#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( দশম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
তবে পরেরদিন আবার সেই ছেলেটার মুখোমুখি হতেই হলো তুলিকে! সেদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখেছিল রঙ্গন ওদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে। লজ্জায় ও তুলির মা বাবার সামনে যেতে পারেনি আজ! তবে ওকে এই বিকেলবেলা শুকনো মুখে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুলি থমকে গেল যেন! আসলে দুপুরে চেম্বার শেষ করে ও আর বাড়ি যায়নি খেতে। তুলির জন্য কিরকম অস্থির লাগছিল আজ! তাই কিছু না ভেবেই এখানে চলে এসেছে; তুলিকে একবার দেখবে বলে।
তবে তুলি এই মুহূর্তে রঙ্গনকে দেখে আর এড়িয়ে চলে যেতে পারলো না! ও এবার নিজে থেকে এসেই জিজ্ঞেস করলো,
—–” তুমি এখানে? কেন এসেছ? কাল তো সব কথা হয়ে গেছে আমাদের!”
কথাগুলো একটু কঠিনভাবেই বললো ও। তবে রঙ্গন এর কোন উত্তর দিতে পারলো না যেন! বলতে পারলো না যে নিজের ভুলের দাম আর এইভাবে দিতে পারছে না দূরে থেকে! কথাগুলো ভাবতেই হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গেল কেমন! রঙ্গন টাল সামলাতে না পেরে নিজের গাড়ির দরজাটা ধরে নিল সেই মুহূর্তে। তবে এটা দেখে তুলির মনে পড়ে গেল রঙ্গন এর তো লো বিপির প্রব্লেম আছে! ওর কি কষ্ট হচ্ছে কোন! কথাটা ভাবতেই তুলি জিজ্ঞেস করে উঠলো,
—–” তোমার শরীর ঠিক আছে তো! আর তুমি খেয়েছো কিছু?”
এই প্রশ্নে রঙ্গন একটু এলোমেলো হয়ে বললো,
—–” ঠিক আছি আমি! আসলে সকাল থেকে কাজের এত প্রেশার ছিল যে খাবার টাইম পাইনি!”
এই কথায় তুলি বেশ উত্তেজিত হয়েই বললো,
—–” কি! খাওনি! তাহলে তুমি এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছো?”
এই প্রশ্নের আবার কোন উত্তর দিতে পারলো না রঙ্গন। আসলে এত ভুলের পর আর সত্যিই তো কিছু বলার নেই! তখন তুলিই বললো কিছুটা ব্যাস্ত হয়ে,
—–” আচ্ছা, ঠিক আছে! ওপরে চলো। কিছু খেয়ে নেবে।”
কিন্তু এই কথায় রঙ্গন সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো,
—–” না প্লিজ! আমি ওপরে যাবো না! আমি যা করেছি, তারপর মা বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেও লজ্জা হয় আমার! আমি খুব হার্ট করেছি ওদের।”
কথাটা শুনে তুলি চুপ করে গেল যেন! এর ঠিক কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না! তবে রঙ্গন কে না খাইয়ে তো ছাড়া যাবে না! এমনিতেই ছেলেটার মাথা ঘুরছে। এই অবস্থায় ড্রাইভ করে বাড়ি যাবে কি করে! কথাটা ভেবেই তুলি একটু সময় নিয়ে বললো,
—–” এই গলির শেষেই একটা ছোট ক্যাফে আছে। ওখানে চলো।”
কথাটা বলেই তুলি এর দাঁড়ালো না। এগিয়ে গেল ধীর পায়ে। তবে রঙ্গন খুব অবাক হয়ে গেল মনে মনে! তার মানে তুলি আজও ওকে নিয়ে এত চিন্তা করে!
তবে সেদিন ক্যাফেতে গিয়েও রঙ্গন খাচ্ছিল না ঠিকভাবে। কিরকম থম মেরে ছিল যেন! আসলে সরি বলারও মুখ নেই ওর! আর রঙ্গন জানে, সব খারাপ লাগা একটা শব্দতেই শেষ হয়ে যায় না! তবে সেদিন ক্যাফে থেকে বেরিয়ে তুলি বলেছিল নিজে থেকে খুব শান্ত গলায়,
—–” প্লিজ আর এখানে এসো না! আমাদের মধ্যে সহজ কথাগুলো সব শেষ হয়ে গেছে। আর খাওয়াদাওয়াটা ঠিকভাবে কোরো। ঠিক রেখো শরীরটা।”
কথাগুলো বলেই তুলি চলে যাচ্ছিল, কিন্তু রঙ্গন এর ডাকে স্থির হয়ে গেল আবার! রঙ্গন এই মুহূর্তে তুলিকে খুব নিঃস্ব হয়েই বলেছিল ভেজা চোখে,
—– ” আই এম সরি তুলি! ফর এভরিথিং!”
কিন্তু তুলি এই কথায় কিরকম স্থির হয়েই উত্তর দিয়েছিল, খুব আস্তে স্বরে,
—–” ইটস নট ওকে..”
তারপর আর না দাঁড়িয়ে খুব জোড়ে পা চালিয়েছিল নিজের, রঙ্গন এর কাছ থেকে দূরে যাওয়ার জন্য।
<২১>
তবে দূরে যেতে চাইলেই তো আর দূরে থাকা যায় না! যে ফিরে পেতে চায়, সে তো কাছে আসবেই। যেমন রঙ্গন; তুলির কথা শুনেও শোনেনি। ও এরপর ফ্ল্যাটের বাইরে দাঁড়িয়ে না থাকলেও ওই বস্তির স্কুলটায় আসতো প্রত্যেক রবিবার। তুলিকে একবার দেখবে বলে! তুলি যদিও নিজে থেকে কথা বলতো না! তবে রঙ্গন বাচ্চাগুলোর সাথে আলাপ জমিয়ে নিয়েছিল খুব। ওদেরই হাত দিয়ে কখনো ফুল, কখনো চকলেট, কখনো সরি লেখা একটা কার্ড, এসব পাঠাতো তুলিকে। নিজের মনের ফিলিংস গুলোকে বোঝানোর জন্য।
এর মধ্যে তুলির মা বাবার কাছে এসেও সাহস করে একদিন ক্ষমা চেয়ে গেছে রঙ্গন। আসলে এই মানুষ দুটো তো খুব ভরসা করতো ওকে! তাই রঙ্গন এর খুব গিল্ট হতো নিজের মনে। তবে তুলির মা বাবা তুলির মতন কঠিন হয়ে থাকতে পারেনি রঙ্গন এর সামনে। ছেলেটাকে তো ওরা নিজের সন্তানের চোখেই দেখে! তাই ওর ভুলটাকে আর মনে রাখেনি।
এরপর তুলি খেয়াল করতো রঙ্গন মাঝে মাঝেই আসতো ওদের বাড়ি। কখনো তুলির মা কে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া, তো কখনো তুলির বাবার জন্মদিনের ডিনারে, রঙ্গন বাড়ির ছেলের মতনই যাতায়াত করতো বার বার। তবে তুলি প্রথমে এই ছেলেটাকে দেখে যতটা কঠিন হয়ে থাকতে পারতো, পরে সেই কাঠিন্যটা দেখাতে পারতো না ঠিক! রঙ্গন এর বার বার এই বাড়ি আসা, বস্তিতে যাওয়া, তুলির সাথে কথা বলার চেষ্টা, সমস্ত কিছুই যেন বুঝিয়ে দিত ছেলেটা রিপেন্ট করছে খুব। তবে সেই এক মাস রঙ্গন এর পুরোপুরিভাবে যোগাযোগহীন হয়ে থাকা, ডিভোর্সের নোটিশ পাঠানো, এই ঘটনাগুলো তুলি চাইলেও ভুলতে পারে না আজও। আসলে কিরকম একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে গেছে ওর আর রঙ্গন এর মধ্যে। আর সেটা ভেঙে তুলি কোনভাবেই রঙ্গন এর কাছে যেতে পারে না আর! সহজভাবে কথা বলতে পারে না নিজে থেকে।
যাইহোক, এসবের মাঝে দু মাস কেটে গেছে। কিন্তু এরপর হঠাৎ এই ব্যাস্ত শহরে তাল কাটলো যেন! সেদিনও সকাল থেকে খুব বৃষ্টি ছিল কলকাতায়। একটা সাইক্লোন শুরু হয়েছিল ভোর থেকে। তাই তুলিদের স্কুলে রেনি ডে হয়ে গেছিল। সেই জন্য সকাল থেকে বাড়িতেই ছিল ও। কিছু না করে সারাদিন ধরে বৃষ্টি পড়া দেখছিল চুপচাপ। এই কালো মেঘ, এই বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ আসলে ভীষণ প্রিয় তুলির। তবে এর মাঝে সেদিন বিকেলে হঠাৎ তুলির বাবা ড্রইং রুম থেকে চিৎকার করে ডাকলো ওকে। তুলি সেই সময় বারান্দায় ছিল। হঠাৎ বাবার ডাকে তাড়াতাড়ি করে ড্রইং রুমে যেতেই থমকে গেল যেন! সারাদিন এত ঝড় হচ্ছিল, বাজ পড়ছিল বলে টিভি খোলা হয়নি। বিকেলে ওয়েদার টা একটু ঠিক হতে অশোকবাবু নিউজ খুলে বসেছিল। কিন্তু নিউজ খুলতেই দেখলো রঙ্গন দের ‘ কেয়ার হোম ‘ হসপিটালের ছবি, আর রঙ্গন এর মার খাওয়া বিদ্ধস্ত চেহারা। খবরে বলছে এম.এল.এ রমাপদ সিকদারকে আজ সকালে হার্ট এটাকের জন্য ভর্তি করা হয়েছিল হসপিটালে। কিন্তু ভর্তি করার আধ ঘণ্টার মধ্যেই উনি কোলাপস করেন। আর এই পুরো কেসটাই দেখছিল ডক্টর রঙ্গন। কিন্তু রমাপদবাবু মারা যাওয়ার পরই পার্টির ছেলেরা চড়াও হয় হসপিটালের ওপর। রিসেপশন ভাঙচুর, রঙ্গন এর ওপর হামলা, মারধোর, এইসব হয় আধ ঘণ্টা ধরে। তারপর পুলিশ এসে কোন রকমে পরিস্থিতি সামাল দেয়। এই ঘটনার জন্য কলকাতার ডক্টরস এসোসিয়েশন থেকে প্রচণ্ড ভাবে নিন্দা করা হয়েছে। রঙ্গন এর মতন একজন ইয়ং ট্যালেন্টেড হার্ট সার্জনকে এইভাবে হেনস্তা, অপমান, মারধোর করাটা যে কত বড় অন্যায়, সেটা প্রেশকে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন এসোসিয়েশন এর হেড।
খবরটা শুনে তুলি যেন থমকে গেছিল সেইদিন। রঙ্গন এর মতন এত ভালো একজন ডাক্তারকে এইসব ফেস করতে হলো! এত অপমান! কথাটা ভেবেই কেমন দিশেহারা লাগছিল ওর। তখনই তুলির মোবাইলটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে নিরুপমার নাম্বার। তুলি কিছুটা এলোমেলো হয়েই ফোনটা ধরলো, তখনই নিরুপমা বলে উঠলো ভাঙা গলায়,
——” তুই শুনেছিস খবরটা?”
প্রশ্নটা শুনে তুলি সাথে সাথেই বললো,
——” এই দেখলাম নিউজে! আসলে সারাদিন টিভি খোলা হয়নি আজ। রঙ্গন কেমন আছে মা? কোথায় ও?”
কথাটা য় নিরুপমা খুব অস্থির হয়ে বললো,
——” ও এই কিছুক্ষণ আগে বাড়ি এসেছে। কিন্তু এসে থেকে কোন কথা বলছে না আমার সাথে! নিজের ঘরে কিরকম চুপ করে বসে আছে। খুব চোট লেগেছে ছেলেটার। খুব বাজেভাবে মেরেছে ওরা!”
কথাগুলো বলতে বলতেই কেঁদে ফেললো নিরুপমা। কিন্তু তুলি এই সময় নিজের এতদিনের সমস্ত দূরত্ব শেষ করে নিজে থেকেই বলে উঠলো,
—–” প্লিজ তুমি কেঁদো না মা! আমি আসছি। আমি এখনি আসছি রঙ্গন এর কাছে।”
কথাগুলো বলেই তুলি আর দেরি করেনি। ওই বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছিল অশোকবাবুর সাথে। যত তাড়াতাড়ি হোক রঙ্গন এর কাছে পৌঁছতে হবে আজ! ছেলেটাকে এই অবস্থায় একা হতে দেবে না তুলি। কোনভাবেই ওর হাতটা ছাড়বে না।
<২২>
তবে সেদিন রঙ্গন এর সামনে গিয়ে তুলি থমকে গেছিল যেন! ছেলেটাকে এই অবস্থায় দেখবে আসলে ভাবেনি কখনো। এলোমেলো চুল, ছেঁড়া জামা, মাথার কাছে রক্ত জমাট বাঁধা! কিরকম জড়োসড়ো হয়ে সেই অবস্থায় বসে আছে রঙ্গন। তুলি সেই মুহূর্তে দরজা থেকে প্রায় দৌড়ে ওর কাছে গেল। তারপর রঙ্গন এর কাঁধে হাত রেখে আস্তে গলায় ডেকে উঠলো ওকে। রঙ্গন এই সময় যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল! তুলির ডাকে ওর স্তম্ভিত ফিরলো হঠাৎ। ও খুব থমকে তাকালো এবার। কিন্তু কিছু ঠিক বলতে পারলো না যেন। তবে তুলি এই মুহূর্তে নিজেকে আর আটকাতে পারলো না! রঙ্গন কে কিছু না বলেই জড়িয়ে ধরলো খুব শক্ত করে। কিছুতেই এরকম ছন্নছাড়া ভাবে ছেলেটাকে শেষ হয়ে যেতে দেবে না ও! বরং নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখবে রঙ্গন কে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ও বলে উঠলো,
—–” এইভাবে মাটিতে বসে আছো কেন! প্লিজ ওঠো, চলো, খাটে বসবে। প্লিজ।”
কথাগুলো বলতে বলতে তুলি কেঁদে ফেললো হঠাৎ। রঙ্গন এবার নিজেও ভেঙে পড়লো তুলির সামনে। কিরকম এলোমেলো হয়েই বললো,
——” নিজের ডাক্তারি জীবনে এত অপমান পাবো; আমি কোনদিন ভাবিনি! আমার কলার ধরে আমাকে কেবিন থেকে বাইরে নিয়ে এলো! তারপর মাটিতে ফেলে মারতে শুরু করলো। চর থাপ্পড় লাথি!”
কথাগুলো শুনতে শুনতে তুলি কিরকম শেষ হয়ে যাচ্ছিল যেন। তবে রঙ্গন নিজের মনেই বলে যাচ্ছিল, —–” পেশেন্ট এর বয়স সেভেন্টি সিক্স ছিল। হসপিটালে নিয়ে আসতেও দেরি করে ফেলেছিল ওরা! তাও আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম! কিন্তু একটা সময়ের পর ডাক্তারদের হাতে কিছু থাকে না! সত্যি থাকে না।”
কথাগুলো বলতে বলতে রঙ্গন কিরকম অসহায়ের মতন কেঁদে ফেলেছিল ওর সামনে। তুলি এই মুহূর্তে আরেকবার খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল রঙ্গন কে। তারপর কোন রকমে ওকে মেঝে থেকে তুলে খাটে বসিয়েছিল। সেই সময় খেয়াল করেছিল রঙ্গন এর কপালে, ঠোঁটে, হাতে কেটে গিয়ে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তুলি এটা দেখে তাড়াতাড়ি ফার্স্ট এড বক্সটা নিয়ে এসেছিল রঙ্গন এর কাছে। তারপর আলতো করে শার্টটা খুলেছিল ওর, আর আঁতকে উঠেছিল কেমন! শুধু কপালে, হাতেই না; পিঠেও একটা দগদগে ঘা, যেখান থেকে এখনও চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে! সেদিন এসব দেখে তুলি কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছিল যেন। এইভাবে মেরেছে একজন ডাক্তার কে! যে রাত দিন জেগে মানুষের জন্য কাজ করে, নিজের সমস্তটা দিয়ে একজন পেশেন্ট কে বাঁচানোর চেষ্টা করে; তাকে এরকম রাস্তার চোর ডাকাতের মতন মেরেছে! এতটা অপমান, এতটা হেনস্তা এরা কিভাবে করতে পারে একজন ডাক্তারকে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ও আস্তে আস্তে রঙ্গন এর চোট গুলো পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছিল। এর মধ্যে ছেলেটা কিরকম নিস্তেজ হয়ে গেছিল যেন। কোন কথা বলছিল না আর।
চলবে।