অভিমান হাজারো পর্বঃ-১

0
4904

অভিমান হাজারো পর্বঃ-১
আফসানা মিমি

অতশী মাথা নিচু করে ঘোমটা দিয়ে বিছানার মাঝখানে বসে আছে। একটা অচেনা, অজানা মানুষের ঘরে বসে আছে। সে ভাবতেও পারেনি আজ তার বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়ে যাবে। যদিও বিয়েটা ভাঙতে চায়নি কিন্তু বিয়েটা করতেও চায়নি। পারলো না সে। ব্যর্থ হয়েছে সে। কি দরকার শুধুশুধু একটা মানুষের জীবন নষ্ট করার? যে কারনে নিজের ভালবাসার মানুষটাকেই দূরে সরিয়ে দিয়েছে। সেখানে এখন থেকে অন্য একটা মানুষ, সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা মানুষের সাথে তার মিথ্যে অভিনয় করে যেতে হবে। এই রাতটা নিয়ে কতই না স্বপ্ন দেখত দুজন! স্বপ্ন দেখতে দেখতে কল্পনার রাজ্যে বিচরন করতো তারা। সেই সুখময় দিনগুলোর কথা ভেবে ভেবে চোখের পানি ঝরাচ্ছে অতশী। সে তো এরকমটা চায়নি। এ কি হয়ে গেল তার সাথে!

অনেকক্ষণ পর সে মাথাটা হালকা তুলে রুমের ভিতরের চারপাশটা দেখতে লাগলো। এতক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকার কারনে ঘাড়ের হালকা টান পড়েছে। মাথাটা বার কয়েক এদিক সেদিক করার সময় চোখ পড়লো পুরো কক্ষের ডেকোরেশনে। চোখ ঘুরিয়ে একবার দেখেই যেন হঠাৎ বুকটা ধুক করে উঠলো। তার কল্পনার সাথে এতটা মিল কিভাবে এই রুমের? বিস্মিত নয়নে এদিক সেদিক বারবার তাকাচ্ছে। রুমটা বেশ বড়। দেয়ালের তিনপাশেই জানা অজানা বিভিন্ন আর্টিষ্টদের আঁকা পেইন্টিং ঝুলানো। খাট রাখা হয়েছে রুমের দক্ষিণ-পশ্চিম কর্ণারে। খাটের দক্ষিণ পাশে বড় এক জানালা। তাতে নীল রঙের থাই গ্লাস লাগানো। থাই গ্লাস ভেদ করে বাইরের হালকা আলো রুমে ঢুকছে। খাটের ঠিক কয়েক ফিট দূরত্বে পূর্ব-দক্ষিণ কর্ণারে একটা ড্রেসিংটেবিল ও একটি টুল রাখা। খাটের ঠিক উত্তরপাশে ছোট একটা বুকশেলফ। যাতে তার পছন্দের রাইটারদের বই সাজানো। ড্রেসিংটেবিলের উত্তরপার্শ্বেই আরেকটি জানালা, তাতেও থাই গ্লাস লাগানো। যাতে করে সকালের প্রথম সূর্যটা চোখে লাগে সেভাবেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। পূর্বপাশে রুমের সাথে লাগোয়া ব্যালকনি। পশ্চিমপাশে সোফা সেট রাখা সামনে একটা কাচের সেন্টার টেবিল, উত্তরপাশে কেবিনেট আর একটা ওয়্যারড্রোব। দুইটার মাঝখানে একটা দরজা। এসব ঘুরেফিরে দেখে আবারো খাটের কোণায় বসলো। অবাক হয়ে ভাবছে এটা কি করে সম্ভব? তার মনের কথাগুলো একমাত্র স্পন্দনই জানতো।

স্পন্দন! স্পন্দনের কথা মনে পড়তেই আবারো চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। কি করছে এখন পাগলটা! তার এখন কি অবস্থা! নিশ্চয়ই পাগলামো করছে তার বিয়ের কথা শুনে! অতশী ভাবন রাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরে এলো বিকট একটা আওয়াজে। জোরে দরজা খুলার আওয়াজ। মাথা নিচু করেই বসে রইল সে। বুঝার চেষ্টা করছে হঠাৎ এরকম করার মানে কি? যার সাথে বিয়ে হয়েছে বিয়ের আগে তাকে দেখে মোটামুটি ভদ্রই মনে হয়েছিল। বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার সাথে সাথেই অতশী অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। যখন তার জ্ঞান ফেরে তখন সে তাকে গাড়িতে আবিষ্কার করে। তার বরের কাঁধে মাথা রেখে বসেছিল সে। নিজেকে সামলে সোজা হয়ে বসে গুটিসুটি মেরে। তার বর জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। একটা কথাও বলেনি তার জ্ঞান ফেরার পর। এখন আবার এতো জোরে দরজা খুলেছে। কোন সমস্যা হয়েছে কি?

তার বরের ভাবগতি বুঝার চেষ্টা করছে সে। রুমের এ মাথা থেকে ঐ মাথা পায়চারি করছে। মুখের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না। তাই পায়ের দিকেই তাকিয়ে আছে অতশী। হঠাৎ করেই গা থেকে শার্টটা খুলে ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলল এবং ধপাস করেই সোফায় দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লো।

এটা কি হলো! আজব তো! লোকটা এমন করছে কেন? মনে হচ্ছে ছেঁকা খেয়ে বাঁকা হয়ে গেছে। যেন গলায় ছুরি ধরে জোর করে বিয়ে করানো হয়েছে। অতশী গুটিসুটি মেরে বসে এসবই ভাবছিল। তার ভাবনার রাজ্যে আবারও বাধা পড়লো খুব পরিচিত, অতি পরিচিত একজনের কণ্ঠ শুনে। কণ্ঠটা শুনেই যেন তার হঠাৎ করেই হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। ডান হাতে বুকের বাঁ পাশটায় জোরে চেপে ধরে বড় একটা নিঃশ্বাস নিলো। আচ্ছা তার কান ভুল শুনছে না তো!

“এ্যাই মেয়ে, বিছানা থেকে নামো।”

অতশী নিজের কানকে ভুল প্রমান করার জন্য সামনে দাঁড়ানো লোকটার দিকে তাকালো। কিন্তু না, তার কান তো ভুল শুনেনি। বরং তার চোখও ভুল দেখছে না। সে তার অতি পরিচিত মানুষটাকেই দেখতে পেলো। তার চোখে মুখে যেন স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ লেগে আছে। এখানে সে তাকে মোটেও আশা করেনি। আচ্ছা তার চোখ ভুল দেখছে না তো!

“কি হলো কথা কানে যাচ্ছে না? কোলে করে নামাতে
হবে আপনাকে?”

ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারছে না অতশী। চারপাশের সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা লাগছে আর চারপাশটা ঘুরছে। মাথার ভিতরটা ভনভন করছে।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


ধরফরিয়ে অতশী উঠে বসল। তার মুখে কে যেন এক বালতি পানি ঢেলে দিয়েছে। তাকিয়ে দেখে তার বর মহাশয় হাতে একটা গ্লাস নিয়ে ভ্রু কোঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো তার যে আসলে কি হয়েছে। যখন বুঝতে পারলো গ্লাসের সবটুকু পানি তার মুখে মারা হয়েছে সে কিছুটা রেগেই গেল। ঝাঁঝালো সুরে বললো

—“এটা কি করেছো তুমি? আর তুমি এখানে কি করছো?”
গ্লাসটা সজোরে সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে বললো
—“কাকে আশা করেছিলে? তোমার ঐ সো কল্ড বয়ফ্রেন্ডকে?”
—“হ্যা তাকেই আশা করেছিলাম। কারন তার সাথেই আমার বিয়ে হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক নয় কি?”
—“না স্বাভাবিক নয়। কারন বিয়েটা তোমার আমার সাথেই হয়েছে।”
—“অসম্ভব! আমি বিশ্বাস করি না।”
—“না করলে নাই। আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দিয়ে সরো এখান থেকে! ঘুমাবো আমি।”
—“তার আগে আমার প্রশ্নের উত্তর চাই।”
—“আমি বাধ্য নই কোন ঠগ, প্রতারকের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার।”
অতশী তার সামনে গিয়ে টিশার্টের কলার চেপে ধরে বললো
—“মুখ সামলে কথা বলো!”

অতশীকে ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিল। আর চিৎকার করে বললো
—“তোমার কোন স্থান আমার জীবনে নেই। যে বিশ্বাসঘাতকতা আমার সাথে করলে তার ক্ষমা হয় না। তোমার মতো মেয়েদের স্থান হয় পায়ের নিচে। আমার বিশ্বাস, ভরসা, ভালবাসা সব ভেঙে তছনছ করে দিয়েছো তুমি। আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করতে বিয়ের পিড়িতে বসে গেলে! একটাবারও কি আমার মুখটা তোমার চোখে ভাসেনি? আমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো কি একবারও মনে পড়েনি? কিভাবে পারলে এমন একটা কাজ করতে? কিভাবে? বিবেকে বাঁধলো না তোমার? অন্তত আমার চোখে এতো নিচু না হলেও পারতে!”

—“আমাকে শুধুশুধু ভুল বুঝে লাভ নেই। তোমার ভালোর জন্যই এমনটা করতে বাধ্য হয়েছি আমি।”
—“অন্য আরেকজনকে ড্যাংড্যাং করে বিয়ে করতে যাচ্ছিলে এতে আমার ভালোটা কোথায় বলতে পারো?”
—“বুঝার চেষ্টা করো প্লিজ!”
—“আর একটা কথাও না। ভেবো না বিয়ে করেছি বলে আগের মতোই ভালবাসবো! আজকের পর থেকে আমার সাথে মেশার চেষ্টাও করবে না। আমার থেকে কয়েক হাত দূরত্ব বজায় রেখে চলবে। আর এই বিছানায় তোমার কোন জায়গা নেই। যাও ফ্লোরে শুয়ে পড়ো।

চলে যাচ্ছিল ফিরে এসে আঙুল তুলে আবারো শাসিয়ে গেল
—“আমাদের সম্পর্কের কথা এই চার দেয়াল ছাড়া আর একটা কাক পক্ষীও যেন টের না পায়! মাইন্ড ইট। যাও নামো বিছানা থেকে। ঘুমাবো আমি।”

বলেই অতশীকে আবারো ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেললো। এবার অতশী নিজেকে আর আঁটকে রাখতে পারলো না। একটু জোরেই আওয়াজ করে কেঁদে দিল।

—“ন্যাকা কান্না বন্ধ করে আমাকে ঘুমোতে দাও। অসহ্য!”

স্পন্দনের এসব ব্যবহার অতশী নিতে পারছে না। কিন্তু তার সহ্য করতেই হবে। তার নিজের দোষে এমন হচ্ছে। যে স্পন্দন তাকে কখনো কোন কটূ কথা বলতো না সে কষ্ট পাবে বলে। আর আজ সেই স্পন্দন তাকে কাঁটা বিঁধিয়ে কথা বলছে! অবশ্য এরকমটাই হওয়ার ছিল। তার নিজের সাথে এমন হলেও সে এর চেয়েও খারাপ ব্যবহার করতো হয়তোবা।

চুপচাপ ব্যালকনিতে চলে গেল অতশী। এই মানুষটাকে সে অনেক বড় কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। আর কোন কষ্ট দিবে না সে। যতদিন এই পৃথিবীর আলো বাতাস সে গ্রহন করবে ততদিনই সে স্পন্দনকে সবকিছু উজার করে ভালবাসবে। মন, প্রাণ, দেহ সবকিছু।

স্পন্দন চোখ বন্ধ করে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। সবকিছুরই যেন অসহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না অতশী এমন একটা কাজ করতে যাচ্ছিল। দম বন্ধ হয়ে আসছিল যখন সে তাকে বিয়ের সাজে দেখেছিল।

আজকের দিনটায় অনেক প্রবলেম ফেস করতে হয়েছে তার। কেন যেন অফিসে কিছুতেই মন বসছিল না। এমনিতেই অতশী কয়েকদিন যাবৎ তার সাথে খুব অদ্ভুত ব্যবহার করছিল। তাকে নাকি আগের মতো আর ভালো লাগে না। কোন ফিলিংস আসে না তার প্রতি। অখচ এখন পর্যন্ত তার হাত ধরলেই সে কেঁপে ওঠে। তার চোখে এখন পর্যন্ত চোখ রেখে কথা বলতে পারে না। শত বলে কয়েও তার মুখ থেকে একবার ‘ভালবাসি’ শব্দটা উচ্চারন করানো যায় না। আর সে বলে কিনা…..

বেশিক্ষণ অফিসে মন টেকেনি তাই বেড়িয়ে এসে টঙের দোকানে বসে এক কাপ চা হাতে নিলো। চুমুক দিতে যাবে তখন সেলফোনটা বেজে ওঠে। ভ্রু কোঁচকে বিড়বিড় করতে করতে ফোনটা পকেট থেকে বের করে দেখে অয়নের ফোন। অয়ন তার বেস্ট ফ্রেন্ড।

—“কিরে হঠাৎ কল দিলি যে! কোন সমস্যা?”
—“তুই কোথায় স্পন্দন? একটু সিটি হাসপাতালে আসতে পারবি?”
—“হাসপাতালে? কেন? কার কি হয়েছে? তোর কণ্ঠ এরকম শুনাচ্ছে কেন?”
—“আব্বুর শরীরের কন্ডিশন অনেক খারাপ। তিন ব্যাগ রক্ত লাগবে। অপারেশনে প্রচুর রক্ত ক্ষয় হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব রক্ত দিতে হবে। নাহলে আব্বুকে বাঁচানো যাবে না। তুই তাড়াতাড়ি আয় ভাই। বলেই কেঁদে দিল।
—“আচ্ছা শান্ত হ তুই আমি আসছি।”
—“হ্যা তাড়াতাড়ি আয়।”

অয়নের বাবার কিডনিতে পাথর হয়েছে। এমনিতেও শরীর অনেক দূর্বল। তাই তিন ব্যাগ রক্ত লেগেছে। স্পন্দনের শরীর থেকে দুই ব্যাগ নেয়া হয়েছে। আরেক ব্যাগ অয়নের দুলাভাই দিয়েছে। আর কারো সাথেই রক্তের গ্রুপ মিলছিল না বিধায় তাদের দুজনকেই দিতে হয়েছে। অয়নের বাবার অবস্থা রক্ত দেয়ার পর এখন অনেকটাই ব্যাটার।

রক্ত দিয়ে কিছু ফলমূল খেয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে এলো। আসার সময় তাকে জড়িয়ে ধরে অয়ন অনেক কাঁদছিল। টালমাটাল পা ফেলে হাঁটছে স্পন্দন। শরীরটা খুব দূর্বল লাগছে। তার মন চাচ্ছে এই রাস্তার ফুটপাতেই শুয়ে পড়তে। রাস্তার পাশে একটা টুল দেখতে পেয়ে সেখানে ধপ করে বসে পড়ল। ক্লান্তিতে ভেঙে আসতে চায়ছে শরীরটা।

সেলফোনটা কর্কশ শব্দে বেজে ওঠলো। এই শব্দটাও অসহ্য লাগছে স্পন্দনের কাছে। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরা মাত্রই কারো উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠ শোনা গেল।

—“ভাইয়া, ভাইয়া কোথায় আপনি?”

মোবাইলটা সামনে এনে দেখে আফরার ফোন। আফরা অতশীর বেস্টফ্রেন্ড।
—“কি হয়েছে আফরা? তোমাকে এত উত্তেজিত লাগছে কেন? কারো কিছু হয়েছে কি?”
—“ভাইয়া অতশীর বিয়ে আজকে।”

কথাটা মাথায় ঢুকতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলো। মস্তিষ্কের হরমোন যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
যা শুনছে ঠিক শুনছে তো নাকি ভুল! মোবাইলটা হাত থেকে পড়েই যাচ্ছিল। শক্ত করে কানে ঠেকালো। কনফার্ম হওয়ার জন্য আবারো জিজ্ঞাসা করলো

—“কি? কি বললে তুমি?”
—“অতশীর বিয়ে আজকে। ইনফ্যাক্ট ও এখন কনে সেজে বসে আছে রুমে।”
—“তুমি আমার সাথে মজা করছো তাই না? দ্যাখো এসব ব্যাপার নিয়ে মোটেও মজা করবে না, ওকে? এখন আমি মোটেও মজা করার মুডে নেই। আর তুমি তো জানোই অতশীর ব্যাপারে আমি কতটা সেনসিটিভ! নেক্সট টাইম ওকে নিয়ে এরকম কোন মজা তুমি করবে না আমার সাথে।”
—“ভাইয়া আমি ভিডিও কল দিচ্ছি। নিজের চোখেই দেখে নেন।”

স্পন্দন যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। ঘোমটা দেওয়া বিয়ের সাজে একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। মাথা নিচু করে বসে আছে। এটা ঠিক যে অতশীর সাথে কয়েকদিন যাবৎ তার সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না। তার কাছ থেকে, এই সম্পর্কটা থেকে মুক্তি চায়ছে অতশী। সে বিশ্বাস করে যে নিশ্চয়ই এর পিছনে বড়সড় কোন কারন আছে। নয়তো তার অতশী এমনটা করার মেয়েই নয়।

আফরার কণ্ঠ শুনে স্পন্দনের ঘোর কাটলো।
—“অতশী একটু এ দিকে তাকা তো তোর কয়েকটা ফটো তুলি। বিয়ে করে তো শ্বশুরবাড়ী চলেই যাবি। চায়লেই তো আর দেখতে পাব না তোকে।”

অতশীকে দেখেই স্পন্দনের হার্ট সর্বোচ্চ গতিতে বাড়তে লাগলো। এরকম সাজে তার দেখার কথা ছিল তাদের বিয়ের সময়। কত রাত জেগে কাটিয়েছে অতশীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে! কিন্তু এখন এভাবে তাকে দেখবে কল্পনাতেও আনেনি সে।

মোবাইলটা হাত থেকে পড়েই যাচ্ছিল। কোনমতে সামলে রওয়ানা দিল অতশীর বাসার উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথেই তার বাবাকে ও অয়নকে ফোন দিল। যত সমস্যার মাঝেই থাকুক না কেন স্পন্দনের বিপদে অয়ন ঠিক হাজির হবে। অয়নের বাবার এই অবস্থায় অয়নকে যেতে বলতো না। কিন্তু সেই একমাত্র যে এই ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে পারবে যেভাবেই হোক।

সেখানে তারা পৌঁছে দেখে বিয়ে পড়ানোর জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছে সবাই। হঠাৎ করেই অতশীর বাবার পায়ে পড়ে স্পন্দন কেঁদে দেয়। উপস্থিত সকলে এমন কাজে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো কিছুটা মুহূর্ত। ছেলেটিকে চিনতে পারছে না অতশীর বাবা। কে এই ছেলে? এভাবে পায়ে পড়ে গিয়ে কাঁদছে কেন?

—“কে তুমি? এভাবে আমার পায়ে পড়ে কাঁদছো কেন?”
—“আঙ্কেল প্লিজ আমাকে অতশীকে ভিক্ষা দিন। ওকে ছাড়া আমি মরেই যাব। প্লিজ আঙ্কেল আমার এই কথাটা রাখুন।”
—“কিসব আবোলতাবোল বকছো? আজ অতশীর বিয়ে। আর কে তুমি? অতশীকে ভিক্ষা কেন চায়ছো?”
—“আমি অতশীর সব। ওর হাসির কারন, ওর কান্নার কারন, ওর ভালো থাকার কারন সব সব। আমি অতশীকে ভালবাসি। এমনকি অতশীও ভালবাসে আমাকে।”
—“এই ছেলে মিথ্যে কেন বলছ? অতশী তো রিমনকে ভালবাসে। ওকে জিজ্ঞাসা করার পর তো তার নামই বলেছে।”
—“মিথ্যে বলেছে আঙ্কেল।”
—“তুমি যে সত্যি কথা বলছো এটারই বা প্রমান কি?”
—“প্রমান আমি আঙ্কেল।”

তাদের কথার মাঝে আফরা এটা বলে উঠলো। স্পন্দন ওর কাছে এসে অসহায়ভাবে বললো
—“আফরা প্লিজ আঙ্কেলকে একটু বুঝাও।”
—“ভাইয়া আপনি শান্ত হোন। আর আঙ্কেল, অতশী স্পন্দন ভাইয়াকেই ভালবাসে। তাদের সম্পর্কের চার বছর চলছে।”
—“কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করার পর ওর কথা কেন বলেনি?”
—“সেই কারনটা আমরা কেউ জানি না আঙ্কেল। তবে ভাইয়া অতশীকে আসলেই অনেক ভালবাসে।
পাগলের মত ভালবাসে। আর অতশীও।”

—“এখন আর কিছুই করার নেই। যেখানে বিয়ে হবার কথা ছিল সেখানেই হবে। নাহলে আমার মানসম্মান সব ধূলোয় মিশে যাবে। কারো কাছে মুখ দেখাতে পারবো না আমি। সবাই আমার মুখে থুতু ফেলবে।”

—“আঙ্কেল আপনি শুধু আপনার সম্মানের কথাই চিন্তা করলেন? অতশীর কথাটা একবারও ভাববেন না? বুঝতে পারছেন না আপনি এতে করে তিনটা মানুষের জীবনই নষ্ট হয়ে যাবে। তিনটা মানুষই তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে পেয়ে মরবে। আপনার মেয়ের কষ্ট আপনি সহ্য করতে পারবেন? স্পন্দন ভাইয়া আর রিমন ভাইয়ার বাবা মা তাদের ছেলের কষ্ট নিজের চোখে দেখতে পারবে? আপনিই ভেবে বলেন।”

—“ভাই সাহেব, আমি আপনার কাছে হাত জোর করছি অতশী মামনীকে আমার ছেলের জন্য ভিক্ষা দেন। নাহয় আমার ছেলেটা মরেই যাবে। কোন বাবা মাই তাদের সন্তানের কষ্ট সহ্য করার মতো ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে না। আপনি যেমন আপনার সন্তানের কষ্ট সহ্য করতে পারবেন না। তেমনি আমিও পারব না আমার একমাত্র ছেলেকে তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে মরতে দেখে। প্লিজ আমার কথাটা একটু বিবেচনা করুন। তাদের সুখের কথা চিন্তা করে হলেও চারটি হাত এক করে দিন প্লিজ। সারাজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।

আফরা, স্পন্দন, অয়ন, স্পন্দনের বাবা সবার অনুরোধ আর জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হলো অতশীর বাবা। অতঃপর উনি অসহায় চোখে রিমনের পরিবারের দিকে তাকালো। রিমনের বাবা এগিয়ে এসে অতশীর বাবার কাঁধে হাত রেখে বললো

—“ভাইসাহেব, এই পরিস্থিতিতে কি বলবো বুঝতে পারছি না। তবে আপনি অনুমতি দিলে একটা প্রস্তাব পেশ করতে পারি আপনার কাছে।”

—“জ্বী জ্বী অবশ্যই। বলেন কি প্রস্তাব?”

—“যেহেতু বিয়ে করাতে এসেছি বউ না নিয়ে গেলে তো ব্যাপারটা খারাপ দেখায় তাই না? তাই বলছিলাম কি যে আপনার ভাতিজিকে যদি আমার মেয়ে হিসেবে চাই তাহলে কি আমাকে দিবেন?”

—“ভাইসাহেব, আমার বুকের ওপর থেকে এক মণ ওজনের পাথর সরে গেল মনে হচ্ছে। বড় বাঁচা
বাঁচালেন আমায়।”

অতঃপর খুশিতে তিন বেয়াইসাহেব মিলে কোলাকুলি করলো। সকলের মুখে প্রশান্তির হাসি। স্পন্দন তো অয়নকে ধরে কেঁদেই দিল। অতশীর কাজিনের মতামত নিয়েই রিমনের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ করা হলো দুজনকে। স্পন্দনের সাথে অতশীর বিয়ে পড়ানো হলো। প্রথমে অতশীর কাছ থেকে সিগনেচার করিয়ে আনলো। অতঃপর খবর পাওয়া গেল অতশী অজ্ঞান হয়ে গেছে। জ্ঞান ফেরাতে চায়লে স্পন্দন বাঁধা প্রদান করলো। একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অতশীকে পাঁজাকোলে করে গাড়িতে এনে বসালো স্পন্দনের শরীরের সাথে হেলান দিয়ে। শত বাঁধা পেরিয়ে অতশীকে বিয়ে করতে পেরেছে এর জন্য খুশি মনে আল্লাহর আছে হাজার শুকরিয়া জানাচ্ছে। অন্যদিকে অতশীর এমন কর্মকান্ডের জন্য তার ওপর প্রচুর পরিমানে রেগে আছে। মনে মনে ভাবছে সুইটহার্টট আমাকে এখনো চেনোনি। তোমার এমন অবস্থা করবো যাতে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা কল্পনাতেও না আনো।

হঠাৎই ব্যালকনি থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ স্পন্দনের কানে বারি খাওয়ার কারনে ভাবন রাজ্যের দরজায় তালা পড়লো। বুকের ভিতরটা যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে অতশীর কান্না শুনে। মনে মনে ভাবছে অনেক খারাপ ব্যবহার করে ফেললাম মনে হয় ওর সাথে। আবার পরক্ষনেই ভাবে ঠিকই করেছি।
ও এরকম ব্যবহার পাওয়ারই যোগ্য।

এমনিতেই সারাদিনের ধকলে অনেক ক্লান্তি লাগছিল। এখন আবার তার অতশীর কান্না। প্রেয়সীর চোখের পানি কোন প্রেমিকের হৃদয় নাড়া না দেয়? ওর কান্না যেন হৃদয় ভেদ করে ভেতরে তীরের ফলার মত গিয়ে বিঁধছে। কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। নাহ, যতক্ষণ না পর্যন্ত এ বুকে অতশীকে রাখবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ পোড়া বুকটা ক্ষান্ত হবে না। অতশীকেও থামাতে হবে।

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে