অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬২

0
8

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৬২
জিয়ান নয়নাকে ভিডিও কল করেছে।
নয়নার চোখে-মুখে তখন রাজ্যের টেনশন।
“কী হলো তোমার? চেহারার অবস্থা এমন করে রেখেছ কেন? তুমি কি চাও আমি জব ছেড়ে চলে আসি?”
নয়না উত্তর দিল, “উঁহু, তা কেন চাইব? তুমি তো বললে আম্মুর সাথে রান্না করতে। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
“এবার বলো, মন খারাপ কেন? এত কিউট চেহারায় আমাবস্যা মানায় না। এই চেহারা হলো বারোমাসি পূর্ণিমা। সব সময় ঝলমল করবে চাঁদের হাসি।”
নয়নার চোখের পাতা ভারি হয়ে এল। নিম্ন স্বরে বলল, “মিস ইউ। আমি তোমাকে ভীষণ মিস করছি।”
জিয়ান আদুরে স্বরে বলল, “এদিকে তাকাও জান। জান, আমি কি তোমাকে মিস করছি না?”
নয়না কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, “তুমি যখন পাশে ছিলে, পৃথিবীটা অন্যরকম ছিল। সব কিছুই তখন রঙিন লাগত। প্রতিদিন মনে হতো বসন্তের আগমন ঘটছে আমার জীবনে। প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতাম। তুমি ছাড়া সব কিছু যেন অস্পষ্ট, অস্বচ্ছ; সব যেন ফিকে মনে হচ্ছে। তোমার হাসি, তোমার স্পর্শ, তোমার নিঃশ্বাস যেন চোখ বন্ধ করলেই অনুভব করতে পারি। প্রতিটি মুহূর্তে তোমার মধ্যে হারিয়ে যেতাম, মনে হতো সময় থেমে গেছে। তুমি ছাড়া আমি যেন কিছুই নই, আমার সব কিছু তোমার সাথে চলে গেছে। নিজেকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে।”
“জান, আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছ পাখি। কী হয়েছে তোমার?”
নয়না কথার প্রত্যুত্তর না করে নিজের মতো বলতে লাগল, “তোমার হাত ধরলে মনে হতো যেন সমস্ত পৃথিবী কেবল আমাদের জন্য থেমে গেছে। এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারতাম না। তোমার চোখে আমি আমার প্রতিটি স্বপ্ন দেখতাম, আর তোমার সাথে কথা বললেই সেই স্বপ্নগুলো বাস্তবে পরিণত হতো। কেন তুমি আমাকে ছেড়ে এত দূরে? তবে যখন তুমি চলে গেলে, তখন আমার অস্তিত্ব যেন মুছে যেতে থাকে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত তোমার অভাবে ভরা। পৃথিবীটা আজ আর আমার আর তোমার নয়। আমি জানি না, প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলব। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। হয়তো আমি জানি না কীভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু তোমার প্রতি আমার অনুভূতি চাঁদ আর সূর্যের মতোই সত্য।”
জিয়ান ডাকল, “সুনয়না, শুনছ?”
নয়না জিয়ানের দিকে দৃষ্টি দিল।
কিছুক্ষণ কথা হলো চোখে চোখে।
“জান পাখি, আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমি সারাদিন রুমে ছিলে, যাও, কিচেনে গিয়ে আম্মুর সাথে কাজ করো।”
নয়না জিয়ানের দিকে তাকাল।
“লাভ ইউ জান।”
নয়না মুচকি হেসে বলল, “লাভ ইউ মিস্টার প্লেন ড্রাইভার।”
নয়না নিচে এসে কিচেনে গিয়ে দেখে, মেহনুর আর মিতা বেগম দাঁড়িয়ে আছে।
“আম্মু, আমিও রান্না করব।”
“আয়, মাংসটা ধুয়ে বসিয়ে দে। আমি ততক্ষণে কলমি শাক ভাজিটা করি।”
“আম্মি, আমিও রান্না করব,” মেহনুর বলল।
“তুই বাঙালি রান্না করতে পারবি না। তুই বরং সন্ধ্যাবেলা সবার জন্য হোয়াইট সস পাস্তা রান্না করিস। বিকেলে সবাই তোর হাতের বানানো পাস্তা খেতে খেতে আড্ডা দেব।”
মিতা বেগম মেহনুরের সাথে কথা বলার মাঝে খেয়াল করলেন, নয়না সুন্দর করে মাংসটা বসিয়ে দিয়েছে। অবাক হয়ে ভাবলেন, মেয়েটা শুধু দেখতে সুন্দর নয়, যেমন রূপবতী তেমনি গুণবতী। মিতা বেগম নয়নাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “নয়না, আজ যেহেতু তোর প্রথম রান্না, এক কাজ কর, পায়েসও রান্না করিস।”
নয়না মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক সম্মতি দিল।
🌿
সায়নাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। সায়না নিজের ফোন থেকে অনিকেতকে কল করল।
সাথে সাথে ওপাশ থেকে রিসিভ হল।
“আপনি কি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন না, ডাক্তার সাহেব?”
অনিকেত কম্পিত কণ্ঠে বলল, “কে?”
সায়না বিচলিত কণ্ঠে বলল, “কী হয়েছে আপনার? আপনি ঠিক আছেন তো?”
ওপাশ থেকে আর কোনো উত্তর এল না।
সায়না দ্রুত উঠে ড্রয়ার থেকে সাইডব্যাগ নিয়ে বসার রুমে আসতে উদ্যত হল।
সায়নার মা এসে সায়নার হাত ধরে বললেন, “রঙতামাশা পরে করবি। তোর জন্য ওনারা সেই কখন থেকে বসে আছে। ব্যাগ রাখ আর চল আমার সাথে।”
সায়না ব্যাগ রেখে বসার রুমে এল।
পাত্রপক্ষের সায়নাকে পছন্দ হল। খুশি হয়ে সায়নার হাতে দুশো টাকার এক বান্ডিল নোট ধরিয়ে দিল।
সায়না আর কালবিলম্ব না করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার ফ্রেন্ডের দাদি মারা গেছে, আমাকে এখনই যেতে হবে।” বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেল।
উপস্থিত সবাই সায়নার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল।
🌿
জিয়ানের আর ঘুম হলো না। উঠে বসল। নিজের ফোন থেকে জাহানারা বেগমকে কল করল।
ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই সালাম দিয়ে বলল, “কেমন আছেন আম্মু?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। তুমি কেমন আছ বাবা?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আম্মু, আমি বলছিলাম, আপনি যদি সুনয়নাকে কয়েকটা দিনের জন্য আপনার বাসায় এনে রাখতেন। কিছু মনে করবেন না। সুনয়নার মন খারাপ দেখলাম, তাই বলছি আর কি।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি আজ বিকেলে গিয়েই নিয়ে আসব। তুমি চিন্তা করো না বাবা।”
“আম্মু, আরেকটা কথা। আমি যে বলেছি, এটা যেন ও না জানে।”
“চিন্তা করতে হবে না বাবা, ও জানবে না। খেয়েছ তুমি?”
“জি। আচ্ছা আম্মু, ভালো থাকবেন। রাখি।”
জিয়ান কল কেটে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বেডে শুয়ে চোখ বন্ধ করে বলল, “তোমার কথাগুলো শুনে ইচ্ছে করছিল একছুটে তোমার কাছে গিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরি বুকের মাঝে। মিস ইউ আমার প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী। আমি তোমাকে অনেক বেশি মিস করছি। তোমার মন খারাপে তোমার মন ভালো করতেও পারছি না। জান, কী হলো তোমার মনের? কী করলে তোমার মনটা হেসে উঠবে? আমার মনেও মেঘ জমে তোমার মন খারাপে।”
🌿
এতিমখানায় এসে দোয়া পড়িয়ে এতিম বাচ্চাদের এক বেলা খাবার খাওয়াল জাহিন আর অন্তর। এতিমখানা থেকে বের হয়ে রমনা পার্কে এসে নিরিবিলিতে বসল দু’জনে। অন্তর চুপ করে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। এরপর বলল, “জাহিন, আমি জানি আমার বোনের হত্যাকারী কে।”
হঠাৎ কথাটা শুনে জাহিন ঘাবড়ে গেল। কপালে আঙুল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বলল, “তাই? তাহলে বল, কে সে?”
“তুই এত ঘামছিস কেন জাহিন?”
“প্রচণ্ড গরম পড়েছে আজ। এত জার্নি করলাম, তাই ঘামছি।”
“মন্ত্রীর ছেলে, তার ভাগ্নে, তার এক বন্ধু আর একজন।”
“আর একজন! কে সেই একজন?”
“জানি না। তার কাছে ঠিক ম্যারিনোর মতো বেড়াল ছিল। স্পটে যে বেড়ালটার লাশ পাওয়া গেল?”
“এভিডেন্স লাগবে। আমাদের কাছে যতটুকু আছে, তা এত জোরালো নয়।”
“আমি এভিডেন্স বের করে ফেলব। আচ্ছা, ম্যারিনোকে তোর সাথে আর দেখা যায় না কেন? আগে তো ম্যারিনোকে ছাড়া বের হতিস না।”
“ম্যারিনো অসুস্থ, তাই আর ম্যারিনোকে নিয়ে বের হই না।”
“আচ্ছা, বলতো, চারজন মানুষ ছিল, কিন্তু তিনজন মানুষ অপরাধী। বাকি একজন কী করছিল সেখানে?”
“একজনকে এনে উত্তম-মাধ্যম দিলেই জানা যাবে।”
অন্তরের হঠাৎ চোখ পড়ল একটা মেয়ে দুই-তিনটা পথশিশুকে আইসক্রিম কিনে দিচ্ছে। অন্তর বলল, “তুই বস, আমি আসছি।”
তুষির মা পিজি হাসপাতালে ভর্তি। তুষি বেরিয়েছিল মেডিসিন নিতে। হাসপাতালে মেডিসিনের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই একটু নিজেকে সতেজ করতে পার্কে ঢুকেছিল।
অন্তর তুষির হাত ধরে বলল, “আর একটু পর সূর্য ডুবে যাবে। এখানে কোনো ভদ্র মেয়ে এই সময় থাকে না।”
তুষি অবাক হয়ে বলল, “ধরুন আমি অভদ্র মেয়ে, তাতে আপনার কী?”
“নিজের ইজ্জতের ভয় নেই? নাকি রাস্তার মেয়ে?”
তুষি অন্তরের কলার চেপে বলল, “নিজের লিমিট ক্রস করবেন না। আপনার সাহস কত বড়, আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলেন? লোক জড়ো করে গণধোলাই খাওয়াতে এক সেকেন্ড সময় লাগবে না।”
ইতিমধ্যে কয়েকজন লোক জড়ো হয়ে গেছে।
তুষি কলার ছেড়ে অন্তরের হাত ধরে বলল, “আপনি একাই রাগতে পারেন? দেখলেন, আমিও নায়িকাদের মতো রাগ দেখাতে পারি।”
কয়েকজন বলল, “কী হচ্ছে এখানে?”
তুষি হেসে বলল, “কিছু না, আমার হ্যাসবেন্ডের সাথে একটু মজা করছিলাম।”
তুষি অন্তরের হাত ধরে পার্ক থেকে বের হয়ে সাথে সাথে হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “শুধুমাত্র রেজা জিজুর জন্য আপনাকে ধোলাই খাওয়ালাম না। চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখুন, আমার হাতে মেডিসিন। আমার আম্মুর এখানে হার্টের সার্জারি হয়েছে। কারো সম্পর্কে না জেনে কথা বলা কোনো ভদ্রতা নয়। ডিসগাস্টিং।”
“তুষির কোনো কথার উত্তর দিল না অন্তর। তুষি চলে যাচ্ছে, সে দাঁড়িয়ে দেখছে।
#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে