানে। আনমনে নন্দাকে প্রশ্ন করল,
“তোমার স্বামী, তাই না?”
নন্দা মাথা নাড়াল। ললিতা বাঁকা হেসে বলল,
“জিজ্ঞেস করলে না আমি আর কী জানি? আমি এটাও জানি, তোমার স্বামী বোধহয় তোমাকে চোখে হারায়। তাই না?”
নন্দা উত্তর দিল না। স্টিফেনের তাড়ায় দ্রুত গাড়িতে গিয়ে বসে। ললিতা তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। গাঢ় চোখে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করে।
_
গাড়ি চলছে নিজ গতিতে। স্টিফেন আর নন্দা বসে আছে পাশাপাশি। হুট করেই স্টিফেন নন্দার হাতটা ধরল। মিষ্টি কণ্ঠে বলল,
“তোমারে দেখিয়া যেকোনো মানুষ মিষ্টি স্বরে বলিবে, ভালোবাসি।”
অলকানন্দার চোখে তীব্র ক্রো ধ ভেসে উঠলো, সে প্রায় তাচ্ছিল্য করেই স্টিফেনের উদ্দেশ্যে বলল,
“আপনার ভালোবাসা আমার কাছে গলার কাঁটার মতন। না পারছি গিলতে আর না পারছি ফেলে দিতে। কেবল অসহ্যকর একটা অস্বস্তি নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে।”
স্টিফেন তাচ্ছিল্যের বিপরীতে হাসল, প্রায় ফিসফিস করে বলল,
“একদিন ভালোবাসিতে বাসিতে দেখিবে, ভালোবাসার দাবী ছাড়িয়া দিবো, সানশাইন। সেদিন তোমার পৃথিবীতে সব থাকিলেও, অস্বস্তির জন্য তুমি হাহাকার করিবে।”
#চলবে
#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
২৮.
খুব সংকুচিত মন নিয়ে বিদেশি বাড়িটাকে আপন করবে না, করবে না করেও কোন সেই মহা গোপনীয়তায় অলকানন্দা এই বিদেশি বাড়িটাকে বড়ো আপন করে নিলো। হয়ে উঠলো বাড়িটার কর্তী। অবশ্য তার পেছনে একটি খুব ক্ষুদ্র কারণ আছে। স্টিফেনের মা কাদম্বরী দেবী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার অনুপস্থিতিতে প্রথা অনুসারে বাড়ির বউয়েরই তো হাল ধরার কথা। সেই ভাবনা মাথায় রেখেই নন্দা শক্ত হাতে হাল ধরল বাড়িটার। আর তার ঘরকন্না শুরু হতেই সকল অনিয়ম মুখ লুকিয়ে পালাল। রান্নাঘরে আর কোনো ভুল হচ্ছিল না, মালিও নিয়মিত জল ঢেলে জাগিয়ে তুলেছিল পুষ্প সজ্জিত বাগানটা, গৃহকর্মীরাও কোনো বাহানা দিতে পারল না। কাজ গুলো কেমন নিজে নিজে একটি শৃঙ্খলায় আবদ্ধ হয়ে গেল। বাড়িটায় অধিক সাজ সজ্জা থাকার পরও যে শ্রীহীনতায় ভুগছিল তা নন্দার ছোঁয়ায় ঘুচিয়ে গেল। কাদম্বরী দেবীরও সুস্থ হওয়ার সবটুকু দায়িত্ব খুব অগোচরেই যেন অদৃষ্ট তার হাতে তুলে দিল।
নন্দা যখন পাকা হাতে সংসার চালাতে ব্যস্ত তখন বাহিরের পরিবেশ কিছুটা অস্থিতিশীল মনে হচ্ছিল। বেশ কয়েকদিন যাবতই তাদের কলেজ থেকে মিছিল বের করছে। ইংরেজদের দেশ থেকে তাড়ানোর জন্য মানুষ সচেষ্ট হয়ে মুখিয়ে আছে। কোম্পানির শাসন শোষনের বিরুদ্ধে একদল বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে খসছে ছক। নন্দাও এর বহির্ভূত নয়। ললিতাদের সাথে প্রায় শহরের বেশখানিকটা জায়গায় তার এ অব্দি যাওয়া হয়ে গেছে। দীপকদা মানুষটাও তাকে আজকাল পছন্দ করছেন। সে হয়তো প্রত্যক্ষ ভাবে দেশের এমন কল্যানে প্রবেশ করেনি কিন্তু পরোক্ষভাবে সেও যেন এই প্রতিবাদের একটি বজ্রকণ্ঠ। বজ্রকণ্ঠ হবে না-ই বা কেন? যার সংসার করছে তার বিপরীতে আন্দোলন করার কাজটা তো ভয়াবহই! অথচ খুব অগোচরে একটি নিষিদ্ধ ভালো লাগার বৃক্ষ ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে উঠছে। নন্দা বুজছে সে বৃক্ষের উৎপত্তি আর তাই সে বৃক্ষকে অপ্রকাশ্যেই বিনষ্ট করতে চাচ্ছে। কিন্তু হেমন্তের গোধূলির আলো ঘেঁষে যে প্রেম কপাটে দাঁড়িয়ে আহ্বান করছে, তাকে ফেরানোর সাধ্যি কী নন্দার মতন ভালোবাসা পিপাসু ফুলের আছে? তাই হয়তো না চাইতেও সে এই বৃক্ষকে গোপনেই বাড়তে দিচ্ছে। মানুষ বরাবরই ভালোবাসার পিপাসু। তারা কোথাও ভালোবাসা পেলে যেতে যেতেও থেকে যায়।
অলকানন্দা রান্নাঘরের তদারকি করে সবেই বিশাল বসার কক্ষটায় এসেছে। ঘামে দেহ প্রায় ভিজে শিথিল। মাথার উপর নিঃশব্দে ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখাটা। আজ তার কাজের ভার বোধহয় একটু বেশিই। তার বন্ধু শতাব্দ এবং ললিতা আজ এখানে আমন্ত্রিত। দু’জনেরই ইচ্ছে নন্দার শ্বশুর বাড়ি দেখবে তাই নন্দা নিমন্ত্রন জানিয়ে দিল। তাদের আপ্যায়নের আয়োজন করতেই নন্দার নাজেহাল অবস্থা। রান্না আর কিছুটা বাকি। নন্দা ঠিক করল সে আরেকবার স্নান করবে। কিন্তু তার আগে আরেকটা কাজ করা বাকি। সে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম টুকু মুছে ছাঁদে রওনা হলো। নিস্তব্ধ বাড়িটার চারপাশে উত্তপ্ত হেমন্তের বাতাস বয়ে যাচ্ছে। চারদিকে পাকা ধান মাঠে মাঠে হাসছে। মনে হচ্ছে সোনালী কন্যা যেন তার দু’হাত উজাড় করে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। কাল থেকে শুরু হবে ধান উঠানোর উৎসব। কৃষকদের বহু প্রতীক্ষিত দিন।
সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করা সুন্দর সিঁড়ি গুলো পায়ে মারিয়ে সে ছাঁদে উঠে গেল। প্রচন্ড গরমে ক্ষণে ক্ষণে কিছু তপ্ত বাতান সংগোপনে এসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে নন্দার ঘর্মাক্ত দেহ। নন্দা এগিয়ে গেল ছাঁদের শেষ প্রান্তের ঘরটার সামনে। জানালা দিয়ে না ডাক দিয়ে সে আজ রুমে প্রবেশ করল। ছোটোখাটো রুমটি কিছুটা এলোমেলো। নন্দা এধার-ওধার চোখ ঘুরাতেই দেখলে ঘরের পশ্চিম দিকের জানালাটার মোটা কাঠে মাথা হেলিয়ে রেখে খুব মনযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে ঘরের রমণী। তার কোনো হুঁশ নেই এখানে যে কেউ একজন এসেছে। নন্দা সেই অবাধে চিন্তা করা নারীর কাছে গিয়ে দাঁড়াল, হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে শুধাল,
“কী করছো বড়োদিদি।”
এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকা মেয়েটার ধ্যান ভাঙল। কিছুটা থতমত খেয়ে বলল,
“তুই কখন এলি, পুষ্প?”
“মাত্রই এলাম। বলো তো, কী ভাবছ?”
বিহারিণী নামের মায়াবী মেয়েটা উত্তর দিল না। অগ্রহায়নের আকাশে উড়ে যাওয়া একটি নিঃসঙ্গ শঙ্খচিলের দিকে তাকিয়ে রইলো সে নির্মিশেষ। নন্দা বুঝল, আজ বিহারিণীর কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই। মানুষটা এমনই, যখন কথা বলতে ইচ্ছে করবে তখন বলতেই থাকবে আর যখন কথা বলার ইচ্ছে থাকবে না তখন হাজারো চেষ্টা করেও তার মুখ থেকে কথা বের করা যাবে না। নন্দা তাই আর বৃথা চেষ্টা করল না। খুব নীরবে মোটা মোটা দাঁত বিশিষ্ট চিরুনিটা দিয়ে বিহারিণীর বিশাল কেশ গুচ্ছ গুছিয়ে দিল। বিহারিণীর ঘন কালো রহস্য খচিত এই কেশমালার দিকে চাইলেই অলকানন্দার মুছে যাওয়া আদি বৈধব্যের কথা মনে পড়ে যায়। কী সেই মহা যন্ত্রণার কাল সে পাড়ি জমিয়েছিল! মাঝে মাঝে সে অবাকই হয়, নিশ্চয় তার বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছা ছিল, নাহয় এত কটু কথা, এত যন্ত্রণা নিয়ে কেউ গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া থাকত না। অথচ সে এই চিন্তা তখন ভুলেও করেনি। গলায় দড়ি দেওয়ার কথা মনে পড়তেই নন্দার কৃষ্ণপ্রিয়ার কথা ভীষণ মনে পড়লো। মেয়েটা খুব বোকা ছিল। আর নিত্যান্তই তার প্রাণ নাশের কারণ তার বোকামি। অতিরিক্ত কিছুই ভালো না। হোক সেটা বোকামি, সরলতা কিংবা বিশ্বাস। আর দুর্ভাগ্যক্রমে কৃষ্ণপ্রিয়ার এই তিনটি গুণই ছিল। আর ছিল অধিক পরিমাণের ভালোবাসার ক্ষমতা। অধিক পরিমাণে ভালোবাসার ক্ষমতা ভালো কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে তা হতে পারে ক্ষতিকারক। কৃষ্ণপ্রিয়ার সাথে ক্ষেত্র বিশেষেরটা হয়েছে। মেয়েটার সব দিকেই পরম দুর্ভাগ্য বলা যায়। ভাবতে ভাবতে নন্দার ভাবনার সুতো বহুদূর প্রসারিত হয়েছে। যার ফলস্বরূপ বুক চিরে বেড়িয়ে এলে দীর্ঘশ্বাস। মানুষ কেবল একটা জিনিসই ভালো করতে পারে, তা হলো আক্ষেপ। অতীত বদলানোর ক্ষমতা মানুষের নেই তাই আক্ষেপের রথে করেই মানুষ স্বান্তনা কুড়িয়ে বাঁচতে চায়।
নন্দার ভাবনার মাঝেই নিশ্চলা বিহারিণী শূন্য কণ্ঠে শুধাল,
“বলো তো ভাই, এই পৃথিবীতে কোন প্রাণী দ্রুত সঙ্গী ভুলে বাঁচতে পারে?”
নন্দা ভ্রু কুঁচকালো। বিহারিণীর হুট করে এমন প্রশ্নের কারণ সে উদঘাটন করতে চাইলেও সবশেষে সক্ষম হলো না। কেবল ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতন অস্পষ্ট স্বরে উত্তর দিল,
“জানিনা যে!”
“মানুষ…. না, না শুধু মানুষ নয়, উত্তর হবে পুরুষ মানুষ। একমাত্র পুরুষ মানুষ সঙ্গী ভুলে বাঁচতে পারে, জানিস?”
নন্দা অবাক, বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো বিহারিণীর পানে। মেয়েটা নাকি মানসিক ভারসাম্যহীন! কই, তার কোনো চিহ্ন বর্তমানের এই নারীটার মাঝে আছে? কেউ বলবে এই মানুষটা মানসিক ভাবে অসুস্থ! একজন মানুষ যখন গোটা পৃথিবীর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এমন দার্শনিক চিন্তাভাবনা করে উত্তর দিতে পারে তার মানসিক স্বাস্থ্য আদৌও অসুস্থ হতে পারে? কখনোই না।
নন্দা ভাবুক স্বরে প্রশ্ন করল,
“কেন এমন কথা বললে?”
“সে অনেক কারণই আছে। এই যে, কিছুদিন আগেও স্বামী মারা গেলে বউকে পুড়িয়ে মারা হতো, কই তখন তো বউ মারা গেলে স্বামীর জন্য কোনো বিধান ধার্য করা ছিল না। বরং বউ মারা যাওয়ার চরম দুঃখে পুরুষ হাসতে হাসতে নতুন বধূর বাসরে চলে যায়। কেন বল তো? যেই বিছানায় একসময় তার প্রিয় নারীর সাথে সজ্জা শায়িত থাকত, সে বিছানায়ই আরেক নারীর সাথে সুখের স্বপ্ন দেখা পুরুষরা বড়ো হৃদয়হীন হয়। জানিস?”
নন্দা উত্তর খুঁজে পেল না। কোনো আদিম মহাকাল থেকে বহু হাতড়েও শব্দ বের করে আনতে পারল না। তার মনে হচ্ছে, তার সামনে একজন সুস্থ নারী বসে এমন গভীর অর্থবহ কথা বলছে। তন্মধ্যেই নিচ থেকে স্টিফেনের ডাক ভেসে আসছে। সে নন্দার উদ্দেশ্যেই ডাকছে। নন্দা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল, বিহারিণীর থেকে বিদায় নিয়ে বের হওয়ার ক্ষণেই পেছন থেকে বিহারিণীর হেয়ালি কণ্ঠের নিছক ঠাট্টা কিংবা ভৎসনা ভেসে এলো,
“পুরুষ কিন্তু নারীর মন ভোলানোর জাদু জানে। পুরুষ জানে- নারী প্রেমের বাণে দুর্বল, তাই তারা সেই বাণেই নারীকে মারিতে চায় আর বোকা নারী স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে। সাবধান পুষ্প, অতি মধুতে পিঁপড়ে বাসা বাঁধে কিন্তু। ভুলিস না মরণ বাণে।”
নন্দা হয়তো কিছু বলতো, কিন্তু তার আগে আবারও নিচ থেকে স্টিফেনের কণ্ঠস্বরে সে আর দাঁড়াতে পারল না। নিচে ছুটে গেল দ্রুত।
_
প্রকৃতিতে ভরা রোদ্দুর। সেই রোদ মাথায় নিয়ে নন্দা আত্মীয় আপ্যায়নে সচেষ্ট। কোথাও কোনো ক্রটি যেন না থাকে সে ব্যাপারে তার কড়া পর্যবেক্ষণ। ললিতা আর শতাব্দ পুরো বিদেশি বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখে সবেই বসার ঘরে উপস্থিত হয়েছে। স্টিফেন আর অ্যালেনও সেখানেই বসা।
ললিতার ঠোঁটে হাসি। বেশ ঠাট্টার সুরেই স্টিফেনকে শুধাল,
“বউকে ভীষণ ভালোবাসেন নাকি?”
নন্দা এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেলেও স্টিফেনের মুখে ছিল মধুর হাসি। সে এই হাসি মাখা মুখেই উত্তর দিল,
“সেটাই কী উচিৎ নহে?”
“অবশ্যই উচিত। তবে শুনেছিলাম বিদেশী পুরুষরা নাকি ভালোবাসতে জানে না?”
“শোনা কথা সব সত্যি হতে হবে এমনই বা কোথায় লিখিয়া রাখা?”
ললিতা হাসল। নিবিড়ে, নিভৃতে তার মনের গোপনে নীল চোখ গুলো কেমন যেন সাড়া জাগিয়ে দিল। সেই রাশভারি কণ্ঠ কোথাও একটা তোলপাড় শুরু করল। ললিতা অবশ্য তা খেয়ালই করল না। বরং বেশ মজা করেই বলল,
“তা, কতোটুকু ভালোবাসেন?”
“যতটুকু ভালোবাসিলে তার হাতে আমি আমার জীবন এমনকি মৃত্যু সমর্পণ করিতে পারিয়াছি ঠিক ততটুকু।”
“তা অবশ্য বাড়ির নেইম-প্লেট দেখেই বুঝে ছিলাম।”
নন্দা অবাক চোখে তাকাল। ললিতার কথা বোধগম্য হয়নি এমন ভাব করে বলল,
“নেইমপ্লেটে কী এমন আছে যে তুমি ভালোবাসা মাপতে পারলে?”
ললিতা উচ্চস্বরে হাসল, তার সাথে যোগ দিল শতাব্দও। ঢোলা জামা পরিহিতা ললিতার চপল, চঞ্চল গালে হাসিটা বড়ো সুন্দর ঠেকল। সে হাসতে হাসতে মশকরা করে বলল,
“জানিস না, নাকি আবার নতুন করে শুনতে চাইছিস?”
নন্দা ভ্রু কুঁচকালো, অবাক কণ্ঠে বলল,
“কী জানার কথা বলছো?”
“তোমার বাড়ির নাম “অলকানন্দার নির্বাসন”….. সে কথা কী জানো না?”
শতাব্দের কথায় বিস্মিত, হতভম্ব হলো নন্দা। সেই হতভম্ব ভাব তার কণ্ঠনালী অব্দি পৌঁছে গেল। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বলল,
“কী?”
ললিতা হেয়ালি করে বলল, “তাই তো দেখলাম আসার সময়। তুই খেয়াল করিসনি? তা জামাইবাবু, এমন একটা নামের কারণ কী?”
শেষের বাক্যটা ললিতা স্টিফেনের দিকে তাকিয়েই করল। নন্দাও উত্তরের আশায় স্টিফেনের দিকে চাইল। স্টিফেনের মুখে মিষ্টি হাসি। সে নন্দার ডান হাত আলগোছে আঁকড়ে ধরে বলল,
“আমার ভালোবাসা যাহার কাছে চক্ষের বিষ তার কাছে এই সংসার নির্বাসনই বটে। তাই না, সানশাইন?”
নন্দার হাত-পা কেঁপে উঠল। বারবার বিহারিণীর কথাটা তার কানো প্রতিধ্বনিত হতে লাগলে। পুরুষের কথার বাণে ভুলতে নেই। সে দ্রুত স্টিফেনের হাত ঝারা দিয়ে ছাড়িয়ে নিল। স্টিফেনের মুখে আগের ন্যায় হাসি। ললিতা সেই দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,
“যার চোখে এত ভালোবাসা, তার বুকে কেন এত কঠোরতা?”
শতাব্দ হয়তো ললিতার এত ক্ষীণ শব্দও শুনতে পেল। তার চোখ-মুখ মলিন হয়ে গেলো। সে ফিসফিস করে বলল,
“ললিতা, ভুলিস না আমরা কী কাজে এখানে এসেছি।”
ললিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, আফসোস মাখা কণ্ঠে বলল,
“এত ভালোবাসায় পরিপূর্ণ বুকে কীভাবে মৃত্যুর বিষ ছুঁড়ে মারবো বল তো!”
শতাব্দ ভ্রু কুঁচকালো, সাবধানী চোখে ইশারা করে বলল,
“ভুলে যাসনা, ওরা আমাদের বাঁচতে দিচ্ছে না।”
“অথচ নন্দা উনার কারণেই বেঁচে আছে।”
#চলবে
#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
স্টিফেন স্পেশাল পর্ব,
ঘোর আধাঁর মাখা প্রকৃতির এক কোণায় দাঁড়িয়ে চন্দ্র বিলাস করতে ব্যস্ত নন্দা। বিকেলেই বিদায় নিয়ে চলে গেছে শতাব্দরা। সারাদিন পর অবসর পেল সে। চাঁদের জোছনায় তার সারা অঙ্গ যেন আহ্লাদে মাখামাখি। তার ধ্যান-জ্ঞান জুড়ে একটি বেঁচে থাকতে চাওয়া জীবনের প্রতিচ্ছবি আঁকানো। মানুষ বাঁচার জন্য কত কিছুই না করে! তার জলজ্যান্ত প্রমাণ সে নিজে। আহারে জীবন! এত বেদনা, তবুও বেঁচে থাকার শখ তার কম না।
“আমি কী তোমার হাতটা একটু ধরিতে পারি, সানশাইন?”
নন্দার ধ্যান ভাঙলো, ভ্রু যুগল তার কুঁচকে এলো আপনা-আপনি। প্রায় ঠেস মেরে সে বলে উঠল,
“ব্যাপারটা ভূতের মুখে রাম নাম হয়ে গেল না?”
নন্দার তাচ্ছিল্যে হাসল স্টিফেন নিজেও। দু’কদম এগিয়ে এসে সেও হেয়ালি করে বলল,
“ব্যাপারটা কী খারাপ? ভূত যদি একটু রাম নাম গাহিতে চায় তবে মনুষ্য জাতির সমস্যা কী? ভালো তো সবাই ই হইতে চায়। সেই ভালো হওয়ার বীজটা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করিবার সাধ্যি কেবল মানুষেরই আছে। আর একমাত্র তাই ভূতেরা চাইয়াও ভালো হইতে পারে না।”
খুব নীরবে স্টিফেন যেন নন্দার গালে সপাটে চ ড় বসিয়ে দিল। নন্দারও তাচ্ছিল্য দৃষ্টি মুহূর্তে নত হয়ে এলো। সে অন্য দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল,
“কী বলতে চান, বলুন?”
“আমায় কী একটু ভালোবাসিত পারো না, সানশাইন? ধরো হঠাৎ পরিচিত হওয়া পথের পথিককে যতটুকু ভালোবাসা মানুষ দিয়া থাকে ঠিক ততটুকুই। দেওয়া যায় কি-না?”
“না।”
নন্দার কঠোর কণ্ঠ, স্টিফেন তবুও নির্লিপ্ত। বুক ভরা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে হাসতে হাসতে। নন্দার থেকে সে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েই নিজের দু’হাত পেছনে আড়াআড়ি করে রাখলেন। দৃষ্টি রাখলেন নীরব, নিশ্চল, জ্বলজ্বল করা ঐ চাঁদের দিকে। নন্দা স্টিফনকে স্থায়ী ভাবে দাঁড়াতে দেখে যেই-না চলে আসতে নিবে ঠিক তখনই মানুষটার ফ্যাকাসে স্বর পাওয়া গেল,
“আচ্ছা, ভালোবাসিতে হইবে না আমায়, ঘৃণাতেই আমি মানিয়ে নিব। তাই বলিয়া কী একটু পাশেও দাঁড়াইয়া থাকা যায় না? আমি বোধকরি অতটাও ছোঁয়াচে নই!”
নন্দা আর যেতে পারল না। চুপ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। স্টিফেন আপন মনেই কথা বলতে শুরু করল,
“জানো সানশাইন, এই যে দেশ, এই যে মাটি, তার প্রতি আমার কী ভীষণ টান! কেন বলো তো এত টান? তুমি ভাবিতেছো, হয়তো আমার জন্মটা এই জন্মভূমিতে হইয়াছে, সেইজন্য। তাই-না? কিন্তু মোটেও তা না। আমার জন্ম হইয়াছিল আমার পিতারই মাতৃভূমিতে। আর সবচেয়ে মজার বিষয় কী জানো? তুমি যাকে আমার মাতা বলিয়া জানো, তিনি কিন্তু আমার জন্মদাত্রী জননী নয়।”
নন্দা শেষ বাক্য শুনে যে আশ্চর্য রকমের বিস্মিয় হলো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সে হতভম্ব কণ্ঠে বলল,
“কী! তবে যে বিয়ের দিন বললেন আপনার মা এই দেশের?”
“আমি কিন্তু আমার জন্মদাত্রীর কথা বলিতেছি। আর জন্মদায়িনীই যে সবসময় মাতা হইতে হইবে তা কোথায় উল্লেখ আছে?”
“আমি আপনার কথা বুজছি না।”
স্টিফেন আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিবশ কণ্ঠে বলল,
“একটা গল্প শোনাই? শুনিবে?”
নন্দা হ্যাঁ অথবা না কিছুই উচ্চারণ করল না। কিন্তু তার ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা এবং নীরবতার মাঝেই স্টিফেন যেন উত্তর খুঁজে পেল। তাই সে নিজেই বলা শুরু করল,
“পৃথিবীর উন্নত একটি দেশে এক অসাধারণ নারীর সাথে সাক্ষাৎ হয় একজন আর্টিস্টের। আর্টিস্ট কী জানো? আর্টিস্ট মানে হইলো চিত্রশিল্পী। সুন্দরী নারী ছিলেন মডেল। দু’জনের পরিচয়টা হইয়া ছিল অনেকটা অসাধারণ ভাবে। চিত্রশিল্পী একটি পরিত্যাক্ত সংবাদপত্রে একজন মডেলের সাদা-কালো ছবি দেখিয়াছিল যার মুখ ছিল পোশাকের ডিজাইন অনুযায়ী আবৃত। দেখা গিয়াছিল বাদামি চুল গুচ্ছ এবং ঘোলা চক্ষু যুগল এর বেশি আর কিছুই জানতে পারেনি সে। তা দেখেই যাদুকরের ন্যায় সেই আর্টিস্ট আঁকিয়া ফেলে এক নারী অবয়ব। এবং সে জায়গায় জায়গায় ঘুরে কেবল সেই নারী মূর্তিকে খুঁজে বেড়ায়। এবং অতঃপর সে দেখা পায় সেই নারীর। তার কাঙ্খিত নারীর। এবং চিত্রশিল্পীর এই অসাধারণ আগ্রহ দেখিয়া নারীটি তাকে বিবাহ করিতে রাজি হয়। এবং অবশেষে সেই সুন্দর শহরকে সাক্ষী রাখিয়াই তাহাদের একটি সংসার হয়।”
স্টিফেন থামে। । নন্দা তখন মনোযোগী শ্রোতা। সম্পূর্ণ কথা জানার জন্য সে বিচলিত। স্টিফেনকে থামতে দেখে সে কিছুটা বিরক্ত হলো বটে। বিরক্ত কণ্ঠেই বলল,
“তারপর?”
“তারপর তাহাদের ঘর আলো করিয়া একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। সন্তানের পিতার তো আনন্দের অন্ত ছিলো না কিন্তু ভিন্নতা দেখা দেয় মডেলের ভেতর। সেই অসাধারণ নারী ভাবতে থাকে সে শিকলে বাঁধা পরে যাচ্ছে। এবং তার জন্য সে ছটফট ছটফট করছিল একটু মুক্তি পাওয়ার আশায়। আর তার মুক্তি হিসেবে তার কাছে আসে তার রঙিন দুনিয়ার এক বন্ধু ম্যাভেন অ্যানে। অ্যানে ছিল খুব চতুর লোক। তিনিও একজন পুরুষ মডেল। তাহার সৌন্দর্য যেকোনো নারীকে মুগ্ধ করিতে পারিত। এবং অবশেষে, চিত্রশিল্পীর সেই নিখাঁদ ভালোবাসাকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করিয়া সেই নারী সৌন্দর্যকে বাছিয়া নিয়া ছিল। কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে সে আনেনি। যেহেতু তার স্বামী খুব ধনী ছিলেন সেহেতু এমন একটা টাকার স্তূপকে তো কেহই অস্বীকার করিতে পারে না তাই না? কিন্তু সেই লেডি ভুলেও জানিতে পারেন নাই যে তার স্বামী সবটাই জানিত। ভালোবাসা সবচেয়ে বড়ো শিকল কি-না! সেই শিকল যে সবার ছাড়িয়া যাওয়ার সাধ্য নাই। ঠিক তখনই তার পুত্র যখন দুই বছরের শিশু, তাকে নিয়ে তার পিতা আরেকটি দেশে আসে। কেবল হাওয়া বদলের জন্য। কিন্তু বিভিন্ন কাজে যুক্ত হইতে হইতে তিনি আটকে পড়েন সেই দেশের ভেতরই। তার পুত্রও ধীরে ধীরে বড়ো হইতে লাগিলেন। তার স্ত্রী মাঝে মাঝে এ দেশে এসে ঘুরিয়া যাইতেন স্বামী সন্তানের কাছে। প্রকৃতপক্ষে তার মন তো পড়িয়া থাকিত তার প্রেমিকের কাছে। তার মাঝেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে সেই চিত্রশিল্পীর সাথে। তিনি যে দেশে ঘুরতে আসিয়া ছিলেন, সে দেশে কিছু কুসংস্কার তখন গোরা শক্ত করে দেশের মাটিতে রাজত্ব করিতে ছিল। সেই কুসংস্কারের দোহাই দিয়েই সে দেশের অনেক মেয়ে বলি হইতে লাগিল। এবং সেই দৃশ্যপটেরই একদিন মুখোমুখি হন চিত্রশিল্পীটা। তার সামনেই একটা মেয়ে দেখতে কুৎসিত বলিয়া তাকে তার বাবা-মা ত্যাগ করিয়া ছিলেন। তার দূর্দশা দেখিতে না পারিয়া আর্টিস্ট মেয়েটিকে বিবাহ করিয়া সম্মান দিতে চান। এবং তা-ই করেন। অতঃপর সেই মেয়েটির কোলে পিঠে করেই লোকটার সন্তান বড়ো হইতে লাগিল। সব ঠিকই ছিল। লোকটার প্রথম স্ত্রী আসিতেন, কয়েকদিন থাকিতেন, তার স্বামীর দ্বিতীয় বধূকে বড়ো অত্যাচার করিতেন আবার নিজের দেশে ফিরিয়া যাইতেন। চিত্রশিল্পী লোকটাও কিছু বলিতেন না। ভালোবাসিতেন কি-না সেই মহিলাকে! ভালোবাসার কাছে তো সব দোষ ক্ষমার যোগ্য। কিন্তু তাহাদের পুত্র সেসব মানিতে পারিত না। তারপর জীবনে এলো ভয়াবহ দুর্যোগ। পুত্র তার মাতার অবাধ প্রেম ও প্রেমিকের কথা একদিন জানিতে পারিল। মাতা প্রেমিকের সাথে বুদ্ধি করিল তার স্বামী ও স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীকে মারিয়া ফেলিবেন। তাহলে সকল সমস্যা সমাধান। তাদের পুত্র এটা মানিতে পারিলেন না। শোনা যায়, তাই নাকি ছাঁদ হইতে নিজের মাতাকে ধাক্কা দিয়া মারিয়া ফেলিয়া ছিল পুত্র। ভালোই করিয়াছিল। বিশ্বাসঘাতকদের কী বেঁচে থাকা উচিত? একদমই নয়। স্ত্রীর মৃত্যু মানিতে পারেননি সেই চিত্রশিল্পী, অতঃপর একদিন নিজেও আ ত্ম হ ত্যা করিলেন। ঐ যে সকলে বলেনা? ভালোবাসার কাছে এসে সকলকেই থামতে হয়। সে তো স্ত্রীকে সত্যিই ভালোবাসিয়া ছিল। তারপর পুত্রের স্থান হয় ঐ অবহেলিত কুৎসিত নারীটির কোলে এই বাংলায়।”
স্টিফেনের কথা থামে অথচ অলকানন্দা অবাক হয়ে দেখল তার শব্দ ফুরিয়েছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে কি যেন! শিরশির বাতাস তার মনে ভীতি তৈরী করেছে। সে অস্ফুটস্বরে বলল,
“সেই পুত্র কে? আর সেই মানুষ গুলোই বা কে?”
“আমার মাতা ক্যারেন বেথ ছিলেন একজন মডেল। আমার পিতা ছিলেন একজন আর্টিস্ট। আর আমার কুৎসিত মায়ের নাম কাদম্বরী।”
নন্দা দু’পা পিছিয়ে যায়। ঘামে তার শরীর ভিজে একাকার। তা দেখে স্টিফেন রহস্য করে বলল,
“বিশ্বাসঘাতকতার দন্ড বিধি কেবল মৃত্যু, তাই না।”
#চলবে