অভিশপ্তরাত (৬ষ্ঠপর্ব)
Umme Nipa
শিহাব মায়ার চেহারা দেখে ভয়ে কুকরে গেল।উপমার রূপ নিয়ে মায়া শিহাবকে এখানে এনেছে।
পাশে মায়া হলে ওই লোক কার লাশ ফালালো ভাবতে ভাবতে শিহাবের বুকে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হল।এক পর্যায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হল।উপমা উপমা করে ডাকছে।উপমার ঘুম ভেঙে যায়। আলো জ্বালিয়ে দেখছে শিহাব কুকড়ে আছে।আতংক নিয়ে ডাকছে উপমা।শিহাবের ঘুম ভেঙে যায়। উপমার দিকে ধ্যান দিয়ে তাকিয়ে আছে শিহাব
উপমা: শিহাব পানি খাবে?তুমি এমন করতেছো কেন?
শিহাব চুপ করে আছে
উপমা পানি এনে শিহাবের দিকে এগিয়ে দিল।শিহাব উঠে পানি মুখে নিতেই বলে উঠলো পানি থেকে পচা গন্ধ আসছে।ছিঃ
উপমা উদ্বিগ্ন হয়ে পানির গ্লাস নাকের কাছে নিল। কোন গন্ধ ই পেল না।
হয়তো শিহাব খুব বাজে স্বপ্ন দেখছে।যার রেশ কাটেনি এখনো।উপমা পানি পাল্টে এনে নিজ হাতেই খায়িয়ে দিল শিহাব কে।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।উপমা শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছিয়ে দিয়ে বললো,তুমি এখনো বাচ্চা ই রয়ে গেলে।এত ভয় কেন পাও?
শিহাব পানি খেয়ে উপমার কোলে মাথা দিল।
উপমা শিহাবের মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর বলছে,শিহাব মনে আছে সেবার তুমি হলে একা ছিলে।রুমে কংকাল ছিল আর তুমি ভয়ে সারারাত আমার সাথে কথা বলেছিলে।
শিহাব এসব কিছু কানেই তুলছেনা।ভয়ানক জায়গা টা তার মনে ভেসে আসছে বার বার।
উপমা শিহাবের দিকে তাকিয়ে আছে।এত ভালো মানুষটাকে কি করে ঠকাই আমি?আমার কি বলা উচিৎ? না না আমার সন্তানের ভালোর কথা ভাবা উচিৎ আমার, এই ভাবতে ভাবতে উপমার মনে ঝড় বয়ে যায়।
শিহাব ক্লান্ত গলায় বলছে শুয়ে পরো
উপমা: আর কিছুক্ষণ থাকো এভাবে।আমার খারাপ লাগছেনা।
শিহাব: আমার সন্তান এলে এই কোল তো শুধু তার ই হয়ে যাবে।
উপমা খিল খিল করে হেসে দিয়ে বলছে কী হিংসুক তুমি!
শিহাব চোখ বন্ধ করেই স্বস্তির হাসি দিল।উপমার হাসি একেবারেই বিশুদ্ধ। এ হাসিতে কোন ক্ষাঁদ নেই।যা শুনলে বুকের ভিতর অব্ধি গিয়ে লাগে।
উপমা: চুপ হয়ে গেলে যে?
শিহাব: আমি যদি জোকার হতে পারতাম!
উপমা: কেন?
উপমা: তোমায় হাসাতে পারতাম।আমি মানুষ টা আসলেই বোরিং। হাসাতে পারিনা।তুমি দিন রাত যদি হেসেই থাকতে কত ভালো হত।
উপমার চোখে বেয়ে টপ টপ করে জল শিহাবের গালে পরলো।শিহাব চোখ মেলে উপমার দিকে তাকালো।
হাসাতে তো পারি ই না উল্টো কাঁদাতে পারি তাইনা উপমা?এ সময় কাঁদতে বারণ করেছি না?
উপমা: ঘুমাও।কিছুক্ষনের মাঝেই আজান দিবে।
শিহাব চোখ বন্ধ করলো।
মাত্র একদিন বাকি আছে আমাবস্যা আসার।কি করে যাবে সে ভাবতে ভাবতে তার মনে হল মায়ার কথা।এতদিন এলো মায়ার একটা খোঁজ নেয়া হল না।উপমা মায়ার খোঁজে মায়ার বাড়ির দিকে রওনা হল।তার বাড়িতে গেলেই তার শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা পাবে।
১৫মিনিটের পথ।রাস্তাগুলি অনেক পরিবর্তন।চারপাশে বাড়ি ঘরের সংখ্যা ও বেড়েছে খুব।
মায়ার বাড়ির সামনে এসেও অনেক টা তফাৎ খেয়াল করলো উপমা।ভিতরে যেতেই ছোট বাড়িটি দেখে চিনতে ভুল হয়না মায়ার বাসা।
ভিতরে কেউ আছেন প্রশ্ন করতেই ভিতর থেকে বয়স্ক মহিলা বাইরে নেমে এলো।মহিলাকে দেখে চিনতে ভুল হয়না উপমার।
খালাম্মা?
-কে মা তুমি?
আমি উপমা খালাম্মা।চিনতে পারেন নি?ওই যে মায়ার সাথে স্কুলে পড়তাম। টিফিনের সময় কত আপনার হাতের রান্না খেয়েছি।
মহিলা উপমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিল।মা ও মা তোমার গা দিয়া আমার মাইয়ার ই গন্ধ আইতাছে মা।আমার কলিজাডা পুইরা যায়রে মা।কতদিন আমার মায়রে বুকে ঝাপটায় ধরিনা।
উপমা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।মহিলার কথা কিছুই বুঝছেনা।
খালাম্মা মায়া কই?ও কি আসছে?
-কই দিয়া আইবোরে মা!আমার মায় তো আর আইবেনা
উপমা: খালাম্মা কি হইছে?এই তো কিছুদিন আগেও মায়াকে দেখলাম।
মহিলা কান্না থামিয়ে দিয়ে বললো,কি কও মা?আমার মাইয়া আজ চাইর মাস হইল মারা গেছে।ওই লাশ টা ও পুলিশ দিল না।কয় চুরি হইয়া গেছে বলতে বলতে মহিলা বসে পরলেন।
উপমা যেন নিজের কান কেও বিশ্বাস করাতে পারছেনা।মায়া আর নেই!তাহলে ও বার বার আমার সাথে দেখা করেছিল।ও অনেক কিছু বলতে চেয়েছিল।
পেটে ভিশন যন্ত্রণা শুরু হল উপমার।বাচ্চাটা যেন নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো।
উপমা বসে পরে স্থির ভাবে বলতে লাগলো খালাম্মা আমায় একটু পানি দিবেন?
দাড়াও মা আনতাছি বলে মহিলা জলদি ঘরের ভিতর চলে গেল।
পানি ঢক ঢক করে পান করে মহিলার দিকে তাকিয়ে উপমা জিজ্ঞেস করলো মায়া কিভাবে মারা গেছে খালাম্মা?
মায়ার মা চোখ আঁচল দিয়ে মুছে বললেন,আমার মাইয়ারে আমার মাইয়া জামাই ই মারছে।দেইখা শুইন্না বিয়া দিলাম তা এত বদ মানুষ এর লগে।বেটা মায়ারে প্রচুর মারধর করতো।টাকা দিতে বলতো।শেষের দিকে আরেকটা বিয়াও করবে বলছে।মায়ারে পাগল বানাইছে।সবাই জানতো মায়ার উপর নাকি জ্বীন ভর করছে।আমি সব জানি মা।ওই সব আজিজ ফকিরের চক্রান্ত। শেষ বার যহন আমার মায় আমার কাছে আইল তহন বার বার কইছে মা আমার ঘরের চারপাশে তাবিজ পাই আমি।ঘর থেইক্কা ধুপ এর গন্ধ আসে রাইত হইলেই।সন্ধ্যা বেলা বিড়াল আসে ঘরে।আমি দরজা লাগাই তাও আসে।আমারে ওরা বাঁচতে দিব না।ওরা কুফুরি কালাম দিয়া আমায় শেষ করতে চায়।আমার লগে বদ জ্বীন আছে এইয়া তুমি বিশ্বাস করো মা?
আমি তহন মাইয়ারে বার বার কইছি মা রে আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।আল্লাহ তো বার বার সুযোগ দিছিল আমি ই বুঝিনাই।
উপমা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,কোন ফকির?
– আজিজ ফকির।গ্রামের সবার মাথা খাইছে।সবাই ওরে অন্ধ ভরসা করে।
উপমা ভয় ঠান্ডা হয়ে গেল।কি করতে নিয়েছিলাম আমি ভাবতে ভাবতে উঠে দাড়ালো।
-কই যাস মা?
উপমা: খালাম্মা আমি যাব এখন।আচ্ছা মায়ার জামাইরে পুলিশ দেন নায়?
-আল্লাহর বিচার আছে মা।মায়ার মরার ১৫দিনের মাথায় ও এক্সিডেন্ট এ মইরা যায়।যেই হাত দুইটা দিয়া আমার মায়রে মারছে সেই হাত দুইটা পুইড়া কয়লা হইয়া গেছে।
উপমা কিছু না বলে চলে যেতে নিল।পেটে খুব যন্ত্রণা শুরু হয়েছে
মা তুমি আবানা আর?প্রশ্ন টা মায়ার মা আবেগ নিয়ে করলেন।
উপমা পিছন তাকিয়ে বললো খালাম্মা আসবো।দোয়া করবেন।আমার সন্তান যেন দুনিয়ায় সুন্দর ভাবে আসে।
মায়ার মা শাড়ির আঁচল মুখে গুঁজে দিয়ে কান্নার স্বরে বললেন,আমার মায়া ও পোয়াতি ছিল
উপমা মাথা নিচু করে হাঁটা দিল।বার বার তার সেদিনের কথা মনে পরে যায়। মায়াও সেদিন পুড়ে যাওয়া হাত নিয়ে তাদের কাছে এসেছিল।
বাড়ি থেকে বের হতে হতে বার বার মনে হচ্ছে মায়ার স্বরে কেউ বলছে,উপমা সাবধান।
ক্লান্ত পায়ে বহু কষ্টে হেটে বাড়ি ফিরলো উপমা।শিহাব উপমাকে দেখেই দৌড়ে উপমার কাছে গেল।
কই গিয়েছিলে উপমা? কিছুটা রাগী স্বরে বললো শিহাব।
এই শরীরে একা একা কেন গিয়েছো?তুমি জানো আমি কত চিন্তায় ছিলাম।মামার বাসায় গিয়েছি।কত জায়গায় না খুঁজেছি তোমায়।
উপমা চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে দিয়ে আদো আদো করে বলছে শিহাব মায়া…মায়া…এই বলে অজ্ঞান হয়ে যায়।
শিহাব উপমাকে তুলে ঘরে এনে শুয়িয়ে দেয়।চোখে মুখে পানি দেয়।উপমার জ্ঞান ফিরেই সে পেটে হাত দিয়ে চেপে ধরে বলছে,ঊষাটা না খুব দুষ্ট হয়েছে।কি নড়াচড়া করছে দেখো।
শিহাব কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বলে মানে!এত অল্প সময় কি করে বেবি রেস্পন্স করতে পারে!উপমার ভুল ভেবে চুপ করে রইল।
উপমা শিহাবের হাত নিয়ে উপমার পেটে রাখলো।রাখার পর শিহাবের বুকে মোচর দিয়ে উঠলো।অদ্ভুত ভাবে বাচ্চা নড়ছে।এমনভাবে নড়ছে যেন সারা শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে উপমার।
শিহাব ধীর গলায় বললো উপমা আমরা চলে যাব। আর এখানে থাকবো না।
উপমা শিহাবকে শক্ত করে ধরে বললো,শিহাব মায়া অনেক আগেই মারা গিয়েছে।আমি ওদের বাসায় গিয়েছি।খালাম্মা বললো মায়া ৪মাস আগে মারা গিয়েছে।তুমি বলো,তুমি ও না দেখলে ও এসেছিল বলো?ও কি চায় আমার কাছে শিহাব?আমার বাচ্চার ক্ষতি করতে চায়?
শিহাব: ও না তোমার বান্ধবী বলো?মনে আছে তুমি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে তখন ও নাকি এসেছিল।
উপমা: হুম ও আসতো আমি বিপদে পরলেই ও ছুটে আসতো।আমার বাচ্চাকে নিয়ে ওর অনেক চিন্তা হয় নাকি।আমার বাচ্চাকে নিয়ে ওর কেন চিন্তা হয়! এই প্রশ্ন করে শিহাব কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিল উপমা।
শিহাব: মায়া মারা যাবার পর মায়াকে পুলিশ আমাদের হাসপাতালেই আনে।আমি ই ওকে প্রথম চেক আপ করেছিলাম।ওর সারা শরীরে কাদা ছিল।ওর মৃত্যু মোটেও স্বাভাবিক ছিলনা।কিন্তু তার প্রমান হয়নি।
উপমা: হুম ওকে নাকি ওর বর মেরেছে।থাক এসব নিয়ে আমাদের ঘাটতে হবেনা।তুমি আমায় অনেক দূরে কোথাও নিয়ে যাও শিহাব।আমার বাচ্চাকে বাঁচাও।
শিহাব উপমার কপালে চুমো দিয়ে আস্থা দিলো,আমি থাকতে কিছু হবেনা তোমার উপমা।আমার উপর ভরসা নেই?
চলবে….