#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৫১
হাতে হাত রেখে রাতের শহর উপভোগ করছে জিয়ান নয়না৷ নয়নার হাতে একগুচ্ছ হলুদ গোলাপ, হলুদ গোলাপের মাঝখানে একটা টকটকে লাল গোলাপ।
“জিয়ান বলল,তোমার হৃদয়ে ওই লাল গোলাপের মত আমার জায়গা। সবার মাঝে থেকেও আমি ভিন্ন৷ তোমার হৃদয়ের চাঁদ আমি।”
“আপনি কি জানেননা হৃদয়ে সবাই থাকে না। হৃদয়ের মানুষ ছাড়া হৃদয়ে কারো জায়গা হয়না৷ বড্ড বোকা আপনি৷”
“তুমি আমাকে আপনি করে বলবা না। আমি তোমার একান্ত ব্যাক্তিগত তুমি।”
“পুরুষ মানুষ প্রেমে পরলে বোকা হয়ে যায়। কথাটা কি সত্য?”
“তা তো জানি। তবে তুমি তাকালেই আমি হয়ে যাই বোকা।আমার পৃথিবী যেনো থমকে যায় তোমার চাহনিতে। কি আছে তোমার এই আঁখি দুটিতে?”
“আফিম আছে। তাই আমার সাথে দৃষ্টি মেলানোর আগে সাবধান।”
“তোমার চাহনিতে যদি আফিম থাকে আমি সে নেশায় নেশাগ্রস্ত হতে রাজি৷ একবার না বহুবার শতবার।”
নয়না শাড়ীর কুচি ঠিক করছে। জিয়ান হাঁটু মুড়ে বসে পরলো,নয়নার হাত সরিয়ে দিয়ে নিজের হাতে ঠিক করতে লাগলো নয়নার কুঁচি। রাস্তায় কত মানুষ চলাচল করছে তারা বাঁকা চোখে তাকিয়ে দেখছে।
“কি করছেন সবাই দেখছে তো?”
“লোকে দেখলে দেখুক আমার। আমার বৌ আমার দ্বায়িত্ব, আমার ভালোবাসা৷ তার এতোটুকু কাজ করবো না! লোকে পাগল বলুক তবুও আমি তোমায় ভালোবাসবো।”
“ইশশ ভালোবাসার জন্য বাসায় আমাদের রুম আছে তো।”
“রুমের মধ্যে ভালোবাসায় চাহিদা থাকে৷ এই ভালোবাসায় যত্ন আছে। আমি শুধু রুমের মধ্যে ভালোবাসবো আর বাহিরে বৌকে পাত্তা দেবো না এমন মোটেই হবে না। দরকার পরলো তোমাকে কোলে তুলি নিয়ে হাঁটবো৷”
“হয়েছে চলুন ফুচকা খাবো।”
“এভাবে বললে নড়বো না।”
“চলো ফুচকা খাবো।”
“যো হুকুম মেরি রানী।”
এক প্লেট ফুচকা নিয়ে নয়না খাচ্ছে। জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা ভালোবাসার মানুষের প্রতিটি কাজ এতো মনোমুগ্ধকর কেন? মনে হয় আমি ফুচকা খাওয়া না, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখছি। ভালোবাসা মানুষকে এক অন্য রকম অনূভুতির জগতে নিয়ে যায়। নয়না জিয়ানের মুখের সামনে একটা ফুচকা ধরে বলে, “এভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন?”
“দেখছি আমার বৌ ফুচকা খাচ্ছে এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য কি আছে!”
“আপনি বড্ড বেশি কথা বলেন৷ নিন হা করুন তো৷”
জিয়ান হা করে ফুচকা মুখে নিলো।
দূর থেকে দাঁড়িয়ে জাহিন এই দৃশ্য দেখলো। একটা কেসের ইনভেস্টিগেশন করতে বের হয়ে ছিলো জাহিন। এমন দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ালো। তার মনে হচ্ছে সামনের মানুষ জিয়ান কেনো হলো। সে কেনো হলো না। হঠাৎ নিজের মধ্যে ফিরে এসে বলে, ছিহহহ জাহিন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনী সম্পর্কে তোর ভাবি৷ তোর চিন্তা ভাবনা এতো জঘন্য হতে পারে না। জাহিন কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলো নিজের গন্তব্যের দিকে তবে কিছু একটা ভেবে আবার ফিরে আসলো৷ এসে দেখে জিয়ান আর নয়না নেই। জাহিন বাইক রেখে সামনে হাঁটা শুরু করলো। দেখতে না পেয়ে ফিরে এসে আবার বাইক স্টার্ট দিলো।
নয়না ফুচকার প্লেট টুলের উপরে রেখে নিজে উঠে দাঁড়ালো টুলের উপর। ঝুঁকে জিয়ানের শার্টের বাটন লাগিয়ে দিলো।
জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে বলে,”ভালোবাসি প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী।”
নয়না টুল থেকে নেমে বলে, “বিল পরিশোধ করে চলুন, এক জায়গায় কতক্ষণ থাকবো?”
জিয়ান বিল পরিশোধ করে নয়নার হাত ধরে বলে, “এই রাত যদি না শেষ হয়,তবে কেমন হতো বলো তো?”
নয়না হেসে বলে, “সব কিছুর শেষ আছে তাই নিয়ম অনুসারে তা সমাপ্ত হবেই। সো মিস্টার প্লেন ড্রাইভার আকাশ কুসুম ভেবে লাভ নেই।”
“দূর ভাল্লাগে না। তোমার জন্য একটু রোমান্টিক হতে পারি না৷”
“আহা মিস্টার প্লেন ড্রাইভার আবার নাকি রোমান্টিকও হতে পারে!”
“তো তোমার আমাকে আনরোমান্টিক মনে হয়!”
“তো তুমি তো আনরোমান্টিকই। তোমার তো হুমায়ুন আহমেদের বই পড়ে রোমান্টিকতা শেখা উচিৎ।”
“ওসব শিখতে হয় নাকি? রাস্তা ফাঁকা থাকলে এখন কয়েকটা চুমু খেয়ে বুঝিয়ে দিতাম। আমি কতটা রোমান্টিক!”
“সুন্দরী মেয়ে দেখলে পুরুষ মানুষের হুস থাকে না৷”
“বৌ তুমি আমাকে উস্কে দিচ্ছো কিন্তু। এরপর এর দায় কিন্তু তোমার।”
নয়না হুট করে তার আঁচল নিয়ে জিয়ানের হাতের কব্জিতে বেঁধে দিলো। নরম স্বরে বলল, “মনের সুতোয় মন বেঁধেছে, দেহ বাঁধলাম আঁচলে।”
জিয়ান গেয়ে উঠলো, “এতো ভালোবাসা গো জান রাখিও অন্তরে, দোলাও তুমি দুলি আমি জগত বাড়ি দোলে৷”
“তুমি তো খুব ভালো গাইতে পারো৷”
“বেশি না তবে পারি। আমাদের দু-জনের কন্ঠই মোটামুটি ভালো। তবে জাহিন বেশি পছন্দ করে গানটান৷”
“হ্যা শুনেছি ভাইয়া খুব ভালো গায়। তবে তোমার মত না।”
“নিজের মানুষের সব কিছু সব সময় বেস্ট তারপর বাকি সব।”
জিয়ান নয়নার আঙুলের ভাঁজে আঙুল ডুবিয়ে বলে, “এ বাঁধন কখনো ছিড়ে যাবে নাতো?”
নয়না স্থির হয়ে দাঁড়ালো রাস্তা এখন বেশ ফাঁকা মাঝে মাঝে দূরপাল্লার বাস শা শা করে চলে যাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোতে জিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি আমার প্রথম অনুভূতি, প্রথম ভালোবাসা। আমি কোনদিন তোমাকে ভুলতে পারবো না৷ সম্ভব না আমার জন্য তোমাকে ভুলে থাকা৷ তবে আমার কি মনে হয় জানো? আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হলে তা তোমার জন্য হবে৷ তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে হয়ত কোন মাঝপথে অথবা অজানা গন্তব্যে।”
জিয়ানের দৃষ্টি এখনো নয়নার দৃষ্টিতে স্থীর৷ জিয়ান বলল, “আমি বলবো না আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি কারন ভালোবাসা অনুভব করার জিনিস মাপার জিনিস না। তবে এতোটুকু জেনে রেখো তুমি আমার জীবন থেকে কখনো হারিয়ে গেলে হয়ত আমি পাগল হয়ে যাবো৷ নয়ত আমি মরে যাবো। তোমাকে ছাড়া হয়ত এ জীবনে আর বেঁচে থাকা সম্ভব না।”
কথার মধ্য দু” জনে এতোটাই মগ্ন আশেপাশের অবস্থা তারা যেনো ভুলে বসেছে। হঠাৎ দূরপাল্লার বাসটা তাদের দিকে এগিয়ে আসলো। নয়না জিয়ান বলে, জোড়ে চিৎকার করলো৷ রাতের শহরে তার চিৎকার মিলিয়ে যেতে লাগলো ইটপাথরের কংক্রিটে।
****
অনিকেত বেডে বসে আছে। তার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তার মায়ের চেহারাটা। জানতে ইচ্ছে করছে কতটা অসহায় হলে মা তার সন্তানকে এতিম খানায় ফেলে যায়! কেনো সে আর খোঁজ নিলো না আর? আমাকে কি একবার দেখতে ইচ্ছে করেনি! জানতে ইচ্ছে হয়না আমি কেমন আছি! কোন মা কিভাবে সন্তানকে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে ছেড়ে দেয় একা একা! আমি শুধু একবার মা ডাকতে চাই। অনিকেতের ফোনটা সেই কখন থেকে বেজেই চলেছে৷ বিরক্ত হয়ে রিসিভ করে বলে, “কি সমস্যা আপনার! ছেলে দেখলেই গলায় ঝুলে পড়তে ইচ্ছে করে? আমি কোনদিন আপনাকে নিজের করবো না। কোনদিন না।”
সায়না মোটেই রাগ করলো না অনিকেতের কথা শুনে, শান্ত স্বরে বলল, “ভালোবাসি।”
অনিকেত থমকে গেলো তার রাগ যেনো মিশে গেলো অজানায়।
সায়না বলল,”আপনাকে ভালোবাসি মানে আপনার, রাগ অভিমান, খারাপ, ভালো সব কিছুই আমি ভালোবাসি। আপনাকে না বেসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না তাই আপনাকে ভালোবাসি।”
অনিকেত ফোনটা কেটে দিতে চাইলো।
সায়না বলল, “আপনার কথা বলতে হবে না, আপনি শুধু কানের কাছে ফোনটা ধরে রাখুন৷ আমি চাই আমি একাকীত্ব না আমাকে অনুভব করুন। শুনছেন ভালোবাসি আপনাকে৷ ভালোবাসি ডাক্তার অনিকেত মাহমুদ কে৷”
হটাৎ করে অনিকেত ফোনটা বুকে চেপে ধরলো। এতোক্ষণ ধরে শূন্যতায় হাহাকার করতে থাকা বক্ষপিঞ্জর যেনো মূহুর্তেই শান্ত হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে কেউ একজন আছে এই পৃথিবীতে যে তাকে ভালোবাসে। টাকার অভাবের চেয়ে ভালোবাসার অভাব মানুষকে বেশী পোড়ায়।
#চলবে