অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬১

0
10

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৬১

তুষির সাথে কলে কথা বলছিলো তখন টুং করে নোটিফিকেশন আসলো। মিস্টার প্লেন ড্রাইভার টেক্সট করেছে৷ এই লোকটা অদ্ভুত রকমের! কিজানি তার টেক্সট বা কল দেখলেই নয়নার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে অটোমেটিক। এটা কে নিশ্চয়ই ভালোবাসার জাদু বলে৷ যে জাদুর মোহে আটকে পরে নিজেকে বিলীন করা যায় আরেকজনের বক্ষে। নয়না কিছুক্ষণ চুপ রইলো৷
তুষি আবার বলল “সবই বুঝলাম কিন্তু সহ্য না হওয়ার থিওরি বুঝলাম না৷”
নয়না কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলে, ,”না বোঝার মত কি আছে তুষি! তুই বল তখন এই ছেলে কেন বললো না! ও যে জিয়ান না! জাহিন।”
“হয়ত ভাবির সাথে মজা করেছে।”
“কেমন অদ্ভুত মজা! আর জানিস উনি আমাকে ভাবি বলে না৷ আমি ওনার বড় ভাইয়ের বৌ আমাকে ভাবি ডাকে না কেন!”
“তোর বয়স কম তাই হয়তো। তুই সব কিছু নিয়ে একটু বেশি ভাবিস। এতো ওভার থিংকিং না করে রিলাক্স কর। এক সপ্তাহ পর কলেজে নবীন বরণ আমি কিন্তু লাল পাড় সাদা শাড়ি অর্ডার করেছি দুটো। আমরা দুজন সেম সেম পরবো৷ জানিস সেখানে একজন গায়ক আসবে। যদিও প্রফেশনাল গায়ক না তবুও সে নাকি খুবই ভালো গান গায় আর দেখতেও নাকি সুপার হ্যান্ডসাম।”
নয়না নিরাশ গলায় আচ্ছা বলে কল কেটে দিলো। এখন তার এসব শোনার ইচ্ছে হচ্ছে না৷ নয়না হতাশ, কি অদ্ভুত তার মনের ফিলিংস সে কাউকে বোঝাতে পারছে না! কেউ কেনো বুঝতে পারছে না জাহিনের সামনে যেতে তার কেমন যেনো লাগে। এই কেমন লাগাটা সে কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না। মেয়ে মানুষের অদ্ভুত এক শক্তি আছে, কোন পুরুষ তার দিকে তাকালে তারা চট করে বুঝে যায় সে দৃষ্টিতে কি আছে, মোহ, ভালোবাসা, নাকি কুদৃষ্টি। এই সেন্স বেশিরভাগ মেয়েদেরই প্রখর। নয়না বুঝতে পারছে না জাহিনের সাথে কিভাবে এক বাসায় দুজন থাকবে! জাহিনকে দেখলেই নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে নয়নার। মনে হয় কোন খোলসে নিজেকে আড়াল করতে পারলে তার স্বস্তি লাগতো৷ আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে চোখ বুঝে এলো নয়নার৷ ঘুম যেনো নয়নার চিরসঙ্গী। গভীর দুঃখ, টেনশন যাহোক তার চোখ থেকে ঘুম কখনো উবে যায় না। এতে সুবিধা ও আছে। ঘুম থেকে উঠলে নিজেকে অনেকটা রিলাক্স লাগে৷ এই কারণেই হয়ত গভীর কোন দুঃখ নয়নাকে তেমন ভাবে আঘাত করতে পারে না৷ তবে একজন আছে তার ঘুমের শত্রু। সেই মানুষটার সাথে তার ঘুমের তুমুল শত্রুতা। সে মানুষটা রেজা চৌধুরী। রাতে নয়নার সাথে গল্প করতে করতে খেয়াল করে নয়না ঘুমিয়ে পরেছে৷ রেজা রেগে যায় একটা মানুষ এভাবে কি করে ঘুমাতে পারে! এদিকে মাঝে মাঝে নয়না টেক্সট দেখে রিপ্লাই করবে ওইটুকু সময়ের মধ্যে ও সে ঘুমিয়ে যায়। জিয়ান টেক্সটের রিপ্লাই পাওয়ার জন্য চাতক পাখির মত অপেক্ষায় থাকে, এদিকে নয়না গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়! এই যে সে জিয়ানকে অপেক্ষায় রেখে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। ঘুমের অদ্ভুত রকমের শক্তি আছে,ঘুমালে মস্তিষ্ক সুখ, দুঃখ দুটোই মনে হয় ভুলে যায়। ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর দুঃখের ভার কমে যায়! পৃথিবীতে তারা’ই হয়তো সবচেয়ে সুখী মানুষ যারা ঘুমখোর। যাদের চোখে ঘুম সহজে আসে না, যারা দুঃখ পেলেই রাত জাগে তাদের মত দুঃখী মানুষ জগতে খুবই কম আছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের দুঃখ বাড়তে থাকে। রাতের গভীরতা আর অন্ধকারের সাথে তাদের দুঃখও প্রখর হতে থাকে। ঘুমিয়ে পরা মানুষ সে দুঃখ অনুভব করতে অক্ষম।
“নয়নার টেক্সটের রিপ্লাই না পেয়ে ঘুম নিয়ে গবেষণা করে ফেললো জিয়ান। সে জানে তার অর্ধাঙ্গিনী এখন হয়ত ঘুমাচ্ছে। ঘুমালে তাকে মায়াবী লাগে৷ তখন যেনো নয়নার মুখশ্রী জুড়ে সরলতা ছড়িয়ে থাকে!” জিয়ান তাকিয়ে আছে তার পাঠানো টেক্সটের দিকে। প্রেমে পরলে মানুষ কিছুটা কাব্যিক হয়ে উঠে। এই যে জিয়ান এতো সুন্দর টেক্সট লিখেছে….. “আমার একটা আকাশ হোক, সেই আকাশ জুড়ে তোমার ভালোবাসার চাঁদ জ্বলতে থাকুক৷
আমার একটা নদী হোক,
সে নদীতে তোমার ভালোবাসার ঢেউ হোক।
আমার একটা সন্ধ্যা হোক,সেই সন্ধ্যা জুড়ে তোমায় নিয়ে গল্প হোক৷”
নিজেই বার কয়েক নিজের লেখা টেক্সট পড়ে মুচকি হাসছে। এই মেয়েটা খুবই অদ্ভুত, পৃথিবীতে কত মেয়ের সাথে তার দেখা হয়েছে কই কাউকে তো এতো স্পেশাল মনে হয়নি?অথচ নয়না নামের হাঁটুর বয়সী মেয়েটি যেনো পৃথিবীর সব নারীর যেয়ে আলাদা। সে জেনো ভালোবাসায় মোড়ানো এক বাসন্তী ফুল৷ যার প্রতিটি পাপড়িতে নানা রঙের মুগ্ধতা জমা আছে৷ জিয়ান একটা জিনিস নোটিশ করেছে, নয়নাকে যে কেউ দেখলে বা নয়নার সাথে কয়েক মিনিট কথা বললেও তার প্রেমে পরতে বাধ্য। এমন এক মুগ্ধ রমনী তার বৌ। অথচ মেয়েটি জানেনা এমন মেয়েকে নিজের করে পাওয়া শত জনমের সাধনা থাকে পুরুষের। এমন এক নিষ্পাপ মেয়ে তাকে ভালোবাসে এই অনূভুতি যেনো জিয়ানকে পৃথিবীর সবচেয়ে লাকী পুরুষ সে এই অনুভূতি দেয়।

নয়নার ঘুম ভাঙ্গলো একটা দুঃস্বপ্ন দেখে। কেউ জিয়ানকে কেড়ে নিচ্ছে তার থেকে৷ ধড়ফড় করে উঠে বসলো নয়না৷ জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। অসময়ে ঘুমালে এই এক অসুবিধা আজেবাজে স্বপ্ন আসে! নয়না দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে জিয়ানের শেষ টেক্সট সিন করা কিন্তু রিপ্লাই করা নেই। দ্রুত রিপ্লাই করলো, “আমি তোমাকে ভিষণ ভালোবাসি৷ তোমাকে হারালে আমার জীবনের সব রঙ হারিয়ে যাবে৷ মানুষ হয়ত নিজের প্রিয় মানুষকে ছাড়া বাঁচে তবে সেই বাঁচার মধ্যে প্রাণ থাকে না।”
জিয়ান অবাক দৃষ্টিতে নয়নার টেক্সটের দিকে তাকিয়ে আছে! হঠাৎ এমন টেক্সট দেখে সে বিচলিত হলো। এতো সুন্দর রোমান্টিক টেক্সটের রিপ্লাই এতো করুণ বিরহের কেন!

🌿
অন্তর রিতুর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে বসে আছে৷ তিনজন মানুষের সিমটম পাওয়া গেছে। জাহিন তদন্ত করছে এই কেসের। জাহিনের হাতে প্রমান এলেই অপরাধীরা শাস্তি পাবে। জাহিনের প্রতি ওর অগাধ বিশ্বাস আছে। অন্তর নিজের হাতমুষ্টি বদ্ধ করে বলে,আমি বেঁচে থাকতে তোর অপরাধীরা ছাড় পাবে না বোন৷ আমি তাদের শাস্তি দেবোই।
অন্তর নিজের ফোন থেকে জাহিনকে কল করলো। জাহিন রিসিভ করে বলে, “তুই এতো টেনশন করছিস কেন? আমার উপর ভরসা নেই নাকি! তোর বোন কি আমার নিজের বোনের থেকে কম!”
“আমি জানি তুই সর্বোচ্চ চেষ্টা করবি। তোর প্রতি আমার ভরসা আছে তবুও হাহাকার করে বুকটা। আমার বোনটা এই পৃথিবীতে নেই! যার হাসিতে যার চাঞ্চল্যে মেতে থাকতো পুরো বাড়ি আর সে বেঁচে নেই। আর কখনো বলবে না ভাইয়া আমার জন্য এটা আনো ওটা না৷ হুট করে কল করে টাকা চাইবে না কোনদিন আর কোন বায়না করবে না। আমি কি করে মেনে নেবো আমার ফুলের মত বোনটা আর কোনদিন আমাকে ভাইয়া বলে ডাকবে না। আমার মনে হয় এইতো হুট করেই আমাকে ডেকে উঠবে ভাইয়া বলে, অথচ এজন্মে আমাকে কেউ আর ওমন করে ভাই ডাকবে না। আর কেউ ওরমতো আবদার করবে না। ঠুনকো কথায় নাক টেনে কাঁদবে না। আমার বোন আর কোনদিন এই পৃথিবীর সূর্য উদয় দেখবে না। রাতের তারা ভরা চাঁদেে আলো উপভোগ করবে না। এই হাতে তাকে আমি চিরনিদ্রায় শায়িত করে এসেছি। এই হাতেই মাটি চাপা দিয়ে রেখে এসেছি। আচ্ছা ওর কি ভয় হচ্ছে এখন ওতো অন্ধকারে ভয় পায় একা থাকতে পারে না।”
জাহিন শীতল কন্ঠে বলল, “একটু শান্ত হ। আল্লাহ তায়ালা রিতুকে জান্নাত বাসি করুক। এক কাজ কর কাল তুই আমি একটা এতিমখানায় দুপুরে খাবার খাওয়াবো রিতুর জন্য দোয়া পড়াবো।”
অন্তর কল কেটে দিলো। এই পৃথিবীতে বোন হারানোর বেদনা বোঝার মত কি কেউ নেই? এই যন্ত্রণার ভার তার হৃদয়ে পাহাড় চেপে আছে কি করে এই বেদনার পাহাড় সরাবে সে! এই পৃথিবীতে কি এ যন্ত্রনার নিরাময় আছে?
🌿
অনিকেত বারান্দায় বসে আছে মেঘে ঢাকা আকাশ। কোথাও একটা তারাও নেই বিস্তৃত আকাশ জুড়ে! কালো মেঘ যেনো আকাশকে গিলে নিয়েছে৷ খুব দ্রুত ধরনী কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টির পর আবার সব স্বাভাবিক হবে। আকাশে তারা জ্বলবে, চাঁদ আলো ছড়াবে। কিন্তু তার জীবনে কি আলো জ্বলে উঠবে? সে কি কখনো সায়না নামক চাঁদের নাগাল পাবে? তীব্র ভালোবাসাকে উপেক্ষা করার যন্ত্রণা মৃত্যুর মত। তারচেয়ে বড় যন্ত্রণা হচ্ছে নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো হতে দেখা। জগতে এরচেয়ে যন্ত্রনার হয়ত আর কিছু নেই। ভালোবাসা বিষয়টা মানুষকে শিশুতোষ করে দেয়, নির্বোধ করে দেয় শুধু একমাত্র একটা মানুষের কাছেই,যাকে সে ভালোবাসে। তার সাথে একটু থাকার আশায় তাকে হারানোর ভয়ে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েও পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে চায়। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো অনিকেত বাহিরে তখন ঝুম বৃষ্টি, হাত বাড়িতে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দিলো অনিকেত। বৃষ্টির ঝাপটা এসে তার চোখে মুখে পরছে৷ আড়াল করে দিচ্ছে তার অশ্রু। চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলে, “মৃত্যুর যন্ত্রণা অনুভব করিনি কভু। তবে তোমাকে হারানোর যন্ত্রণা অনুভব করছি, মনে হচ্ছে দেহ থেকে কেউ শ্বাস কেড়ে নিচ্ছে। এই দমবন্ধ কর যন্ত্রণা ব্যখ্যা করার ভাষা আমার জানা নেই প্রিয়তমা। তুমি অন্য কারো গল্পের পূর্নতা হয়ে ভালো থাকো৷ পৃথিবীর সব সুখ তোমার হোক।সব ভালোবাসা পূর্নতা পায় না। সব ভালোবাসা পূর্নতা পেলে পৃথিবীতে না পাওয়ার যন্ত্রণা যে মৃত্যুর সাক্ষাৎ করায় তা কেউ অনুভব করতে পারতো না।” অনিকেতের চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে, ঠোঁটের কোনে তবুও প্রেয়সীর সুখ প্রর্থনার হাসি!
#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে