স্কুলে আমার দুইটা নাম ছিল। কেউ ডাকতো লেবেনডিস, কেউ ডাকতো খ্যাতুশ দিপঙ্কর। ডাকবে না ই বা কেন? মা রোজদিন চুপচুপা করে তেল দিয়ে টাইট করে দুই বেনী বেঁধে দিত। বলতেন চুল বেঁধে না রাখলে নাকি চুলের মধ্যে শয়তান ঢুকে যাবে। পড়াশোনা তখন শিকেয় উঠবে। আমিও ভালো ছাত্রীর মতো পড়াশোনায় পুরো মনোযোগ দিয়ে প্রতি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে শুধু বৈষয়িক বিষয়ে এগিয়ে থাকলেও জীবনের বাকী আনন্দযজ্ঞে ডাবল জিরো মার্ক নিয়ে দিন পার করছিলাম। ক্লাস নাইন টেনে যখন অনেকে ছেলেদের গল্প করতো কিংবা কে কার প্রেমে পড়েছে তার গল্প করতো আমি তখন ওদের সাথে কথা না বলে বই নিয়ে বসে থাকতাম।
মেট্রিক, ইন্টারে স্টার পেয়ে পাস করার পর বুয়েটে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হই ক্ল্যাসিক কোচিংয়ে। তখন একটু একটু দুনিয়াদারী বুঝতে শিখেছি। মা চাইলেও আমি আর ওভাবে তেল দেয়া মাথা নিয়ে কোচিংয়ে যাইনা। বেশ কজন বন্ধুও জুটে যায় কোচিংয়ে। ওরাই বেশী কথা বলতো, আমি কেবলই শ্রোতা। একদিন ক্লাসের খাতা খুলে দেখি একটা ছোট চিরকুট, ছড়ামতো লেখা।
‘তোমার ঘন কালো চুলে নিত্য হারায়
আমার চোখের দৃষ্টি,
জানো মেয়ে তুমি বিধাতার যেন
অপরূপ এক সৃষ্টি।’
জীবনের প্রথম প্রেমপত্র বা বলা ভালো চিরকুট পেয়ে আমি পুরোপুরি দিশেহারা। বন্ধুরা সব নির্বিকার। তার মানে অন্য কেউ। পরের দিনের চিঠিটা পাই ব্যাগের সাইড পকেটে।
‘ আমার সকাল কেটে বিকেল যে হয়
তোমার কথাই ভেবে,
কথা দেবে কি এক জীবনে
আমারই শুধু হবে?’
আমাকে পুরোপুরি দিশেহারা বানিয়ে প্রায় প্রতিদিন চিরকুট আসতে থাকে কিন্তু আমি কিছুতেই খুঁজে পাইনা মানুষটাকে। বন্ধুরা শুনলে যদি হাসাহাসি করে তাই কাউকে কিছু বলি ও না।
এই চিঠির পেছনের মানুষটাকে ভেবে আমার পড়াশোনা শিকেয় উঠলো। বুয়েটের পরীক্ষায় ডাব্বা মেরে তবেই আমার অদেখা প্রেমিকের প্রতি প্রেমের ঝোঁক কাটলো। পড়াশোনায় পুরোপুরি মন দিলাম। ফলাফল কুয়েটে চান্স পেলাম। বলা ভালো আমার কোচিংয়ের বন্ধুদের প্রায় সবাই বুয়েটে চান্স পেয়েছে শুধু আমি আর রাহাত কুয়েটে।
পরিচিত একজন চান্স পাওয়াতে মনে একটু সাহস থাকলেও বাসা থেকে এতো দূরে হোস্টেলে যেয়ে থাকতে হবে মনে করে রোজদিন কান্নাকাটি করে দিন যাচ্ছিলো। অবশেষে একদিন বাক্সপ্যাটরা নিয়ে হাজির হলাম কুয়েট ক্যাম্পাসে। আমার জীবনের সবচেয়ে স্বর্নালী অধ্যায় কাটে এই ক্যাম্পাসে। ক্লাস শুরুর দুমাসের মাথায় জানতে পারি সেই অদেখা কবি আর কেউ নয়, রাহাত। তারপরের অংশটুকু শুধুই প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানোর গল্প। প্রেম পিরীতি যাই করি আমরা দুজনে পড়ালেখায় কিন্তু দারুন সিরিয়াস ছিলাম। ফাইনাল পরীক্ষার আগ পর্যন্ত জীবন নিয়ে তেমন একটা মাথা দুজনের কেউই ঘামাইনি। পাস করার সাথে সাথে রাহাত বন্ধুদের সাথে একটা ব্যবসায় জয়েন করে। আর আমিও চাকুরী পেয়ে যাই একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে।
এতোদিন পড়ার অজুহাতে নিজের বিয়ে ঠেকিয়ে রাখলেও এ বেলা বাবা মায়ের মুখোমুখি হতেই হয়। আমাদের ধারনা ছিল আমরা দুজনেই চাকুরী করবো, সংসার করবো, ভালো থাকবো; এতে নিশ্চয়ই দুই পরিবারের কারো আপত্তি থাকার কথা না। কিন্তু আমাদের সব ধারনাকে ভুল প্রমান করে দিয়ে দুই পরিবার এক সাথে ভেটো দিল আমাদের বিয়েতে। কারণ দুটো, আমরা সমবয়সী এবং আমরা প্রেম করেছি। দু পক্ষের একই অভিযোগ শুনে মনে হলো যেন তারা যুক্তি করেছে আমাদের বিয়ে দেবেনা বলে। দুজনেই গো ধরে রইলাম। আমার জেদের কাছে বাবা হার মানলেও মা সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘তোমরা বিয়ের পর নিজেদের নিয়ে ভালো থাকো, দোয়া রইলো। আমাদেরকে কোনভাবে তোমাদের কোন বিপদে বা প্রয়োজনে ডাকবেনা। আমরাও চেষ্টা করবো তোমাদের না ডাকার।’
আমরা দুজনে ভেবেছিলাম, বিয়ের পরে সব হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে কিছুই ঠিক হলোনা। দুই পরিবারই আমাদের একঘরে করে দিল। প্রথম প্রথম কাজ, নিজেদের সংসার গোছানোতে সময় গেলেও দিন দিন করে বাসার জন্য এতো খারাপ লাগতে লাগলো যে কোন কিছুই ভালো লাগতোনা। অনেকবার বাসায় ফোন দিয়েছি, মা আমার গলার স্বর শুনে ফোন নামিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে আমি প্রেগন্যান্ট হলাম। দু বাসাতেই জানালাম। কারোই কোন বিকার হলোনা। যেন আমরা শূন্য থেকে পৃথিবীতে এসেছি এবং এই পৃথিবীতে আমাদের কোনদিন কোন প্রিয়জন ছিল না।
মানুষ বোধহয় জীবনের সব কঠিন সময় কিভাবে কিভাবে পার করেই ফেলে। কিন্তু মনের গহীনে জমে যায় এক জীবনের তরে কিছু ছোট ছোট অভিমান যেগুলো কখনোই মুছে ফেলা যায়না। আমার দ্বিতীয় বাচ্চাটা হওয়ার সময় আমি এতো শরীরের কষ্ট পেয়েছি কিন্তু এবার আর কাউকে জানাইনি। রাহাত পুরো বাসা একা হাতে সামলেছে। আসলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ বেঁচে থাকার উপায় বের করেই ফেলে। বাচ্চা হওয়ার আগে ও পরে সমস্যা হওয়াতে আমি আর অফিসে জয়েন করিনি। ছোটবেলা থেকেই আর্ট আর ক্রাফটের প্রতি নেশা ছিল। সেটাকে কাজে লাগিয়ে ছোট করে একটা অনলাইন শোরুমের মতো করি। শুধু পরিচিত মানুষদের জানিয়ে। কয়েক বছরের মধ্যেই জমে ওঠে ব্যবসা।
হঠাৎ এক বিকেলে আমার আজন্ম পরিচিত একটা নাম্বার থেকে ফোন আসে; আমার বাসার ল্যান্ডফোন নাম্বার। ফোনের ওপাশে বাবার গলা। এতোদিন পর বাবার মুখে তিন্নি নামটা শুনে বুকের ভেতর যে কেমন করে উঠলো। গলার ভেজা ভাবটুকু লুকিয়ে কিছুক্ষণ কথা বললাম। মা নাকি আমাকে দেখতে চেয়েছে। বাসায় গেলে বাকী কথা বলবে। রাহাতকে জানালাম, কি করবো? আমার একলা কষ্টের দিনে ও আমার হাত শক্ত করে ধরেছিল, আজ শুধু বাবার ফোন পেয়ে ওর মতামত না জেনে বাবার বাসায় যেতে মন সায় দিল না।
আমাদের বাসাটা বাইরে থেকে আগের মতোই আছে। বাসায় যেয়ে যা দেখলাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। মা সিঁড়ি থেকে পরে পায়ের হাড় ভেঙে ফেলেছে। অপারেশন হয়েছে কিন্তু নড়াচড়া বন্ধ পুরোপুরি। বাবার হার্টে সমস্যা। বাসায় দুটো কাজের মেয়ে পুরো ঘর সামলাচ্ছে। অযত্নের ছাপ সর্বত্র। প্রসঙ্গত আমার বড় দু ভাই বোন দুজনেই কিছু বছরের ব্যবধানে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। মায়ের পা ভাঙার পর থেকে ওনার মনে হয়েছে আমার প্রতি উনি অন্যায় করেছেন। তাই আমাকে সরি বলার জন্যই আজ ডেকেছেন।
– মা, আমাকে আরো আগে জানালে কি আমি তোমার বিপদের দিনে পাশে থাকতামনা? মা হয়ে তুমি আমাকে এতো পর কিভাবে করে দিলে?
– তোর বিপদের দিনে তো আমি থাকিনি। কোন মুখে তোকে ডাকি তুই ই বল? আমাকে মাফ করে দিস।
ঐ রাতেই মা বাবা দুজনকেই জোর করেই আমার বাসায় নিয়ে আসি। মায়ের পা পুরোপুরি ভালো হওয়া পর্যন্ত আমি পুরোটা সময় মায়ের যত্ন নেই। রাহাত ও দারুন রকম সাহায্য করেছে। ছেলেমেয়েরা এতো বছর পর তাদের নানা নানুকে পেয়ে সারাক্ষণ হই হুল্লোড়ে বাড়ি মাতিয়ে রেখেছে।
…………….
অবশেষে মা আজ ক্রাচ ছাড়া নিজের পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরে যাচ্ছে। কি যে ভালো লাগছে এক জীবনে মায়ের যত্নটুকু নিতে পেরে। মায়ের মাথায় তেল দিয়ে বেনী করে দিতে দিতে বলছিলাম, ‘মা মনে আছে তুমি আমাকে এভাবে রোজ বেনী করে দিতে স্কুলে যাওয়ার সময়?’
– খুব মনে আছে। তিন্নি মা, তুই আর রাহাত এই কয়দিনে আমাকে তোদের ভালোবাসার মায়া দিয়ে বুঝিয়ে দিলি আমি তোদের প্রতি অন্যায় করলেও তোরা আমাকে তোদের ভালোবাসার কুঠুরীতে যত্ন করে রেখেছিলি। মা হিসাবে আমার তোকে নিয়ে খুব গর্ব হচ্ছেরে। তোর একটা জীবন যেন তোর মনের মতো সুখে কাটে আমার দোয়া রইলো। মায়ের প্রতি কোন কষ্ট রাখিস না।
মা কে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘মাগো, তুমি আমাকে আর কখনো দূরে ঠেলে দিওনা, তাতেই আমার চলবে।’ আর মনের ভেতর জমিয়ে রাখা অভিমানদের বললাম, ‘আজ থেকে তোমাদের দিলাম একেবারেই ছুটি।’
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস