অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬৭

0
10

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৬৭

জিয়ান ফোনটা কেটেই রাগে গজগজ করতে করতে বলল, “সাহস কী করে হয় আমার রুমে প্রবেশ করার?”
“স্যার, আমার একটা দরকার ছিল।”
“দরকার মাই ফুট! গেট লস্ট। জাস্ট লিভ।”
“স্যার, আমার কথাটা শুনুন।” মেয়েটি দু’কদম সামনে এগিয়ে এল।
জিয়ান তার সামনে থাকা আয়নায় ঘুষি মেরে বলল, “এই মুহূর্তে আমার রুম থেকে বের হোন। নির্লজ্জ, বেহায়া, ডার্টি মহিলা।” অন্য হাতে গার্ডকে কল করে বলল, “আপনাদের কেন কাজে রাখা হয়েছে, ঘাস কাটতে? এত রাতে আমার রুমে আসার সাহস কী করে কেউ পায়? আগামীকাল সকালে যেন এর মুখ আর না দেখি।”
সিকিউরিটি গার্ড আসার আগে মেয়েটি জিয়ানের কাছে এগিয়ে গেল। জিয়ান নিজের সামনে থাকা ফুলদানি হাতে তুলে নিল।
মেয়েটি দু’কদম পিছিয়ে বলল, “স্যার, আপনি কাজটা ভালো করলেন না। আমি প্রমোশনের জন্য আপনার মনোরঞ্জন করতে এসেছিলাম। আমরা একই দেশের মানুষ। ছেলে হিসেবে আপনার ফিজিক্যাল নিড আছে। আজ রাতে আপনার সেই নিড আমি পূরণ করার জন্য স্বেচ্ছায় ধরা দিতে চেয়েছিলাম, আর আপনি!”
সিকিউরিটি গার্ড আসতেই জিয়ান বলল, “এই অসভ্য মহিলার চেহারা যেন আর না দেখি। পাইলট রেজা চৌধুরী এত সস্তা নয়। কেউ যেন দ্বিতীয়বার এই দুঃসাহস না করে, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।”
বেডের ওপর বসল জিয়ান। পাইলট আর কেবিন ক্রু-সহ সবার খাবার সার্ভ করে তিনজন মহিলা। তাদের মধ্যে একজন মিস রায়া। মেয়েটি এতটা নির্লজ্জ, জিয়ান সেটা কল্পনাও করেনি। লজ্জা ছাড়া মানুষ পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট। যার লজ্জা নেই, সে যা খুশি করতে পারে। দরজা বন্ধ করে বেডে বসল। মোবাইলটা হাতে নিল নয়নাকে কল করার জন্য। কিন্তু তার আগেই ওপাশ থেকে কল এল।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবকের রুমে মধ্যরাতে একটা মেয়ে কেন প্রবেশ করে? এর উত্তর অজানা নয় নয়নার। তবুও নিজের মনকে সে বোঝাচ্ছে। হয়তো কোনো প্রয়োজনে এসেছে, অথবা কোনো বিপদও হতে পারে। নয়না পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করল। এই পাঁচ মিনিট তার কাছে পাঁচ হাজার বছরের মতো মনে হয়েছে। মোবাইল হাতে নিয়ে কাঁপা-কাঁপা হাতে জিয়ানের নম্বরে ভিডিও কল করল। রিং হচ্ছে? না, যেন নয়নার হৃদয়ে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে!
জিয়ান সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা রিসিভ করে বলল, “তর সইছে না, বউ?”
নয়না হকচকিয়ে গেল। জিয়ানের পেছনের আয়নাটা ভাঙা, হাতে রক্ত লেগে আছে, তবুও মুখে হাসি! নয়না শান্ত স্বরে বলল, “কোন সুনামি ঘটিয়েছেন? আপনি নিজের রাগ সংযত করতে পারেন না কেন?”
“তুমিই বলো, আমি রুমে ঢুকে দরজা নক করতে ভুলে গেছি, ড্রেস চেঞ্জ করে শুয়েছি। এই রাতে এই মেয়ের এত বড় সাহস, না বলে আমার রুমে ঢুকে পড়ে! মেয়েমানুষ, তার গায়ে তো হাত তোলা যাবে না। তাই এই হাল।”
নয়না জিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, “ফার্স্ট এইড বক্স কোথায়? বক্সটা নিন আর এখনই হাতে ব্যান্ডেজ করুন।”
“ সেরকম জখম হয়নি, জান।”
“যা বলেছি, তাই করুন।”
জিয়ান বক্স এনে হাতে অ্যান্টিসেপটিক লাগাল। নয়না মুগ্ধ নয়নে জিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা মানুষ আর কতভাবে তাকে মুগ্ধ করবে? কঠিন মানুষের ভালোবাসা আরও কঠিন। তাদের ভালোবাসায় কোনো ‘যদি’ বা ‘কিন্তু’ থাকে না।
“এভাবে কী দেখছ, বউ? এমনিতেই মেজাজ খারাপ, তোমার সঙ্গে দেহমন তোমাকে চাচ্ছে । তার ওপর এভাবে তাকিয়ে থাকলে তো দিশেহারা হয়ে যাব।”
নয়না দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলল, “এত সুন্দর আয়নাটা ভেঙে ফেললেন, দয়ামায়া নেই?”
“দয়া, মায়া, ভালোবাসা সব আছে, কিন্তু তা শুধু তোমার জন্য, বাটার মাশরুম। এই শুনছ…”
“বলুন।”
“তোমার চোখদুটো মারাত্মক। আমাকে হত্যা করার জন্য তোমার দুটি চোখই যথেষ্ট।”
“এ আবার কেমন কথা, মিস্টার ড্রাইভার?”
“এ হত্যা সে হত্যা নয়, গো রঙ্গনা। এ হলো হৃদয় হত্যা। তোমার দৃষ্টির সীমানার বাইরে আছি, তাই দৃষ্টির প্রখরতা আমাকে হত্যা করছে। ভালোবাসি তোমাকে, প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী।”
“কবে আসবেন আপনি?”
“এই তো, খুব তাড়াতাড়ি। আমিও যে ব্যাকুল হয়ে আছি। উফ, কবে যে তোমার উষ্ণ আলিঙ্গনে হৃদয় সতেজ করব?”
নয়না মৃদু স্বরে বলল, “এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। আমিও ঘুমাই।”
“আমার রিপ্লাই কই, জান?”
“অপেক্ষা করুন, মিস্টার ড্রাইভার।”
সংযোগ বিচ্ছিন্ন হল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ভোর হতে বেশি বাকি নেই। নয়না বাইরে তাকিয়ে বলল, “আমার শহরে ভোরের আলো, তোমার শহর মধ্যরাতের নিকষকালো। এক আকাশের নিচে, তবুও হাজার মাইলের দূরত্ব।”
🌿
তুষি কয়েকবার শ্বাস নিল। চোখ বন্ধ করে বলল, “আমি যে ভুল মজার ছলে করেছি, আমি চাই না সে ভুলের মাশুল অন্য কেউ দিক।”
অন্তর বলল, “এত হেঁয়ালি না করে সোজাসাপটা বলুন।”
“জাহিন চৌধুরী নয়নাকে পছন্দ করে।”
অন্তর উত্তর দিল না। “তারপর?”
“তিন বছর আগে নয়নার সঙ্গে জাহিনের দেখা হয় শপিংমলে। হয়তো সেদিনই প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে যায়। এরপর আমি আর নয়না স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন আরেকবার দেখা হয়। নয়না যদিও খেয়াল করেনি, আমি খেয়াল করেছি। জাহিন ছেলে হিসেবে সুদর্শন। একজন সুদর্শন ছেলে আমাদের পিছু নিচ্ছে, ব্যাপারটা জোস লাগল আমার। প্রেমের প্রতি আমার ইন্টারেস্ট আগে থেকেই ছিল। নয়নার কাছে পড়াশোনা ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছুতেই ইন্টারেস্ট ছিল না।”
“জাহিন একদিন আমাদের স্কুলের দারোয়ানের কাছে অনেকগুলো চকোলেট পাঠায়—ক্যাডবেরি, কিটক্যাট। নয়নাকে দিতে বলে, কিন্তু নয়নাকে না পেয়ে দারোয়ান আমার হাতে দিয়ে যায়। সঙ্গে একটা কাগজে নম্বরও লেখা ছিল।”
“এরপর শুরু হয় ফোন আলাপ। বিভিন্ন সময়ে অনেক গিফট সে পাঠায়। আমাদের প্রেম হয় ফোনে ফোনে। আমি কিন্তু টাইমপাস করছিলাম—চকোলেট, গিফট আর এত অ্যাটেনশনের লোভে। আমার তখন প্রেমিক ছিল। এরপর এভাবে চলতে থাকে। কথা হতো মাঝেমধ্যে, খুব বেশি না হলেও নিয়মিত টুকটাক কথা হতো। একদিন আমার বয়ফ্রেন্ড বিষয়টা জেনে যায়। সমস্যা হয় আমাদের মাঝে। আমি কথা বলা বন্ধ করে দিই। কিন্তু ততদিনে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। নয়না এই বিষয়ে কিছুই জানে না। নয়না বারবার বলে, জাহিনের চাহনি ওর ভালো লাগে না। আমি বুঝি জাহিন নয়নাকে ভালোবাসে। মানুষ নিজের প্রথম প্রেম কখনো ভুলতে পারে না। জাহিনও পারছে না। জাহিনের মনে হচ্ছে নয়না জাহিনকে ঠকিয়ে জিয়ানকে বিয়ে করেছে। অথচ বিয়েটা হয়েছে কাকতালীয়ভাবে।”
অন্তরের রাগ হচ্ছে তুষির ওপর। তিন বছর আগে এই মেয়ে ছিল ক্লাস নাইনে বা এইটে। ওইটুকু বয়সে এত কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে! বিরক্ত লাগছে তুষিকে। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে। নিজের রাগ সংযত করে বলল, “কতদিন কথা হয়েছে আপনাদের?”
“প্রায় দেড় বছর।”
“কেমন টাইপ কথা হতো?”
“খুবই সাধারণ কথা। তবে ‘লাভ ইউ জান’, ‘লাভ ইউ টু জান’, ‘মিস ইউ জান’, ‘মিস ইউ টু জান’—এই কথাগুলো আমাদের মধ্যে বেশি আদান-প্রদান হতো।”
“জাহিনের কাছে যান আর এসব স্বীকার করুন। নয়তো জানি না এর পরিণাম কী হবে।”
তুষি অন্তরের হাত আঁকড়ে ধরল। কান্নারত কণ্ঠে বলল, “আমি জানি আমি ভুল করেছিলাম। বিশ্বাস করুন, ওই বয়সে ওই দামি দামি চকোলেট আর গিফটের লোভে এসব করেছি। আমি খারাপ, আমি জানি, কিন্তু এতটাও খারাপ না। প্লিজ আমাকে হেল্প করুন। আমার জন্য আমার বোনের মতো বান্ধবীর জীবনে ঝড় আসুক, আমি চাই না।”
অন্তর কঠিন মানুষ, তবুও শান্ত স্বরে বলল, “এখন অনেক দূর গড়িয়ে গেছে জল। এই ঝড় কীভাবে সামলাবো, আমার জানা নেই। তবে আমি চেষ্টা করব।”
তুষি মনে মনে ভেঙে পড়েছে। না জানি কত বড় বিপদ সে ডেকে এনেছে নয়নার জীবনে।
🌿
মেহনুর মিতা বেগমকে বলল, “আম্মি, আমি জাহিনকে বিয়ে করতে রাজি।”
“হ্যাঁ, তুই তো বলেছিস আমাকে। কিন্তু জাহিনকে তো শোনাতে পারছি না। এই ছেলেটাকে আমি বুঝতে পারি না, কখন কী যে করে!”
“তোমার ছেলেরা আমাকে এত অপছন্দ করে কেন, আম্মি? আমি কি এতটাই খারাপ?”
“এসব কী বলছিস? অপছন্দ করবে কেন? আজকালের ছেলেমেয়েরা প্রেম-ট্রেম করে নিজেই পছন্দ করে রাখে। তাই এই সমস্যা হয়। তুই চিন্তা করিস না, তোর জন্য ভালো পাত্র খুঁজব।”
মেহনুর মিতা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই, আম্মি।”
🌿
জাহিন কোট হাতে নিয়ে শার্টের হাতা গুটিয়ে টেবিলের ওপর পা তুলে বসে বলল, “মন্ত্রী সাহেব, সব হলো মানি পাওয়ার। মানি পাওয়ার না থাকলে মানুষের কোনো মূল্য নেই।”
#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে