অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৫৯

0
14

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৫৯

“জিয়ান চলে গেছে ঘন্টা খানেক হবে৷ আকাশের দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে নয়না৷ আজকাল আকাশে প্লেন দেখলেই নয়নার মন কেমন করে উঠে! মনে হয় তার আপন মানুষটা জুড়ে আছে এই দূর আকাশে উড়তে থাকা প্লেনে।আচ্ছা তোমার মনে আমার কথা কি এমন করেই জাগে? এমন করেই কি মন পোড়ে তোমার? নাকি তুমি ব্যস্তার ভারে ভুলে যাও আমাকে? নয়নার চোখের কোনে চিক চিক করছে নোনাপানি।বুকটাভার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে বুকের উপর কেউ পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। শ্বাস নিতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে নয়নার৷ মনে মনে বলে,এই যে আমার বুকভার, এ ভার কি তোমার হৃদয়ে ও পরে?নয়না জিয়ানের সাথে এয়ারপোর্টে যায় নি৷ হাতে সময় খুব কম ছিলো দ্রুত পৌঁছাতে হবে। তাই নয়নাও বায়না করেনি৷ যাওয়ায় সময় যখন নয়নাকে আলিঙ্গন করলো নয়নার ভেতরটা কেমন হাহাকারে ছেঁয়ে গেছে৷ মানুষটার চোখেও ছিলো রাজ্যের কষ্ট। কি নিদারুণ দৃশ্য। মেয়ে মানুষ তাও কাঁদতে পারে ছেলে মানুষ তো চাপা কান্না হৃদয় আটকে রেখে দিব্যি চলে। রোজ কত মানুষ এমন করেই প্রিয় মানুষের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে কে রাখছে সে-সবের খবর? জীবিকার তাগিদে বা একটু ভালো থাকার আশায় রোজ বেদনা লুকায় দুই প্রান্তে থাকা দু’টি মানুষ। অথচ সুখ সে তো সোনার ডিম সহজে তো ধরা ছোঁয়া যায় না৷ তবুও মানুষ একটু সুখের আশায় তেপান্তরে পারি জমায়।
“হাতের উল্টো পিটে চোখের কোনে জমে থাকা জলটুকু মুছে নিলো নয়না৷ মোবাইল হাতে নিতেই ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো মৃদু হাসি। এই যে প্রিয় মানুষের ছোট একটা টেক্সট নিমিষেই মনের মেঘ কাটিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারে এক চিলতে রোদ। এই ক্ষমতা তো পৃথিবীতে এই মানুষটার ছাড়া কারো কাছে নেই। ছোট একটা টেক্সট অথচ নয়নার মনজুড়ে ছেঁয়ে গেছে প্রশান্তি।….আমি আছি। যত দূরেই থাকি তোমার হৃদয়ে আমি আছি প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী।
” নয়না রিপ্লাই করলো না। এখন রিপ্লাই করলেও টেক্সট সেন্ট হবে না। সকালের তোলা পিকগুলো দেখতে লাগলো। মনে মনে বলে,আপনি তো ছিলেন চির অচেনা অথচ আজ আপনি ছাড়া অচল হয়ে পরে হৃদয়ের গতিপথ!
🌿নয়নার দেয়া ঠিকানায় পৌঁছে দাঁড়িয়ে আছে তুষি৷ বিশাল বড় আলিশান বাড়ি। গেঠের সামনে বড় করে লেখা চৌধুরী ম্যানশন। নয়না দারোয়ানকে নিজের পরিচয় দিলো৷ দারোয়ান তুষির জন্য গেট খুলে দিলো৷ সুন্দর এক গার্ডেন এরিয়া৷ দুইপাশে পানির ফোয়ারাও আছে৷ ছোট ছোট দু’টো চেয়ার টেবিল আছে দুই পাশেই৷ তুষি ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো ঘরের প্রবেশ দ্বারে। হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লেগে ব্যালেন্স হারিয়ে পরতে নিলে কারো হাতে বন্দি হয় তুষির হাত।
“তুষি সামনে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে বলে,আপনি!
” অন্তর তুষির হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,এখানে কেন এসেছেন মতলব কি? চুরিটুরি করার ধান্দা নাকি?
“মুখ সামলে কথা বলুন মিস্টার। এটা আমার জিজুর বাড়ি। সাইডে সরুন।
” অন্তরের মন ভালো নেই তাই কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো বের হয়ে। এসেছিলো জাহিনের সাথে রিতুর কেসের বিষয়ে কথা বলতে। জাহিন জিয়ানের সাথে এয়ারপোর্টে গেছে তাই দেখা হয়নি৷
“তুষি বাসায় ঢুকে সার্ভেন্টের সাথে নয়নার রুমের দিকে গেলো৷ নয়না তখন বিরহবিলাস করতে ব্যস্ত। তুষি সার্ভেন্টকে হাতের ইশারায় সরিয়ে দিয়ে ধীর পায়ে নয়নার কাছে এসে পেছন থেকে নয়নার চোখে হাত রাখলো।
” নয়না চমকে উঠে বলে কে? পর মূহুর্তে তুষির কথা মনে পরতেই বলে,ভুষি তুই চলে এসেছিস?
“তুষি চোখ ছেড়ে দিয়ে বলে,না এসে উপায় আছে৷ নয়না তুই তো একদম রাজ্যসহ রাজপুত্র পেয়েছিস। আগে ছিলে মাম্মাস প্রিন্সেস এখন হয়েছিস মহা রাজার, মাহা রানী।
” হু। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ তায়ালা আমাকে আমার কল্পনার চেয়েও বেশি দিয়েছেন৷ সব ঠিক আছে। এখন এসব বাদ দিয়ে তুই এবার তোর কথা বল৷ ফোন-টোন বন্ধ করে কই গা ঢাকা দিয়েছিলি আর দিয়েছিলি কেন সেটা বল? হঠাৎ করে গায়েব হওয়ার ভূত মাথায় চাপলো কেনো?
“নিজেকে একটু সময় দিতে। আসলে আমরা যত যত্ন করে ভালোবাসি অপর মানুষটা ঠিক ততটা যত্নে আমাদের ঠকায়।
” রাফিন ভাই তোকে ঠকিয়েছে? এটা ইম্পসিবল!
“আমিও প্রথমে এটাই ভাবতাম৷ অথচ কত নিখুঁত ভাবেই না আমাকে সে ঠকিয়ে গেছে। জানিস আমি দম বন্ধ হওয়া অনূভুতি নিয়ে কেঁদেছি এই ঠকবাজের জন্য। এখন এসব ভাবলেও হাসি পায়। আমি মৃত্যু যন্ত্রণা দেখিনি অথচ তাকে হারানো শোক আমাকে সে অনুভূতির সাক্ষাৎ করিয়েছে৷
” এটা কিভাবে সম্ভব?
“রাফিনের যে কাজিনটাকে নিয়ে আমাদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই ঝগড়া ঝামেলা হতো। ও যে বারবার বলতো আমরা যাস্ট কাজিন এ-র বেশী কিছু না। সামনের শুক্রবার তার সাথেই ওর বিয়ে।
” কি বলছিস! তোকে বিয়ে করার জন্য তো রাফিন ভাই পাগল ছিলো৷ তো ভালোবাসা না থাকলে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়?
“শোন কিছু পুরুষ মানুষের মুখ আর মুখোশ চেনা বড়ই কষ্টসাধ্য। বিয়ে করতে চাইলেই সে সত্যি কারের ভালোসতো এটা তো নয়।ভালোবাসা আর চাহিদা দু’টোই ভিন্ন। আমি থাকতেও যার অন্য নারীর সঙ্গ প্রয়োজন ছিলো আমি কিনা তার জন্য এমন পাগলের মত কেঁদেছি! যাক বাদ দে এসব মানুষের কথা মুখে আনতেও ঘৃণা হয়। তাকে ঘৃনা করবো সেই যোগ্য ও সে না। আমার ঘৃণাও সে ডিজার্ভ করে না৷ অথচ তাকে আমি সর্বস্ব উজার করে ভালোবেসেছিলাম!
” আচ্ছা মন খারাপ করিস না৷ কথায় আছে যে যেমন তার সাথে তেমনটাই মেলে৷ কামারের দোকানে কি হিরে জহরত থাকে! তোর মত ভালো মেয়ে ওর কপালে নেই।মনে রাখিস যে যেমন তার সাথে তেমটাই মেলে৷ এসব ছাড় চল আমার সাথে।
“কই?
” আম্মুর সাথে দেখা করিয়ে আনি।
“আন্টি এই বাসায়?
” আরেহহহ নাহহ আমার শ্বাশুড়ি আম্মু।
🌿জিয়ান বিমানে উঠে বসেছে।এবার তার মনটা খারাপ। নয়না সাথে আসলে হয়ত একটু ভালো লাগতো৷ কিন্তু এতো সর্ট সময়! এরমধ্যে নয়নাকে আনা সম্ভব হলো না৷ মোবাইল বের করে নিজের ওয়ালপেপারে নয়নার হাসোজ্জল মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,এরপরের বার তোমাকে ছাড়া এই পাইলট বিমানে উঠবে না৷ তোমাকে নিয়ে তবেই উঠবো৷ নিজের খেয়াল রেখো প্রেয়সী প্রিয়তমা৷ দশ দিনের ছুটির বদলে পনেরোদিনের ছুটি কাটিয়েছে জিয়ান৷ এবার হয়ত ছুটি পাবে না সহজে৷ এই দীর্ঘ সময় কি করে কাটাবো তোমাকে ছাড়া! এই যে আমি যাচ্ছি আমার সাথে কেবল আমার দেহ আছে। মন মস্তিষ্ক, চিন্তা, ভালোবাসা সবটা ফেলে রেখে যাচ্ছি তোমার কাছে। ফেরার পথ দীর্ঘ হলেও অপেক্ষায় ভালোবাসা সুমিষ্ট স্বাদে ভরপুর হয়ে উঠে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর তোমার স্পর্শে আবার সতেজ হবে আমার দেহ-মন। ততদিন জলহীন মাছের মতই ঝটফট করবে ভেতরটা।
🌿জিয়ানকে ড্রপ করে জাহিন নিজের প্রাইভেট এপার্টমেন্টে চলে আসলো৷ আসতে আসতে চার পাঁচটা সিগারেট খাওয়া শেষ! আজকাল সিগারেট ছাড়া যেনো জাহিনের চলেই না৷ শার্ট খুলে রেখে আয়নার নিজের প্রতিবিম্ব দেখে বলে,ঠোঁটটা তোমার ঠোঁটের উষ্ণ পরশের অভাবে কেমন শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। তুমি তো কোনদিন আমায় ভালোবাসবে না। উন্মুক্ত বডির দিকে তাকিয়ে বলে,বডি বানিয়ে কি হবে যদি ভালোবাসার মানুষই পাশে না থাকে!হঠাৎ জাহিনের চোখ রক্ত বর্ণ ধারণ করলো রাগে কপালের রগ ফুটে উঠছে। স্বজোড়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় আঘাত করলো৷ সাথে সাথে চুর্ণ বিচূর্ণ হয়ে ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরলো কাঁচের টুকরোগুলো৷ হাতের উল্টো পিঠ গেঁধে গিয়ে সেখান থেকে ঝড়তে লাগলো র’ক্ত৷
“বেডে বসে চিৎকার করে বলে,আই হেইড ইউ বাবা। সেই ছোট থেকে পদে পদে আমাকে বুঝিয়েছো আমি লুজার৷ তোমার সব ভালোবাসা কেবল জিয়ানের জন্য। আমি কেউ না! লাগবে না আমার তোমার মত বাবা৷ রাখবো না আমি জিয়ানকে এই পৃথিবীতে ও মরলেই তুমি আমার কদর বুঝতে শিখবে। তোমার আর আম্মুর সব ভালোবাসা, সব কেয়ার, সব প্রায়োরিটি রেজা পেয়েছে। আমি কে সেটা আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেবো৷ আমার কাউকে দরকার নেই কাউকে না। হাত থেকে র’ক্ত ঝড়ে সাদা বেডসিট রঙিন হয়ে যাচ্ছে। তার শরীরের ব্যথা যেনো তার মনের ব্যথার কাছে তুচ্ছ।
#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে