অভিমান হাজারো পর্বঃ১১
আফসানা মিমি
বিয়ের কার্য সম্পাদন শেষে কনে বিদায়ের পালা ঘনিয়ে এলো। আফরার মা ওকে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে। মায়ের কান্না দেখে আফরারও বুক ফেটে কান্না আসছে। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে সামির। চোখে তার নোনা পানি ভীড় করেছে। একমাত্র ছোট বোনটা কত বড় হয়ে গেল আজ! পরের বাড়ি চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। কখনো আর এসে আবদার করবে না ‘ভাইয়া আমার এটা চাই, ওটা চাই’, কখনো আর রাত জেগে একসাথে বসে পপকর্ণ খেতে খেতে মুভি দেখা হবে না। ভাবতেই বুকের ভিতরটা ভেঙে গুড়িয়ে আসতে চায়ছে। তার কাছে এসে বুকে ঝাপিয়ে পড়লো আফরা। স্নেহভরে দু’হাতে আগলে ধরলো আদরের বোনটাকে।
লাল টুকটুকে বউটার দিকে তাকিয়ে অয়নের বুকের ভিতর একটা প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেল। চোখ, মুখ, গাল, নাক, ঠোঁট ফুলে লাল হয়ে আছে। কান্না করার কারণেই বোধহয় চোখ মুখের এই অবস্থা। বড়ই মোহনীয় লাগছে আজ আফরাকে। চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়ছে যেন। এত্তো সুন্দর কেন তার বউটা! নিজের মনকে নিজেই প্রশ্ন করছে অয়ন।
আফরাকে ধরে এনে অয়নের সামনে দাঁড় করালো ওর বাবা। মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে আফরা। কান্নার দমকে ওর শরীর ঈষৎ কেঁপে কেঁপে উঠছে। যখন অয়নের হাতে ওর হাতটা রাখলো তখন কেমন ভালো লাগার একটা শিহরন খেলে গেল ওর ভিতর বাহির পুরোটা জুড়ে। আফরার বাবা আফতাব হক অশ্রুসিক্ত চোখে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো
—“আমার একমাত্র আদরের রাজকন্যাটা তোমার হাতে তুলে দিলাম বাবা। বড় আদর যত্নের সহিত লালন পালন করেছি এতোগুলো দিন। আশা করি বাকি দিনগুলো ভালবেসে আগলে রাখবে আমার মেয়েটাকে! কখনো অমর্যাদা কোরো না। অবুঝ তো! ভুল হলে শুধরে দিও। কখনো কোন কষ্ট দিও না ওকে।” বলতে না বলতেই ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন আফতাব হক।
অয়ন আফরার হাতটা আরেকটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আত্মবিশ্বাসী গলায় বললো
—“বিশ্বাস করে যখন দায়িত্ব দিয়েছেন সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা করবো না কখনো ইনশা আল্লাহ্! ভরসা রাখতে পারেন। আপনার চোখের মণি আমার প্রাণভোমরা। কোন কষ্টই ওর কাছে আসতে দিব না। এভাবেই দু’হাতে আগলে রাখবো।” বলে আফরার ডান হাতটা তার দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো। আফরার মাথা কাটা যাচ্ছে লজ্জায়। লজ্জা শরমের বালাই নেই লোকটার মাঝে। কিভাবে অকপটে বলে দিল তার প্রাণভোমরা আফরা। ইশ কি লজ্জা! উপস্থিত সকলে মিটিমিটি হাসতে লাগলো অয়নের এমন কথায়।
গাড়ি পর্যন্ত সামিরকে জড়িয়ে ধরেই হেঁটে হেঁটে গেল আফরা। এখনো কেঁদেই চলেছে। অয়ন বুঝে পাচ্ছে না এভাবে মরাকান্না কাঁদছে কেন আফরা! তাকে তো আর মেরে ফেলতে বিয়ে করেনি যে এভাবে কাঁদতে হবে। প্রচুর বিরক্ত লাগছে তার কাছে। আর কতক্ষণ যে এভাবে সঙয়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আল্লাহ্ মালুম।
গাড়িতে তুলার সময় আবারো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো আফরা। অন্যদের তুলনায় আফরা একটু বেশিই কাঁদছে। এক নিজের বাপের বাড়ি ছেড়ে পরের ঘরে চিরস্থায়ীভাবে চলে যেতে হচ্ছে। দুই অয়নকে ভয় পাচ্ছে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে অয়ন তাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে কোন লবন মসলা ছাড়াই। সেই ভয়েই আরো বেশি করে কাঁদছে। অয়নের বিরক্তিতে ছেয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে অরুনিমা বললো
—“বৌমণি এভাবে কাঁদছো কেন? আমরা কি তোমাকে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছি? নাকি মেরে ফেলতে নিয়ে যাচ্ছি? প্লিজ আর কেঁদো না। তুমি তো আর একেবারের জন্য চলে যাচ্ছো না। কালকেই আবার আসবে এখানে। সো কান্নাকাটি অফ করে তাড়াতাড়ি আমাদের সাথে চলো তো! নয়তো কালকে কিন্তু আসতে দিব না এই বলে দিচ্ছি।”
অরুনিমার কথা শুনে একবার অয়নের দিকে তাকিয়ে আরেকবার বাবা, মা, ভাই সবার দিকে তাকিয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। নতুন গন্তব্যে পা বাড়ালো আফরা। গাড়িতে তার একপাশে বসেছে অরুনিমা আরেক পাশে বসেছে অয়ন। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে অয়নের পাশে বসে থাকতে। তাই অরুনিমার দিকে আরেকটু চেপে বসলো। আফরার জড়তা কাটাতে অরুনিমা বললো
—“বৌমণি তুমি এতো আনরোমান্টিক কেন?”
আফরা অবাক হলো অরুনিমার কথায়। সেই অবস্থায়ই জিজ্ঞাস করলো
—“কেন আমি আবার কি করেছি?”
—“আবার জিজ্ঞাসা করছো কি করেছো? আমার বিয়ে হলে জানো আমি কি করতাম? শ্বশুরবাড়ি প্রথম যাওয়ার সময় বরের কোলে করে বসে গলায় ঝুলে গাড়িতে করে যেতাম। আর সাথে আনলিমিটেড রোমান্স তো আছেই। কিন্তু তুমি দেখি পুরাই একটা নিরামিষি চিজ। কোথায় ভাইয়ার সাথে চেপে বসবে অথবা কোলে গিয়ে বসবে! তা না করে ভাইয়ার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে আমার দিকে চেপে বসেছো। এটা কোন কথা হলো! নাহ তোমাকে দেখছি আমারই সব শেখাতে হবে প্রথম থেকে। রোমান্টিকের ‘র’ ও দেখছি জানো না তুমি।”
বেশ আফসোসের সাথে বললো অরুনিমা। আর এদিকে তার কথা শুনে আফরা লজ্জায় লাল নীল কমলা বর্ণ ধারণ করছে ক্ষণে ক্ষণে। উফফ্! এভাবে কেউ কাউকে লজ্জা দেয়!
…
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
—“অতশী!”
—“হুম।”
—“বেশি খারাপ লাগছে?”
—“বেশি না তবে মাথায় পেইন হচ্ছে অনেক।”
—“এসো আমার কোলে মাথা রাখো তো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”
—“নাহ তার কোন দরকার নেই।” নিজেকে স্পন্দনের কাছ থেকে খানিক গুটিয়ে নিয়ে বললো অতশী। গতকাল রাতের ঐ ঘটনাটার পর থেকে অতশী স্পন্দনের সাথে দরকার ছাড়া কোন কথা বলেনি। বড্ড কষ্ট পেয়েছে সে স্পন্দনের এমন ব্যবহারে। সে তো অন্যায় কিছু চায়নি তাই না! তাহলে স্পন্দন তাকে কেন এভাবে ফিরিয়ে দিল! কেন তার ভালবাসাকে এভাবে অপমান করলো! ও কি কষ্ট পায় না!
স্পন্দন বেশ অবাক হলো অতশীর এমন কর্মকাণ্ডে। সে খেয়াল করছে গতকাল রাতের পর থেকেই অতশীর মাঝে বেশ কিছু পরিবর্তন এসে গেছে। এক রাতের মাঝেই কিভাবে সম্ভব এটা! তবে সেও আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে বা করতে পারছে না। কেমন গিল্টি ফিলিং হচ্ছে ভিতরে ভিতরে।ট আসলেই ভুল হয়ে গেছে। এমনটা করা উচিৎ হয়নি।
বাসায় এসে দেখে পুরো বাসা নীরব নিস্তব্ধ। সবাই ঘুমে বিভোর। এতো রাত পর্যন্ত জেগে থাকার কোন মানেই হয় না। রাত প্রায় বারোটা বাজতে চললো। রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো স্পন্দন। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। বিছানায় পিঠ লাগানোর সাথে সাথেই যেন সব ঘুম এসে ভর করলো তার চোখে। কিন্তু ঘুমাতে পারছে না। অতশী কোথায়! রুমে চোখ বুলিয়ে দেখে অতশীর টিকিটিও নেই পুরো রুমের অস্তিত্ব জুড়ে। কই গেল!
অতশী ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে তার অন্ধকারে এমন নিস্তব্ধ পরিবেশে একা সময় কাটাতে ভালো লাগে। সে মনে করে কালেভদ্রে নিজেকে কিছুটা হলেও সময় দেওয়া উচিৎ। এতে করে নিজের মনের সাথে বুঝাপড়া করার একটা সুযোগ হয়। কারণ জীবনে কিছু হিসাব নিকাষ থাকে যা একান্তই নিজের। যা কিনা অন্যকাউকে বলা যায় না। নিজের পিছনে দ্বিতীয় কারো অস্তিত্ব টের পেয়েও অনড় বসে রইলো অতশী। তার কিছুই ভালো লাগে না আজকাল। শুধু মনে হয় কেন তাকে আল্লাহ্ দুনিয়াতে পাঠালো! মা তাকে ছেড়ে গেছে আজ দশ বছর। কিছু বুঝে উঠার আগেই মায়ের ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হলো। তার বেশ কয়েক বছর পর তার হাতদুটো আগলে ধরলো এই মানুষটি। স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। এই মানুষটা তাকে পদে পদে সকল বিপদআপদ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। মনপ্রাণ উজার করে ভালবেসে গেছে নিঃস্বার্থ ভাবে। ভেবেছিল এই মানুষটার বুকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মাথা রেখে কাটিয়ে দিবে। কিন্তু একটা ঝড় এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিল। সেই ঝড়ে দুজনের সম্পর্ক একই সুতায় বাঁধা পড়লেও ছিটকে সরে গেছে একজন আরেকজনের জীবন থেকে। অগোছালো করে দিয়ে গেল তাদের দুজনের জীবন।
অতশীর এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে স্পন্দনের বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠলো। কিসের এতো সংকোচ অতশী যা তোমার মনের কথাগুলো আমার কাছে পৌঁছুতে এতো বাধার সম্মুখীন হচ্ছে বারবার! স্পন্দনের এমন অন্তর্ভেদী দৃষ্টির মাধ্যমে প্রশ্ন করাটা যেন নাড়িয়ে দিয়ে গেল অতশীর ভিতরটাকে। স্পন্দনের এমন দৃষ্টির সামনে টেকা দায় অতশীর। তাই দ্রুত উঠে রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। পিছন থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থেমে যায় তার পদযুগল। আস্তে করে টেনে তাকে পিছন ঘুরিয়েই স্পন্দনের সামনে দাঁড় করায়। পিছন থেকে সবল দুই হাতে আবদ্ধ করে তাকে। শাড়ীর ফাঁক গলে স্পন্দনের শীতল হাত তার পেট স্পর্শ করার পর ঈষৎ কেঁপে উঠলো সে। অতঃপর তার কাঁধে মুখ ডুবায়। দীর্ঘ কয়েকটা শ্বাস টেনে অতশীর শরীরের গন্ধটা মনভরে ভিতরে টেনে নেয়। নাসারন্ধ্র বেয়ে গন্ধটা মস্তিষ্কে পৌঁছানোর পর অদ্ভুত এক ভালো লাগা ঝেঁকে ধরলো স্পন্দনকে। নিজেকে মাতাল মাতাল লাগছে। যেন নেশা করেছে। অতশীর সারা শরীর বেয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। চোখ বুজে সময়টা উপভোগ করতে লাগলো সে। বুকের ভিতর যেন কেউ হাতুরি পিটাচ্ছে। ঘোরলাগা কণ্ঠে আচমকা স্পন্দন বলে উঠলো
—“অতশী!”
অতশীর উত্তর দিতে ইচ্ছে করলো না। সে চায়ছে এভাবেই সময়টা থমকে যাক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এভাবেই স্পন্দনের বাহুডোরে থাকতে চায়। নিজেকে সঁপে দিতে চায় স্পন্দনের কাছে।
—“এই অতশী!”
স্পন্দন এমন করে ডাকায় হালকা কেঁপে উঠলো অতশী। কি যেন ছিল ঐ ডাকে! সাড়া না দিয়ে পারলো না সে।
—“হুঁ।”
—“ভালবাসি।”
অতশীর বুকের গভীরে কেমন একটা চিনচিনে ব্যথার উদয় হলো স্পন্দনের এমন ‘ভালবাসি’ কথাটা শুনে। নিঃশ্বাস আস্তে আস্তে ভারী হয়ে আসতে লাগলো তার। স্পন্দন আবারো বললো
—“এই পাগলী ভালবাসি তো!”
আটকাতে পারলো না আর নিজেকে। দ্রুত ঘুরে স্পন্দনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। স্পন্দন ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল নিবিরভাবে। কান্নারা বাইরে আসতে চায়ছে ঠেলে ঠেলে। বুকে ঠান্ডা কিছুর অস্তিত্ব টের পেয়ে অতশীর মুখটা নিজের দু’হাতে তুলে নেয় স্পন্দন। অতশীর চোখে অশ্রুকণা চিকচিক করছে। তা দেখে স্পন্দনের হৃদপিণ্ডে কে যেন খামচে ধরলো। এভাবে তার মানসপ্রিয়াকে কষ্ট দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে! একটা ভুল নাহয় করে ফেলেছে কিন্তু তার শাস্তি হিসেবে সবকিছু থেকে এভাবে তাকে বঞ্চিত করাটা কি সমীচীন হচ্ছে! এমন রোবটিক অতশীকে তো সে চায়নি। তার জীবনটা যেন সুখে কানায় কানায় পূর্ণ করে দেয় তেমনটাই তো চেয়েছিল। কিন্তু হলো কি! তার উল্টোটা। আর ভুল করবে না সে। অতশীর পরিপূর্ণ হক, প্রাপ্য অধিকার তাকে দিতেই হবে।
এক ফোঁটা অশ্রুকণা চোখ থেকে টুপ করে পড়ে গাল স্পর্শ করার পর তা মাটিতে পড়ার আগেই নিজের অধরোষ্ঠ দ্বারা শুষে নিল স্পন্দন। এমন কাণ্ডে অতশী চোখ বন্ধ করে ফেললো। অতঃপর অতশীর বন্ধ দু’চোখের পাতায় দুটো চুমু খেয়ে কপালের মধ্যভাগে একটা চুমু দিল। ধীরে ধীরে নিচে নেমে ঠোঁট পর্যন্ত আসার পর অতশী হঠাৎ স্পন্দনের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রুমে চলে গেল। হঠাৎ অতশীর এমন কাজে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো স্পন্দন।
বেশ কিছুক্ষণ পর রুমে প্রবেশ করে দেখে অতশী একপাশ হয়ে শুয়ে আছে। সেও গিয়ে শুয়ে পড়লো অতশীর পাশ ঘেঁষে। বুকটা ফাঁকা লাগছে। অতশীকে নিজের বুকে টেনে আনতেও কেমন একটা জড়তা কাজ করছে। অবশেষে সকল জড়তা কাটিয়ে অতশীকে নিজের বুকে টেনে নিল। কিন্তু অতশী অসাড়ের মতো পড়ে রইলো স্পন্দনের বুকে। এভাবেই দু’মিনিট পার হওয়ার পর অতশী নিজের জায়গায় ফিরে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে রইলো। স্পন্দন নির্বাক হয়ে অতশীর দিকে তাকিয়ে রইলো। এতো অভিমান! অবশ্য এতে অতশীর দোষ কোথায়! সব দোষ তো তারই। তার জন্যই তো সম্পর্কটা এমন জড় পদার্থে রূপ নিয়েছে। সে-ই তো স্বাভাবিক করেনি সম্পর্কটা। উল্টো অতশীকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। স্পন্দনও আর কিছু না বলে অপরপাশে ঘুরে শুয়ে রইলো। অথচ কারো চোখেই ঘুম নেই। দুজনেই চায়ছে যেন অপরপক্ষের মানুষটা আগ বাড়িয়ে কাছে আসুক। কিন্তু এমনটা হচ্ছে না। উল্টো দুজনের ভিতরটা সমানভাবে জ্বলতে পুড়তে লাগলো। একটা সূক্ষ্ম ব্যথা উভয়ের হৃদপিণ্ডে খোঁচাতে লাগলো অনবরত। তাদের দুজনের মাঝের এ দূরত্ব কবে ঘুচবে!
…
অরুনিমা অস্থিরচিত্তে পায়চারি করছে পুরো রুম জুড়ে। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না সে। বুকের ভিতরটা খুব জ্বলছে। সামিরের চোখে তখন আসার সময় পানি দেখে তারও খুব জোরে কান্না পেয়েছিল। কিন্তু কাঁদতে পারেনি। লোকে কি বলবে! আসলেই ভালবাসার মানুষটার চোখের পানি কেউই সহ্য করতে পারে না। আল্লাহ্ কাউকেই সেই সহ্যক্ষমতা দেয়নি। উজার করে ভালবাসতে সুযোগ দিয়েছে অথচ তাঁর কান্না সহ্য করার ক্ষমতা দেননি। সে কিছুতেই নিজের মনকে শান্ত করতে পারছে না যে বোনকে বিদায় দিয়েছে বলে এভাবে কেঁদেছে। তার খালি চোখে ভাসছে ঐ ঘোলা চোখে পানি টলমল করছিল। সে তো ঐ ঘোলা চোখের প্রেমেই পড়েছে। অবশ্য শুধু প্রেমে পড়েনি। হাত পা ভেঙে হুমরি খেয়ে পড়েছে।
মনে পড়ছে কয়েক মাস আগের কথা। যেদিন সামিরকে সে প্রথম দেখেছিল। সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। সে মাঝে মাঝে হেঁটেই বাসায় ফিরে। কারণ বাসা থেকে ভার্সিটি বেশি দূর নয়। তেমনই সেদিন হেঁটে হেঁটেই ফিরছিল। দিনটা কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল। যেন আল্লাহর আদেশ পাওয়া মাত্রই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ঝরবে। হলোও তাই। বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। যাত্রী ছাউনীতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দেখে এক সুদর্শন ছেলে তার ছাতাটা ফুটপাতে বসে থাকা এক প্রৌঢ়া ভিক্ষুককে দিচ্ছে। উনাকে ধরে যেখানে বৃষ্টি না পড়ে সেখানে নিয়ে বসায়। এরপর কয়েকটা নোট দিতে দেখা গেল। একটু দূর হওয়ায় বুঝা যায়নি কত টাকা দিয়েছে। সে একদৃষ্টিতে ঐদিকে তাকিয়ে ছিল। কখন যে তার পাশে এসে ছেলেটা দাঁড়ালো সে টেরই পেল না। হঠাৎ গাড়ির হর্ণের আওয়াজে তার হুঁশ ফেরার পর আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে সেই সুদর্শন ছেলেটা তারই পাশে একটু দূরে দাঁড়িয়ে। যাত্রী ছাউনীতে বেশ ভীড়। তাই ছেলেটার কাছে গিয়ে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো। যাতে বুঝতে না পারে যে সে ইচ্ছা করে কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। একটু পর পর আড়চোখে দেখতে লাগলো ছেলেটিকে। উচ্চতা না হলেও প্রায় ছ’ফিট হবে। পাঞ্জাবী পরে থাকায় যা সুন্দর লাগছিল বলার মতো না। হঠাৎই সে চোখের দিকে তাকালো। এবং সেখানেই আটকে গেল সে। ছেলেটার চোখের মণি কালো না, হালকা ঘোলা। যাকে বলে বিড়ালচোখী। সে মনে হয় এই প্রথম এমন চোখের অধিকারী কাউকে দেখেছে। সে ড্যাবড্যাব করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ছিল। বৃষ্টি থামার পর কখন যে ছেলেটা চলে গেল সে ঘূর্ণাক্ষরেও টের পেল না। হুঁশ হতেই দেখে ছেলেটা তার পাশে নেই। বৃষ্টিও থেমে গিয়েছে। ধুর মনটাই খারাপ হয়ে গেল! বিষণ্ণ মনে বাসায় ফিরলো। এরপর বেশ কয়েকবারই দেখা হয়েছিল ভার্সিটির আশেপাশে। তবে কখনো কথা হয়নি। যখনই তাকে দেখতো তখনই যেন ওর হৃদপিণ্ডটা নাচা শুরু করতো খুশিতে। থামতোই না সহজে। আজকে অনেকদিন পর হঠাৎই তাঁকে দেখে কেমন মনে হাজারো রঙবেরঙ এর প্রজাপতি উড়াউড়ি করছিল। ইশ এত্তো সুখ কেন! ভালবাসার মানুষটাকে চোখের সামনে দেখলে বুঝি এভাবেই সুখ সুখ অনুভূত হয়! সুখে মরে যেতে ইচ্ছা করে!
চলবে………