অভিমানী বিকেল শেষে পর্ব-০৬

0
466

#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( ষষ্ঠ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১২>
তবে রঙ্গন এর রূপকথাটা বাস্তবের সাথে ধাক্কা খেল ফুলসজ্জার রাতে। যদিও রঙ্গন এই দুদিনে খেয়াল করেছে তুলি কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে আছে যেন! কোন আনন্দ, কোন উল্লাস নেই ওর এই বিয়েটা নিয়ে। এই দৃশ্য দেখে রঙ্গন এর পুরনো কিছু কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। বিয়ের আগের এই দুমাস যতবারই রঙ্গন তুলির সাথে দেখা করেছে, তুলি দরকারের বেশি একটা কথাও বলেনি। কখনো ওকে নিজে থেকে ফোন করেনি। একটা মেসেজ ও করেনি। তখন রঙ্গন এর মনে হতো তুলি হয়তো লজ্জা পাচ্ছে! তবে বিয়ের পর এই দু দিনে রঙ্গন এর কেন জানে না মনে হচ্ছে তুলি এই বিয়েটায় খুশি না! মন থেকে রাজি না। তবে এইসব খেয়াল করলেও বিয়েবাড়িতে এত লোকের ভিড়ে রঙ্গন কিছু আর আলাদা করে জিজ্ঞেস করতে পারেনি তুলিকে। কিন্তু ফুলসজ্জার রাতে রঙ্গন ঘরে ঢুকতেই তুলি ভীষণ আড়ষ্ট হয়ে ছিল যেন! সেদিন রঙ্গন এসে প্রথম ওর হাতটা ধরেছিল আলতো করে। তবে তুলির জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা দেখে বুঝেছিল ও কম্ফর্টেবল না। সেই মুহূর্তে রঙ্গন কিছুটা সহজ হয়ে বলেছিল,
——” ডু ইউ ওয়ান্ট টু শেয়ার মি সামথিং? তোমার মনে যা আছে তুমি আমাকে বলতে পারো।”
এই কথায় তুলি একটু সময় নিয়ে বলেছিল,
——” আই নিড টাইম.. আসলে আমি এই বিয়েটা আমার মা বাবার কথায় করেছি। মা বাবার তোমাকে খুব পছন্দ ছিল! কিন্তু আমি ওইভাবে ফিল করিনি কখনো তোমার ব্যাপারে।”
কথাটা শুনে রঙ্গন এর কেমন যেন ধাক্কা লাগলো একটা। ও বেশ অবাক হয়েই বললো,
——” এই কথাটা তুমি আমাকে প্রথমে বলোনি কেন? আমি তো প্রথম দিনই জিজ্ঞেস করেছিলাম। আর তুমি কি জোর করে বিয়ে করেছ আমাকে? নিজের মন থেকে না!”
এই প্রশ্নে তুলি সঙ্গে সঙ্গেই বললো,
——” আমি মানুষ হিসেবে রেসপেক্ট করি তোমাকে খুব, প্রথম দিন থেকেই। তাই যখন বাবা মা এই বিয়ের কথাটা বললো, আমি রাজি হয়ে ছিলাম। কিন্তু কাউকে ভালোবাসার জন্য একটু সময়ের দরকার হয়। সেটা তো হঠাৎ করে হয় না! দ্যাটস হোয়াই আই নিড সম টাইম..”
কথাটা শুনে রঙ্গন আর বেশি কিছু বলতে পারলো না! কারণ এটা তো সত্যি! রঙ্গন ভালোবাসে বলেই যে তুলিও হঠাৎ করে ভালোবেসে ফেলবে, এর তো কোন মানে নেই! তবে খুব ক্লান্ত লাগছিল যেন এই মুহূর্তে ওর। তাই তুলিকে নিজে থেকেই বললো,
——” আমি অপেক্ষা করবো। জানি ভালোবাসা একদিনে হয় না! সময় লাগে। যাইহোক, ঘুমিয়ে পরো। অনেক রাত হলো।”
কথাটা বলে রঙ্গন ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়েছিল এরপর। স্বামী হওয়ার কোন অধিকারই ও ফলায়নি তুলির সাথে। তুলিকে একবারের জন্য না ছুঁয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল নিজের মনে। তবে এই পুরোব্যাপারটাই তুলির মনে একটা দাগ কেটেছিল যেন! কতজন ছেলে পারে একটা মেয়ের কথাকে সম্মান করতে! আজকের দিনেও তাকে না ছুঁয়ে, না ভালোবেসে থাকতে! কিন্তু রঙ্গন কাজটা কত সহজে করলো! কত সহজে তুলির কথা ভেবে তুলির থেকে দূরে সরে থাকলো!
সেদিন এই ভাবনাগুলোর ভিড়েই তুলি অনেকক্ষণ জেগে ছিল সেই রাতে। ঘুমন্ত রঙ্গনকে দেখে মনে হচ্ছিল নিজের মা বাবার কথা ভাবতে গিয়ে এই ছেলেটার প্রতি অন্যায় করলো না তো! এই বিয়েটায় রঙ্গন এর তো কোন দোষ নেই। ও তো ডিসার্ভ করে নিজের স্ত্রীর কাছ থেকে ভালোবাসা, ফিলিংস। কিন্তু তুলি কি কোনদিন এই ভালো মানুষটাকে ভালোবাসতে পারবে! নিজের অতীতটাকে ভুলে রঙ্গন এর সাথে নতুনভাবে শুরু করতে পারবে! কথাগুলো কেমন ভাবতে ভাবতেই ভোর হয়ে এলো রাত পেরিয়ে। আর একটা নতুন দিন শুরু হলো শহরে।
তবে সামনের দিনগুলোতে রঙ্গন সত্যি ভীষণ নতুন হয়ে ধরা দিল তুলির কাছে। ছেলেটা অষ্টমঙ্গলাতে তুলিদের বাড়ি গিয়ে এত সুন্দর ভাবে মিশে গেছিল সবার সাথে! তুলির বাবার প্রেশার চেক করা থেকে ওর মায়ের হাঁটুর ব্যাথার জন্য একজন চেনা ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড করে দেওয়া, নিজে থেকেই করেছিল সব রঙ্গন। বাড়ির কাউকেই বুঝতে দেয়নি তুলির সাথে ওর মনের দূরত্বর ব্যাপারে। তুলি এইসব দেখে সেই রাতে একা ঘরে এসে বলে উঠেছিল,
—–” থ্যাঙ্ক ইউ.. মায়ের জন্য অনেকদিন ধরেই একজন ভালো ডাক্তার খুঁজছিলাম। তুমি খুব হেল্প করলে আজ!”
এই কথায় রঙ্গন খুব সহজভাবেই বলেছিল,
——” এর জন্য থ্যাঙ্ক ইউ বলার কিছু নেই। আমি একজন ডাক্তার, এই ফিল্ডে অনেক চেনা জানা আছে! তাই এপয়নেন্টটা করে দিতে পেরেছি।”

তুলির কথাটা শুনে সেই মুহূর্তে ওদের প্রথম আলাপের দিনটা মনে পরে গেছিল। সেদিনও রঙ্গন নিজে থেকে ওর বাবার এডমিশন করিয়ে দিয়েছিল নার্সিং হোমে। আর তারপর ঠিক এই কথাটাই বলেছিল। ‘ থ্যাঙ্ক ইউ বলার দরকার নেই! এটা আমার ডিউটি..’
তবে সেদিন তুলি জানতো না, এই ছেলেটার সাথেই সারা জীবনের মতন বাঁধা পড়ে যাবে ও!
যাইহোক, এরপর পরের সপ্তাহে রবিবার দিন তুলি বিকেলের দিকে রেডি হচ্ছিল বেরোবে বলে। রঙ্গন সেদিন বাড়িতেই ছিল। ও তুলিকে রেডি হতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো,
——” তুমি বেরোচ্ছ কোথাও?”
তুলি এটা শুনে একটু সময় নিয়ে বললো,
——” আসলে আমার বন্ধুর একটা এন. জি. ও আছে। শহরের বস্তির ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করে ওরা। আমি প্রত্যেক রবিবার বিকেলে একটু পড়াতে যাই ওদের। ওই তারাতলার কাছেই বস্তিটা। ওখানেই একটা ঘর ভাড়া করে ক্লাস হয়।”

কথাটা শেষ হতে রঙ্গন কেমন নিস্পলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
——-” এটা তো খুব ভালো ইনিশিয়েটিভ! আজ আমি ফ্রি.. আমি কি যেতে পারি তোমার সাথে? যদি তোমার কোন প্রবলেম না হয়!”
এই কথায় তুলি বেশ অবাক হয়েই বললো,
—–” তুমি যাবে! আমার কি প্রব্লেম! অবশ্যই চলো।”
সেদিন এই কথা হওয়ার পর তুলি রঙ্গন এর সাথেই গেছিল বস্তিতে। রঙ্গন এরপর নিজে থেকেই আলাপ করেছিল বাচ্চাগুলোর সাথে। তুলি এইসব দেখে সত্যি কেমন চুপ হয়ে গেছিল যেন! এত বড় একজন হার্ট সার্জেন! কিন্তু কিভাবে মাটির সাথে মিশে থাকতে পারে ছেলেটা! কিভাবে সবার জন্য ভাবতে পারে নির্দ্বিধায়! কথাগুলো সেদিন ভীষণভাবে মনে হচ্ছিল তুলির। তখনই রঙ্গন ওর কাছে এসে বললো,
—–” আমি ভাবছি এদের জন্য একটা মেডিক্যাল ক্যাম্প করার কথা। এই বাচ্চাগুলোকে দেখে বুঝলাম বেশিরভাগই ম্যাল নিউট্রিশন এর পেশেন্ট। ওদের একটা রুটিন চেক আপ খুব দরকার।”
কথাটা শুনে তুলি বলে উঠলো,
—–” হ্যাঁ, জানি। ওরা আসলে সবাই আধ বেলা খেয়ে থাকে। তাই নিউট্রিশন ঠিক মতন পায় না! তবে এন.জি.তে অনেকবারই এই মেডিক্যাল ক্যাম্প অর্গানাইজ করার কথা উঠেছে। কিন্তু প্রত্যেকবারই টাকার জন্য হয়ে ওঠেনি। আসলে আমাদের এই ‘ স্পর্শ ‘ এন.জি. ও টা তো খুব ছোট। নতুন শুরু হয়েছে। তাই ফান্ডস পায় না অতো!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল তুলি। আর এইসব শুনে রঙ্গন সাথে সাথেই বলে উঠেছিল,
—–” ফান্ডস নিয়ে ভাবতে হবে না! আমার অনেক ডাক্তার বন্ধু আছে। আমি তাদের রিকুয়েস্ট করলে তারা না করবে না। ইভেন কিছু টাকা ডোনেট ও করে দেবে। তুমি শুধু এই স্পর্শ এন.জি.ওর সাথে আমাকে কথা বলিয়ে দাও। বাকিটা আমি এড়েঞ্জ করে নেব।”
কথাগুলো বলে রঙ্গন আবার সেদিন চলে গেছিল ওই বাচ্চাগুলোর মাঝে। কিন্তু তুলি ভীষণ স্থিরভাবে দাঁড়িয়েছিল এক জায়গায়। নিজের অজান্তেই একটা ভালো লাগা এসে জমছিল মনে। এরকম হিসেবী পৃথিবীতে একজন না হিসেব করা মানুষকে কাছে পেয়ে ভালো লাগছিল খুব।
<১৩>
যাইহোক, এইভাবেই দিনগুলো এগোচ্ছিল। এর মধ্যে নিরুপমা কিছু দিনের জন্য বোনের বাড়ি গিয়েছিল বেড়াতে। বাড়িতে তাই শুধুই তুলি আর রঙ্গন। এর মধ্যে তুলির সেই মাসের তিনটে কষ্টের দিন এসে হাজির। এমনকি ফার্স্ট ডে এতটাই যন্ত্রণা করছিল পেটে, যে তুলি সারা রাত ঘুমোতে পারেনি। সেই জন্য পরেরদিন ঘুম ভাঙতে বেশ দেরি হয়ে গেছিল। তবে সেদিন ও জেগেই দেখছে রঙ্গন হসপিটালে যাওয়ার জন্য পুরো রেডি। তুলি এটা দেখে তাড়াতাড়ি মোবাইলটা খুলে টাইমটা দেখলো। দশটা বেজে গেছে! তুলি এবার তাড়াহুড়ো করে উঠে গিয়ে বললো,
—–” আশ্চর্য! দশটা বেজে গেছে! তুমি আমায় ডাকোনি কেন? তুমি একটু ওয়েট করো, আমি এক্ষুনি ব্রেকফাস্ট রেডি করে দিচ্ছি। প্লিজ না খেয়ে বেরিও না।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো তুলি। কিন্তু তখনই রঙ্গন ওকে শান্ত করে বললো,
—–” এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু হয়নি! আমি ব্রেকফাস্ট তৈরি করে ফেলেছি অলরেডি। আর এই টাইমে মেয়েদের কত কষ্ট হয় আমি জানি। তুমি প্লিজ রেস্ট নাও। কাল সারা রাত এমনিতেও ঘুমোতে পারোনি। আর আজ রান্নার মাসি আসবে না বলেছে। তাই অনলাইনে আমি খাবার অর্ডার করে দেবো কিছু দুপুর আর রাতের জন্য। তোমার এই অবস্থায় রান্না করার দরকার নেই।”
কথাগুলো খুব সহজ ভাবে বলেছিল রঙ্গন। কিন্তু তুলি এইসব শুনে কেমন নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে! এতটাও সেনসিটিভ কেউ হয় একটা মেয়ের এই দিনগুলোর যন্ত্রণা নিয়ে! সুপ্রিয় তো কখনো এরকম করে ভাবেনি। মনে আছে একবার পিরিয়ডের যন্ত্রণার জন্য তুলি ওর সাথে দেখা করতে যেতে পারেনি। সুপ্রিয় কি রেগে ছিল তারপর। তিন দিন কথাই বলেনি ওর সাথে! সত্যি, তুলি কি সেই সময় ভালোবাসায় অন্ধ ছিল! এইসব দেখেও ও বোঝেনি সুপ্রিয় কতটা স্বার্থপর! আজকে এই ফাঁকা ফ্ল্যাটে হঠাৎ এই কথাগুলোই মনে হচ্ছিল ওর। আর মনে হচ্ছিল রঙ্গন এর কথা। ছেলেটা সকাল সকাল উঠে ওর জন্য চিকেন স্যান্ডুইচ আর কফি বানিয়েছে। একবারও ঘুম থেকে ডাকেনি ওকে। আবার বলেছে আজকে সন্ধ্যেবেলা তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে, যাতে এই যন্ত্রণা নিয়ে বেশিক্ষণ একা থাকতে না হয় তুলিকে। সত্যি, কথাগুলো যতবার ভাবছে, অবাক হয়ে যাচ্ছে! এতটা ভাবে ছেলেটা ওর জন্য! এতটা কনসার্নড! সেদিন শরীরটা খারাপ না হলে এইসব বোঝাই হতো না তুলির! আর রঙ্গন এর জন্য এতটা মন থেকে ফিল করতে পারতো না ও।

যাইহোক, এরপর একটা মাস কেটে গেছে। এই কদিনে একজন ডাক্তারের জীবন কে খুব কাছ থেকে দেখে বুঝেছিল এই প্রফেশনটা কতটা টাফ! দিন নেই, রাত নেই, ডিউটি দিতে হয়। এত এত পেশেন্ট কে ম্যানেজ করা, তাদের জীবনের দ্বায়িত্ব নিয়ে চলা যে কত বড় রেসপনসিবিলিটি, এটা রঙ্গন কে কাছ থেকে না দেখলে জানাই হতো না! এই যেমন এই সপ্তাহে রঙ্গন এক রাত বাড়িই আসতে পারেনি। একটা বাস এক্সিডেন্ট এর কেস এসেছিল হসপিটালে। তার মধ্যে চার জনের হার্টে ম্যাসিভ ইঞ্জুরি ছিল। রঙ্গনই অপারেট করেছিল ওদের। খবরটা বুধবার রাতে বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছিল রঙ্গন। কিন্তু এইসব শুনে নিরুপমার মুখটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। ও তুলিকে আনমনেই বলে উঠেছিল,
——–” ছেলেটা সারা রাত হসপিটাল এ থাকবে! কি যে খাবে কে জানে! আর কোনদিন তো কাজের মধ্যে থাকলে খাওয়ার কথা মনেও থাকে না। একটু যে ক্যান্টিনে গিয়েও কিছু একটা খেয়ে নেবে, সেটাও না।”
কথাগুলো শুনে তুলি একটু ভেবে বলেছিল,
——” মা, আমি যাবো খাবার নিয়ে হসপিটাল?”
এই প্রশ্নে নিরুপমা সাথে সাথেই বলে উঠেছিল,
——” তুই যাবি! এত রাতে?”
এটা শুনে তুলি নিরুপমা কে শান্ত করে বলেছিল,
—–” এত রাত আর কোথায়! মাত্র আটটা বাজে। আমি ট্যাক্সি নিয়ে যাবো। এক দেড় ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবো।”
এই কথায় নিরুপমা কিন্তু কিন্তু করেও রাজি হয়ে ছিল অবশেষে। তারপর তুলি রঙ্গন এর জন্য খাবার প্যাক করে সোজা হাজির হয়েছিল ওদের হসপিটালে। সেদিন একজন নার্সের কাছ থেকে তুলির আসার খবরটা পেয়েছিল রঙ্গন। কথাটা শুনেই রঙ্গন ওয়ার্ড থেকে তাড়াহুড়ো করে নেমে এসেছিল নিচের করিডোরে। তুলিকে সেখানে একটা ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাকই হয়েছিল হঠাৎ। তুলি সেই মুহূর্তে রঙ্গন এর কাছে গিয়ে বলেছিল,
——-” পনেরো মিনিট হবে তোমার? ”
এই প্রশ্নে রঙ্গন কিছু না বুঝতে পেরেই বলেছিল,
——” হ্যাঁ হবে। কেন?”
এটা শুনে তুলি নিজের হাতের ব্যাগটা দেখিয়ে বলেছিল,
——” খাবার এনেছি তোমার জন্য। তাই।”
তুলির এই কথায় রঙ্গন একটু ইতঃস্তত হয়েই বলেছিল,
—– ” তুমি আবার খাবার আনতে গেলে কেন! আর কিসে করে এসেছো? আর আমি তো ক্যান্টিনে খেয়ে নিতাম।”
এটা শুনে তুলি একটু কঠিন হয়ে বললো,
—–” তাই! খেয়েছ কিছু সকাল থেকে?”
এই প্রশ্নে রঙ্গন আর ঠিক কোন উত্তর দিতে পারলো না! তাই চোখ দুটো নিচে নামিয়ে নিল নিজের। তুলি তখন হঠাৎ করে রঙ্গন এর হাতটা ধরলো। তারপর কেমন অর্ডার করার সুরে বললো,
——” পনেরো মিনিটের জন্য ক্যান্টিনে চলো। খেয়ে এসে তারপর আবার কাজ করবে।”
কথাটা বলে তুলি রঙ্গন এর হাতটা ধরে এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে। কিন্তু রঙ্গন এই ছোঁয়ায় কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল! এতটা অধিকার ওর প্রতি তো শুধু তুলিরই থাকতে পারে! তাহলে কি তুলিও আজকাল ওকে নিয়ে চিন্তা করে। নইলে ওর খাবার নিয়ে এই রাত্রিবেলা চলে আসতো না নিশ্চয়ই হসপিটালে!
সেদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই এরপর রঙ্গন ডিম পোস্ত দিয়ে এক টুকরো রুটি মুখে পুরেছিল। কিন্তু খাবারটা টেস্ট করতেই ও অবাক হয়ে বলেছিল,
—–” এটা কে রান্না করেছে? রান্নার মাসি তো এরকম রাঁধে না! আর মায়ের হাতের টেস্টও এটা না!”
কথাটা শুনে তুলি একটু চিন্তা নিয়েই বলেছিল,
——” কেন? খারাপ হয়েছে খেতে?”
এই প্রশ্নটা শুনে রঙ্গন নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
—–” না না! খারাপ কেন হবে! ভীষণ ভালো টেস্ট। তবে এই রান্না আমি প্রথম খেলাম। আর ডিম পোস্ত তো আমার ভীষণ ফেভারিট।”
এই কথায় তুলি আলতো হেসে ফেলেছিল সেই মুহূর্তে। তারপর আস্তে গলায় বলেছিল,
—–” জানি ফেভারিট।”
এটা শুনে রঙ্গন হঠাৎ বুঝতে পেরেছিল রান্নাটা কার হাতের! ও তুলির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল,
——” তুমি রান্না করেছ এটা! তুমি এত ভালো রান্না জানো?”
তুলি এর উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারেনি! আসলে রান্না জানে এটা ঠিক। কিন্তু সেটা ভালো কি খারাপ সেটা তো যে খাবে সে বলতে পারবে!
তবে এরপর রঙ্গন খুব তৃপ্তি করে খেয়েছিল খাবারটা। তুলির সেটা দেখে ভীষণ শান্তি হচ্ছিল মনে। আসলে আজ তো রান্নাটা তুলি এই ছেলেটার কথা ভেবেই করেছিল! তারপর যখন শুনলো সারা রাত বাড়ি ফিরতে পারবে না রঙ্গন, তখন তুলির মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছিল কেমন। চিন্তা হচ্ছিল মনে মনে ছেলেটার জন্য! সারাদিন কিছু খেয়েছে তো! সারা রাত কি খালি পেটেই ডিউটি করবে রঙ্গন! এইসব ভাবনার ভিড়েই তো এসেছিল আজ হসপিটালে। তারপর রঙ্গন এর শুকনো, ক্লান্ত মুখটাকে দেখে ও কেমন থমকে গেছিল হঠাৎ। মনে হচ্ছিল যদি আজ রঙ্গনকে নিজের সাথে বাড়ি নিয়ে ফিরতে পারতো! যদি সেই রাতটা ছেলেটা একটু ঘুমোতে পারতো শান্তিতে; তাহলে তুলি নিশ্চিন্ত হতো।

<১৪>
সেদিন ট্যাক্সিতে আসতে আসতেও তুলি সারাটা রাস্তা আনমনে রঙ্গন এর কথাই ভেবেছে। কিন্তু ওদের ফ্ল্যাটের সামনে ট্যাক্সিটা দাঁড়াতেই তুলির যেন ঘোরটা কাটলো! মনে হলো এইভাবে অবচেতনে কেন ভাবছে এত রঙ্গন এর জন্য! কেন এত চিন্তা এসে ঘিরে ধরছে ওকে আজ! এসব কি এমনি অকারণে হচ্ছে; না কি ছেলেটা ধীরে ধীরে ওর মনে জায়গা করে ফেলছে নিজের!

এই ভাবনার ভিড়েই রাতটা কেটেছিল ওর। আজ ঘরটা আসলে একটু বেশিই ফাঁকা লাগছে। অন্যদিন হলে রঙ্গন বেশ রাত অব্দি ল্যাপটপটা খুলে বসে থাকে; নয়ত কোন বই পড়ে! কিন্তু আজ খাটের এক পাশটা কিরকম খালি খালি লাগছে তুলির। সেই জন্য ঠিকভাবে ঘুমও আসছিল না ওর। তখনই মোবাইলে একটা হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ ঢোকার আওয়াজ এলো কানে। তুলি আনমনে মেসেজটা খুলতেই দেখে সেই চেনা নাম্বার; রঙ্গন। এত রাতে কি লিখেছে ছেলেটা! কথাটা ভাবতে ভাবতেই তুলি মেসেজটার দিকে চোখ রাখলো, আর রঙ্গন কয়েকটা শব্দ হয়ে বলে উঠলো,
——” রাতে ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে ঘুমিও আজ। নইলে মাঝে মাঝে তুমি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে আঁতকে ওঠো। যাইহোক, গুড নাইট.. আর আজ আমাকে একবার দর্শন দেয়ার জন্য থ্যাঙ্ক ইউ..”
কথাগুলো পড়তেই তুলির মুখে হঠাৎ হাসি চলে এলো এই মুহূর্তে। আর মনে পরে গেল সেই রাতটাকে। এই তো তিনদিন আগে, তুলি ভূতের গল্পের বই পড়ে রাতে ঘুমোতে গেছিল। তারপর উল্টো পাল্টা স্বপ্ন দেখে তো চিৎকার করে উঠেছিল ঘুমের মধ্যে। রঙ্গন তখন ওকে জড়িয়ে ধরে কোনভাবে শান্ত করেছিল। তারপর সারা রাত ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়েছিল তুলি। কথাটা ভাবতেই তুলির রঙ্গন কে আরো বেশি করে মনে পড়লো আজ। আর সারাটা রাত কেমন নির্ঘুম অবস্থায়ই কেটে গেল ওর!

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে