অভিমান হাজারো পর্বঃ-৪
আফসানা মিমি
একসাথে নাস্তা তৈরী করতে ব্যস্ত অতশী আর অদিতি। তাদের দুই বউয়ের টুকটাক গল্প করার মাঝে বাধা দিয়ে লাবণ্য এসে খোঁচা মেরে বললো
—“বাহ ভালোই তো গল্পের আসর বসিয়েছেন দুই বউ মিলে। তা আজকে কি নাস্তা করতে পারবো নাকি না খেয়েই ভার্সিটি যেতে হবে?”
এই মেয়ের কথা শুনলেই মেজাজ খিঁচড়ে যায় অদিতির। নিজেকে যথেষ্ট সামলে অদিতি উত্তর দিল
—“লাবণ্য তুমি টেবিলে গিয়ে বসো। আমি খাবার আনছি।”
—“হ্যাঁ হ্যাঁ তাই করো। গল্প করে সময় নষ্ট না করে সেই সময়টাতে হাত লাগিয়ে কাজ করলেই তো তাড়াতাড়ি সেরে যায়। রসের আলাপ পরেও বসে করা যাবে।”
মেজাজ ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছে অদিতির। কেন জানি এই মেয়ের নাম শুনলেই তার শরীরে পোকায় কিলবিল করে। আবারো দাঁতে দাঁত চেপে মুখে হাসি টেনে বললো
—“হ্যাঁ আদরের ননদিনী, তুমি গিয়ে আর একটু অপেক্ষা করো।”
—“এই মেয়েটাকে আল্লাহ্ মানুষের সাথে কিভাবে ভালো করে কথা বলতে হয় সেই গুণটাই দেয়নি। সারাক্ষণ খিটখিট করতেই থাকে। অসহ্য!”
অতশী হেসে দিয়ে বললো
—“একমাত্র মেয়ে তো তাই। তাছাড়া সবার আদরেরও। আচ্ছা ভাবী একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো!”
—“হ্যাঁ বলো কি কথা!”
—“আপনি এ বাড়িতে এসেছেন কতদিন হলো?”
—“উম্ম…এইতো সামনের মাসে ৪ বছর হবে।”
—“লাবণ্য কি তখনও এরকমই ছিল?”
—“হ্যাঁ আর বোলো না! আমার আবার এমন বদমেজাজি মানুষকে খুব একটা পছন্দ নয়। আর দ্যাখো ভাগ্য করে এমন একটা ননদিনী পেয়েছি যে কিনা সারাক্ষণ কথায় কথায় মেজাজ দেখায়।”
—“যারা বেশি আদর পায় তারা একটু ঢঙীই হয়।” বলেই আবারো হেসে দিল অতশী।
—“হুম আদরে আদরে বাদর হয়েছে মেয়েটা। লাবণ্য যেন বাবার প্রাণভোমরা। আর ওর বড় ভাইয়ের চোখের মনি। তবে মা আর স্পন্দন খুব একটা আমলে নেয় না ওর ন্যাকামোগুলো।”
—“ভাবী চলেন নয়তো দেখা যাবে আবারো এসে কথা শুনাবে।”
অদিতি আর অতশী সবাইকে খাবার সার্ভ করছিল। তাদের শাশুড়ী বলে উঠলেন
—“আরে আমরা তো নিজেদের হাতেই নিয়ে খেতে পারবো। তোমরাও বসে যাও না! একসাথে বসে খেয়ে নাও।”
অদিতি বললো
—“সমস্যা নেই মা। আমরা দুজন পরে খেয়ে নিব। আপনারা খান।”
—“এখন খেলে সমস্যা কোথায়?”
—“না মা আসলে…”
তাদের কথার মাঝখানে লাবণ্য খাবার চিবাতে চিবাতে বিরস মুখে জবাব দিল
—“তাদেরকে নিয়ে এতো আদিখ্যেতা করছো কেন মা? এসব মানুষদের এতো মাথায় তুলতে নেই। পরে দেখা যাবে সবার মাথার উপর উঠে ধেই ধেই করে নাচছে।”
ইয়াসমিন বেগম বিরক্তিকর দৃষ্টি হেনে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললো
—“আমার কথার মাঝখানে তুই কথা বলছিস কেন? চুপচাপ বসে খা। খেয়ে ভার্সিটি যা।”
তারপর অতশীর দিকে তাকিয়ে বললো
—অতশী তোমার বাসায় ফোন দিয়েছিলে? কথা হয়েছে তাদের সাথে?”
—“হ্যাঁ আন্টি, গত রাতে আব্বু ফোন দিয়েছিল কথা হয়েছে।”
—“আচ্ছা। তা তুমি এবার কিসে পড়ো যেন!”
—“বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষ। সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা।”
—“পরীক্ষা দিবে না তুমি? বেশিদিন তো নাই বোধহয়।”
—“হ্যাঁ আন্টি আসলে……”
অতশীর কথার মাঝখানে বাগড়া দিয়ে লাবণ্য বলে উঠলো
—“আপনি মা’কে আন্টি আন্টি করছেন কেন? বিয়ের পর শ্বশুর শাশুড়ীকে বাবা মা বলে ডাকতে হয় সেটাও কি জানেন না? আপনার বাবা মা কি আপনাকে এটুকু শিক্ষাও দেয়নি জন্মের পর?”
লাবণ্যর দিকে তার মা চোখ গরম করে তাকালো। লাবণ্য সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আবারো সমানতালে বলতে শুরু করলো
—“অবশ্য কি শিক্ষাই বা দিবে! যত্তসব গাঁইয়া, আনকালচার্ড! থার্ডক্লাস ফ্যামিলি থেকে উঠে এসে হাইবর্ন ফ্যামিলিতে ঢুকে পড়েছেন। যেন সাপের পাঁচ পা দেখে ফেলেছেন! বড়দেরকে সম্মান করার গুনটাও থাকতে হয়। আপনার মাঝে তো তার ছিটেফোঁটাও নেই দেখছি।”
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
লাবণ্য তার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তাকে থাপ্পড় মারার প্রবল ইচ্ছাটা বহুকষ্টে দমন করে তেতে উঠে তার মা বললেন
—“লাবণ্য! মুখ সামলে কথা বল বলে দিচ্ছি! কাকে কি বলছিস ভেবে বলছিস তুই? বড়দের সম্মান করার গুনটা তোর মাঝে আদৌ আছে তো! কেমন গুনী তুই তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে বলে আমার মনে হয় না। আর কাকে তুই থার্ডক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে বলছিস? কে কেমন ফ্যামিলি থেকে বিলং করে তা তার উপর দেখে বুঝার উপায় নেই। ওর মতো হতে পারবি তুই? এতো অহংকার ভালো না বুচ্ছিস? পস্তাতে হবে ভবিষ্যতে এই বলে দিচ্ছি। পরবর্তীতে যেন আর কখনো এমন করে কথা বলতে না দেখি ওর সাথে। একেবারে বখে গেছিস আদরে আদরে।”
লাবণ্যর কথাগুলো যেন অতশীর গায়ের চামড়ায় কাঁটার মতো বিঁধে শরীর ক্ষতবিক্ষত করে হাড় ভেদ করে কলিজায় গিয়ে আঘাত করেছে বারবার। আর কিছু সহ্য করতে পারলেও সে বাবা মা কে নিয়ে কোনপ্রকার কটু কথা সহ্য করতে পারে না। এর চেয়ে দুইটা থাপ্পড়ও অনেক ভালো। চোখ থেকে আপনাতেই অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছিল। কিন্তু পরে তার শাশুড়ীর কথায় গায়ের ক্ষত এবং কলিজায় যেন মলম লাগানোর ন্যায় স্বস্তি পেল। শাশুড়ীর কথায়ও চোখে পানি এসে গেল। কিন্তু কোনটা কষ্টের পানি আর কোনটা আনন্দের পানি বুঝা বড় দায়। বড় কপাল করে এমন শাশুড়ী পেয়েছে সে। এজন্য হাজার শুকরিয়া আল্লাহর কাছে।
স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন
—“আর তুমি! তোমার সামনে বসে যে তোমার মেয়ের মুখ দিয়ে যা তা বের হচ্ছে তোমার কানে কি যাচ্ছে না সেসব? সময় থাকতে মুখে লাগাম টানতে বলো তোমার মেয়েকে। এর কিন্তু ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে এই বলে দিচ্ছি!”
—“লাবণ্য তোর কিন্তু এভাবে কথা বলা মোটেও উচিৎ হয়নি। ও মাত্রই এসেছে এ বাড়িতে। ওর সাথে এমন ব্যবহার করলে আমাদের ব্যাপারে ও কি ভাববে বল তো! এরকম ভুল আর কখনো করবে না।”
—“তোমরা দুজন এই মেয়েটার জন্য আমাকে বকা দিচ্ছো? আসতে না আসতেই ও তোমাদের কাছে আপন হয়ে গেল আর আমি পর হয়ে গেলাম?”
এবার একটু শান্ত হয়ে ইয়াসমিন বেগম বললেন
—“দ্যাখ লাবণ্য, তোরও একদিন বিয়ে হবে, তুইও পরের বাড়ি যাবি একদিন। যে যেমন কর্ম করে সে তেমনই ফল ভোগ করে। তোর ভালোর জন্যই বলছি এসব।”
—“থাক আমার ভালো তোমার চায়তে হবে না। আমারটা আমিই বুঝে নেব।”
এতোক্ষণে লাবণ্যর বড় ভাই আদিল মুখ খুললো
—“মা এবার থামো তো! অনেক হয়েছে কথা কাটাকাটি। কিরে বনু লেখাপড়া কেমন চলছে তোর?”
—“হ্যাঁ ভাইয়া খুব ভালো। ভাইয়া আমার না কিছু টাকা লাগবে।”
—“কত?”
—“এই ধরো হাজার দশেক।”
—“আচ্ছা আমার ওয়ালেট থেকে নিয়ে নিস।”
মেয়ের দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো
—“এতো টাকা দিয়ে কি করবি তুই?”
মায়ের এমন প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উত্তর দিল
—“আমার এক ফ্রেন্ডের বার্থডে। তাকে সারপ্রাইজ দিব।”
স্বামীর দিকে গরম চোখে চেয়ে বললো
—“মেয়েকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলছো। যখন যা আবদার করে তাই পূরণ করছো। যত টাকা চাচ্ছে ততই দিচ্ছো। যেন টাকার দুইটা গাছ পেয়েছে! ঝাঁকি দিবে আর টাকা ঝরবে। ভবিষ্যতে এর ফল যে কি হবে বুঝতে পারছো তোমরা? পরের বাড়ি গিয়ে এমন বিলাসিতা করতে পারবে? কপালে কি না কি লেখা আছে আল্লাহ্ ভালো জানেন।”
মুখে হালকা হাসি এনে আরমান সাহেব বললেন
—“আমার মেয়ের জন্য পাতাল ফেড়ে হলেও রাজপুত্র আনবো। যে কিনা মাথার তাজ বানিয়ে রাখবে আমার মেয়েকে।”
—“হ্যাঁ আরো আহ্লাদ করো মেয়েকে নিয়ে। যেমন বাপ তার তেমন মেয়ে!”
রাগে গজগজ করতে করতে ডায়নিং টেবিল ত্যাগ করলো ইয়াসমিন বেগম। খাওয়া শেষ করে একে একে সবাই বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল।
স্পন্দন যাওয়ার আগে অতশীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে চোখে চোখ রেখে বললো
—“তুমি কি কান্না করেছো?”
স্পন্দনের হঠাৎ এমন অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকানো দেখে অতশী ঘাবড়ে গেল। কোনমতে বললো
—“ন্..না না কান্না করবো কেন?”
—“তাহলে চোখমুখ এমন ফুলে লাল হয়ে আছে কেন?”
—“পে্..পেঁয়াজ, হ্যাঁ পেঁয়াজ কেটেছিলাম। তার জন্য চোখ দিয়ে পানি পড়েছে।”
কথাটা স্পন্দনের কেন জানি পছন্দও হয়নি বিশ্বাসও করতে পারছে না।
—“আচ্ছা, নেক্সট টাইম আর পেঁয়াজ কাটাকাটিতে যাওয়ার দরকার নেই। আর সারাদিনের খাবার ঠিকমতো খাবা। এসে যদি শুনি যে খাওনি তাহলে কিন্তু খবর আছে বলে দিচ্ছি!”
ভাগ্যিস খাবার টেবিলে সবার শেষে এসেছিল স্পন্দন! নয়তো লাবণ্যর কথাগুলো যদি শুনতো তাহলে আজ একটা কুরুক্ষেত্র ঘটে যেতো এ বাসায়। কারণ অতশী জানে স্পন্দন নিজে যত যা-ই করুক না কেন, থার্ড পার্সন তার অতশীকে কষ্ট দিবে আর সে বসে বসে দেখবে এমন মানুষ সে নয়। যদিও স্পন্দন নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে এমন করছে। তবুও দোষ তো তারই। স্পন্দন তাকে কষ্ট দিলে সে যতটা না কষ্ট পায়! তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি কষ্ট পায় স্পন্দন।
—“বাহ্ বা! কি ভালবাসা দেখেছো? আমার দেবরের এতো আদর ভালবাসা কই রাখো গো দেবরাণী? লোড নিতে পারো তো!”
স্পন্দনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হাসছিল অতশী। হঠাৎ পিছন থেকে কথাগুলো ভেসে আসায় ফিরে দেখে অদিতি মুচকি মুচকি হাসছে কথা বলার শেষে। লজ্জা পেয়ে যায় সে কথাগুলো শুনে।
—“ভাবী! ইশ আপনিও না!”
লজ্জায় রাঙা হয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে অতশী। তার এমনভাবে চলে যাওয়া দেখে অদিতি উচ্চস্বরে হেসে ওঠলো।
…
—“জান আমরা কবে বিয়ে করছি? আমার কিন্তু এক মুহূর্তও তোমাকে ছাড়া থাকতে ভালো লাগে না।”
—“এইতো আর মাত্র কয়েকটা দিন সোনা। আম্মুকে তোমার কথা বলেছি। এখন আম্মু বুঝিয়ে সুঝিয়ে আব্বুকে বললেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তোমাদের বাসায় যাবে। আর তারপর তুমি আমার হবে চিরস্থায়ী ভাবে।”
—“জানো তোমার সাথে ঐ লাবণ্যকে একদম সহ্য করতে পারি না আমি। দেখলেই আমার পিত্তি জ্বলে ওঠে।”
—“আরে ও তো আমার জাস্ট ফ্রেন্ড। হুম্ম্ম্ম্ম…পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি আশেপাশে। কারো কি কলিজা পুড়ছে এই মুহূর্তে? গন্ধটা কিন্তু বেশ ইয়াম্মি!
—“যাহ্! তুমি আসলেই একটা দুষ্টু। আমি সিরিয়াস আর তুমি কিনা মজা করছো আমার সাথে! যাও কোন কথা নাই তোমার সাথে।”
গাল টেনে দিয়ে বললো
—“ওলে ওলে আমার বাবুতা রাগ করেছে! আচ্ছা যাও আজকের পর থেকে লাবণ্যর সাথে আর বেশি মিশবো না ওকে!”
—“প্রমিস!”
—“পাক্কা প্রমিস।”
লাবন্যকে এদিকে আসতে দেখে মীমকে ভুলভাল বুঝিয়ে তাকে সেখান থেকে বিদায় করে লাবণ্যর দিকে এগিয়ে গেল রনক।
—“তোমার আসতে এতো লেট হলো কেন জান? তোমার চিন্তায় চিন্তায় তো আমি মরেই যাচ্ছিলাম। তোমাকে দেখেই যেন আমার দেহে প্রাণ ফিরে পেলাম।”
লাবণ্যর জন্য রনকের এতো চিন্তা দেখে নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে করে লাবণ্য।
—“আর বোলো না রাস্তায় যা জ্যাম! তাড়াতাড়ি আসার উপায় আছে!”
—“ইশ মুখের কি হাল হয়েছে দেখেছো গরমে? একেবারে লাল টমেটো হয়ে গেছে গালদুটো। ”
বলেই লাবণ্যর মুখের ঘাম মুছে দেবার বাহানায় রনক ওর মুখটা ছুঁয়ে দিল। এই মেয়েটা এতো বোকা কেন? মেয়েটা ওর কথা খুব সহজেই বিশ্বাস করে ফেলে। যাকে বলে অন্ধবিশ্বাস। রনক ভাবতেও পারেনি যে মেয়েটা ওর প্রেমে এভাবে হাবুডুবু খাবে! সে যেন লাবণ্যর আত্মা। লাবণ্যর কাছে পৃথিবীর বাকিসব একদিকে আর সে একদিকে।
—“জান চলো না আজকে একটু নিরিবিলিতে সময় কাটাই দুজনে! কতদিন হলো তোমাকে একটু কাছে পাই না! একটু মন ভরে দেখতে পারি না! তোমার এই মুখটি দেখলে স্বর্গসুখ পাই আমি তুমি কি জানো?”
রনকের মুখ থেকে বের হওয়া প্রতিটি শব্দই লাবণ্য চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে। আর আপনমনেই ভাবে রনক আমাকে কত ভালবাসে! মনে হয় না এভাবে আর অন্যকেউ ভালবাসতে পারবে আমাকে।
“লাবণী একটু দাঁড়াবে। দুই মিনিট কথা বলার সুযোগ দিবে আমাকে?”
রনককে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যাচ্ছিল লাবণ্য। পরিচিত এই কণ্ঠটা পিছন থেকে শুনে মুখে বিরক্তির রেখা ফুটে ওঠলো তার। এই ছেঁচড়াটা জীবনেও মনে হয় ওর পিছু ছাড়বে না। চোখমুখ কুঁচকে পিছন ফিরে সামিরের উদ্দেশ্যে বললো
—“ছেঁচড়ার মতো এভাবে আমার পিছনে পড়ে আছিস কেন ফকিরের বাচ্চা? সুন্দরী মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না তোদের?”
লাবণ্যর কথা শুনে মুহূর্তেই চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো সামিরের। আর যাই হোক ভালবাসার মানুষের অবহেলা সহ্য করা কোন প্রেমিক প্রেমিকার জন্য সুখকর অনুভূতি নয়। তবুও শত অবহেলা সত্ত্বেও ভালবাসার মানুষটার মুখখানি দেখলেও মনে প্রশান্তি আসে। লাবণ্য সামিরকে শত অপমান করলেও লাবণ্যর মুখটা দেখলে সেসব কিছু মনে থাকে না তার।
—“আমি আসলেই বুঝে পাই না আমার পিছনে কুকুরের মতো এভাবে ঘুরঘুর করার কারন কি তোর?”
নিজেকে সামলে ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে সামির জবাব দিল
—“ভালবাসার মানুষের পিছনে ঘুরঘুর করি এতে দোষের কি আছে?”
—“তুই আসলেই একটা বেহায়া। লজ্জা শরমের ছিটেফোঁটাও তোর মাঝে নেই। নাহলে এতো অপমানের পরও কেউ এভাবে বেহায়ার মতো আমার পিছনে পড়ে থাকতো না।”
—“সবাই আর আমি কি এক হলাম নাকি! আমি তোমাকে ভালবাসি। তাই শত অপমান, অবহেলা, দুর্ব্যবহার করার পরও তোমার মুখটা না দেখলে শান্তি পাই না। শুধু মনে হয় কি যেন একটা নেই। বুকের ভিতরটা ফাঁকা লাগে। তাই অবহেলা পাব জেনেও তোমার ঐ মায়াবী মুখটা দেখার জন্য ছুটে আসি বারবার। আর তুমি জানো না ভালবাসায় লজ্জা শরম থাকতে নেই! নাহলে ভালবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়া যায় না।”
—“হেই ইউ, ব্লাডি বীচ! তোর সাহস তো কম নয়। তুই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমারই গার্লফ্রেন্ডকে বুক ফুলিয়ে ভালবাসার কথা বলছিস।” দাঁতে দাঁত চেপে কলার চেপে ধরে কথাটা বললো রনক।
জোর করে হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললো
—“যাকে ভালবাসি তার কাছে তা প্রকাশ করতে দোষ কোথায়? আর আপনি আমাদের মাঝে কথা বলার কে? দেখছেন না আমি আর লাবণী কথা বলছি! আপনি জানেন না দুইজন মানুষ যখন ইম্পোর্টেন্ট কথা বলে তখন তার মাঝে অপর ব্যক্তি এসে বাধা দেওয়া কতটা ম্যানারলেস আচরণ!”
—“শালা তোর এতো বড় সাহস! আমাকে ম্যানার্স শেখাতে আসিস! আর আমার দিকে আঙুল তুলছিস? এই রনক আহমেদ খানের দিকে! আর ভুলে যাস না আমি কিন্তু লাবণ্যর বয়ফ্রেন্ড।” আঙুল তুলে শাসিয়ে কথাগুলো বললো রনক।
রনককে সামিরের সামনে থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে লাবণ্য বললো
—“এসব ছোটলোকের সাথে লাগতে যেও না তো রনক। কোত্থেকে যে আসে এগুলা! রাস্তার পা চাটা কুকুরদের মতো সারাক্ষণ পিছনে ঘুরঘুর করে। মুডটাই নষ্ট করে দিল।”
—“আর কোনদিন যদি লাবণ্যর আশেপাশেও দেখি তাহলে তোর কি অবস্থা হবে তা আর নাইবা বললাম। মাইন্ড ইট!”
—“আমি লাবণীকে ভালবাসি। তাই বারবার ওর কাছে আমি ফেরত আসবো। সে যতই অপমান করুক না কেন! ওর পিছু আমি ছাড়ছি না এ জন্মে। আর না ছাড়বো পরের জন্মে।”
—“কি লাবণী লাবণী করছিস তুই হ্যাঁ? আমার নাম লাবণ্য ওকে! মাথায় ভালো করে ঢুকিয়ে নে। আর নেক্সট টাইম যদি দেখি তুই আমাকে ফলো করছিস অথবা আমাকে ডিস্টার্ব করার চেষ্টা করিস তাহলে তোর নামে আমি মানহানির মামলা করবো। মনে রাখিস কথাটা।”
তাদের গমনপথের দিকে এক পাহাড়সম কষ্ট নিয়ে তাকিয়ে রইলো সামির। লাবণ্যর ব্যবহার আসলেই অনেক কষ্ট দেয় সামিরকে। তার ভালবাসা যদি সত্যিকারের হয়ে থাকে তাহলে একদিন না একদিন তার কাছে শত বাধা পেরিয়ে হলেও ফিরে আসবেই। এটাই তার বিশ্বাস। কিন্তু তাকে চেষ্টাও করে যেতে হবে। ঐ রনকের বিশাল কালো হাতের থাবা থেকে লাবণ্যকে মুক্ত করতে হবে।
রনক, যে কিনা কোটিপতি বাপের একমাত্র বখে যাওয়া ছেলে। সিগারেট, মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, মারিজুয়ানা, মেয়েদের নেশাসহ বিভিন্ন জঘন্যতম কাজে লিপ্ত। এমন কোন রাত বাকি নেই যে মেয়েদেরকে সে শয্যাসঙ্গিনী বানায় না। বাপের কালো টাকার বেশিরভাগই তার দ্বারা বেআইনীভাবে আত্মসাৎ করা। সাথে নারী পাচারের ব্যবসা তো আছেই। এ সব কিছু সামির খোঁজ নিয়ে জেনেছে তার এক এসিপি বন্ধুর কাছ থেকে। যে কিনা রনক এবং তার বাবার সকল পাপকার্যের লিস্ট বানাচ্ছে ধীরে ধীরে। যাতে সময় সুযোগ বুঝে গ্রেফতার করতে পারে।
কিন্তু এসব লাবণ্যকে কে বলতে যাবে! সামির নিজে যদি গিয়ে এসব বলে তাহলে বিশ্বাস তো করবে না-ই, বরং উল্টো ভুল বুঝে অশ্রাব্য গালিগালাজ করবে। এখন তো যা-ই একটু দেখা হয় মাঝে মাঝে কথা হয়। হোক সেটা অপমান করে কথা বলা। তবুও এতে শান্তি পায় সে। ঐ মুখটা একদিন দেখতে না পেলেই দমবন্ধ লাগে। দেখা যাবে সে এসব বলার পরে তো তাকে বিশ্বাস করবেই না বরং ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিবে। তবে এ সত্যের মুখোমুখি তো হতেই হবে একদিন। কিন্তু তার আগেই না লাবণ্যর কোন ক্ষতি হয়ে যায়! ভাবতেই গায়ের পশম কাঁটা কাঁটা হয়ে ওঠে।
চলবে……….