#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৬৩
“মিস ইউ জান, মিস ইউ ভেরি ব্যাডলি।”
নয়না মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে টেক্সট দেখে মুচকি হাসছে। সকাল সকাল উঠে প্রিয় পুরুষের টেক্সট দেখে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। নয়না রিপ্লাই করল না। সে জানে জিয়ান এখন ঘুমাচ্ছে। তাই উঠে নিজের মতো ফ্রেশ হয়ে হালকা কিছু খেয়ে রুমে এল।
তুষির দেওয়া লাল পারের সাদা শাড়ি পরে রেডি হলো নয়না। সাদা হিজাব পরেছে। হাতে লাল ও সাদা রেশমি চুড়ি। চোখে হালকা কাজল দেওয়া শেষ করে লিপস্টিক হাতে নিল। লিপস্টিকের বক্সটা হাতে নিতেই নয়না থমকে গেল। এই লিপস্টিক সেটটা জিয়ান তাকে গিফট করেছিল—Forever Dior-এর লিপস্টিক সেট। এখানে বারোটা কালার অ্যাভেইলেবল। নয়না ডিপ রোজউড টোন, স্মুদ শাইন শেডটা নিল। এটার কালার নয়নার সবচেয়ে বেশি পছন্দ। হালকা করে ঠোঁটে অ্যাপ্লাই করলেই অসাধারণ একটা কালার ফুটে ওঠে। নয়না নিজের লিপস্টিক সেট থেকে দুটো লিপস্টিক তুষির জন্য নিয়ে নিল। রুম থেকে বের হওয়ার সময় থমকে দাঁড়াল। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে স্বর্ণের একটা ব্রেসলেট বের করে হাতে পরে নিল। শেষবারের মতো নিজেকে আয়নায় দেখে নিয়ে রুম থেকে বের হলো। নিজের রুম থেকে সোজা গেল মিতা বেগমের রুমে।
মিতা বেগম নয়নাকে দেখে বললেন, “মাশাআল্লাহ! মনে হচ্ছে আসমান থেকে পরী নেমে এসেছে জমিনে! কারো নজর না লাগুক।” বলেই দোয়া পড়ে নয়নার মাথায় ফুঁ দিয়ে দিলেন। “সাবধানে যাবি। ড্রাইভারের সাথে যাবি, আবার ঠিক সময় চলে আসবি।”
নয়না মৃদু স্বরে বলল, “ঠিক আছে আম্মু। আসি এখন।”
নয়না গেট দিয়ে বের হবে, ঠিক তখন কেউ ডেকে উঠল, “সুনয়না, শুনছো?”
নয়না থমকে দাঁড়াল। জিয়ান আসল কোথা থেকে! পেছনে ফিরতেই নয়নার চেহারায় রাগ ফুটে উঠল।“নিজের ভাবিকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয়, এই শিক্ষা আপনার কি জানা নেই?”
“উপস! সরি, তুমি এত কথায় কথায় রেগে যাও কেন? আমার চেয়ে বয়সে ছোট, তাই তুমি করে বলি।”
“আপনার মুখ থেকে ‘তুমি’ ডাক শুনলে আমার শরীর ঘৃণায় রি রি করে ওঠে। গা গুলিয়ে আসে।” বলেই সামনে পা বাড়াল।
জাহিন নয়নার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে বলল, “আই লাইক ইয়োর অ্যাটিটিউড।”
জাহিনের ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। জাহিন ফোন বের করে কল রিসিভ করে বলল, “অবশেষে মনে পড়ল আমাকে, মন্ত্রী মহাশয়? তা, আপনার অপরাধের লিস্ট তো বিশাল।”
ওপাশ থেকে শব্দ এল, “আমার বাগানবাড়িতে চলে আসুন, সামনাসামনি বসে কথা হবে।”
“কথার আর কী বাকি? জাহিন চৌধুরী যা বলে, সেটাই শেষ কথা। ওই কথা রাখতে পারলে তবেই দেখা পাবেন, মন্ত্রী মহাশয়।”
“আচ্ছা, আসুন, সিক্রেট গোয়েন্দা অফিসার জাহিন চৌধুরী।”
“ওকে।” জাহিন কল কেটে দিল। গান গাইতে গাইতে নিজের রুমে যাচ্ছে, “সাদা সাদা, কালা কালা, রঙ জমেছে সাদা-কালা।” সিস বাজাচ্ছে আর শাওয়ার নিচ্ছে। তার মনে আজ আনন্দ আর আনন্দ। অবশেষে একটা বিগ ডিল হতে যাচ্ছে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ব্ল্যাক জিন্স আর হোয়াইট শার্ট পরে নিল। হাতে ব্ল্যাক ওয়াচ। চুলগুলো ঠিক করে নিয়ে নিজের পছন্দের পারফিউম লাগিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।মেহনুর চুপিচুপি আড়ালে দাঁড়িয়ে জাহিনের কর্মকাণ্ডে নজর রেখেছে। মেহনুর একটা ব্ল্যাক চুরিদার পরেছে। ফর্সা শরীরে ব্ল্যাক চুরিদারে যেন মেহনুরের রূপ উপচে পড়ছে।
***
গাড়িতে উঠেই নয়না জিয়ানকে কল করল। কল করতেই সাথে সাথে রিসিভ।
জিয়ান হাই তুলতে তুলতে বলল, “এসব কী হু! বর নেই দেশে, বউ পরী সেজে কোথায় যাচ্ছে?”
“মিস্টার প্লেন ড্রাইভার, আজ তো নবীনবরণ অনুষ্ঠান। শাড়িটা তুষি আমাকে গিফট করেছে।”
জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে বলল, “বউটা দিন দিন আরো কিউট হয়ে যাচ্ছে। এমন চলতে থাকলে জব-টব ছেড়ে দেশে গিয়ে রিকশা চালাব, তবুও বউয়ের আঁচলের তলায় থাকব সারাক্ষণ।”
“এই যে, হ্যালো মিস্টার প্লেন ড্রাইভার, এত কী ভাবছেন?”
“ভাবছি, জব ছেড়ে দিয়ে রিকশা চালাব। তবুও বউ ছেড়ে দূরে থাকব না।”
“আহাগো, শখ কত নাগরের?”
“বহুত শখ, বউ।”
“তো রিকশা চালককে তো সুনয়না তালুকদার মেনে নেবে না।”
“নিষ্ঠুর রমনী, আমার কাজ দেখছে, ভালোবাসা দেখছে না।”
“এই শোনো…”
“বলো, জান।”
“এই যে তোমার-আমার ভালোবাসার মাঝে সাময়িক দূরত্ব আসে, তুমি কি জানো, এই দূরত্ব আমাদের ভালোবাসার উন্মাদনা আরো বাড়িয়ে তোলে? এই যে তিন মাস পর মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য তোমাকে কাছে পাই, প্রতিবার তোমাকে নতুন লাগে। মনে হয় দীর্ঘ অপেক্ষার পর তৃষ্ণা নিবারণ হচ্ছে।”
জিয়ান অবাক চোখে চেয়ে আছে তার বাচ্চা বউটার দিকে। কে বলবে এই মেয়ে কেবল সতেরোয় পা দিয়েছে!“ওগো, শুনছো? এভাবে তাকিয়ে থেকো না। আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি না। আমি তোমার আছি, তোমারই থাকব, প্রিয়।”
জিয়ান ফিসফিস করে বলল, “এই ঠোঁট এগিয়ে আনো তো।”
“কেন?”
“তোমার গোলাপ রাঙা ঠোঁট দুটো আমাকে বড্ড টানছে। ইচ্ছে করছে এখনই তোমার উষ্ণ ঠোঁট দুটো আমার রুক্ষ ঠোঁট দিয়ে আড়াল করে ফেলতে।”
নয়না লজ্জা পাচ্ছে, তবুও নিজেকে সংযত করে বলল, “প্রেমিক পুরুষ, তুমি প্রেম জমিয়ে রাখো। আমি তৃষ্ণার্ত হতে থাকি তোমার স্পর্শের। এরপর এসে আমার তৃষ্ণা নিবারণ করবে।”
জিয়ান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কতকাল হয়ে গেল তোমাকে জড়িয়ে ধরিনি! মনে হচ্ছে শত যুগ পার হয়ে গেছে। আমার বক্ষপিঞ্জরের আদুরে পাখিটার উষ্ণ আলিঙ্গনের অভাবে বক্ষপিঞ্জর হাহাকার করছে।”
“চোখ বন্ধ করে অনুভব করো। আমি আছি খুব কাছে। তোমার সবটা জুড়ে তোমার সাথে। আমার অনুভবে যেমন তুমি জীবন্ত, তোমার অনুভবেও আমাকে জীবন্ত করে নাও, প্রিয়।”
“মিস ইউ, জান।”
“মিস ইউ সো সো মাচ। মিস্টার ড্রাইভার, আমি চলে এসেছি কলেজে। আপনি এবার আবার ঘুমিয়ে পড়ুন। ভালোবাসি, আমার ভালোবাসার প্রথম পুরুষ।” কন্টাক্ট বিচ্ছিন্ন হলো। জিয়ানের চোখে কি আর ঘুম নামবে! বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে লাগল। এই মুহূর্তে ছুটে গিয়ে নয়নাকে জড়িয়ে ধরতে পারলে ভালো লাগত। ইশ, বউ, তুমি এত দূরে কেন!
🌿
অনিকেত কোনোমতে দরজা খুলতেই দেখল, শাড়ি পরিহিতা এক রমনীর চিন্তিত মুখশ্রী। সায়না অনিকেতকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ঠিক আছেন আপনি? কী হয়েছিল আপনার? কথা বলছেন না কেন?”
অনিকেত দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। সায়না সোফায় বসে আছে। রুম জুড়ে পিন ড্রপ নীরবতা। নীরবতা ভেঙে অনিকেত বলল, “আজ আপনার এনগেজমেন্ট ছিল, তাহলে এনগেজমেন্ট ছেড়ে চলে এসেছেন কেন?”
সায়না শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে অনিকেতের কলার ধরে বলল, “শালা ভাঙবে, তবু মচকাবে না! ভালো যখন বাসেন, স্বীকার করতে কিসের ভয়? মেয়েমানুষের ভয় থাকে, পুরুষমানুষ হয়ে ‘ভালোবাসি’ বলতে ভয়? আজ, এখনই কাজি ডেকে আমাকে বিয়ে না করলে পুরো শহর জুড়ে ছড়িয়ে দেব আপনার নামে বদনাম।”
“এই, ছাড়ুন! এসব কী হচ্ছে? ডাকিনী নাকি আপনি?”
“ন্যাকা, কী হচ্ছে বোঝে না! মোবাইল বের করে কাজি ডাকুন, নয়তো পুরো এপার্টমেন্টের মানুষ জড়ো করব এখন।”
“কাজি ডাকুন বললেই হয়ে গেল! বিয়ে কি মামার বাড়ির মোয়া?”
“মামার বাড়ির মোয়া হোক আর না হোক, আজ আমি আপনাকে ‘কবুল’ বলে তবেই ছাড়ব। ভালোয় ভালোয় কাজি ডাকুন, নয়তো আগামীকাল সকালে সংবাদপত্রের হেডলাইন হবে—‘সুন্দরী প্রেমিকার হাতে বলদ ডাক্তার খুন। ভালোবাসা অস্বীকার করার অপরাধে খুন হলেন ডাক্তার অনিকেত মাহমুদ।’”
“আপনি তো ডেঞ্জারাস!”
“আপনি ‘কবুল’ বললেই আমি হাওয়াই মিঠাই হয়ে যাব।”
অনিকেত আর কিছু বলার আগে সায়না অনিকেতের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলল, “তোমাকে আমার চাই, সারাজীবনের জন্য শুধু তোমাকেই চাই। আমি তোমার পৃথিবীতে একমাত্র ভালোবাসা হতে চাই। আমি এ জন্মে তোমার পিছু ছাড়ব না। ভালোবাসি তোমাকে।”
অনিকেত প্রথমবারের মতো সায়নার সাথে রেসপন্স করতে লাগল। দু’জনে হারিয়ে যেতে লাগল দু’জনের ঠোঁটের মাদকতায়।
🌿
মান্নাতের সাথে আজ অনেক কথা বলেছে অন্তর। অন্তর নিজের বোনের শোকে ভুলেই গিয়েছিল মান্নাতের বাবা-মায়ের কথা।
আচ্ছা, এই সবকিছুর নেপথ্যে কে রয়েছে? জাহিন মান্নাতকে সেফ করার জন্য বাইরের দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ও জানল কী করে মান্নাতের ক্ষতি হবেই? অন্তর কিছু ভাবতে পারছে না। সব গোলকধাঁধার মতো তার মাথায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। অন্তরের ফোনটা সশব্দে বেজে উঠল। রিসিভ করতেই জাহিনের কণ্ঠ কর্ণপাত হল, “কিরে, বের হবি কখন? আজ না আমাদের প্রোগ্রাম আছে কলেজে?”
অন্তর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল, “এই তো, বের হব। তুই এগো, আমি আসছি।”
#চলবে।