অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-১২

0
11

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব- ১২
‘এই ছাড়ুন আমাকে৷
‘কোলে বসে আছো ভালো লাগছে না বেবি৷
‘আমাকে ছাড়ুন?
‘আমার প্রতি এতো রাগ?
‘রাগ, অভিমান তার সাথে করা যায় যাকে মানুষ ভালোবাসে। আপনি তো সুনামি যার আছড়ে পড়ার আঘাত কত কাল আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে জানা নেই! আপনার প্রতি রাগ অভিমান বেমানান। আপনার প্রতি থাকবে ক্ষোভ আক্ষেপ।
‘হুট করেই জিয়ান বলে, আই নিড ইউর লিপস যাস্ট টু মিনিট।
‘আমি ইংরেজি বুঝি না৷
‘জিয়ান হাত টান দিয়ে বলে, যে সাহিত্য বোঝে সে এই সামান্য কথা বুঝবে না!
‘যে হাত সারাজীবন ধরে রাখতে পারবেন না সে হাত ধরার সাহস কেনো দেখাচ্ছেন?
‘জিয়ান হাতটা ছেড়ে দিলো৷
‘নয়না দ্রুত বারান্দা থেকে রুমে চলে আসলো।
‘জিয়ান সেভাবেই বসে রইলো। সে হঠাৎ কেনো নয়নার কাছে অমন আবদার করলো! কিন্তু এই মূহুর্তে জিয়ানের মনে হচ্ছে নয়নার ঠোঁটের স্পর্শ তার প্রয়োজন খুব প্রয়োজন কারো উষ্ণ আলিঙ্গন।

নয়না রুমের লাইট অন করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলো। নিজের চেহারার দিকে তাকালো। জীবনের মাত্র ষোলতম বছর পার করছে নয়না৷ কত রঙিন স্বপ্ন কত প্ল্যান কত আশা ছিলো ছোট মস্তিষ্কে। একটা দিন একটা আকস্মিক ঘটনা তার জীবনটা মূহুর্তে পাল্টে দিলো! কি হলো এই পাঁচটা দিন তার সাথে? যে হাত আজ পর্যন্ত কেউ সাহস করে স্পর্শ করতে পারেনি! আজ সেই শরীর জুড়ে কারো স্পর্শ লেপ্টে আছে৷ ঠোঁটে হাত দিয়ে কেঁপে উঠলো নয়না। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো বিভৎস সেই রাতের দৃশ্য। কেউ টেনে তার লেহেঙ্গার ওড়না ছুড়ে ফেললো৷ অন্ধকার রাত মোমবাতির টিমটিম আলো আর নানা রকম ফুলের সৌরভ। সে-সব নিছক তাকে আঘাত করার জন্য সাজানো। জোর করে কেউ তাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দিলো৷ সে কি যন্ত্রণার। নয়নার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়তে লাগলো। হঠাৎ কেউ তার কাঁধে হাত রেখে বলে,কি হয়েছে তোমার?

‘নয়না হুট করে উঠে এসে সামনে থাকা মানুষটিকে জড়িয়ে ধরে, কাঁপতে থাকে৷

‘জিয়ান নয়নাকে আগলে রাখে নিজের বক্ষে। শান্ত স্বরে বলে, কি হয়েছে তোমার? বলো আমাকে কি নিয়ে সমস্যা?

‘নয়না জিয়ান কন্ঠ শুনো চোখ খুলে জিয়ানের মুখের দিকে তাকায়। চিৎকার দিয়ে বলে, দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন আমার সাথে এমন করবেন না? ছেড়েদিন আমাকে।

‘জিয়ান হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকে নয়নার দিকে।

নয়না ততক্ষণে জিয়ানের কয়েক হাত ধুরে সরে দাঁড়ায়৷

‘জিয়ান বেড সাইট টেবিলের উপরে থাকা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নয়নার সামনে পা বাড়ায়।

‘নয়না আরো দূরে সরে যাচ্ছে আর বলছে,আমাকে ছেড়েদিন।

‘জিয়ান থমকে দাঁড়ালো। নরম স্বরে বলল,কি হয়েছে তোমার সুনয়না৷ ভয় পাচ্ছো কেনো? দেখো আমি তোমাকে ধরিনি। আর এখানে আর কেউ নেই৷ ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই৷।

‘নয়না আর কিছু বলতে পারলো না তার আগেই তার চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেলো। মাটিতে লুটিয়ে পরার আগেই জিয়ান নয়নাকে নিজের বাহু বন্ধনে আগলে নিলো। কোলে তুলে বেডে শুইয়ে দিয়ে নিজে নয়নার মাথার সামনে বসলো। কি করবে এখন সে? এ বাড়ির কাউকে কিভাবে বলবে।মাথা নিচু করে বসে থেকে মোবাইল নিয়ে তার ফ্রেন্ড অনিকেতকে কল করলো৷ অনিকেত পেশায় একজন ডাক্তার।

‘ভ্রু কুচকে মোবাইলের দিকে তাকালো অনিকেত।এতো রাতে কল করার মত মানুষ অনিকেতের জীবনে নেই! তাহলে কে কল করলো? বিরক্তি নিয়ে মোবাইলের স্কিনে তাকাতেই দেখতে পেলো জ্বলজ্বল করছে রেজা নামটা। অনিকেত কাল বিলম্ব না করে সাথে সাথে রিসিভ করে বলে,কিরে শা’লা এতোদিন পর মনে পরলো? শুনলাম এরমধ্যে বিয়েও সেরে ফেলেছিস?

‘তোর কথা পরে শুনবো আগে আমার কথা শোন..তারপর অনিকেতকে সবটা খুলে বলল৷

‘অনিকেত সব শুনে বলে, সম্ভবত ভাবির প্যানিক আট্যাক হয়েছে৷ এই পরিস্থিতি সাধারণত কয়েক মিনিটের মধ্যে শীর্ষে পৌঁছায়, কিন্তু তখনও তা ভয়াবহ বা অস্বস্তিকর অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। প্যানিক অ্যাটাক সাধারণত অতিরিক্ত মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা নির্দিষ্ট পরিস্থিতি সামাজিক বা কর্মজীবনের চাপ এই ধরনের আক্রমণকে হতে পারে। তুই এক কাজ কর, চোখে মুখে পানির ছিটা দে।জ্ঞান ফিরলে আতঙ্কিত এবং বিচলিত থাকতে পারে।ভাবির পাশে থাক এবং শান্ত থাকার চেষ্টা করবি, ভাবিকে সান্ত্বনা দিবি তাকে অনুভব করাবি যে সে নিরাপদ আছে। মনোযোগ অন্য দিকে নেয়ার চেষ্টা করবি৷ আর কয়েকবার লম্বা শ্বাস প্রশ্বাস নিতে বলবি৷ দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। ভয়ের কিছুই নেই প্রথম প্রথম অনেক মেয়েই এটাকে ভয় পায়।

জিয়ান আর কোন কথা শুনলো না৷ খট করে ফোনটা কেটে দিলো। জিয়ান ভালো করেই জানে এখন অনি উল্টোপাল্টা কথা বলবে।

‘ফোন কেটে দিলো! মানুষ ঠিকি বলে বৌ পেলে মানুষ সব ভুলে যায়। আচ্ছা আমি কবে সব ভুলে যাওয়ার মত বৌ পাবো? বাবা আমার কি বিয়ে হবে না?

‘জিয়ান বেড সাইড টেবিলের উপর থাকা জগটা থেকে সামান্য পানি নিয়ে নয়নার চোখমুখে ছিটিয়ে দিলো৷

কিছুক্ষণ পর নয়না চোখ খুললো৷ জিয়ান নয়নার মাথা নিজের বক্ষে নিয়ে,নয়নাকে বললো,তুমি তো আমাকে বেশ ভয় পাইয়ে দিচ্ছেলে?বললেই হতো আজ তোমার বাচ্চাদের মত ঘুমোতে ইচ্ছে করছে তাহলেই আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতাম।

‘ছাড়ুন আমি বালিশে শোবো।

‘জিয়ান নয়নার মাথা বালিশে রেখে সরে বসলো। এই তুমি জোরে শ্বাস নিতে পারো? এই আমার মত করে?

‘এটা কোন ব্যপার হলো? এই দেখুন বলেই জোরে শ্বাস নিলো।

‘এতো আমার চেয়ে কম হলো৷

‘নয়না আবার শ্বাস নিলো লম্বা শ্বাস। তারপর জিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে আপনি সত্যি গান গাইতে পারেন?

‘নাহহ, পারি না আমি গান গাইলে তোমার এলাকার সব লোক লাঠিসোটা নিয়ে হাজির হবে। এতো বাজে কন্ঠ আমার।

‘নয়না উচ্চ স্বরে হেসে বলে,এতো বাজে কন্ঠ আপনার?

‘হুম খুব বাজে একবার কি হয়েছিলো জানো?

‘নিশ্চিত আপনার গান শুনে কুকুর তাড়া করে ছিলো আপনাকে!

‘নয়না উঠে বসলো। এই একটা হেল্প করেন আমার গয়না গুলো খুলতে সাহায্য করেন।

‘জিয়ান নয়নার গহনা খুলতে সাহায্য করলো৷ নয়না উঠে দাঁড়ালো। ড্রয়ার থেকে ড্রেস বের করে বলে,আমি চেঞ্জ করে আসি আপনিও চেঞ্জ করুন৷

‘আমি তো কিছু নিয়ে আসিনি?

‘আপনার শ্বশুর আব্বা আপনার জন্য ড্রেস কিনে রেখেছে ওই যে চারটা শপিং ব্যাগ দেখছেন তাতে আপনার প্রয়োজনীয় কাপড় পেয়ে যাবেন।

‘নয়না ওয়াশরুমে চলে যাওয়ার পর জিয়ান ব্যাগ খুলে অবাক, টিশার্ট থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট,তোয়ালে শার্ট, ব্লেজার সব আছে এতে! একটা টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট বের করে পরে নিলো। নয়নার রুমটার দিকে নজর গেলো। পুরো রুম জুড়ে হোয়াইট আর পিংক কালারের ফার্নিচার। রুমের রংটা হালকা পার্পল। বলতেই হয় নয়না খুব আদুরে মেয়ে। তাইতো প্রিন্সেসের মত রুপটা সাজানো। হঠাৎ চোখ পরলো দেয়ালে টাঙানো একটা পেইন্টিংয়ের দিকে৷ অবাক হয়ে বলে এটা এখানে কি করছে?

‘নয়না ওশারুম থেকে বের হয়ে বলে,আমার রুমটা খুব সুন্দর তাই না? সব কেবিনেট আমার মন মত করে বানানো।

‘হুম খুব সুন্দর। তবে তোমার চেয়ে..

‘কি আমার চেয়ে?

‘তোমার চেয়ে কম।

‘এই পাস্তা খাবেন? আমার খুব খিদে পাচ্ছে এই রাত আর সাথে পাস্তা আর কফি যাস্ট জমে যাবে।

‘তুমি পারো?

‘ইয়েস মিস্টার ড্রাইভার।

‘নট ড্রাইভার ইট’স পাইলট।

‘একি তো।

‘কখনো রাত জেগে উপন্যাস পড়েছেন?

‘নাহহ আমার এসব পড়ার সময় হয়নি। সাকালে ভার্সিটি দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত পাইলট হওয়ার জার্নি এভাবেই কেটেছে দিন।

‘এরজন্য আপনার মধ্যে কোন রসকষ নেই। উপন্যাসের নায়ক চরিত্রগুলো হয় কল্পনার পুরুষের মত। তাদের রাগ তাদের আগলে রাখা, তাদের অ্যাটিটিউড সব কিছুই সুপার সে উপার৷ আর ভালোবাসা? তাতো বলার ভাষা রাখে না।

‘তোমার উপন্যাস নিয়ে গবেষণা শেষ হলে পাস্তা আর কফি বানিয়ে আনো।

‘এই যে মিস্টার প্লেন ড্রাইভার। আমার পিছু পিছু আসেন।

‘তোমার বাসার কেউ দেখে ফেললে?

‘দেখে ফেললে কি? আমরা কি চোর নাকি? জিয়ানের হাত ধরে বলে চলেন তো।

‘রান্নাঘরে এসে নয়না, চুলায় পানি বসালো, তাতে সয়াবিন তেল, আর লবন দিলো।

‘জিয়ান জীবনে প্রথমবার কিচেনে ঢুকেছে৷ অবাক হয়ে বলে,সাদা পানিতে তেল আর নুন কেনো দিলে?

‘ওরেহহহ ড্রাইভার সারাজীবন বইয়ের পাতায় ডুবে থাকলে জানবেন কি করে? চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন আর দেখুন ঘরোয়া স্টাইলে সহজ ভাবে কিভাবে পাস্তা রান্না করতে হয়।

‘পানি ফুটে উঠলে নয়না গ্যাস কমিয়ে তাতে পাস্তা দিলো। এরপর ফ্রিজ থেকে টমেটো, ক্যাপসিকাম, ধনিয়াপাতা, সয়াসস, টমেটো সস, কাঁচা মরিচ বের করে আনলো। একে একে পেয়াজ, টমেটো, ক্যাপসিকাম কুচি করে নিলো৷ ততক্ষণে পাস্তা সেদ্ধ হয়ে গেছে। পাস্তা ছাকনীতে দিয়ে চুলায় প্যান বসিয়ে একে একে সব দিয়ে নাড়া চাড়া করে এরপর ডিম দিলো ডিমটা হয়ে এলে পাস্তা ঢেলে দিলো৷ নামানোর আগে ধনিয়া পাতা দিয়ে নামিয়ে নিলো৷ হিটারে পানি গরম করে, তাতে গুঁড়া দুধ, কফি পাউডার দিয়ে মিক্সড করে নিলো৷

‘জিয়ান এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে রান্না দেখছিলো৷ এবার বলল,আমি ব্ল্যাক কফি পান করি। সুগার আর মিল্ক পাউডার এভোয়েট করি।

‘আয়হায় কি বলেন! যারা ব্ল্যাক কফি পান করে তারা তো বিষ পান করলেও মরবে না৷

‘হোয়াট?

‘আমার মাথা! চলুন।

‘জিয়ান হাঁটা শুরু করলো৷

‘আরেহহহ ওই মিস্টার ড্রাইভার এতোসব আমি একা রুমে নিয়ে যাবো কি করে?কফি মগ আপনি নিন পাস্তার প্লেট আমি নিচ্ছি।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে