অভিমানী বিকেল শেষে পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0
645

#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( শেষ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
তুলি, নিরুপমা এই সব কিছুই খেয়াল করছিল কদিন ধরে। কিন্তু রঙ্গন কে কিভাবে বুঝিয়ে আবার আগের মতন স্বাভাবিক করবে, বুঝতে পারছিল না! আসলে যেই ঘটনাটা ঘটেছে, তার জন্য শুধু রঙ্গন এর শরীরে না, মনেও দাগ কেটেছে ভীষণ। সেই জন্যই ছেলেটা আজও রাতে ঠিকভাবে ঘুমোতে পারে না! আঁতকে আঁতকে ওঠে স্বপ্নের মধ্যে। তুলিকে সেই সময় খুব ভয়ের মধ্যে জড়িয়ে ধরে ও। তুলি বুঝতে পারে, ছেলেটার শরীর দিয়ে ঘাম নেমে এসেছে ঘুমের ঘোরেই। তুলি সেই সময় রঙ্গন এর গায়ে হাত বুলিয়ে, জল খাইয়ে, ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে। এমনকি এই সময় রঙ্গন এর একটা নার্ভের প্রব্লেম অব্দি শুরু হয়ে গেছে! খুব বেশি স্ট্রেস হলেই এরপর নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যেতে পারে ওর। সেদিনের ঘটনাটা আসলে এতটাই স্পষ্ট আজও রঙ্গন এর কাছে, যে চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় ওই দিনটাকে, খালি ঘরে শুনতে পায় লোকগুলোর গলার আওয়াজ, চিৎকার, ভাঙচুরের শব্দ।
যাইহোক, এর মধ্যেই তুলি এসেছিল একদিন ওর কাছে। হাতে একটা পেপার ছিল। তাতে লেখা ছিল, —–” ডক্টর রঙ্গন চ্যাটার্জি কে নিগ্রহ কাণ্ডে গ্রেপ্তার করা হলো অভিযুক্তদের। ইউটিউবের ভাইরাল ভিডিওতেই পুলিশ প্রশাসনের এই পদক্ষেপ।”
লাইনটা পড়ে রঙ্গন থমকে গেছিল সেদিন! তুলি যদিও ওকে কদিন আগে দেখিয়েছিল ইউটিউবের ভিডিওটা। সেদিনের সিসিটিভি ফুটেজে ঘটনাটা খুব পরিষ্কার ভাবেই বোঝা যাচ্ছিল। সাথে অনেক ডাক্তারই পাশে দাঁড়িয়েছিল ওর, এই ঘটনার নিন্দা করেছিল ভীষণভাবে! কিন্তু এই ভিডিওটা যে সবাই এত শেয়ার করবে! আর প্রশাসনের কানে গিয়ে পৌঁছবে সবটা, এটা রঙ্গন ভাবেনি আসলে। তাই এই নিউজটা দেখে ও নির্বাক হয়ে গেছিল যেন। মনে হয়েছিল তুলির চেষ্টায় একটা উত্তর অন্তত দিতে পারলো এই গোটা সিস্টেমকে। সেই মানুষগুলোকে, যাদের কাছে ডাক্তারদের গায়ে হাত তোলাটা খুব সহজ, খুব সস্তা একটা ব্যাপার।
<২৫>
কিন্তু কিছু ঘটনা জীবনে এতটা তীব্র হয় যে মানুষ চাইলেও নিজেকে সামলাতে পারে না সহজে। রঙ্গনও যেমন পারেনি। ও এই ঘটনার এক মাস বাদে হসপিটালে জয়েন করেছিল আবার। কিন্তু সার্জারি রুমে গিয়ে সবটা ঝাপসা হয়ে এসেছিল যেন। সেই আগের কনফিডেন্সটা ছিল না আর। সেইদিনের অতো লোকের চিৎকার, ভাঙচুরের আওয়াজ, ওকে মারা চর থাপ্পড়গুলোর প্রতিধ্বনি যেন শুনতে পাচ্ছিল এই নিঃস্তব্ধতার মাঝে। তাই হাতটা কাঁপতে শুরু করেছিল ওর। শরীরটা হালকা হয়ে এসেছিল হঠাৎ। তারপর চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে গেছিল কয়েক সেকেন্ডে।
এরপর সেদিন বেশ কিছুক্ষণ বাদে ওর সেন্স এসেছিল। ততক্ষণে তুলি হসপিটালে চলে এসেছে খবর পেয়ে। রঙ্গন চোখ খুলে দেখেছিল তুলি ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বসে আছে সামনে। রঙ্গন এই সময় বুঝতে পারছিল না যে কিভাবে ও সার্জারি রুম থেকে এখানে এলো! সেদিন তুলি ওকে থমকে থাকা গলায় উত্তর দিয়েছিল,
——” ডাক্তার বলেছে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছিল তোমার! সেই জন্য এইভাবে হঠাৎ করে সেন্সলেস হয়ে গেছিলে।”
কথাগুলো শুনে রঙ্গন আর কিছু বলতে পারেনি। শুধু মনে হচ্ছিল সব হয়তো শেষ হয়ে গেল! আর সম্ভব না নতুন করে শুরু করা। সেদিনের সেই অপমান, গালাগালি, মারগুলো ডাক্তার হিসেবে কখনো ভুলতে পারবে না আসলে। আর সেই ঘটনাটার ভয়টাকে পুরোপুরি মুছে ফেলে পেশেন্টদের ট্রিটমেন্ট করতে পারবে না রঙ্গন। সেদিন এসব ভাবনার ভিড়ে কিরকম চুপ করে গেছিল ও। তবে তুলিও আজ স্তব্ধ হয়ে গেছিল ভীষণ। রঙ্গন অপারেশন থিয়েটারে সেন্সলেস হয়ে গেল! তার মানে এতটা ভেঙে পড়েছে ও মন থেকে যে নার্ভ গুলোও নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে! কথাটা ভেবেই কেমন অস্থির লাগছিল যেন। একটা ছেলে এইভাবে চোখের সামনে শেষ হয়ে যাচ্ছে! হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে! না, তুলি এটা মানতে পারছে না কিছুতেই। রঙ্গনকে যেভাবেই হোক সেইদিনটা ভুলতে হবে। মুছে ফেলতে হবে ওই ঘটনার স্মৃতিগুলো। কথাগুলো ভেবেই তুলি সেই রাতে রঙ্গন এর কাছে গেছিল। চুপ করে থাকা রঙ্গন এর হাতটা আগলে বলেছিল,
——” তুমি খুব পাহাড় ভালোবাসো না? মায়ের কাছে শুনেছি।”
রঙ্গন এই প্রশ্নে একটু অবাক হয়েই বলেছিল,
—–” হ্যাঁ। কেন? হঠাৎ পাহাড়?”
তুলি এটা শুনে নিজের মোবাইল থেকে বার করে কিছু ছবি দেখিয়েছিল ওকে। নর্থ বেঙ্গল এর ছোট্ট একটা গ্রাম তাবাকোশি। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে রংবং নদী। আর তার সামনে দোতলা কাঠের বাড়ি, ছোট্ট বাগান। ছবিগুলো দেখে রঙ্গন কিরকম হারিয়ে গেছিল যেন। এত সুন্দর জায়গা! কথাটা ভাবতেই তুলি বলে উঠেছিল,
——-” যাবে এখানে আমার সাথে? এটা বাবার বন্ধু শিভম তামাং এর হোম স্টে। বাবা যখন প্রথম নর্থ বেঙ্গলে একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছিল, তখন থেকে বন্ধুত্ব। তারপর বাবা চাকরি চেঞ্জ করে কলকাতা চলে আসে; কিন্তু বন্ধুত্বটা রয়েই গেছে।”
কথাগুলো শুনে রঙ্গন একটু ভেবে বললো,
——” কিন্তু তোমার স্কুল? ছুটি নেই তো এখন।”
এটা শুনে তুলি আলতো হেসে বললো,
—–” ওটা ম্যানেজ হয়ে যাবে। তুমি শুধু হ্যাঁ বলো।”
এই কথায় রঙ্গন একটা শব্দেই বললো অল্প হেসে,
—–” হ্যাঁ।”
<২৬>
মেঘ পাহাড় আর বৃষ্টির দেশ তাবাকোশি। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা গ্রাম। রঙ্গন এর এখানে এসে জায়গাটাকে দেখেই মুখে কেমন হাসি ফুটে গেল! মিরিখের চা বাগান পাড় করে বেশ কিছুটা আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করেই এখানে আসতে হয়। আর এই পুরো সময়টা রঙ্গন এর সঙ্গী ছিল ওর ক্যামেরা। গাড়ির কাঁচ ভেদ করে কখনো পাহাড়, কখনো নিচে পরে থাকা টুকরো টুকরো শহর আর গ্রামগুলোর ছবি, তো কখনো সবুজ চা বাগানকে নিজের ক্যামেরা বন্দী করছিল ছেলেটা। আর এইসব দেখে তুলির মুখেও আলতো হাসি ছিল আজ। ঠিক এই কারণের জন্যই কলকাতা ছেড়ে কদিনের জন্য এখানে আসা। তুলি জানে, ওই শহরে আজকাল দম বন্ধ হয়ে আসে রঙ্গন এর। খোলা আকাশ এখন খুব দরকার এই ছেলেটার। তাই তাবাকোশি।
যাইহোক, সেদিন যখন ওরা তাবাকোশি পৌঁছলো তখন ঘড়িতে দুপুর বারোটা। শিভম তামাং নিজে গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল ওদের ওয়েলকাম করার জন্য। মাঝারি হাইটের রোগা চেহারার হাসি খুশি একটা লোক। রঙ্গন এর প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে গেল কেমন! আর তুলি তো ছোট থেকেই চেনে। তাই এই মানুষটার জন্য ভালো লাগাটা ছোট থেকেই। যাইহোক, কাঠের এই ছোট্ট কটেজের সামনে দিয়েই রংবং নদী বয়ে যায়। রঙ্গন আর তুলি এই নদীর সামনে এসে কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছিল যেন! দূরে সারী দিয়ে সাজানো পাহাড়, সামনে বয়ে চলা নদী, দূরে একটা ছোট পাহাড়ি ব্রিজ, সবটা মিলিয়ে ওরা যেন কেমন স্থির হয়ে গেছিল প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা এই ছবির সামনে। মনে হচ্ছিল কত শান্তি এই জায়গায়!

সেদিন বিকেলটা তো ওই কটেজের ব্যালকনিতে বসেই কেটে গেল দুজনের! সঙ্গে কফি, আর স্টিমড মোমো। আর সাথে নদীর কলকল শব্দ। রঙ্গন এই মুহূর্তে তুলিকে হঠাৎ বলে উঠলো,
—– ” থ্যাঙ্কস.. আমাকে এখানে নিয়ে আসার জন্য। সিরিয়াসলি থ্যাঙ্ক ইউ..”
এই কথায় তুলি এবার একটু ভ্রু কুঁচকে বললো,
——” একটু বেশিই ফর্ম্যালিটি হয়ে যাচ্ছে না? আমি এখানে তোমাকে থ্যাঙ্কস বলার জন্যও নিয়ে আসিনি!”
রঙ্গন কথাটা শুনে সাথে সাথেই বললো অল্প হেসে,
——” তাহলে কি বলার জন্য নিয়ে এসেছো? আই লাভ ইউ?”
কথাটা ও তুলির চোখের দিকে তাকিয়েই বললো হঠাৎ। তুলি এটা শুনে ঠিক কি বলবে ভেবে পেল না! তাই অল্প লজ্জা জড়ানো গলায় একটু হেসে বললো,
——” কি যে সব বলছো! ধুর।”
কথাটা বলেই ও চলে যাচ্ছিল, কিন্তু রঙ্গন হঠাৎ ওর হাতটা শক্ত করে ধরে টেনে নিল তুলিকে নিজের কাছে। তারপর খুব আলতো গলায় বললো,
——” কেন? ঠিকই তো বলছি। আই লাভ ইউ.. আজ থেকে না! যখন তুমি রোজ আমাদের বাড়িতে আসতে গান শেখাতে; তখন থেকে। অনেস্টলি, তার আগে সুর তাল মিউজিকের ব্যাপারে আমার অতো ইন্টারেস্ট ছিল না! কিন্তু তুমি আসার পর, তোমার গান না শুনলে রোববারগুলো আমার কমপ্লিট হতো না! সেই জন্য ইচ্ছে করে বাড়ি থাকতাম আমি ওই দিনগুলোতে। সেই সময় থেকে ভালোবাসি তোমায়। খুব ভালোবাসি।”
কথাগুলো খুব মন থেকে বললো আজ রঙ্গন। তুলি এই মুহূর্তে কোন শব্দ খুঁজে পেলো না যেন! শুধু চোখ দুটো ওর ভিজে এলো হঠাৎ। এই সময় রঙ্গন কিছু না বলে ওর গালে নিজের ঠোঁট দুটো ছুঁয়ে দিল। তারপর খুব শক্ত করে তুলিকে জড়িয়ে ধরলো নিজের মধ্যে। তুলিও এরপর এই পাহাড়ি বিকেলে আর চুপ থাকলো না! রঙ্গন এর কানের কাছে এসে বললো আলতো স্বরে,
—– ” আমিও ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি, তোমাকে। ”
সেই মুহূর্তে হঠাৎ মেঘ ডেকে উঠলো আকাশে। বিদ্যুৎ এর ঝলকানিতে আবছা ভাবে ভেসে উঠলো সামনের পাহাড় আর রংবং নদী। আর তার মাঝে বৃষ্টিতে ভিজলো তাবাকোশি। আর সেই বৃষ্টির জল এসে ভিজিয়ে দিল তুলি আর রঙ্গনকেও।
<২৭>
সেদিনের পর যেই নতুন দিনটা শুরু হয়েছিল এই পাহাড়ি গ্রামে, সেটা ছিল রোদ মাখানো ঝকঝকে একটা দিন। তুলির সকালে উঠেই তাই মনটা খুব খুশি হয়ে গেছিল। তবে আজ ও রঙ্গনকে সকাল থেকে একটুও চুপচাপ বসে থাকতে দেয়নি। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে গ্রাম ঘোরাতে, চা বাগানে। যদিও রঙ্গনও খুব এনজয় করছিল জায়গাটা! তাবাকোশির চা বাগান, পাহাড়ি বেঁকে যাওয়া এলোমেলো রাস্তা, কমলা লেবুর বাগান, ঝর্না, একটা ছোট্ট প্রাইমারি স্কুল, সব কিছুই কিরকম একটা ভালো লাগা নিয়ে আসছিল মনে। কিন্তু এইসবের ভিড়েও একটা চিন্তা, একটা সংশয় সব সময় কাজ করছিল মনে। নিজের কাজ নিয়ে সংশয়। তাই সেদিন চা বাগানের বেঞ্চটায় বসে থাকতে থাকতে রঙ্গন তুলিকে হঠাৎ বলে উঠেছিল,
——” আমি মনে হয় আর ডাক্তারিটা করতে পারবো না! সেই কনফিডেন্সই নেই আর আমার মধ্যে।”
কথাটা শুনে তুলি একটু হতাশ মুখেই বললো,
——” তুমি আবার ওইসব কথা ভেবে যাচ্ছো! এরকম একটা জায়গায় এসেও! প্লিজ, এইসব চিন্তা বাদ দাও এখন। ”
রঙ্গন এই কথায় খুব অন্ধকার মুখেই বললো,
——” চাইলেও বাদ দিতে পারছি না যে! সিরিয়াসলি কলকাতায় গিয়ে করবোটা কি!”
তুলি এটা শুনে হঠাৎ একটা অন্য কথা বলে উঠলো অল্প চিন্তা করে,
——” অনেক কিছুই করতে পারো! আমার কাছে গান শিখে গানের টিচার হয়ে যেতে পারো! মায়ের কাছে দারুণ দারুণ রান্না শিখে শেফ হয়ে যেতে পারো! একচুয়ালি এই আইডিয়াটাই ভালো। আমরা একটা হোম ডেলিভারি খুলবো। বাঙালিরা আর কিছু না হোক, খেতে খুব ভালোবাসে। তোমার ব্যাবসাটা দারুণ চলবে! ভালো আইডিয়া না?”
শেষ কথাটা বেশ হেসে বললো তুলি। তবে রঙ্গনও এসব শুনে আর গম্ভীর থাকতে পারলো না! ও তুলির কথায় তাল মিলিয়ে আরো একটু ওপরে উঠে বললো,
—— ” বাঙালিদের খাদ্য প্রেমের ব্যাপারেই যখন বলছো, তাহলে তো লিস্টে ফুচকা সবার ওপরে! ভাবছি কলকাতায় ফিরে ফুচকাওলা হয়ে যাবো। গলির সামনে দোকান দেব একটা। আর তুমি হবে আমার এসিসস্টেন্ট। কেমন আইডিয়া? চলবে?”
তুলি এই প্রশ্নে মুখে অনেক বড় একটা হাসি নিয়ে বললো, —–” না, দৌড়বে। ”
কথাটা বলেই ও রঙ্গন এর হাতটা জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রাখলো। আসলে এই হাসি খুশি ছেলেটাকেই ফিরে পেতে চায় ও, যেভাবেই হোক। আর তুলি জানে, নতুন সময় ঠিক আসবে আবার, যেদিন রঙ্গন ঘুরে দাঁড়াবে। নতুন করে শুরু করবে।

তবে সেই সময়টা আসতে খুব বেশি দেরি হলো না আর! সেই দিনটা পেরিয়ে রাত নামলো তাবাকোশি তে। পাহাড়ে সবাই আগে আগে খেয়ে নেয়। তাই রঙ্গনরাও ওই সাড়ে আটটার দিকে ডিনার করে দশটার আগেই ঘুমের দেশে চলে গেছিল। কিন্তু হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল মাঝরাতে, দরজা ধাক্কানোর শব্দে। তুলি আর রঙ্গন তো এই আওয়াজে প্রথমে ঘাবড়েই গেছিল। তারপর একটু ঘুমের ঘোরটা কাটতে বুঝলো শিভম তামাং এর গলার আওয়াজ। কিন্তু এত রাতে উনি হঠাৎ ডাকছেন কেন! আর এদিকে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাবাকোশিতে। দরজা জানলা বন্ধ থাকলেও মেঘ ডাকার আওয়াজ, বৃষ্টির আওয়াজ স্পষ্ট আসছে কানে। কিন্তু এরকম ঝড় জলের মধ্যে উনি কেন এলেন হঠাৎ! ব্যাপারটা বুঝতে না পেরেই রঙ্গন আর তুলি উঠে দরজা খুলেছিল ঘরের। কিন্তু তখনই শিভম তামাংজি খুব ঘাবড়ে বলেছিল,
—–” সরি, এত রাতে দরজা ধাক্কাছি। আসলে আমাদের গ্রামে তুহিন বলে একজনের বুকে খুব ব্যাথা উঠেছে হঠাৎ! তারপর কিরকম সেন্সলেসের মতন হয়ে গেছে! আর এখানে তো কোন হসপিটাল , ডাক্তার কিছু নেই! আর মিরিখ নিয়ে যেতেও সময় লাগবে এই বৃষ্টির মধ্যে। তাই বাধ্য হয়েই তোমার কাছে এলাম রঙ্গন। অশোকের কাছে শুনেছি তুমি হার্টের ডাক্তার! একটু হেল্প করবে বাবা! ছেলেটার দুটো ছোট ছোট বাচ্চা আছে। কিছু হয়ে গেলে ওরা অনাথ হয়ে যাবে!”
কথাগুলো ভীষণ অসহায়ভাবে বলেছিলেন উনি। কিন্তু রঙ্গন হ্যাঁ না কিছুই বলছিল না যেন! কিরকম একটা চিন্তায় হারিয়েছিল। ওই সেদিনের ঘটনাটা আবছা হয়ে ভাসছিল চোখের সামনে। তবে তুলির ডাকে হঠাৎ ঘোরটা কাটলো ওর। তুলি খুব দৃর হয়ে বললো ওকে,
——” তুমি এইভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন! তুমি জানো না এরকম কিছু হলে এক একটা সেকেন্ডও কতটা ইম্পর্টেন্ট! চলো, যাই আমরা শিভম আঙ্কেলের সাথে!”
কিন্তু এই কথায় রঙ্গন কেমন অস্থির হয়ে বললো,
——” কিন্তু আমি! আবার! আমি কি পারবো?”
এই প্রশ্নে তুলি খুব শক্ত হয়ে বললো,
——” তুমিই পারবে। এরকম অনেক কেস হ্যান্ডেল করেছো তুমি! আর এত এত পেশেন্ট কলকাতায় তোমার একটা এপয়েন্টমেন্টের জন্য ওয়েট করে থাকে। কারণ তারা সবাই বিশ্বাস করে তোমাকে। ভরসা করে তোমার ট্রিটমেন্টের ওপর। আজ যেমন শিভম আঙ্কেল করছে! তাই এত রাতে ছুটে এসেছে তোমার কাছে। এন্ড ইউ কান্ট লেট হিম গো এলোন..”
কথাগুলো কিরকম নিস্পলক ভাবে শুনেছিল রঙ্গন, আর নিজেকে স্থির করেছিল মনে মনে। সত্যি, আর বেশি সময় নেই! আর দেরি করা যাবে না। কথাটা ভেবেই বেরিয়ে এসেছিল কটেজের বাইরে, অন্ধকার ঘেরা তাবাকোশিতে। তারপর বেশ জোড়ে পা চালিয়ে পৌঁছেছিল শিভম তামাং এর সঙ্গে একটু দূরের ছোট্ট কাঠের বাড়িটায়। আধো অন্ধকার, আধো আলো ঘেরা ছোট্ট একটা ঘর। তাতে গ্রামের অনেক লোকরাই এসে ভিড় করেছে। তার মাঝে একটা বছর ছত্রিশ কি সেই ত্রিশের ছেলে বিছানায় প্রায় অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে। আর পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে ছোট্ট দুটো বাচ্চা, আর একজন অল্প বয়স্ক মহিলা। রঙ্গন এইসব দেখে তাড়াতাড়ি ঘরটা খালি করে দিতে বললো এয়ার সার্কুলেশন এর জন্য। তারপর যেহেতু স্টেথোস্কোপ নেই, তাই ছেলেটার বুকে কান রেখে শুনলো হার্ট বিট। ভীষণ স্লো চলছে। যেকোন সময় কোল্যাপস করে যেতে পারে! হসপিটাল হলে অনেক ইকুইপমেন্টস থাকতো, কিন্তু এখন যেহেতু কিছু নেই, তাই রঙ্গন হাত দিয়ে ছেলেটার হার্ট পাম্প করার চেষ্টা করলো জোরে জোরে চাপ দিয়ে। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে পেশেন্টের চেস্ট কমপ্রেশন করলো প্রায় চার পাঁচ মিনিট ধরে। আর অবশেষে ছেলেটা সাড়া দিল। হঠাৎ জোড়ে শ্বাস নিয়ে উঠলো ও। যেন হার্ট বিট ফিরে পেল আবার! ততক্ষণে বাইরে গাড়ি চলে এসেছে, মিরিখের হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য! তবে ছেলেটার সেন্স চলে এসেছিল এরপর। যাইহোক, গ্রামের লোকেরা এবার ধরাধরি করে ওকে গাড়িতে তুললো। ততক্ষণে সবাই যেন একটু স্বস্তি পেয়েছে। তুহিন যে চোখ খুলে তাকিয়েছে, এটা দেখে।
সেদিন গ্রামের লোকেরা, তুহিনের বউ, দুটো বাচ্চা রঙ্গন কে প্রায় হাত জোড় করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল! এইভাবে যে একজন ডাক্তার খুঁজে পাবে ওরা, এত রাতে; এটা আসলে ভাবতে পারেনি কেউ! শিভম তামাংও এই সময় রঙ্গন এর হাত দুটো ধরে খুব মন থেকে বলেছিল,
——” থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ! আজ যদি তুমি না আসতে, তাহলে হয়তো তুহিনকে বাঁচানো যেত না! পুরো ফ্যামিলি টা শেষ হয়ে যেত আজ।”
কথাগুলো শুনে রঙ্গন অনেকদিন বাদে সেই পুরনো কথাটা বলে উঠলো ওকে, খুব শান্ত গলায়,
——” প্লিজ থ্যাঙ্কস বলবেন না। এটা আমার ডিউটি, এজ আ ডক্টর..”

যাইহোক, সেদিন তুলিও দাঁড়িয়েছিল বাইরে, গ্রামের লোকেদের সঙ্গে। রঙ্গন এই মুহূর্তে ভিড়ের মধ্যে খেয়াল করেছিল সেটা। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেছিল তুলির কাছে সেদিন। এরপর নিঃশব্দেই জড়িয়ে ধরেছিল ওকে ভেজা চোখে। কিরকম যেন মনে হচ্ছে সবটা ফিরে পেয়েছে আবার! সেই পুরোনো বিশ্বাস, নিজের মধ্যে। তাই খুব আলতো স্বরে বলেছিল তুলিকে,
——” আমি পেরেছি। আমি আবার পেরেছি। ”
তুলি এই কথাটা শুনে নিজেও ভেজা চোখে বলে উঠেছিল, —–” আমি জানতাম। এন্ড আই ট্রাস্ট ইউ.. তুমি একজন খুব ভালো ডাক্তার রঙ্গন। আর একটা ঘটনার জন্য সব কিছু শেষ হয়ে যায় না! এতদিনের এক্সপিরিয়েন্স, প্র্যাকটিস, সবের একটা দাম আছে।”
কথাগুলো বলে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিল ও রঙ্গনকে। তারপর নতুন স্বপ্ন শুরু হয়েছিল আবার জীবনে। আসলে বৃষ্টির ফোঁটা পেয়ে যেমন শুকনো গাছের পাতারা আবার গাঢ় সবুজ হয়ে যায়! সেরকম আজ এই বৃষ্টির রাতে রঙ্গন আর তুলির জীবনেও রুক্ষ্মতা, শুষ্কতা কেটে নতুন একটা রং এসে ধরা দিয়েছিল হঠাৎ। যেই রং পুরনো খারাপ স্মৃতিগুলোকে মুছে আরেকবার বাঁচতে শিখিয়েছিল, প্রাণ ভোরে নিঃশ্বাস নিতে শিখিয়েছিল, নতুন করে। এই বৃষ্টির দিনে। এই পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট গ্রামে।
————< সমাপ্ত >———-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে